23/11/2025
এক্সেস রোডে সাজ্জাদ হত্যা: মূল নেপথ্যে বহিষ্কৃত যুবদল নেতা বাদশা
নিজস্ব প্রতিবেদক:
চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া থানাধীন এক্সেস রোডে কলেজ ছাত্র ও আনসার সদস্য সাজ্জাদ হত্যাকাণ্ড এখন শুধু একটি খুনের ঘটনা নয়। এটি নগর রাজনীতির গভীরে গেঁথে থাকা ক্ষমতার লড়াইয়ের স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি। প্রথম মামলার পর নিহতের মা ফরিদা বেগমের করা দ্বিতীয় মামলায় উঠে এসেছে আরও ভয়ংকর তথ্য। অভিযুক্ত বহিষ্কৃত যুবদল নেতা এমদাদুল হক বাদশা ও তার সহযোগীদের বিতর্কিত ভূমিকা নিয়ে নগরবাসীর প্রশ্ন আরও বেড়েছে। কেন নগর মেয়র নিজেই ফোন করে মামলা তুলে নেওয়ার চাপ দিচ্ছেন? কেন মামলার বাদীকে ঘিরে ভয় দেখানোর মহড়া চলছে?
ঘটনা ঘটে ২৮ অক্টোবর রাত ১২টা ৪০ মিনিট থেকে ১টা ৫ মিনিটের মধ্যে। স্থানীয়রা জানায়, রাতের আঁধারে হঠাৎ নিভে যায় এক্সেস রোড, সৈয়দ শাহ রোড থেকে বলাকা আবাসিক পর্যন্ত পুরো এলাকার বিদ্যুৎ। সেই অন্ধকারে এমদাদুল হক বাদশা গ্রুপের প্রস্তুত থাকা লোকজন অবস্থান নেয়। পরে জানা যায়, এই ব্ল্যাকআউট ছিল একটি পরিকল্পিত কৌশল, যাতে গুলির শব্দ, চলাফেরা কিংবা হামলাকারীদের মুখ শনাক্ত করা কঠিন হয়। বিশেষ করে দ্বিতীয় মামলার ৫ নম্বর সাক্ষী প্রকৌশলী রিয়াজুল হকের মতে, বিদ্যুৎ লাইন ইচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ করা হয়েছে। তার মন্তব্য মতে, এটা প্রচার পেলে সন্ত্রাসীরা ভবিষ্যতে অপরাধ করতে এ ধরনের কৌশল ব্যবহার করতে পারে।
সেদিন সাজ্জাদ বাড়ি থেকে বের হন একটি ফোন কলে। আল আমিন ফোন করলেও সাজ্জাদ পরিবারকে জানান মোবারক ডাকছে। রাত ১টা ২৪ মিনিটে আসামি আবদুল কাদের আবার ফোন করে সাজ্জাদের মাকে হাসপাতালে যেতে বলেন। কিন্তু মেডিকেল নথি বলছে, সাজ্জাদের নিথর দেহ হাসপাতালে পৌঁছায় ১টা ৪১ মিনিটে। প্রশ্ন ওঠে, যখন হাসপাতালে লাশ তখনো পৌঁছায়নি, তখন কাদের কীভাবে জানল সাজ্জাদ আহত বা নিহত?
স্থানীয়রা বলছে, বাদশা গ্রুপ আগেই অবস্থান নিয়ে ছিল। দোকানপাট বন্ধ করে দেওয়া হয়, রাস্তা ফাঁকা ছিল। অন্ধকারে গুলির শব্দ শোনা যায়। পরে বলাকা আবাসিকের সামনে পড়ে থাকতে দেখা যায় সাজ্জাদকে। অন্যদিকে বাদশা গ্রুপ দাবি করে, তাদের ওপর প্রতিপক্ষের হামলা হয়েছে, তারা আহতদের সাহায্য করছিল। কিন্তু প্রশ্ন থেকেই যায়, হামলার ১০ মিনিটের মধ্যেই কীভাবে তারা আহতদের নিয়ে হাসপাতালে গেল এবং সাথে সাথে মিডিয়ায় বক্তব্য দিল? এটি কি আগেই সাজানো কোনো চিত্রনাট্য?
চমেক হাসপাতালে নিহতের মায়ের করা দ্বিতীয় মামলার এক নম্বর আসামি ও বহিষ্কৃত যুবদল নেতা এমদাদুল হক বাদশার দেওয়া বক্তব্য এবং তার সঙ্গে থাকা ছবি ও ভিডিওতে দেখা যায়, যাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখানো হচ্ছে, বোরহান ও সোহেল, তাদের সঙ্গে বাদশার রাজনৈতিক সম্পর্ক দীর্ঘদিনের। একই রাজনৈতিক পরিচয়ের লোকজন হঠাৎ দুইটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে পড়ে। স্থানীয়দের মতে, মূল লড়াই ছিল আধিপত্য, এলাকা নিয়ন্ত্রণ এবং ক্ষমতা প্রদর্শনকে কেন্দ্র করে।
প্রথম মামলাটি করেন নিহত সাজ্জাদের বাবা, চাপ, ভয়ভীতি আর প্রতারণার মধ্যে দিয়ে। অভিযোগ উঠেছে, বাদশার লোকজন সাজ্জাদের বাবাকে নিজেদের দলে নিয়ে গিয়ে নামজাদা প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে অভিযোগ চাপিয়ে মামলা করায়। সেই মামলায় ১৭ জনকে আসামি করা হয়, যার বাইরে রাখা হয় বাদশা ও তার নেতৃস্থানীয় সহযোগীদের নাম। পুলিশও দ্রুত গ্রেপ্তার করে ১০ জনকে। শুরু থেকেই প্রশ্ন ওঠে, মামলাটি কি সাজানো? আসল খুনিরা কি আড়ালে?
এই প্রশ্নের উত্তর স্পষ্ট হতে শুরু করে নিহতের মা ফরিদা বেগমের দ্বিতীয় মামলায়। আদালতে দেওয়া তার জবানবন্দিতে উঠে আসে ভয়ংকর চিত্র। বাদশা শুধু খুনের পরিকল্পনাই করেননি, ষড়যন্ত্র করেছেন মামলাটি ভিন্ন খাতে নেওয়ারও। তিনি, তার ভাই জাবেদ, সহযোগী সাদ্দাম, জাকির, জসিম, ফয়সালসহ একাধিকজন মিলে ব্ল্যাকআউট কিলিং অপারেশন পরিচালনা করেন। মামলায় আরও বলা হয়েছে, বাদশা এলাকার নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে অস্ত্রধারী বাহিনী দিয়ে মানুষের ওপর নিয়মিত সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতেন।
সবচেয়ে আলোচিত বিষয়, দ্বিতীয় মামলার পরপরই ফরিদা বেগম ভয়াবহ হুমকির মুখে পড়েন। তার অভিযোগ, চট্টগ্রাম সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন নিজেই ফোন করে তাকে মামলা প্রত্যাহারের জন্য চাপ দেন। আদালত থেকে বাসায় ফেরার পর আবার অস্ত্রধারীরা তার বাড়ির সামনে মহড়া দেয়। সন্তান হারিয়ে বিচার চাইতে গিয়ে একজন মা এমন উল্টো হুমকির মুখে পড়বেন, এমন অভিযোগ সাধারণ মানুষকে আরও আতঙ্কিত করেছে।
ফরিদা বেগমকে মামলা তুলতে বারবার হুমকি দেওয়া হচ্ছিল, আজ চট্টগ্রাম আদালতে তার বাস্তব প্রমাণও পাওয়া গেছে। সিটি মেয়রের চাপ, বাড়িতে গিয়ে ভয়ভীতি দেখানো, সব মিলিয়ে নিরুপায় ফরিদা বেগম বাধ্য হয়ে আদালতে মামলা প্রত্যাহারের পিটিশন দাখিল করেন। বৃহস্পতিবার মামলা দায়ের করলেও পরদিনই আবার মামলা তুলে নেওয়ার জন্য নতুন করে হুমকি দেওয়া হয় তাকে।
এদিকে মোজাম্মেলের দেওয়া স্বীকারোক্তি, জসিম ও হিরনের ফোনালাপ, বিদ্যুৎ বন্ধের তথ্য এবং সাজ্জাদের সঙ্গে থাকা কয়েকজনের সন্দেহজনক আচরণ, সব মিলিয়ে দ্বিতীয় মামলাটি নতুন মোড় দিয়েছে। স্থানীয়রা বলছেন, হত্যার পর বাদশা গ্রুপের আচরণও ছিল অস্বাভাবিক। লাশ নিয়ে যাওয়া, জানাজার আয়োজন, মানববন্ধন, সবকিছুতেই তারা অদ্ভুত সক্রিয় ছিল। যেন পুরো ঘটনাটি নিজেদের মতো করে ম্যানেজ করার চেষ্টা ছিল।
এখন প্রশ্ন, নগর রাজনীতির প্রভাবশালীরা কি সত্যিই সাজ্জাদ হত্যাকাণ্ড আড়াল করতে চেষ্টা করছে? একজন মায়ের অভিযোগ কি উপেক্ষিত হবে? পুলিশ প্রথম মামলায় দ্রুত অভিযুক্ত গ্রেপ্তার করলেও দ্বিতীয় মামলায় তারা নিস্পৃহ। আদালতে ফরিদা বেগম লড়ছেন একা, আর তার প্রতিপক্ষ এক ক্ষমতাবান রাজনৈতিক সিন্ডিকেট।
চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালত নং ৫ এর বিচারক নুসরাত জাহান জিনিয়ার আদালতে মামলাটি এখন আদেশের অপেক্ষায়। স্থানীয়দের মতে, এটি শুধু একটি হত্যা মামলা নয়। ক্ষমতার ছায়ায় ঢাকা একটি মায়ের আর্তনাদ এবং সত্য লুকানোর ভয়ংকর প্রয়াসের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এখন দেখার বিষয়, চট্টগ্রামের সাজ্জাদ কি আরেকটি অমীমাংসিত রাজনৈতিক খুন হয়ে যাবে, নাকি আইনের কাছে সমানভাবে দায়ী হবে প্রতিটি অপরাধী।
ঘটনা এখানেই শেষ নয়। আড়ালে রয়েছে আরও জটিল ও গভীর একটি গল্প। চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন ভোর সকালেই চট্টগ্রাম মেডিকেলে গিয়ে নিহত সাজ্জাদকে দেখেন। নগরের বড় বড় হত্যাকাণ্ডে নিজ দলের সক্রিয় কর্মীদের পরিচয় অনেক সময় এড়িয়ে চলা সিনিয়র নেতারা যেখানে নীরব থাকেন, সেখানে একজন সাবেক ছাত্রলীগ নেতাকে দেখতে মেয়রের দ্রুত হাসপাতালে ছুটে যাওয়া জনমনে নানা প্রশ্ন তুলেছে।
হাসপাতালে তিনি মিডিয়ার সামনে আবেগঘন কণ্ঠে বলেন, আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তার করার জন্য তিনি আগেই ওসিকে ফোন করেছিলেন, এমনকি সিএমপি কমিশনারকেও জানিয়েছেন। তার এমন বক্তব্য ঘটনাটিতে আরও প্রশ্নের জন্ম দেয়। তাহলে কি আগে থেকেই তিনি কিছু জানতেন? কেন তিনি গ্রেপ্তারের কথা উল্লেখ করলেন? এবং চট্টগ্রামে এত নেতাকর্মী থাকা সত্ত্বেও তিনি নিজে সেখানে উপস্থিত হলেন কেন, এ নিয়েও সন্দেহ বাড়ছে।
মেয়র যাদের যুবলীগের শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে দাবি করেছেন, বাস্তব তথ্য সেখানে ভিন্ন চিত্র দেয়। অভিযুক্ত বোরহান উদ্দিন ছিলেন ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন মহানগর ছাত্রদলের সভাপতি গাজী মোহাম্মদ সিরাজ উল্লাহ ও বেলায়েত হোসেন বুলুর স্বাক্ষরিত কমিটির ৪৫ নম্বর সিরিয়ালের চকবাজার থানা ছাত্রদলের সাহিত্য সম্পাদক। অভিযুক্ত নজরুল ইসলাম সোহেল ছিলেন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় সংসদ কমিটির সুলতান সালাউদ্দিন টুকু ও আমিরুল ইসলাম আলীমের স্বাক্ষরিত তালিকার ১৮৫ নম্বর সদস্য (পটিয়া)। আর অভিযুক্ত মিল্টন সাবেক ছাত্রশিবিরের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। এই তথ্যগুলো স্পষ্ট হওয়ার পর প্রশ্ন উঠছে, মেয়র কেন তাদের নিজের দলের কর্মী হিসেবে অস্বীকার করলেন? এই অস্বীকারে কি আরও কোনো রহস্য লুকানো আছে? এছাড়া বোরহান ও সোহেল মেম্বারের একাধিক ব্যানারে গাজী সিরাজ উল্লাহর ছবি থাকা তাদের রাজনৈতিক পরিচয়কে আরও পরিষ্কার করে।
আমাদের হাতে থাকা একটি হোয়াটসঅ্যাপ কলের ভিডিও স্ক্রিনশটে দেখা যায়, বোরহান ও বাদশার মধ্যে গত সাত থেকে আট মাস ধরে নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। তাদের দীর্ঘ আলাপচারিতাও স্পষ্ট। আরও একটি ভিডিওতে দেখা যায়, বোরহান ও বাদশা একসঙ্গে মিছিলে অংশ নিচ্ছেন, এমনকি একে অপরকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানোর ছবিও আছে।
কে এই এমদাদুল হক বাদশা?
এমদাদুল হক বাদশা দীর্ঘদিন ধরে নগর রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। অভিযোগ আছে, ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার বিদায়ের পর থেকে বাকলিয়া ও চকবাজার এলাকায় তিনি একের পর এক দখল ও চাঁদাবাজির ঘটনায় জড়িয়ে পড়েন।
এই অভিযোগের ভিত্তিতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী ১২ জুলাই ২০২৫ তারিখে চট্টগ্রাম মহানগর যুবদলের বিলুপ্ত কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক এমদাদুল হক বাদশাকে প্রাথমিক সদস্যপদসহ দল থেকে বহিষ্কার করা হয়।
জাতীয়তাবাদী যুবদল কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সভাপতি আবদুল মোনায়েম মুন্না ও সাধারণ সম্পাদক মোহাম্মদ নূরুল ইসলাম নয়ন এ সিদ্ধান্ত অনুমোদন করেন। বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বহিষ্কৃত নেতাদের অপকর্মের দায় দল নেবে না এবং তাদের সঙ্গে সাংগঠনিক কোনো সম্পর্ক না রাখার নির্দেশ দেওয়া হয়। পাশাপাশি ভবিষ্যতে এমদাদুল হক বাদশার বিরুদ্ধে দলীয় পরিচয় ব্যবহার করে কোনো বেআইনি কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ পেলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে বলা হয়।