15/12/2025
সম্মানিত আলেম সমাজের প্রতি খোলা চিঠি
হেযবুত তওহীদের এমাম হোসাইন মোহাম্মদ সেলিম
শ্রদ্ধেয় আলেম-ওলামাবৃন্দ,
সালামু আলাইকুম ওয়ারাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। হেযবুত তওহীদের পক্ষ থেকে সকলকে জানাই আন্তরিক অভিনন্দন। আজ জাতির এক ক্রান্তিলগ্নে আমরা আপনাদের প্রতি এক উদাত্ত আহ্বান জানাচ্ছি। আজ ভয়াবহ অশান্তির লেলিহান আগুনে জ্বলছে সমগ্র বিশ্বমানবতা। কোথাও শান্তির লেশমাত্র নেই। বিশেষ করে মুসলিম উম্মাহর ওপর ইতিহাসের জঘন্যতম ও বর্বরোচিত মানবাধিকার লঙ্ঘন চলছে।
বিশ্বের বর্তমান মোট জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ, অর্থাৎ ২০০ কোটি মুসলমান, আজ ৫৭টি রাষ্ট্রে বিভক্ত। সংখ্যায় এত বিশাল হওয়া সত্ত্বেও আজ যখন ফিলিস্তিনকে বিশ্বের মানচিত্র থেকে মুছে দেওয়া হচ্ছে, তখন আমরা কার্যকর কিছুই করতে পারি না। মিয়ানমারের লণ্ডমণ্ড মুসলমান এখনো বাস্তুচ্যুত ও উদ্বাস্তু, তাদের ন্যূনতম মানবাধিকারটুকুও নেই। বিশ্বের অন্যত্রও মুসলিম জাতির লাঞ্ছনা ও কষ্টের কোনো শেষ নেই।
অন্যদিকে, আমাদের প্রিয় জন্মভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ৫৪ বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু একের পর এক দাবি আদায়ের আন্দোলন, হরতাল, রাজনীতি, অপরাজনীতি এবং হামলা-পাল্টা হামলার এই ধ্বংসাত্মক সংস্কৃতি জাতিটিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশ বিদেশিদের কাছে প্রায় ২১ ট্রিলিয়ন বা ২১ লক্ষ কোটি টাকার ঋণে জর্জরিত (সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার, ১৫ নভেম্বর ২০২৫)। অর্থাৎ, পুরো দেশটাই আজ ঋণের জালে বন্দী।
গত সরকারের পতনের পর থেকে এখন পর্যন্ত দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা বেড়েই চলেছে। রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, মব সন্ত্রাস, আন্দোলন-সংঘর্ষ, আন্তর্জাতিক সম্পর্কের চাপ এবং অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে সাধারণ মানুষ আতঙ্কিত। জীবন ও জীবিকার নিরাপত্তা হারিয়ে তারা দিশেহারা। এ পরিস্থিতি থেকে কে তাদের রক্ষা করবে এবং শান্তি ফিরিয়ে আনবে? দেশের পরিস্থিতি বিবেচনা করে এ থেকে উত্তরণের লক্ষ্যে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার রাষ্ট্র সংস্কারের কাজে হাত দিয়েছে।
সংস্কারের বিষয়ে আমাদের সুস্পষ্ট বক্তব্য সরকারের কাছে উপস্থাপন করেছি। আমরা বলছি, বর্তমান রাষ্ট্রব্যবস্থা মানুষের তৈরি। এই ভ্রান্ত ব্যবস্থা বজায় রেখে দুর্নীতি ও অর্থপাচার বন্ধ হবে না, বিচার বিভাগের জুলুম শেষ হবে না এবং অর্থনীতিতে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে না। শান্তি ও মুক্তি পেতে হলে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আধুনিক যুগের বাস্তবতার নিরিখে কীভাবে আল্লাহর দীন তথা কোরআনের বিধান রাষ্ট্রজুড়ে কার্যকর ও প্রতিষ্ঠা করা যায়, তার একটি পূর্ণাঙ্গ রূপরেখা সম্বলিত প্রস্তাবনা আমরা সরকারের কাছে পেশ করেছি।
আমাদের এই প্রস্তাবনার শিরোনাম- “তওহীদভিত্তিক আধুনিক রাষ্ট্রব্যবস্থা”। সরকারের পাশাপাশি আমরা রাজধানীসহ সারা বাংলাদেশের প্রায় সমস্ত জেলার প্রেসক্লাবে গণমাধ্যমকর্মীদের সামনে এই রূপরেখা তুলে ধরেছি। এছাড়া অনলাইন ও অফলাইনে বিরামহীনভাবে বিষয়টি জনগণের সামনে তুলে ধরছি।
আমাদের দেশের মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনামলে রেখে যাওয়া এবং ইহুদি-খ্রিস্টান সভ্যতার তৈরি আইন-কানুন ও ব্যবস্থাকে অনুসরণ করতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রের নামে মানবরচিত তন্ত্র-মন্ত্র আর রাজনৈতিক দলাদলির বেড়াজালে তারা আটকে আছে। তাদের মন-মগজ থেকে এ ধারণাটিই হারিয়ে গেছে যে, একজন মুসলমান ঈমান আনার পর তাকে একমাত্র আল্লাহর আইন ও বিধান দিয়ে রাষ্ট্র ও সমাজ পরিচালনা করতে হয়।
দুঃখজনকভাবে, আমাদের বিভিন্ন ধর্মীয় সংগঠনগুলো আজ বিভিন্ন ফেরকা ও দলে বিভক্ত হয়ে টুকরো টুকরো হয়ে গেছে। ফলে দীন প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিজেদের শক্তি ও সামর্থ্য ব্যয় করতে তারা ব্যর্থ হচ্ছে।
এমতাবস্থায় আমরা মনে করি, অনেক সময় নষ্ট হয়েছে। আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে, অনেক তাজা প্রাণ ঝরে গেছে। কিন্তু সামনে আরও ভয়ানক পরিস্থিতি অপেক্ষা করছে। তাই সম্মানিত আলেমদের প্রতি আমার আকুল আবেদন—আপনারা কোরআন-হাদিসের জ্ঞানে পারদর্শী, আপনারা শরীয়তের সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম মাসয়ালা-মাসায়েল নিয়েও গবেষণা করেন।
আপনারা জানেন, ইসলামের মূল ভিত্তি হলো ‘তওহীদ’ বা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’, অর্থাৎ আল্লাহর বিধান ছাড়া আর কারও বিধান মানা যাবে না। পবিত্র কোরআনে প্রদত্ত মু’মেনের সংজ্ঞায় আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) প্রতি ঈমান আনার পরপরই জান-মাল দিয়ে জিহাদের কথা উল্লেখ করা হয়েছে (সুরা হুজরাত ১৫)। এই জিহাদ হলো দীন প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক প্রচেষ্টা। নবী করীম (সা.)-এর জীবনী পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, তিনি আজীবন শিরক, কুফর ও গাইরুল্লাহর বিধানের বিরুদ্ধে আপসহীন জিহাদ করেছেন।
আজ অত্যন্ত দুর্ভাগ্যের বিষয়, আমাদের দেশে অসংখ্য মসজিদ, সম্মানিত খতিব ও ইমাম সাহেবগণ আছেন। হাজার হাজার মাদ্রাসার মুহতামিম ও শিক্ষকবৃন্দ দীনের এলেম শিক্ষা দিচ্ছেন। অসংখ্য বক্তা ওয়াজ-মাহফিলের মাধ্যমে দীনের দাওয়াত দিচ্ছেন। কিন্তু আফসোসের বিষয় হলো—আমাদের রাষ্ট্র চলে ব্রিটিশের তৈরি আইনে, বিচার চলে তাগুতের বিধানে। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় জীবনে আমরা আল্লাহর বিধান অনুসরণ করতে পারছি না; সেক্ষেত্রে আমাদের ঈমানের দাবিও পূরণ হচ্ছে না।
আমরা হেযবুত তওহীদ আন্দোলন এ বার্তাটি তুলে ধরার চেষ্টা করছি যে, বর্তমান অকার্যকর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাদ দিয়ে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করতে হবে। এই লক্ষ্যেই আমরা একটি ইস্পাতকঠিন ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলেছি। আমাদের আন্দোলনের পাঁচ দফা কর্মসূচিও সরাসরি নবীর (সা.) একটি হাদিস থেকে প্রাপ্ত এবং আল্লাহ প্রদত্ত।
রসুল (সা.) সমগ্র জীবন এই কর্মসূচি অনুসারে সংগ্রাম করে গেছেন এবং দুনিয়া থেকে বিদায় নেওয়ার আগে তিনি তাঁর নিজ হাতে গড়ে তোলা উম্মাহর উপরে এই কর্মসূচি অনুযায়ী সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব অর্পণ করে গেছেন। তিনি বলেন:
১. আল্লাহর তওহীদের ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়া।
২. নেতার আদেশ শোনা (শৃঙ্খলা)।
৩. নেতার আদেশ পালন করা (আনুগত্য)।
৪. যাবতীয় শিরক ও কুফরের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করা (হিজরত)।
৫. এই দীনুল হক (সত্য জীবনব্যবস্থা) পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য জান-মাল দিয়ে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানো (জিহাদ)।
যে ব্যক্তি এই ঐক্যবন্ধনী থেকে বহির্গত হয়, সে ইসলামের বন্ধন থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে সে আবার তওবা করে ফিরে এলে অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব।
এই কর্মসূচির আলোকেই আমরা বিরামহীন সংগ্রাম চালাচ্ছি। আমরা মনে করি, সাধারণ জনগণের চেয়ে গুরুদায়িত্ব আলেম সমাজের ওপর বেশি বর্তায়। কারণ সাধারণ মানুষ ধর্মীয় বিষয়ে আলেমদের মুখাপেক্ষী। ইসলামের কোনো প্রসঙ্গ উঠলে তারা তাকিয়ে থাকে—আলেমরা কী বলেন। তাই আলেমদের দায়বদ্ধতা অনেক বেশি।
সম্মানিত আলেম সমাজ, শত শত বছর ধরে মুসলিম সমাজে এক ফেরকার সঙ্গে আরেক ফেরকার মাসালা-মাসায়েলগত বিরোধ চলে আসছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে একে অপরের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার ও ফতোয়া দেওয়া হচ্ছে। ফলে আল্লাহর কাঙ্ক্ষিত ঐক্যের বদলে অনৈক্য, ভ্রাতৃত্বের বদলে শত্রুতা, হিংসা-বিদ্বেষ ও পারস্পরিক অবিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম সমাজের সামষ্টিক শক্তি ভেঙে পড়েছে এবং দীন প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য থেকে দৃষ্টি সরে গেছে।
এই সুযোগটাই ইসলামবিরোধী শক্তিগুলো কাজে লাগাচ্ছে। তারা মুসলিমদের পারস্পরিক সংঘর্ষকে আরও উসকে দিচ্ছে এবং বিভেদের আগুনকে প্রজ্বলিত করছে। তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মতবিরোধের কারণে আমাদের মূল্যবান সময়, শ্রম ও অর্থ শুধু অপচয়ই হয়নি, বরং মুসলিম উম্মাহর অস্তিত্ব পর্যন্ত হুমকির মুখে পড়েছে।
তাই আমরা মনে করি, লক্ষ লক্ষ ইসলামপ্রেমী, দীন-প্রতিষ্ঠাকামী আলেম-ওলামার জ্ঞান, শ্রম ও অর্থকে একত্র করে একটি নির্দিষ্ট ও সঠিক লক্ষ্যের দিকে পরিচালিত করার এখনই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। হেযবুত তওহীদ আন্দোলন এই মহান লক্ষ্যেই কাজ করে যাচ্ছে।
আপনাদের প্রতি আমাদের বিশেষ কিছু আবেদন:
১. অন্তত ইসলামের প্রকৃত সত্যের পক্ষে দুটি কথা বলুন। আলেমদের মধ্যে একটি শ্রেণি পরিকল্পিতভাবে হেযবুত তওহীদের বিরুদ্ধে অহেতুক জঘন্য অপপ্রচার চালিয়েছে। আমরা যা বলিনি, তা আমাদের নামে চালানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে আমরা আল্লাহর হুকুমত তথা দীনুল হক প্রতিষ্ঠা করতে চাই। কারো অপপ্রচারে প্রভাবিত না হয়ে নিরপেক্ষ মন দিয়ে আমাদের প্রকাশনা পড়ুন।
২. জনগণকে আল্লাহর নিরঙ্কুশ তওহীদের দিকে উদ্বুদ্ধ করুন। তাদেরকে বোঝান যে, আল্লাহর আইন-বিধান ছাড়া মানুষের তৈরি আইনে শান্তি আসতে পারে না।
৩. মসজিদের মিম্বর, মাহফিল, মাদ্রাসা, খানকায়—যেখানে থাকুন না কেন, অনলাইনে ও অফলাইনে বর্তমান ব্যর্থ ব্যবস্থার অসারতা তুলে ধরুন এবং আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থার পক্ষে জনমত গড়ে তুলুন।
আসুন, সকল ভেদাভেদ ভুলে আল্লাহর জমিনে আল্লাহর দীন প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধ হই। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।