29/06/2024
Ikhlas - ইখলাস
#রোকেয়া_নামা
বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন (১৮৮০-১৯৩২)। বাঙালি শিক্ষিত সমাজে ‘মুসলিম নারীজাগরণের অগ্রদূত’ হিসেবে যাকে ইতোমধ্যেই প্রতিষ্ঠিত করে ফেলা হয়েছে। বিংশ শতাব্দীর প্রথম দশক থেকে আরম্ভ করে ১৯৩২ সালে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত যার অধিকাংশ লেখা শিক্ষিত মুসলিম-অমুসলিমদের মাঝে বেশ আলোচিত-সমালোচিত ছিল। এমনকি একশো বছর পেরিয়ে আজও যিনি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রাসঙ্গিক। প্রতিটি স্কুল-মাদ্রাসায় ছোট ছোট কোমলমতি শিশুদের পাঠ্যবইতে তাকে মহান মহীয়সী হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়।
বেগম রোকেয়া যে তিনটি কারণে সবচে বেশী আলোচিত ব্যক্তিত্ব, সেগুলো হল-
1. ‘নারী অধিকার’ প্রতিষ্ঠায় তার লেখনী।
2. সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল প্রতিষ্ঠা, তথা নারীশিক্ষার পক্ষে তার সামাজিক প্রচেষ্টা।
3. তার সাহিত্য কর্ম।
ব্রিটিশ উপনিবেশ আমলে তাদের অনুগত শিক্ষিত সমাজের অধিকাংশ সদস্য (মুসলিম, অমুসলিম দুই সম্প্রদায়ই) বেগম রোকেয়ার সাহিত্য কর্ম, নারী জাগরণের আহ্বানের অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। তার প্রতি অতীত ও বর্তমান এলিট ক্লাসের সম্মানের আতিশয্যে ভ্রম হয়, বেগম রোকেয়া ছিলেন মুসলিম নারীদের রক্ষার জন্য আসমান থেকে নাযিল হওয়া ‘ঐশী দূত’, যার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম নারীদেরকে ইসলাম ও মুসলিম সমাজের যুলুমের বেড়াজাল থেকে রক্ষা করা। তবে, বেগম রোকেয়ার সামগ্রিক সাহিত্য পড়লে ধারণা হয়, ইসলামের কওল বা বক্তব্য, পুরুষ ও আলিমদের সঙ্গে তার নারীশিক্ষার প্রসারের ব্যাপারে বেশ মতপার্থক্য ছিল। তাই, ইসলাম, পুরুষ ও আলিমদের প্রতি বেশ চাপা একটা ক্ষোভও রোকেয়ার লেখনীতে বেশ স্পষ্ট।
যাক সে কথা। বেগম রোকেয়ার সাহিত্য, নারীদের অবস্থার ‘উন্নয়নে’ তার চেষ্টা, উপনিবেশের অধীনে থাকা তৎকালীন বাঙালি সমাজ থেকে শুরু করে আজ অব্ধি স্বাধীন বাংলাদেশের অসংখ্য নারীদের জীবনে তার ‘সামাজিক’ কর্মকাণ্ডের প্রভাব সম্পর্কে আলোচনা করার আগে বেগম রোকেয়া সম্পর্কে বিশেষ উল্লেখযোগ্য তথ্যগুলো আমাদের জেনে রাখা প্রয়োজন। তাহলে তৎকালীন সমাজ কিংবা এক শতাব্দী পর এসে আজকেও বেগম রোকেয়ার প্রাসঙ্গিকতা কতটুকু—সেটা বুঝতে আমাদের জন্য সহজ হবে।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধে (১৮৮০ সাল) রংপুরের এক ধনাঢ্য মুসলিম বাবা-মায়ের ঘরে বেগম রোকেয়ার জন্ম। তার পিতার নাম জহীরুদ্দিন মোহাম্মদ আবু আলী হায়দার সাবের (মৃত্যু ১৯১৮)। তিনি ছিলেন ব্রিটিশদের অধীনস্থ একজন জমিদার। সিপাহি বিপ্লবের সময় জমিদার আলী সাবের ইংরেজ অথবা আইরিশ এক নারীকে বিয়ে করেন , যদিও তখন তার ঘরে স্ত্রী-সন্তান ছিল। আলী সাবের তার বড় দুই ছেলেকে কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজে পড়াশোনা করান।
রোকেয়ার বড়ভাই মোহাম্মদ ইবরাহিম ১৮৮৫ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। ওই বছরই কলকাতায় বড় বোন করিমুন্নেসার বাড়িতে থাকতে বেগম রোকেয়া সেখানে ইউরোপিয়ান গভর্নেসের কাছেও কিছুদিন পড়াশোনা করেন। প্রাথমিক জীবনে বড় দুই ভাই, বোন করিমুন্নেসা এবং মেম গভর্নেসের কাছে রোকেয়ার শিক্ষার সূচনা ঘটে।
১৮৯৮ সালে বেগম রোকেয়ার বিয়ে হয় খানবাহাদুর সৈয়দ সাখাওয়াত হোসেনের (১৮৫৮-১৯০৯) সঙ্গে। অনেকেই মনে করেন, বেগম রোকেয়ার নারীদের ব্যাপারে চিন্তাভাবনার বিপ্লব সাখাওয়াত হোসেনের হাতেই হয়েছে। এখানে কিছু কথা জানিয়ে রাখা প্রয়োজন। বেগম রোকেয়ার সঙ্গে বিয়ের আগে সাখাওয়াত হোসেন ১৮৮৫ সালে বিলেতে পড়াশোনা করতে যান। সেখানেই তিনি পশ্চিমা নারীদের সাথে মুসলিম নারীদের পর্দা ও অন্যান্য রীতিনীতির পার্থক্য স্বচক্ষে দেখতে পান। ওই সময় ব্রিটেনে নারীদের ভোটাধিকার ও অন্যান্য অধিকারর দাবীতে দীর্ঘ আন্দোলন চলমান ছিল। এসব কিছুই তিনি প্রত্যক্ষ করে দেশে ফিরে আসেন।
বিয়ের পর সাখাওয়াত হোসেন বেগম রোকেয়াকে যত্নের সঙ্গে ইংরেজি শেখান। বিহারের ভাগলপুরের সাখাওয়াত ছিলেন উর্দুভাষী, বাংলায় তার দখল অতটা ছিল না। এভাবেই করিমুন্নেসার কাছে বাংলা, ভাই ও স্বামীর কাছে ইংরেজির শিক্ষা পান তিনি। ফলে একই সঙ্গে বাংলা, উর্দু, ফার্সি, আরবি ও ইংরেজি ভাষায় তার দক্ষতা আসে। সে সময়ে মুসলিমরা সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের ইংরেজি ভাষাশিক্ষাকে নিন্দনীয় মনে করতো। তাই, রোকেয়ার পাঁচ ভাষা শিক্ষার এ সুযোগকে বেশ দুর্লভই বলা চলে।
বেগম রোকেয়া নিয়মিত ইংরেজি পত্রিকা ও বই পড়তেন। এসব সম্ভবত তার স্বামীর বদৌলতে তার হাতে পৌঁছুত। গ্যালিলিও, নিউটন, John Howard Payne, Marie Corelli সহ অতীত ও তৎকালীন অনেক জনপ্রিয়, অজনপ্রিয় ব্যক্তি ও সাহিত্যিকের কর্ম, সাহিত্যের সঙ্গেই তার পরিচয় ছিল। তার লেখায় বিজ্ঞানের তৎকালীন অনেক জটিল বিষয়েও লেখা পাওয়া যায়। যাতে বোঝা যায়, রোকেয়ার ইংরেজি পড়ার সীমা নিতান্ত কম ছিল না। বেগম রোকেয়ার অনেক প্রবন্ধের সঙ্গে পশ্চিমা অনেক সাহিত্যিকের মূলভাবের সাদৃশ্যও দেখা যায় । তাই এ কথা বলা ভুল হবে না যে, নারীমুক্তির যে আদর্শ তিনি তার লেখনীতে তুলে ধরেছেন, সে আদর্শের পরিচয় তিনি মূলত পশ্চিমা লেখকদের কাছ থেকেই লাভ করেন ।
Iklas-ইখলাস, [6/28/2024 7:23 PM]
বেগম রোকেয়া দুজন সন্তান জন্মদান করেছিলেন, দুজনই শৈশবে মৃত্যুবরণ করে। তাই আমৃত্যু তিনি নিঃসন্তান হিসেবেই জীবনযাপন করেন। ১৯০৯ সালে রোকেয়ার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মারা যান। পাঁচ মাস পর রোকেয়া পাঁচজন ছাত্রী নিয়ে বিহারের ভাগলপুরে ‘সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস স্কুল’ প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে পারিবারিক সমস্যার কারণে ভাগলপুর ছেড়ে ১৯১১ সালে কলকাতায় একই নামে আবারো স্কুল প্রতিষ্ঠিত করা হয়। বেগম রোকেয়ার জীবদ্দশায় বাংলা ভাষাভাষী ছাত্রীর অভাবে স্কুলে বাংলা ভাষায় শিক্ষাদান চালু করা সম্ভব হয়নি। শুরুতে শুধু উর্দু এবং পরবর্তীতে ১৯১৭ সালে ইংরেজি ভাষায় পাঠদান আরম্ভ হয় ।
১৯৩২ সালে বেগম রোকেয়া কলকাতায় মৃত্যুবরণ করেন। এ সময়ের মধ্যে তিনি মতিচূর ১ম ও ২য় খণ্ড, পদ্মরাগ ও অবরোধ-বাসিনী—এ চারটি বই ছাড়াও অনেক প্রবন্ধ ও অন্যান্য লেখা লিখেছেন। যেগুলোর উল্লেখযোগ্য একটা অংশই তৎকালীন জনপ্রিয় সব পত্রিকায় ছাপা হয়।
[চলবে]