25/09/2024
ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের তঞ্চঙ্গ্যারা কেন চাকমা টাইটেল লিখে তার উত্তর- (সাক্ষাৎকার পড়ুন)।
[বিঃদ্রঃ সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে মাতৃভাষায়, বাংলাদেশী তঞ্চঙ্গ্যাদের সুবিধার্থে বাংলায় লেখা হয়েছে ক'দিন পর ইংরেজি ভাবানুবাদে প্রকাশ করা হবে। সাক্ষাৎকার নেওয়া হয়েছে অনলাইনে]
আত্মকথা- দাদা নমস্কার।
অমৃত নন্দ - হুম, আপনাকেও নমস্কার।
আত্মকথা- কেমন আছেন দাদা? কেমন আছে আপনার ত্রিপুরা রাজ্যের জাতি ভাইয়েরা?
অমৃত নন্দ- হুম, ভালো আছি। আপনি, আপনারা কেমন আছেন?
আত্মকথা- ভালো মন্দ মিলেই আছি আমরা। তো দাদা আপনি চাকমা লিখেন? আপনি চাকমার কোন গছার?
অমৃত নন্দ- হুম, আমরা চাকমা লিখতাম। আমি "কারওয়া গছা" তবে আমাদের এখানে "মো'অ গছা, ধন্যা গছাও আছে এবং মিজোরাম ও অরুণাচলেও আমাদের জাত ভাই আছে।
আত্মকথা- হ্যাঁ আমিও তাই শুনেছি। আমাদের অনেকেই নাকি (দাদুর দাদুরা) অরুণাচল চলে গিয়েছিল। কিন্তু দাদা, চাকমা জাতিতে আপনার উল্লিখিত কোন গছার অস্তিত্বই নাই? তো আপনি কিভাবে চাকমা পরিচয় দেন অর্থাৎ কোন যুক্তিতে? ত্রিপুরা রাজ্যে কতজন আছেন আপনারা?
অমৃত নন্দ- আমাদের দাদুর দাদুরা আগে থেকেই চাকমা লিখতো। আমাদের দাদু এবং বাবারা বলতো আমরাই নাকি আসল এবং খাঁটি চাকমা। সেই যুক্তিতে এবং সূত্রে আমরা চাকমা লিখি। তবে আনক্যা চাকমাও আছে। যারা বাংলাদেশের চাকমা নামে পরিচিত এবং এখানেও অনেক আছে। এখানে প্রায় ৬-৭ হাজার মতো আছি আমরা, তবে আনক্যা বেশি।
আত্মকথা- আনক্যা চাকমা আবার খাঁটি বা আসল চাকমা বিষয়টা বুঝতে পারছি না দাদা। আর আপনারা কী বাংলাদেশ থেকে ত্রিপুরায় গেছেন? নাকি আগে থেকেই ওই খানে?
অমৃত নন্দ- আমার দাদুরা আগে থেকেই এখানে আছে, সেই সূত্রে বাবা মা এ আর কী ☺ ! আর আনক্যা চাকমা মানে হলো যারা পূর্বেকার থেকে বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাস করে আসছিল, আর আমরা হলাম রোয়াইঙয়া চাকমা নামে পরিচিত অর্থাৎ যারা আরাকান প্রদেশে বাস করত এবং এখনো আছে, যাদেরকে মায়ানমারেরা দৈংনাক বা দাইনাক বলে আখ্যায়িত করতো। আরাকানে এখনো দৈংনাক পাড়া নামে গ্রাম আছে। আপনাদের দেশে কক্সবাজারেও নাকি আছে।
আত্মকথা- কিন্তু দাদা ত্রিপুরা রাজ্যে যারা আপনারা চাকমা টাইটেল ধারণ করেন, অন্যান্য যে চাকমা (বাংলাদেশের) আছে তারা মনে করে আপনারা তাদের এক জাতি ভাই।
অমৃত নন্দ- টাইটেল এক হলে যে একই জাত হবে তা তো নয়, দেখতে হবে গছা গোষ্ঠী মিলে কিনা, পোশাক এবং ভাষা মিলে কিনা। বাংলাদেশী যে চাকমা আছে তাদের গছা গোত্রের মধ্যে তো কারওয়া গছা, মো'অ গছা, ধন্যা গছা, লাঙ গছা নাই। সুতরাং এক জাতি দাবি করাটা কতটা যুক্তিযুক্ত। তাছাড়া পোশাক পরিচ্ছদ এবং ভাষাও ভিন্ন।
আত্মকথা- আপনারা নিজেদের মধ্যে কিভাবে পরিচয় চিহ্নিত করেন?
অমৃত নন্দ- সেটা কিরকম পরিচয় চিহ্নিতকরণ?
আত্মকথা- ধরুন, আপনারাও চাকমা লিখেন, আর আনক্যারাও চাকমা লিখে?
অমৃত নন্দ - ও আচ্ছা, তারা আমাদেরকে তঞ্চঙ্গ্যা চাকমা ডাকে, আর আমরা ওদেরকে আনক্যা চাকমা বলে ডাকি।
আত্মকথা- কিন্তু দাদা, তারাতো উভয়কে চাকমা জাতি বলে দাবি করে, এমনকি বাংলাদেশের তঞ্চঙ্গ্যাদেরও। সেটা আপনার দৃষ্টিতে কিরকম ভাবায়?
অমৃত নন্দ- দেখেন, ভুলভাল তথ্য দিয়ে যা ইচ্ছে তা বললেতো হয় না। এখানে দেখতে হবে রিয়াল কোনটা। তারা দাবি করলে যে সব হয়ে যাবে সেটা তো না, তার ভিত্তি থাকতে হবে। ওরা তো মায়ানমারের যারা দাইনাক বা দৈংনাক লিখতো তাদের আনক্যা চাকমা বলে দাবি করে প্রোপাগান্ডা ছড়াচ্ছে, ওদেরকে ভুল বুঝিয়ে অনেক কিছু বলছে। মায়ানমারের যে মেয়েটা ক'দিন আগে বি.এড ডিগ্রি লাভ করেছিল সে তো দৈংনাক এবং ধন্যা গছার মেয়ে। কিন্তু তারা তাদের বিভিন্ন পেইজে দাবি করছে সেটা চাকমা মেয়ে এই সেই। চাপিয়ে দিয়ে তো কারোর পরিচয় নির্ধারণ করে দেওয়া যায় না। যেটা মানবাধিকারের প্রশ্নও বটে।
আত্মকথা- মায়ানমারে যারা প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে বলছেন তারা আসলে কারা এবং কোত্থেকে?
অমৃত নন্দ- যারা প্রোপাগাণ্ডা ছড়াচ্ছে তারা হলো বৌদ্ধ সন্ন্যাসী, তারা রং কাপড় নিয়ে বুদ্ধের অনুশাসনে ঢুকে মায়ানমারে ধর্ম প্রচারের নামে প্রবেশ করে জাত নিয়ে বিভিন্ন বিভ্রান্ত ছড়াচ্ছে। তারা মূলত বাংলাদেশী চাকমা জনগোষ্ঠীর বলে আমাদের কাছে তথ্য আছে। তাদের উদ্দেশ্যে মহৎ নয়।
আত্মকথা- আপনারাও চাকমা লিখেন, ওরাও চাকমা লিখে। জাত ভিন্ন বলছেন, অথচ টাইটেল এক হয়ে গেলো না?
অমৃত নন্দ- আগেও বলেছি আমরা (তঞ্চঙ্গ্যারা) হলাম আসল, খাঁটি চাকমা এবং এখনো অনেক বুড়ো বুড়ি বলতো। কিন্তু তারা কোন উদ্দেশ্যে চাকমা টাইটেল ধারণ করে আসছিল সেটা আসলে বোধগম্য নয়। দেখেন তাদের মধ্যে আবার খাঁ ছিল, রায়, দেওয়ান, লারমা প্রভৃতি। অথচ আমাদের ত্রিপুরায় এরকম কোন কিছু নাই অন্তত আমরা যারা খাঁটি চাকমার উত্তরাধিকারী হিসেবে দাবি করি। রায়, লারমা, দেওয়ান এসব লিখি না, শুধু চাকমায় লিখি।
আত্মকথা- সেক্ষেত্রে খাঁটি নাকি নকল চাকমা তা কিভাবে চিহ্নিত করা যেতে পারে? যেটা এক কথায় চিহ্ন বা সাইন বলা যায়।
অমৃত নন্দ- আমাদের যে পাঁচ কাপড় (পাইত্৷ কাবর) আছে না, সেটায় আসল পরিচয়। সেটাই চিহ্ন হিসেবে ভূমিকা রাখতে সাহায্য করবে।
আত্মকথা- আপনি জানেন কিনা তারা তো আপনাদের দেখিয়ে বলে এই দেখ আমাদেরও পাঁচ কাপড়, এরা চাকমা জনগোষ্ঠীর লোক।
অমৃত নন্দ- সেক্ষেত্রে যারা এরকম দাবি করে তাদের উদ্দেশ্যে মহৎ নয়।
আত্মকথা- শেষের আগে একটা প্রশ্ন করি, এখনকার সময়ে তো অনেকে পাইত্ কাবর ব্যবসা করছে। সেটা আপনি কিভাবে দেখছেন?
অমৃত নন্দ- সেটা নেগেটিভ পজিটিভ দুটোই আছে, তবে পজিটিভের চেয়ে নেগেটিভ মাত্রা বেশি। কারণ এই পাইত্ কাবর নিয়ে অনেকে অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার করতে পারে, যেটা একটু আগে আপনি একটু করে বলেছিলেন। পাইত্ কাবরের বিশেষত্ব হারিয়ে যেতে পারে, যতটা সম্ভব সেটা ধরে রাখাটা আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। দেখা যাবে আনক্যারা পাইত্ কাবর কিনে এবং নকশা নকল করে শেষমেশ নিজেদের বলে দাবিও করতে পারে।
আত্মকথা- তার মানে আপনি বুঝাতে চাচ্ছেন, পাইত্ কাবরই আমাদের আসল পরিচয়?
অমৃত নন্দ- অবশ্যই। ভাষা আর পোশাক যদি হারিয়ে ফেলি তাহলে জাতির অস্তিত্ব হারিয়ে যাবে।
আত্মকথা- শেষ প্রশ্ন দাদা, আপনি নিশ্চয়ই রাজগুরু অগ্রবংশ মহাথেরর কথা শুনেছেন! বাংলাদেশের অনেক চাকমা (আপনার মতে আনক্যা চাকমা) দাবি করতো এরকম, রাজগুরু ভান্তেও নাকি নিজেকে চাকমা দাবি করতেন, অপরদিকে দেখা যাচ্ছে চাকমা আর তঞ্চঙ্গ্যাদের (বাংলাদেশ) ইতিহাস প্রায়ই কাছাকাছি এবং অভিন্ন সেটা কিভাবে বিশ্লেষণ করবেন।
অমৃত নন্দ- হ্যাঁ ভালো একটা কথা বলেছেন আপনি, আমিও উনার নাম শুনেছি। শুনেছি রাজগুরু অগ্রবংশ ভান্তে বেশ জ্ঞানী ও মহৎ লোক। রাজগুরু ভান্তে নিজেকে চাকমা দাবি করতেন অনেকটা আমাদের মতো, খাঁটি বা আসল চাকমা এ সূত্র থেকে। তবে মজার বিষয় তিনি আনক্যা চাকমাদের যে গছা গোত্র আছে সেই গছা গোত্রের কোনটায় না। তিনি মো'অ গছা এবং বিলাইছড়ি তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত অঞ্চলের তঞ্চঙ্গ্যা পরিবারের সন্তান।
উভয়ের ইতিহাস কাছাকাছি বা অভিন্ন হবেই না বা কেন? তাদের বংশদ্ভূত বা মূল শেকড় তো শাক্যবংশীয়। পুরনো বুড়ো-বুড়িদের কথা যদি সত্যি দাবি করা হয় যে, অর্থাৎ আমরা যে খাঁটি চাকমা বা আসল চাকমা তাহলে ওই ইতিহাস আমাদের ছিলো। কিন্তু কালেক্রমে তখনকার থেকেই কিছু মানুষ ইতিহাস বিকৃত করে নিজেদের দাবি করে আসছে। এখন তাদের উদ্দেশ্য কী সেটাও ভাবার বিষয়।
আত্মকথা- আপনার কথা ভাববার বিষয় তো! এখন সাধক কবি শিবচরণ যে ওদের চাকমা (আনক্যা) দাবি করা হয়, অথচ দেখা গেছে সেই শিবচরণের আদি বাড়ি হচ্ছে রাজস্থলী নাড়াইছড়িতে যেটা তঞ্চঙ্গ্যা অধ্যুষিত এলাকা। গোজেন লামা (তঞ্চঙ্গ্যারা বলে গোসাইন লামা) নামক গ্রন্থেও তা উল্লেখ আছে। রাধামন ধনপুদি নিয়ে বাংলাদেশে এক চাকমা (আনক্যা) কবি ও লেখক সরকারি টাকায় গ্রন্থ ছাপিয়েছে সেই গ্রন্থে প্রারম্ভে উল্লেখ আছে সেই রাধামন ধনপুদি কাহিনি তিনি এক তঞ্চঙ্গ্যা বুড়ো (শ্রী কার্তিক চন্দ্র তঞ্চঙ্গ্যা'র মামা) থেকে পান্ডুলিপিটা সংগ্রহ করেছিলেন। তবেই কী এগুলি সেটার আলামত যে তঞ্চঙ্গ্যাদের (খাঁটি বা আসল চাকমা যাদের বলা হয়) ইতিহাস মুছে ফেলার তাগিদে পরিকল্পিত ভাবে বিকৃতি করা হচ্ছে?
অমৃত নন্দ- আপনার অনুমান বা ব্যাখ্যাটা অমূলক নয়। তবে এই নিয়ে আরও গবেষণার দাবি রাখে। আসল কথা কী জানেন এসব গবেষণা করতে সময় ও অর্থ দরকার, কিন্তু আমাদের সেই সামর্থ্য অপ্রতুল। যার ফলে আমাদের অনেক মূল্যবান জিনিস অবহেলায় হারিয়ে যাচ্ছে কিংবা অন্যকেউই চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে।
আত্মকথা- হ্যাঁ অমৃত দা, আপনার সাথে আমিও একমত। বাংলাদেশের তঞ্চঙ্গ্যাদের উদ্দেশ্যে আপনি কিছু বলবেন কিনা?
অমৃত নন্দ- কি আর বলব! আপনারা তঞ্চঙ্গ্যা লিখেন আর আমরা চাকমা লিখি, কিন্তু আমাদের গছা গোত্র এক এবং অভিন্ন। আমাদের পাইত্ কাবরই পরিচয় করিয়ে দেয় আমরা এক জাতিগোষ্ঠীর। সেক্ষেত্রে আমাদের যোগাযোগ আরও বাড়বে, সখ্যতা বৃদ্ধি পাবে সেটায় প্রত্যাশা। এ পাইত্ কাবর কিন্তু অন্য কারোর নেই, সেটা নিয়ে যেন অন্য কেউই অসৎ উদ্দেশ্যে ব্যবহার না করে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে আমাদের সবার।
আত্মকথা- আচ্ছা, অমৃত দা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ আমাদের টিমকে পরামর্শ ও সময় দেওয়ার জন্য। আপনাদের কাছে অনুরোধ থাকবে যেন বাংলাদেশে বেড়াতে আসেন।
অমৃত নন্দ- অবশ্যই! আপনাদেরকেও অসংখ্য ধন্যবাদ সময় দেওয়ার জন্য, ভালো থাকবেন এবং ভারতে (ত্রিপুরা, মিজোরাম, অরুণাচল) বেড়াতে আসেন।
আত্মকথা- আপনিও ভালো থাকবেন।
©Tanchangya Nation