30/12/2024
চন্ডুওয়ালার দোকান...
নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে যে "চন্ডু" নামক কোন একটি দ্রব্য বা পণ্যের ব্যবসায়ী সম্পর্কে কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে এই চন্ডু জিনিসটা কি?
বলা হয়,আমাদের এই অঞ্চলে,বিশেষত ঢাকা শহরে চন্ডুর ব্যবসা শুরু হয় আজ হতে প্রয় দু'শ বছর আগে। ১৮৩০ সালে ঢাকার রোকনপুরের সোনাউল্লাহ নামক এক ব্যক্তি প্রথম চন্ডুর দোকান খোলেন এই শহরে। অল্প কিছু দিনের মাঝেই শহরের এক বিশাল জনগোষ্ঠী হয়ে ওঠে চন্ডু ভক্ত। এই চন্ডু আদতে আর কিছু নয় আমাদের অতি পরিচিত সেই ঐতিহাসিক 'আফিম'!
ক্রমশ এই বিপজ্জনক নেশাদ্রব্য ঢাকা থেকে ছড়িয়ে পড়তে থাকে বৃহত্তর ময়মনসিংহ, ত্রিপুরা "কুমিল্লা ও ত্রিপুরা রাজ্য" বাকেরগঞ্জ "বরিশাল" প্রভৃতি অঞ্চলে। আবার ভিন্ন ভিন্ন মানের ও দামের আফিমের সহজলভ্যতার কারণে প্রায় সকল শ্রেণির প্রাপ্তবয়স্ক পুরুষই এই নেশায় আসক্ত ছিলেন। ধনীর জন্য এটি ছিল আভিজাত্যের প্রতীক, দরিদ্রের জন্য দিনের খাটনি শেষে আয়েশের উপায়।
তবে আরো বিপজ্জনক ব্যাপার ছিল এই যে, এর অত্যধিক প্রচলনের কারণে পান, হুক্কা ইত্যাদির মতো একেও নেশাদ্রব্য মনে করা হতো না। আর তাই মধ্যবয়স্ক পুরুষদের পকেটে সবসময়ই চন্ডু বা আফিম পাওয়া যেত। শুধু এটাই নয়। নেশাদ্রব্য হিসেবে চিহ্নিত না হওয়ার কারণে শিশুদেরও আফিম সেবন করানো হতো।
নবজাতকের মুখে আফিম দিয়ে তাকে বরণ করা তো রীতিমতো একটি প্রথাই হয়ে ওঠে। এমনকি ঠাণ্ডার চিকিৎসা হিসেবে শিশুদের বয়স প্রায় চার বছর হওয়া অব্দি তাদের আফিম খাওয়ানো হতো। আর সে কারণেই ঢাকায় শিশুমৃত্যুর হার অবিশ্বাস্য রকম বেশি ছিল, যা তৎকালীন ঢাকাবাসীর অজানা ছিল।
তবে আফিমকে ক্ষতিকর হিসেবে গণ্য না করা হলেও একটি কথা প্রচলিত ছিল যে এর সেবনে পুরুষত্বহীনতা হতে পারে। আর তাই দুপুরের খাবারের পর আফিমের সাথে শক্তিবর্ধক হিসেবে এক গ্লাস দুধও পান করা হতো।
চন্ডু বা আফিমের দোকান ইংরেজ আমলে হলেও এই অঞ্চলে আফিমের চাষ সম্পর্কে প্রথম তথ্য পাওয়া যায় পর্তুগিজ পর্যটক পাইরেসের ১৫১৬ সালের একটি লেখা থেকে। পরবর্তীতে মোগল আমলের এর প্রসার ঘটে। ব্রিটিশ আমলে পুরো ঢাকা শহরে সর্বোচ্চ ২০টি চন্ডুর দোকানের তথ্য পাওয়া যায়। তবে ব্রিটিশ এবং পাকিস্তান আমলে নানা আইন প্রণয়নের কারণে দোকানের পরিমাণ কমতে থাকে। সবশেষে বাংলাদেশের জন্মের পর ১৯৮৯ সালে ঢাকায় চন্ডুর ব্যবসা চিরতরে সমাপ্ত হয়।
লোকজ এই পেশাটি আজ বিলুপ্ত হলেও আমরা বলতেই পারি যে কিছু কিছু বিলুপ্তি প্রশংসার দাবীদার। "চন্ডুওয়ালা" বরং কেবল লোকজ পেশার ইতিহাসেই থাকুক, বাস্তবে নয়।
লেখাটি অনলাইন থেকে সংগৃহীত। প্রকৃত লেখকের নাম পাওয়া গেলে পরবর্তীতে সংযুক্ত করা হবে।