28/05/2025
#জ্বীনের_বিয়ে_পর্ব_১
নাজমুন নাহার সামিয়া
জ্বিনের বিয়ে – পর্ব ১
(গল্পটি ২০ বছরের তরুণী ফারজানাকে ঘিরে। সে ঢাকার মগবাজার এলাকার একটি পুরোনো, তিনতলা মেসে থাকে। তার পরিবার থাকে চট্টগ্রামের হালিশহরে।)
সন্ধ্যা নেমে এসেছে। জানালার বাইরে রোদ পড়ে গেছে অনেক আগেই। কাকের ডাক থেমে গেছে যেন ঘণ্টাখানেক আগে। সারা পাড়াটা যেন হঠাৎ নিঃশব্দ হয়ে গেছে। দূরে কোনো এক মসজিদ থেকে ভেসে আসছে মাগরিবের আজানের করুণ সুর—জীবনের ভেতর কিছু একটা যেন দোল খায় সে সুরে।
মেসের ঘরটা ছোট, মেঝেতে পুরোনো মোজাইক, দেয়ালে ফাটল। জানালায় পাতলা পর্দা, বাতাসে দুলছে ধীরে ধীরে। এক কোণে একটা সস্তা কাঠের আলমারি, তার পাশেই আয়নাওলা একটা ছোট টেবিল।
ফারজানা আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের ঘন কালো চুল আঁচড়াচ্ছিল ধীরে ধীরে। আয়নার কাঁচটা একটু ঝাপসা, মাঝেমাঝেই ধুলো জমে যায়। কিন্তু আজ তার চুল আঁচড়ানোর সময় হঠাৎ থমকে গেল হাত। কাঁচের এক কোণায়, একেবারে নিচের দিকে, কিছু একটা নড়ল যেন।তার চোখ স্থির হয়ে গেল সেখানে।একটা কালো ছায়া।
না, কোনো স্পষ্ট অবয়ব না, শুধু একটা গাঢ় অন্ধকার। যেন কেউ দাঁড়িয়ে আছে ঠিক তার পেছনে, কিন্তু আয়নায় প্রতিফলন দেখাচ্ছে খুব অস্পষ্টভাবে, কুয়াশার মতো।
ফারজানা মুহূর্তেই ঘুরে তাকাল পেছনে।
শূন্য।
ঘরে কেউ নেই। রুমমেটরাও বাইরে গেছে, কেউ এখনো ফেরেনি।
সে নিঃশব্দে ফিরে তাকায় আয়নার দিকে। আবারও — শুধু সে, তার নিজের প্রতিফলন।
কিন্তু বুকের ভিতরটা কেমন ধুকপুক করছে।
এই প্রথম না, কয়েক দিন ধরেই এমন হচ্ছে।
রাতে ঘুমাতে গেলে হঠাৎ যেন কারো নিঃশ্বাসের শব্দ, ঘুমের মধ্যেও জেগে ওঠার মতো অনুভূতি—জানালার পর্দা নড়ে ওঠে কোনো বাতাস ছাড়াই, কলের পানি টুপটাপ পড়ে—আর সবচেয়ে ভয়ঙ্কর ব্যাপার—
কেউ যেন তাকিয়ে থাকে।
অদৃশ্য কোনো চোখ, যেন প্রতিটি মুহূর্তে নজর রাখছে তার উপর।
প্রথমে ভেবেছিল—ভ্রম।
রুমমেটদের বলেছিল একদিন।
তারা বলেছে-
“তুই বেশি ওয়েব সিরিজ দেখিস ফারজানা, মাথায় উঠে গেছে সব।
এটা বলে রুমমেট রিমি, হেসে।
এইসব বাজে জিনিস নিয়ে ভাবিস না। মেসে এত মেয়ে থাকে, যদি কিছু হতো আমরা কি টের পেতাম না?—বলেছিল মিথিলা।
কিন্তু ফারজানা জানে, এ কেবল কল্পনা না। তার ত্বকে, তার নিশ্বাসে, তার ঘাড়ের পেছনে—একটা অস্তিত্ব সব সময় থাকে।
আর সেটা মানুষ নয়।
সেদিন রাত তখন ঠিক ২টা। ঘড়ির কাঁটা একটানা টিক টিক করে চলছে। বাইরের শীতল বাতাস জানালার কাচে ধাক্কা মারছে, আর দূরে কোথাও শেয়ালের কান ফাটানো ডাক ভেসে আসছে। চারপাশের নিস্তব্ধতা এতটাই ঘন হয়ে উঠেছে যেন তা ছুঁয়ে ফেলা যায়।
হঠাৎই ঘুম ভেঙে গেল ফারজানার।
সে ধীরে ধীরে চোখ খুললো। ঘুম ভাঙার কারণ বুঝতে পারছিল না প্রথমে। শরীরটা ভারী লাগছিল। যেন অনেকক্ষণ ঘুমিয়ে ছিল সে। কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকার পর, হঠাৎ চোখ পড়লো ঘরের দরজার দিকে। সেটা আধা খোলা।
তার বুক ধক করে উঠলো।
“আমি তো নিজের হাতে লক করেছিলাম..ফিসফিস করে বললো সে।
সে ধীরে ধীরে উঠে বসল। শরীরটা ঠান্ডায় কাঁপছে না, কাঁপছে ভয়ে। ঘরের ভেতরের বাতাসে একটা অদ্ভুত গন্ধ—পঁচা কিছু একটা, কেমন যেন ভেজা মাটির মতো গন্ধ। কিন্তু তার চেয়েও ভয়ংকর ছিল বাতাসের ভার। যেন কেউ বসে আছে বুকের উপর। নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
ঠিক তখনই, কোথাও থেকে ভেসে এলো এক কণ্ঠস্বর—
গভীর, শীতল, পুরুষালী এক আওয়াজ।
তুমি আমার।
তুমি শুধু আমার।
কেউ তোমার দিকে তাকাতে পারবে না।
এক ঝটকায় উঠে বসল ফারজানা। ঘরের আলো জ্বলছে, ঘড়ির কাঁটা চলছে, কিন্তু ঘরটা নিঃসাড়, নিস্তব্ধ। কোথাও কেউ নেই। কিন্তু... সেই কণ্ঠস্বরটা? কে ছিল?
সে ধীরে ধীরে জানালার দিকে তাকালো।
তার চোখ এক মুহূর্তে স্থির হয়ে গেল।
জানালার কাচে ভেসে উঠেছে এক জোড়া লাল চোখ। জ্বলজ্বলে, বিদ্বেষে ভরা, ঠিক যেন মানুষের নয়। সে চোখের দৃষ্টি তার বুকের ভেতর কাঁপিয়ে দিল।
ফারজানা চিৎকার করে উঠলো —
কে?কে ওখানে?
কোনো জবাব এলো না।
তবে এক অদ্ভুত জিনিস ঘটলো ঠিক তখনই—ঘরের বাতাস যেন হঠাৎ আরও শীতল হয়ে উঠলো, যেন কারও নিঃশ্বাস ঘাড়ের পেছনে লাগছে।
তারপর, একটুকরো বাতাস ঘরজুড়ে ছড়িয়ে গেল।
আর সেই সাথে নিভে গেল ঘরের সব আলো।
ঘরটা ডুবে গেল গভীর অন্ধকারে।