11/04/2025
তিন গেরিলা এবং লোগাং ইতিহাসের গোপন পাতা
আজ ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে আমার পুরনো ব্যাগ চোখে পড়ল। খুব ময়লা হয়েছে। বাইরে পরিষ্কার করে ভেতরে দেখলাম পুরনো ডায়েরিগুলো ঠিক আছে কিনা। কিন্তু চোখে পড়ল সেই ডায়েরি যেখানে ৫৭টি পৃথিবী না-জানা বীরত্বের কাহিনি নিয়ে অবহেলায় রাখা এই ৩০ বছর পুরনো স্মারক।
এই একেকটা কাহিনী যেন ইতিহাসের মাটিতে পুঁতে রাখা বিস্ফোরক। কিছু গল্প আছে, যা বললে শুধু চোখে জল আসে না, বরং চোখের জলে আগুন জ্বলে।
সেই ৫৭টি পৃথিবী না-জানা বীরত্ব কাহিনীর একটি আজ না বলে থাকতে পারলাম না। কারণ এই কাহিনী না বলা পর্যন্ত বুকে বাঁধা পাথর সরাতে পারছি না, যা আমি ৩০ বছর ধরে নীরবে যন্ত্রণায় একাকী বয়ে চলেছি। আমি চাই এই কাহিনী আমার মতো আর কেউ বয়ে নিক এবং আমাকে এই বোঝা বয়ে নিতে সাহায্য করুক।
কারণ নীরবতা কখনো নিরীহ থাকে না। অনেক সময় নীরবতার কাঁধেই জুলুমের ভার চাপিয়ে দেয় শাসক। তাই বলতে হবে। এবার বলতে হবে। তাই লিখে প্রকাশ করছি।
দিনটি ছিল ১০ এপ্রিল ১৯৯২ সাল।
পার্বত্য চট্টগ্রামের বসবাসকারী আদিবাসী পাহাড়িদের সবচেয়ে বড় তিন দিনব্যাপী উৎসবের দিন ফুল বিঝু। আনন্দের দিন। এই দিনে আদিবাসী শিশুরা গ্রামের পাশের বনের হরেক রকম পাহাড়ি ফুল তুলে, আর সেই বন্য ফুল দিয়ে ঘর সাজায়। এমনকি তাদের পালিত গরু, মহিষ এবং ছাগলের গলায়ও আদরে ফুলের মালা পরায়।
এই আনন্দ শুধু উৎসব নয়—এটা এক মাটি-কেন্দ্রিক সংস্কৃতির আত্মা, যা অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার এক নিরীহ প্রথা অথচ অবিনাশী অস্তিত্বের প্রতীক।
মালার কাজ শেষ হলে কিছু চাল এবং ধান নিয়ে পাহাড়ি জুমে ধানের বীজ বোনার ছোট্ট কুরুম কোমরে বেঁধে গ্রামে হাস-মুরগিকে খাবার দিতে বের হয়, যেন গ্রামের কোনো পালিত প্রাণী না খেয়ে থাকে। কারণ আজ বিঝু। সারা পাহাড় জুড়ে গা জুড়ানো আনন্দের দোলা। সেই আনন্দ পাহাড়ি না হলে উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
অবশ্যই সেই আনন্দের সুর কেবল পাহাড় জানে, সমতলের রাষ্ট্র তা বোঝে না। বোঝেও না বোঝার ভান করে।
এই দিনে পাহাড়ি আদিবাসী লোকেরা বন-জঙ্গল থেকে পাহাড়ি আলু, পাজনের শাকসবজি সংগ্রহ করে। কেউ পাহাড়ি নদীতে মাছ ধরে। কেউ পাহাড়ে শিকার করে। কারণ পরের দিন মূল বিঝু। অতিথি আসবে। তাদের সুন্দর খাবার খাওয়াতে এই আয়োজন।
সকালে লোগাং গুচ্ছ গ্রামের অনেকে ক্যাম্প থেকে অনুমতি নিয়ে জঙ্গলে গেছে।
তারা জানত না, সে দিন জঙ্গলই হবে তাদের শেষ আশ্রয়। যে পাহাড় এতকাল বাঁচিয়েছে, আজ তারই কোলে লুকাতে হবে প্রাণ।অথবা সেখান থেকে ভারতে গিয়ে শরণার্থী হয়ে মানবেতর জীবন শুরু হবে। দেখা হবে না আর কোনদিন গুচ্ছগ্রামে ফেলে আসা পরিবারের সেই প্রিয় মুখগুলি। তারা হারিয়ে যাবে চিরতরে।
সে দিন লোগাংয়ের পূর্ব পাড়ে তারাবনের মুখে একদল শান্তি বাহিনী পেটের ক্ষুধায় অস্থির হয়ে আছে। তারা ভাত খেয়ে বড় হয়েছে। কিন্তু সরকার সব পাহাড়িদের লোগাং গুচ্ছগ্রামে রাখায় কোনো পাহাড়ি এখানে কোন ঘর ছিল না। তাই তাদের এই ভাতের অভাব।
কিন্তু পেটের ক্ষুধার চেয়ে বিবেকের ক্ষুধা শতগুণে তীব্র।সেটা তারা একটু পরে টের পেল।
দূর থেকে দেখা গেল একদল আদিবাসী শিশু লোগাং পশ্চিম পাড়ে চরে গরু চরাচ্ছে। এখনো ১১ টা বাজেনি। কিন্তু হঠাৎ একজন টের পেল কিছু একটা হচ্ছে। কোমর থেকে দূরবীন বের করে দেখা গেল। পাঁচজন মিলে এক আদিবাসী কিশোরীকে ধাওয়া করে ধরে বালু চরে ফেলে ঝাঁপটে ধরেছে।
এই যেন এক নিরীহ, ফুটফুটে হরিণ শাবকের চারপাশে পাঁচ ক্ষুধার্ত পাঁচ হায়েনা।ছিঁড়ে খাবে শাবকের মাংস।এখন বুঝতে দেরি হল না কী হচ্ছে। কাছে মনে হলেও যেতে সময় লাগে।
মুহূর্তে চোখের সামনে ঘটনা ঘটে গেল। এক এক করে পাঁচজন তাদের লালসা মেটাল।তারপর গলা কেটে মুরগি জবাই করল। কি বীভৎস! কি লোমহর্ষক মুহূর্ত!
তারা বুঝে গেল রাষ্ট্র যখন পাহাড়ের ফুলকে রক্ষা করে না, তখন হায়েনার লালসা কেবল একজনকে নয়—সমস্ত জাতিসত্তাকেই অপমান করে।
এখন কি করা?
কেউ গুলির অনুমতি চাইল। কিন্তু অনুমতি মিলল না।
কারণ উত্তরে একটি পোস্ট, দক্ষিণে আরেকটি পোস্ট। তাছাড়া অনেক দূর। খালি চোখে পরিষ্কার দেখা যায় না। দূরবীনে দেখতে হয়। গুলি এত দূর ধরলেও কার্যকর ফলাফল হবে কিনা সন্দেহ। এখন গুলি করলে গুচ্ছ গ্রামের সব লোক মারা যাবে। সেটলার এবং সেনা, বিডিআর মিলে সব পাহাড়ি জবাই করবে।
তাই কমান্ডার "না" করে দিলেন।
এই "না" ছিল নৈতিকতার মৃত্যু পরোয়ানা। এই না-র অর্থ—সব দেখেও কিছু না করা।
এই অপমানে, দুঃখে, ক্ষুধা ভুলে গেল। হৃদয় থেকে যেন ফুঁস ফুঁস করে নিশ্বাসের সঙ্গে আগুনের স্ফুলিঙ্গ বেরিয়ে আসছে সবার।
না, এই হায়েনার দল থামেনি। এবার একই ভাবে আরেকজনকে ধাওয়া করছে। মুহূর্তে আরেক আদিবাসী কিশোরীর সতীত্ব তারা কেড়ে নিল। ঐ একই জবাই। তারা আরেকটি বীভৎস মুহূর্তের নীরব সাক্ষী হয়ে গেল তারা।
আর নয়।
তিনজন এবার কমান্ডারের কোনো কথা মানলো না। শান্তি বাহিনীর ড্রেস খুলে লুঙ্গি পরে নিল। রাইফেল রেখে কোমরে পিস্তল এবং ছোরা নিয়ে সাধারণ মানুষের ভান করে লোগাং পূর্ব পাড়ে মাছ খুঁজতে খুঁজতে গরুর পালের দিকে অগ্রসর হতে থাকল।
এই অবাধ্যতাই ছিল প্রকৃত গেরিলা সিদ্ধান্ত। সব গেরিলা যুদ্ধ বন্দুক দিয়ে হয় না—মানবতার পক্ষ নেওয়াই বড় যুদ্ধ।
ততক্ষণে আরেক ত্রিপুরা কিশোরীর দিকে হায়েনারা অগ্রসর হচ্ছে। তিনজনের শরীরের মাংসপেশিগুলি আগে থেকেই শক্ত হয়ে আছে হায়েনা মারার নেশায়। কিন্তু এখনো মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। দৌড়ানো যাবে না। স্বাভাবিক থাকতে হবে। যাতে বিডিআর-এর পোস্ট থেকে তাদের টের না পায়।
কিন্তু যখন ঘটনাস্থলে পৌঁছল তখন সেটলার হায়েনারা কিশোরীকে ধরে ফেলেছে। পরনের তামী এক হাতে ধরে, অন্য হাতে প্রতিরোধ করছে মেয়েটি। দুই হায়েনা দুই পা ধরে রেখেছে। হিংস্র হায়েনারা দাঁত বের করে হাহা করে হাসছে। এবার দুই হাতও ধরে ফেলল। বাকি একজন লুঙ্গি না খুলেই তার সেই লালসার অস্ত্র দেখাচ্ছে। লুঙ্গির ভিতরে যেন কিছু একটা লাফিয়ে লাফিয়ে উঠছে যেন ভেতরে কেউ নেশাঘোরে নাচছে।
আর দেরি নয়। তিনজন বজ্রপাতের মতো তীব্র আক্রোশে ঝাঁপিয়ে পড়ল এই পাঁচ হায়েনার উপর। এই আক্রোশে পাঁচ সেকেন্ডে নিভিয়ে দিল হায়েনাদের লালসা। লোগাংয়ের পবিত্র বালু যেন এই পাপিষ্ঠদের রক্ত শুষে নিতে চায় না।
যে দেশ তারই এক প্রান্তে নাগরিকদের সেনা পাহারা দেয়, আবার সেটলারদের হাতে তুলে দেয় সেই পাহাড়িদের শরীর—সেখানে সময় নয়, শুধু নীরবতা থাকে। লোগাং তার প্রমাণ।
আর একটু দুরে যেতে চোখে আখ ক্ষেত। সেখানে এক সাদা দাড়িওয়ালা বুড়ো ঝাঁপিয়ে ধরে আছে এক মাঝ বয়সী মহিলা। গলায় ধারালো ছুড়ি দিয়ে হুমকি দিয়ে বলছে "চুপ নড়বে না! চিল্ললাবি না।"
প্রতিতুত্তরে শোনা গেল, " দিলে দেনা। কক্কন ধরি রাগেবে।"
একজনকে পাহারায় রেখে দুজন ভিতরে ঢুকে সেই বুড়ো হায়েনাকে ধরে ফেলে গেরিলা নিয়ম মেনে আগে কিছু তথ্য আদায় করতে চেষ্টা করল। যে তথ্য পেল তা হৃদয় কেঁপে উঠল। তার মানে এখনই লোগাং হত্যাকাণ্ড শুরু হবে। আর মাত্র ১৫ মিনিট বাকি।
পাহাড়ি মেয়েদের শরীর যেন সেই হত্যাকাণ্ডের আগমনী বার্তা হয়ে উঠেছিল।
এক সাথে ফিরে আসা সম্ভব নয়। তিন জনে তিন দিকে লোগাং পার হয়ে পূর্বদিকে আস্তে আস্তে হাঁটা শুরু করল যাতে পাশের পোস্ট থেকে কিছু বুঝতে না পারে। যারা জংগলে শাকসবজি কিংবা ছোট পাহাড়ি নদীতে মাছ ধরতে গিয়েছিল তাদের আটকাতে হবে। তা না হলে তারাও মারা যাবে।
তাদের খবর ছড়িয়ে দিতে পাহাড় থেকে পাহাড়ে জোর গলায় বলে দেওয়া হল, "গ্রামে ফির না। পরিস্থিতি খারাপ।"
খবর ছড়িয়ে পড়ল। কিন্তু এত অল্প সময়ে সবাইকে রোধ করা গেল না।
পনের মিনিট নয় ঠিক ৩৫ মিনিট পর গুচ্ছ গ্রাম থেকে গুলির আওয়াজের সঙ্গে কালো ধোয়া শুরু হল। সঙ্গে গগন বিদারী নিরীহ মানুষের চিৎকার।
নিমেষে শেষ হয়ে গেল হাজারো আদিবাসীর সেই বিঝুর আনন্দের স্বপ্ন। আনন্দ হয়ে গেল বিষাদ আর প্রিয়জন হারানোর অশ্রু আর বাকরুদ্ধ কান্নায়।
ফুল তুলে ঘর সাজানো যে দিন, সে দিনই কেউ সাজাল আগুন। কারো হাতে ফুল ছিল, কারো হাতে গুলি।
তারপর তো সবায় আমরা জানি কি হয়েছে। কত বীভৎস ছিল সেই গণহত্যা! এমনকি সেই সময়ের এক মহান ব্যক্তি যিনি তখন পানছড়ি জোনে কর্মরত ছিলেন তার কথা শুনলে বুঝা যায় এই লোগাং হত্যাকাণ্ড কতটুকু লোমহর্ষক ছিল।
তার ভাষায়, " লোগাং গণহত্যার সময় আমি পানছড়ি জোন সদরে কর্মরত ছিলাম। এটি একটি পরিকল্পিত গণহত্যা। সে ভয়ানক দৃশ্য না দেখলে কাউকে বোঝানো যাবে না এর নৃশংসতা। মায়ের বুকে ছোট শিশু পুড়ে কয়লা হয়ে গেছে অগণিত লাশের স্তূপে যাদের সৎকারও ভাগয়ে জুটেনি। মানুষ এত নির্মম হতে পারে তা কল্পনাও করা যায়না। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই লোগাং গণহত্যার খবর জানে না। যতদিন বেঁচে থাকবো ততদিন সেই ভয়াল গণহত্যার দৃশ্য ভুলবো না। যারা সেই দিন হত্যাকাণ্ডে নিহত হয়েছেন তাদেরকে আমরা আর ফিরে পাবো না তবে যারা এই হত্যার সাথে জড়িত তাদের বিচারে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হলে নিহতের আত্মা শান্তি পাবে।"
লোগাং গণহত্যার আজ কত বছর পেরিয়ে গেল? বিচার তো দূরের কথা। কেউ গ্রেপ্তার হয়েছে কি?
যাক। এই গল্প আজ ৩০ বছর পরে প্রকাশ করার অর্থ শুধু লোগাং গণহত্যার লোমহর্ষক দিক তুলে ধরে সরকার এবং সেনা- সেটলারদের মুখোশ উন্মোচিত করা নয় বরং সেই তিন শান্তিবাহিনী অবাধ্য বীরদের বীরত্বের কথা স্মরণ করার জন্য। তারা বেঁচে থাকুক আমাদের হৃদয়ে সত্যিকারের বীর হিসেবে।
তারা আমাদের শেখায়—মানুষ হতে হলে আদেশ মানতে হয় না, বিবেক মানতে হয়।
তাদের দু’জন আজ আর আমাদের মাঝে নেই। কয়েক বছর আগে তারা ভ্রাত্রিঘাতে শহীদ হয়েছেন। আর যিনি এখনো বেঁচে আছেন, হয়তো বসে আছেন তার সেই পোড়া জুমের পাশের ছোট্ট সদ্য গড়া জুমঘরে—নিঃসঙ্গ, নীরব।
হয়তো তাকিয়ে আছেন দূরের সবুজ পাহাড়ের দিকে, সেই নতুন পোড়া কালো জুমের ওপর দিয়ে দূরে। বয়সের ভারে নুয়ে পড়া শরীর হয়তো এখনো বুকের ভেতর ধারণ করে রেখেছে এক চিরতরুণ মন, যে আজও খুঁজে ফেরে সেই রংরাঙ্গের ডাক, সেই তীব্র প্রতিজ্ঞা, সেই স্বপ্নের তিন সীমানার গহিন অরন্য।
পরিশেষে দুটি হাত তুলে বলি "যেখানে থেকো —ভাল থেকো, সেই অবাধ্য শান্তিবাহিনীর গেরিলা বীর। আজ অশ্রুভরা নয়নে তোমাকে স্মরণ করছি। স্মরণ করছি তোমাদের বীরত্বের সেই কাহিনী। অনেক তরুণ আজ হতে তোমাদের বীরত্বের কাহিনী মনে রাখবে।"
(বিদ্রঃ ছবিটি তাদের স্মরণে আঁকা)
সংগৃহীত 🥹🥹