27/08/2025
স্বামী বিবেকানন্দের জীবনদর্শন: সত্যের সন্ধানে ও সেই অনুযায়ী জীবনযাপন
স্বামী বিবেকানন্দ। এই নামটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এক অবিচল আত্মবিশ্বাস, গভীর প্রজ্ঞা এবং মানবজাতির প্রতি এক অপার ভালোবাসা। তাঁর প্রতিকৃতিতে আমরা প্রায়শই দেখি এক ধ্যানমগ্ন সন্ন্যাসীকে, কিন্তু তাঁর জীবন ছিল গতিময় কর্মের এক প্রোজ্জ্বল উদাহরণ। তিনি কেবল আধ্যাত্মিক সত্যের প্রচারক ছিলেন না, বরং সেই সত্যকে জীবনে কীভাবে ধারণ করতে হয়, তার জীবন্ত প্রতীক ছিলেন। তাঁর জীবনের প্রতিটি ঘটনা আমাদের শেখায়, "সত্যকে খোঁজ, এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন করো।"
সত্যের সন্ধানে: নরেন্দ্রনাথ থেকে বিবেকানন্দ
বিবেকানন্দের প্রথম জীবন ছিল সত্যের এক নিরলস অনুসন্ধান। যুবক নরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রচলিত সব ধর্মীয় প্রথা ও বিশ্বাসকে প্রশ্ন করতেন। তাঁর মন ছিল যুক্তিবাদী এবং তিনি কোনো কিছুকেই বিনা প্রমাণে মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে কি না, তা নিয়ে তাঁর মনে ছিল গভীর সংশয়। সেই সময়ে, তিনি বহু প্রসিদ্ধ ধর্মগুরু ও পন্ডিতদের কাছে একটিই প্রশ্ন নিয়ে ছুটে যেতেন: "আপনি কি ঈশ্বরকে দেখেছেন?" এই প্রশ্নের সন্তোষজনক উত্তর কেউ দিতে পারেননি, যতক্ষণ না তিনি দক্ষিণেশ্বরের এক সাধারণ ব্রাহ্মণ শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের কাছে পৌঁছালেন।
শ্রীরামকৃষ্ণ যখন এই প্রশ্নের উত্তরে এক মুহূর্তও দেরি না করে বললেন, "হ্যাঁ, দেখেছি। যেমন তোকে দেখছি, তার চেয়েও স্পষ্ট করে দেখেছি।" – তখন নরেন্দ্রনাথের জীবনের মোড় ঘুরে যায়। এই সাক্ষাৎ তাঁর দীর্ঘদিনের জিজ্ঞাসার অবসান ঘটায়। তিনি বুঝতে পারেন, ঈশ্বর কোনো কাল্পনিক ধারণা নয়, বরং এক পরম সত্য যা উপলব্ধি করা সম্ভব। এই উপলব্ধিই ছিল তাঁর জীবনের প্রথম এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সত্য।
সত্যের প্রকাশ: শিকাগো ধর্ম মহাসভা
শ্রীরামকৃষ্ণের কাছ থেকে আধ্যাত্মিক সত্য উপলব্ধি করার পর বিবেকানন্দের জীবনে শুরু হয় সেই সত্যকে বিশ্ববাসীর কাছে তুলে ধরার পালা। ১৮৯৩ সালে, তিনি ভারতের সনাতন ধর্ম ও সংস্কৃতির প্রতিনিধি হয়ে আমেরিকা যান। আর্থিক প্রতিকূলতা এবং অজানা পরিবেশে বহু বাধা সত্ত্বেও তিনি হার মানেননি। এটি ছিল তাঁর দৃঢ় প্রতিজ্ঞা এবং অর্জিত সত্যের প্রতি গভীর বিশ্বাসের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
শিকাগো ধর্ম মহাসভায় তাঁর ভাষণ শুধু উপস্থিত শ্রোতাদেরই নয়, বরং সমগ্র বিশ্বকে চমকে দিয়েছিল। তিনি তাঁর ঐতিহাসিক ভাষণ শুরু করেছিলেন, "আমেরিকার ভাই ও বোনেরা" বলে। এই একটি সম্বোধনেই তিনি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন যে, ধর্ম কোনো বিভেদের প্রাচীর নয়, বরং এক বিশ্বজনীন ঐক্য ও ভালোবাসার বার্তা। তিনি সকলকে শিখিয়েছিলেন, "সর্বভূতে ঈশ্বর" – অর্থাৎ প্রতিটি মানুষের মধ্যেই সেই পরম সত্য বা ঈশ্বরের বাস। এই শিক্ষা তাঁর উপলব্ধি থেকে আসা এবং তিনি এটিকে কেবল মুখে বলেননি, নিজের জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করে গেছেন।
সত্যের প্রয়োগ: "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"
বিবেকানন্দ যখন ভারতে ফিরে আসেন, তখন তিনি কেবল একজন আধ্যাত্মিক গুরু হিসেবে আবির্ভূত হননি, বরং এক সমাজ সংস্কারক হিসেবেও তাঁর ভূমিকা ছিল অপরিসীম। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন যে, দরিদ্র ও পীড়িত মানুষকে সেবা করা ঈশ্বরেরই সেবা করা। তিনি বলেছিলেন, "তোমরা ঈশ্বরকে কোথায় খুঁজে বেড়াও? ঈশ্বর তো রয়েছেন সেই দরিদ্র, দুঃখী, আর্ত মানুষের মধ্যে।" এই ধারণা থেকেই জন্ম নেয় তাঁর বিখ্যাত বাণী "শিবজ্ঞানে জীবসেবা"।
এই বাণীকে বাস্তব রূপ দিতে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। এই মিশনের মূল লক্ষ্য ছিল শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা এবং দরিদ্রদের সাহায্য করার মাধ্যমে মানুষের মধ্যেকার সুপ্ত আত্মবিশ্বাস জাগিয়ে তোলা। বিবেকানন্দ দেখিয়েছেন যে, আধ্যাত্মিক উপলব্ধি কোনো গুহায় বসে ধ্যান করার বিষয় নয়, বরং তা সমাজের প্রতিটি মানুষের সেবার মধ্য দিয়ে প্রকাশ পায়। তাঁর জীবন আমাদের শেখায়, আমাদের প্রাপ্ত সত্যকে কেবল হৃদয়ে ধারণ করলেই হবে না, তাকে কাজে লাগাতে হবে, মানুষের কল্যাণে ব্যবহার করতে হবে।
বিবেকানন্দের জীবন তাই এক অবিস্মরণীয় শিক্ষা। তিনি দেখিয়েছেন, সত্যের অনুসন্ধান এবং সেই অনুযায়ী জীবনযাপন—এই দুটিই একজন মানুষের পরিপূর্ণ জীবনের জন্য অপরিহার্য। তাঁর জীবন আমাদের অনুপ্রাণিত করে সেই সত্যকে খুঁজে নিতে এবং সেই সত্যের আলোয় নিজেদের ও সমাজের জীবনকে আলোকিত করতে।