
29/05/2025
#জ্বীনের_বিয়ে_পর্ব_২
নাজমুন নাহার সামিয়া
আমি যেনো এতক্ষণ স্বপ্ন দেখছিলাম।আবার গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম।
পরেরদিনের ঘটনা।ছাত্রীনিবাসের সকালটা যেমন হবার কথা, তেমনই ছিল।হালকা রোদ, পোকাদের একটানা শব্দ, কারো হাই, কেউ চুল আচড়াচ্ছে, কেউবা ফোনে স্ক্রল করছে ফেসবুকের টাইমলাইন। আমি একটু দেরিতে উঠলাম। সাধারণত রাত জেগে পড়ি, তাই সকালটা আমার অলস কাটে।
আজকেও দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দাঁত ব্রাশ করছিলাম, হঠাৎ তৃষা চিৎকার করে উঠলো
-তোর গলায় এটা কী?
আমার ব্রাশের গতি থেমে গেল। আয়নায় তাকিয়ে চমকে উঠলাম। গলায় একটা পাতলা সোনালী চেইন। নিচে ঝুলছে একটা ছোট্ট তাবিজ, ধাতব রঙের।
তৃষা আবার জিজ্ঞেস করলো, গলায় কৌতূহল নিয়ে
তুই এটা পরলি কখন?
আমি বললাম-
আমি তো পরিনি কিছু।আমার মনে নেই একদম। সত্যি বলতে আমার কিছুই মনে নেই।
ইশরাত হেসে উঠলো।আরে রাতে কেউ বিয়ে করে দিয়ে গেছে বুঝি?
সবাই হাসছিল, কিন্তু আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছিল। আমি চেইনটা খুলে হাতে নিলাম। ঠান্ডা ধাতব খাপের ভেতর থেকে তাবিজটা খুলতেই ভেতরে ভাঁজ করা ছোট্ট একটা কাগজ পেলাম। ধীরে ধীরে ভাঁজ খুলে দেখি— ক্ষুদ্র, সূক্ষ্ম আরবি হরফে লেখা—
“নিকাহ কবুল” — "نکاح قبول"
আমার গলা শুকিয়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছিল। আমি ফিসফিস করে বললাম— এটা কীভাবে সম্ভব? আমি তো কোথাও যাইনি গতকাল… আমি তো ঘুমিয়েই ছিলাম।
ঠিক তখনই মনে পড়ে গেল। রাতে কিছু অস্পষ্ট দৃশ্য… লাইট নিভে গিয়েছিল… হঠাৎ করে অন্ধকারে ডুবে গেছিল চারপাশ… একটা ঠান্ডা নিঃশ্বাস ঠিক আমার গলার পেছনে… একটা কণ্ঠস্বর— "তুমি আমার, এখন থেকে… শুধু আমার।"
একটা ছায়ামূর্তি বসেছিল আমার পাশের খালি বিছানায়। তার আঙুল ছুঁয়েছিল আমার কপাল। তারপর চুলে বিলি কেটে খুব ধীরে কিছু পড়ছিল… আলো নিভে গিয়েছিল, অথচ সুইচ আমি টিপিনি। দরজা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম… কিন্তু ঘুমটা যেন খুব অদ্ভুত, ভারী… স্বপ্নের মতো, তবু স্বপ্ন নয়।
আমি কি আদৌ ঘুমিয়েছিলাম? নাকি কোনও অন্য জগতে পা দিয়েছিলাম?
আরও একটা ব্যাপার মনে পড়ল— গত কয়েকদিন ধরে আমার স্বপ্নে একটা লোক আসছে। লম্বা কালো পাঞ্জাবি পরে থাকে, মুখ দেখা যায় না, শুধু চোখ… দুই চোখ জ্বলজ্বল করে। সে কোনো কথা বলে না… শুধু তাকিয়ে থাকে। অথবা ফিসফিস করে— "তুমি আমার… তুমি আমার হবেই।"
আগে এসব স্বপ্ন বলে হেসে উড়িয়ে দিতাম। কিন্তু আজ… আমার গলায় তাবিজ… আর তাতে সেই লেখা— “নিকাহ কবুল”
এর ব্যাখ্যা কী?
আমি বিছানায় চুপ করে বসে থাকলাম। চারপাশে তখন আর কারও হাসি নেই। সবার চোখে একটাই প্রশ্ন— যদি এটা স্বপ্ন না হয়… তবে সত্যিটা কী?
সেদিন থেকেই আমি আর আগের মতো ছিলাম না। মাঝরাতে হঠাৎ ফিসফিস আওয়াজ শুনতাম। আলো নিভে যাওয়া দেখতাম। আয়নায় কারো দাঁড়িয়ে থাকা… এসব যেন আমার জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
আর সবচেয়ে ভয়ংকর ব্যাপার— চেইনটা আমি যতবার খুলে ফেলি, যত দূরেই ছুঁড়ে ফেলি, পরের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখি… সেটা আবার আমার গলায় ঝুলে আছে।
তাবিজটা খুলে দেখলে এখনো সেই একই লেখা: “নিকাহ কবুল”
সেই সকাল থেকেই আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ঘুম থেকে উঠে দেখি শরীরটা ভেঙে পড়েছে। মাথা দপদপ করছে, শরীর গরমে জ্বলছে অথচ ঠাণ্ডায় কাঁপছি। নিজের শরীরের সাথে নিজের আত্মা যেন তাল মিলাতে পারছে না।
আমার চোখ লাল হয়ে গিয়েছিল, গলা কাঁপছিল। মুখে জ্বরের ঘোর, কিন্তু ভিতরে এক অবর্ণনীয় ভয়। যেন কোনো অদেখা আতঙ্ক আমার আশেপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
রুমমেটরা বলেছিল, হাসপাতালে নিয়ে যাবে। আমি তখন কাঁপা গলায় বলেছিলাম— না, কেউ আমার কাছে আসবে না। আমি একা থাকতে চাই। প্লিজ।
আমার চোখের চাহনি দেখে ওরা ভয় পেয়ে গেছিল। একসময় সবাই আমার থেকে দূরে সরে গিয়েছিল। আমার দরজা তখন প্রায়শই ভিতর থেকে বন্ধ থাকতো।
কিন্তু কেউ জানতো না… আমি আর একা নই।
দরজার ওপাশে, অন্ধকার ঘরের কোণায়, খাটের পাশে একটা ছায়া ধীরে ধীরে নড়ে। ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়ায় এক অদ্ভুত গন্ধ… আমার ঠোঁট কাঁপে, কিন্তু আমি চিৎকার করি না।
কারণ আমি জানি— চিৎকার করে লাভ নেই। যে এসেছে… সে কেবল মন এর আওয়াজ শুনতে পায়।
চলবে'''