05/07/2025
পড়ুন।
কেন আমি বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে বের হয়ে গেলাম?
ড. মোহাম্মদ মাহমুদ হাসান*
৫ই আগস্টের পর থেকে আওয়ামীলীগ, যুবলীগের পাশাপশি ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের উপর কি ভয়ংকর রিপ্রেসিভ আচরণ হচ্ছে সেসব তো আমরা সবাই জানি। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রলীগকে শুধু অত্যাচারই করা হয়নি, তাদের বিভিন্ন সার্বজনীন মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করেছে সরকারের প্রত্যক্ষ মদদে। বৈষম্যবিরোধী সমাজ গড়ার নাম করে তথাকথিত বিপ্লবীরা ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের হ*ত্যা থেকে শুরু করে তাদের বেশিরভাগের শিক্ষাজীবন ধ্বংস করে দিয়েছে। হাজার হাজার শিক্ষার্থী ভয়ে ক্যাম্পাসে যেতে পারে না। এই তালিকায় শুধু শিক্ষার্থীই না, অনেক শিক্ষকও আছেন।
কয়েকদিন আগেই আশির্ধো এক মুক্তিযোদ্ধা ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা পেনসনের টাকা তোলার কাজে ক্যাম্পাসে গেলে মব লিঞ্চিং এর শিকার হয়ে এরেস্ট হন। আজকে চট্টগ্রাম বিশেওবিদ্যালয়ের এক হিন্দু শিক্ষক প্রমোশনের ইন্টার্ভিউ দিতে গেলে ছাত্র শিবিরের কর্মীরা মব তৈরী ভিসির রুমে গিয়ে তাকে আক্রমন করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক বিভাগের শিক্ষককে ক্যাম্পাসে যাওয়া থেকে বিরত রাখতে বাধ্য করছে তাদের কলিগরা। অনেক বিভাগই এটা মিটিয়ে ফেললেও সমাজ বিজ্ঞান ও আইন বিভাগের চারজন করে শিক্ষককে একাডেমিক ও প্রশাসনিক কাজ থেকে বঞ্চিত করছে। ছাত্রদের লেলিয়ে দিয়ে নষ্ট রাজনৈতিক খেলা চালাচ্ছে কিছু শিক্ষক। তাদের অপরাধ তারা আওয়ামীলীগ বা ছাত্রলীগ করতেন বা সমর্থন করতেন। এমনকি যারা মুক্তিযুদ্ধপন্থী, এরকম শিক্ষকদের হেনস্থার শিকার হতে হচ্ছে।
একটা কথা প্রায়ই বলি আমি, দিন শেষে সবই ব্যাক্তিগত। যাদেরকে অরাজনৈতিক শিক্ষক ও শিক্ষার্থী হিসেবে জেনে এসেছি এবং তাদেরকে আওয়ামীলীগ আমলে যাবতীয় সুবিধা নিতে দেখেছি, তারাই এখন আন্দোলনের বড় নেতা। আওয়ামীলীগ আমলে পদবঞ্চিত বলে আদালত বা অন্যভাবে ঠিকই পদ আদায় করে নিচ্ছে। যাদের হাত ধরে একসময় এরা সুবিধা নিয়েছে, তাদেরকে এখন বিপদে ফেলেছে। যেমন, সমাজবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ও জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন ভিসি অধ্যাপক সাদেকা হালিমের কাছ থেকে যারা সুবিধা নিয়েছে একসময়, তারাই এখন তার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তাকে অন্যায়ভাবে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। আইন বিভাগের অধ্যাপক রহমতুল্লাহকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে, কিন্তু তিনি যখন ডিন ছিলেন এবং আওয়ামীলীগ সরকারের সময় মামলা খেয়েছিলেন, তখন তার সাথে আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক আসিফ নজরুলের কত খাতির ছিল সেটা আমি নিজ চোখে দেখেছি। ক্যাম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে আসা আইন বিভাগের দুই তরুন শিক্ষক যখন নিয়োগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন তখন আসিফ নজরুল ফেসবুক পোস্টে বলেছিলেন যে আইন বিভাগের সেরা শিক্ষক নিয়োগ। তাদেরকে বিভাগ থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। আইন বিভাগের আরেকজন সাসপেন্ডেড শিক্ষক আছেন, ২০২২ সালে যার সাথে আসিফ নজরুল আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বিভাগের অন্যতম সেরা শিক্ষক হিসাবে। রহমতুল্লাহর বদান্যতায় আসিফ নজরুল ল ডিপার্ট্মেন্টের চেয়ার হয়ে ছাত্র শিবির ও হিজবুত তাহরিরকে পেট্রোনাইজ করেছে। অফিস আওয়ারের পর তাদেরকে নিয়ে তার রুমে মিটিং করতেন সেটা অজানা নয় কারোই।
জুলাই আন্দোলনে ছাত্র নেতাদের পাশাপাশি সবচেয়ে পরিচিত মুখ ছিল বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের কয়েকজন শিক্ষক। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের প্রতি সরকারী রিপ্রেশনের প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আন্দোলন ও অনলাইনে প্রতিবাদ করার কারণে লেফটিস্ট ও সেন্টার লেফটিস্টদের পছন্দের তালিকায় চলে আসেন। তাদের এরকম একটিভিটির কারণেই আমি কয়েক বছর আগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কে যোগ দেই। তাদের কাজের সাথে একাত্ত্বতা দেখাই। জুলাই আগস্ট আন্দোলনের সময় তাদের সার্বক্ষনিক অবস্থানের কারণে, আন্দোলনের নেতাদেরকে র্যাবের হেফাজত থেকে ছাড়িয়ে আনা, আওয়ামীলীগ সরকারের পতনের দাবী উত্থাপনের কারণে আন্দোলনের হিরোতে পরিনত করেছিল শিক্ষক নেটওয়ার্ককে। সরকারীভাবে তার রিকগনিশনও পেয়েছেন তারা। তাদেরকেও জুলাই যোদ্ধা বলা হয়। হয়তো তারাও সরকারী ভাতা পাবেন একসময়।
আমি ব্যাক্তিগতভাবে আন্দোলনের সময় ও পরে বেশ কিছুদিন শিক্ষক নেটওয়ার্ককে ডিফেন্ড করে বেশ কয়েকজনের সাথে তর্কও করেছি। মূলত সেইসময় এবং ৫ই আগস্টের পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের পুরো কর্তৃত্ব চলে যায় কয়েকজনের হাতে। তারা কয়েকজনেই সকল সিদ্ধান্ত নিতেন। কিন্তু যে আদর্শে তারা শিক্ষক নেটওয়ার্ক শুরু করেছিলেন সেই আদর্শ থেকে নিজেদের বিচ্যুতি ঘটান দ্রুত। যে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক আওয়ামীলীগ আমলে উদ্ভব ঘটানোর পর থেকে নির্যাতিত শিক্ষক ও ছাত্রদের ব্যাপারে ভোকাল ছিল, রাস্তায় নেমে আসতো, প্রতিবাদ লিপি দিতো হরহামেশাই, তারাই পোস্ট-৫ আগস্ট নিশ্চুপ ভূমিকা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলো। সারা বাংলাদেশে এতো এতো শিক্ষক ও শিক্ষার্থী (রাজনৈতিকভাবে) অত্যাচার ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হলো, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক তাদের জন্য একটা বাক্যও ব্যয় করেনি। ছাত্রলীগ বা আওয়ামীলীগ যারা করতো বা করে তারা কী মানুষ না? তাদের অধিকার থাকতে নাই?
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক থেকে আমি নিজেকে সরিয়ে নিয়েছি আমি। যে সংগঠন ইনক্লুসিভিটি ও নিরপেক্ষতা দেখাতে ব্যর্থ হয়েছে তাদের সাথে থাকার যৌক্তিকতা নাই বলে আমার মনে হয়েছে। এই নেটওয়ার্ক নিজেদেরকে নিউট্রাল রাখতে পারে নাই। শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রভাবশালী একজনকে সবসময় দেখতে পাই জাতীয় নাগরিক কমিটির/পার্টির নেতাদের সাথে অনুষ্ঠান করে বেড়াচ্ছেন এবং সরকারের সবচেয়ে ঘনিষ্ট এলাই হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। নেটওয়ার্কের আরেকজনকে প্রায় একই চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যাচ্ছে। আন্দোলনের সময় ফুল প্রফেসর থাকলে হয়তো কোন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও হয়ে যেতেন। পরে অবশ্য আদালতের রায়ের মাধ্যমে প্রফেসরশিপ পেয়েছেন। আরেকজন অবশ্য বড় পুরস্কার পেয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য হতে পেরে জীবন ধন্য হয়েছে তার। আরেকজন শিক্ষককে সময়ের পরিক্রমায় কিছুটা নিরপেক্ষ থাকার চেষ্টা করতে দেখা যাচ্ছে, যদিও এই সরকার আসার কিছুদিনের মাথায় ফুল প্রফেসর হয়ে গেছেন। কিছু একটা পাওয়ার আশায় আরেকজন হয়ে গেছেন ইউনুসেক্সুয়াল! এতোদিনেও কিছু না পেয়ে এখন সরকার বিরোধী হয়ে গেছেন ইদানিং। অথচ এসব ব্যাক্তিগত স্বার্থের পিছনে না ছুটে তাদের উচিত ছিল, এতোদিন যা করে এসেছেন তাই করা। তাদের প্রথম পরিচয় তারা তাদের সকল ছাত্র-ছাত্রীর শিক্ষক। কলিগরা যেন বিপদ থেকে রক্ষা পান তার জন্য কাজ করা। তাদের কলেজিয়ালিটি মেনটেইন করার কথা ছিল।
কয়েকদিন আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রাক্তন শিক্ষার্থীর কথা লিখেছিলাম যে হার্ভার্ডে মাস্টার্স করার সুযোগ পেয়েছে। সে ছাত্রলীগ করতো বলে ৫ই আগস্টের পট-পরিবর্তনের পরে তাকে ভীষণ ব্যাকল্যাশের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আন্দোলনের আগেই সে ফাইনাল ইয়ারের লিখিত পরীক্ষা শেষ করে ফেলেছিল। তখনো ছাত্রলীগকে নিষিদ্ধ করেনি সরকার। 'সাধারণ শিক্ষার্থী' নাম দিয়ে একটা ফটোকার্ড বা ফেসবুক পোস্টে বলা হয় "** ছাত্রলীগের সাথে জড়িত, এবং তার ভাইভা ও থিসিস ডিফেন্স নেওয়া হলে তার ক্লাসের সবাই মিলে শিক্ষকদের বয়কট করবে।" এরপর একে একে হ*ত্যা ও ধ*র্ষণের হুমকি পেতে থাকে সে। ফেসবুক ডিয়েক্টিভেট করতে হয়। সে শিক্ষক নেটওয়ার্কের ভীষণ একটিভ দুইজন সদস্যের, যারা তার সরাসরি শিক্ষক, সাথে যোগাযোগ করে। ইমেইলে ফোনে সেই শিক্ষার্থী তাদেরকে তার বিপদের কথা জানালেও নিশ্চুপ থেকে তারা। সে ক্লাসের ফার্স্ট গার্ল হওয়ায় তাকে সব শিক্ষক খুব ভাল মতোই চিনে। তার শিক্ষাজীবন ধ্বংস হয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও, তারা সেই মেয়ের কোন ইমেইলের রিপ্লাই তো দূরের কথা অন্য শিক্ষকদের মাধ্যমে সাহায্যের হাত বাড়ায়নি। সে ক্যাম্পাসে গেলে মেরে ফেলবে এবং ধ*র্ষণ করবে বলে হুমকি পেয়ে এসেছে। তাই তার ক্যাম্পাসে যাওয়া উচিৎ হবেনা বলে অন্য শিক্ষকরা তাকে বলে। যেহেতু তারা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্কের প্রভাবশালী সদস্য এবং উগ্রবাদী ছাত্ররা তাদের কথা শুনতো, এবং এইসব শিক্ষকের সাথে সম্পর্ক ভাল ছিল, সেহেতু সে তাদের কাছ সাহায্য আশা করেছিল। কিন্তু তারা ন্যুনতম সাহায্য করেনি। দুই প্রভাবশালী শিক্ষক দুইজন চাইলে তার কাজটা সহজ হয়ে যেত। অন্য কয়েকজন শিক্ষক ভিসির বরাবর তার অবস্থা জানালে ভিসির সরাসরি হস্তক্ষেপে অবশেষে সে অনলাইনে ভাইভা দিতে পারে এবং সে তার ক্লাসের সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে প্রথম হয়।
* সহযোগী অধ্যাপক
আইন বিভাগ
কার্লটন ইউনিভার্সিটি, কানাডা