
19/07/2025
#ভালোবাসার_বাহুডোরে
#কানিজ_ফাতেমা
#সিজন_২
#পর্ব_৫৬
নিশ্ছিদ্র নিস্তব্ধতা যেন ঘরের প্রতিটি কোণকে জড়িয়ে ধরেছে। সবার নিশ্বাসের শব্দটাও পর্যন্ত স্পষ্ট শোনা যাচ্ছে। বাতাস ভারী হয়ে এসেছে অদৃশ্য চাপ আর অজানা আশঙ্কায়।বসার ঘরে উপস্থিত প্রত্যেকটি মানুষ তীব্র কৌতূহল আর উত্তেজনায় লিমনের দিকে তাকিয়ে আছে, অজানা সেই রহস্যময় কথা শ্রবণ করতে।রাফসান একপাশে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, তার চোখে প্রত্যাশার ছায়া স্পষ্ট। রাইসা আর দিলরুবা বেগম নিঃশব্দে এক কোণে বসে আছে।
মেহেনাজ নিজেকে আর ধরে রাখতে পারছে না। চোখ দুটো আটকে আছে লিমনের মুখে।কলিজা টা যেন ছিঁড়ে এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে যাচ্ছে। ওর প্রতিটি নিঃশ্বাসে কষ্ট আর যন্ত্রণার ছাপ।ওর চোখে জোড়া ভিজে উঠেছে অজান্তেই।কখন যে চোখ থেকে একফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়েছে, সে টেরও পায় নি।যে মামা জীবনের একমাত্র ছায়া ছিলো, নিরাপত্তার দেয়াল ছিলো,সে আর এই পৃথিবীতে নেই,এটা বিশ্বাস করা ওর পক্ষে অসম্ভব।মনে হচ্ছে, কেউ ওর হৃদস্পন্দন দু’হাত দিয়ে চেপে ধরেছে।নিঃশ্বাস নিতে খুব কষ্ট হচ্ছে ওর। সমস্ত শরীরের রক্ত হিম হয়ে গেছে। এই কষ্ট ব্যাখ্যার বাইরে, এ যন্ত্রণার নাম নেই।
রাফসান দূর থেকে মেহেনাজের মুখটা দেখছে। সেই মুখ, যেখানে সবসময় একরাশ আত্মবিশ্বাস ঝলসে উঠত, আজ সেখানে কেবল কান্নার রেখা, অসহায়তা আর এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।ওর ভিতরটা দুমড়ে-মুচড়ে উঠলো। রাফসান ধীরে ধীরে এগিয়ে গেল সে মেহেনাজের পাশে।কোনো শব্দ করলো না।শুধু নিঃশব্দে, সস্নেহে একপাশ থেকে ওকে নিজের বুকে টেনে নিলো।মেহেনাজ প্রথমে নড়লো না।তারপর আচমকা যেন কোনো বাঁধ ভেঙে গেল।ও দুহাতে রাফসানের শার্ট আঁকড়ে ধরলো। মাথাটা গুঁজে দিলো ওর বুকে।সেখানে কান্নার শব্দ নেই, কেবল নিঃশ্বাসে নিঃশ্বাসে এক অপ্রকাশিত হাহাকার।রাফসান ওর পিঠে হাত রাখলো। কোমল ছোঁয়ায় মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। গলা দিয়ে এক ফোঁটা শব্দও বের হলো না, কিন্তু চোখ দুটো টলমল করে উঠলো।
নিঃশব্দে ফিসফিস করে বলল,
“ আমি তোমার পাশে আছি মাহা, তুমি একা না।
রাফসান নিজেকে সামলে রেখেছে শুধু মেহেনাজের জন্য।কারণ ও জানে, আজ সে ভেঙে পড়লে, মেহেনাজ আর দাঁড়াতে পারবে না। এখন এই মেয়েটার কষ্টের ভাগিদার একমাত্র সে।ভালোবাসার গভীরতা বোঝাতে সবসময় শব্দ লাগে না,কখনও কখনও একটা শক্ত জড়িয়ে ধরা শক্ত হাত, একটা নিশ্চিন্ত আশ্রয়ই অনেক কিছু বলে দেয়।
লিমন বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে, ধীরে ধীরে চোখ বন্ধ করে গভীর একটা শ্বাস নেয়।এবার ওকে মুখ খুলতেই হবে অতীতের সেই জমে থাকা কথাগুলো উন্মোচনের জন্য।কারন ওদের লুকানো সত্তা উন্মোচিত হয়ে গেছে। সত্যি টা না বলা ছাড়া আর কোনো পথ নেই।
লিমন নিঃশব্দে সামনের দিকে তাকায়,তারপর ধীর কণ্ঠে বলা শুরু করে…
আমি আর সোহান দুজনেই একে অপরের খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলাম। হাই স্কুল থেকে শুরু করে কলেজ পর্যন্ত আমাদের বন্ধুত্বের বন্ধন ছিল অটুট।আমরা শুধু বন্ধু ছিলাম না, একে অপরের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলাম।একসাথে ক্লাস করা, টিফিন খাওয়া। সুখ-দুঃখ, আনন্দ-বেদনা সবকিছুই আমরা একে অপরের সঙ্গে শেয়ার করতাম।
একদিন কলেজ শেষে ক্যাম্পাসের ছায়া ঘেরা নিরিবিলি কোণে বসেছিলাম আমরা দুজন। হঠাৎ সোহান মোবাইলটা বের করে আমার সামনে ধরে,
“ দোস্ত, দেখ তো মেয়ে টা কেমন?
আমি অবহেলা ভরে তাকালেও, পর মুহূর্তেই চোখ বড়ো বড়ো করে স্থির হয়ে গেলাম। হৃদপিণ্ডটা যেন হঠাৎ থেমে গেল কিছুক্ষণের জন্য। কারন ঐ ছবির মেয়েটা আমার সবচেয়ে কাছের মানুষ,আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।কিন্তু শুধু বন্ধু নয়, সে আমার হৃদয়ের সবচেয়ে গোপন কোণে থাকা ভালোবাসা।যাকে আমি নিঃশব্দে ভালোবেসে গেছি দিনের পর দিন,কিন্তু কখনো বলতে পারি নি।
আমি একদৃষ্টিতে ছবিটার দিকে হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম, এমন সময় সোহান উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে ওঠে,
“ এই মেয়েটাকে আমি অনেকদিন ধরে ফলো করছি। অসম্ভব পছন্দ করি ওকে। ও আমার স্বপ্নের রানী রে ভাই।
সোহানের কথাগুলো শুনেই বুকের ভেতর কেমন যেন ছ্যাঁকা লাগল আমার।মনে হলো কেউ যেন হঠাৎ ছুরি বসিয়ে দিল আমার নির্জন ভালোবাসার ঠিক মাঝখানে।হঠাৎই হৃদয়ের ভেতর থেকে এক অসম্ভব রকমের ধাক্কা এসে আছড়ে পড়ল বুকে।
তারপর আমি নিজেকে অনেক কষ্টে সামলিয়ে নিলাম।সোহানকে অনেক বোঝানোর চেষ্টা করলাম। যতটা সম্ভব ঠান্ডা মাথায় বললাম,
“ দোস্ত, অনেক মেয়ে আছে দুনিয়াতে। এই একটা মেয়ের জন্য এত পাগলামো করিস না। ছেড়ে দে, ভুলে যা ওকে। তোকে মানাবে না ওর সঙ্গে। তোর জন্য আরও ভালো কেউ আছে
সোহান আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল,
“ তুই বুঝবি না লিমন। আমি ওকে চোখের আড়াল করলেই বুকটা মোচড় দিয়ে ওঠে। আমি ওকে ছেড়ে দিতে পারি না রে, দোস্ত। ও আমার দিলের রানী।
সোহান ছবিটার ঠোঁটের ওপর এক আলতো চুমু আঁকল। সেই চুমু আমার রক্তে আগুন ঢেলে দিল।
মুহূর্তে আমার দৃষ্টিটা ঝাপসা হয়ে এল রাগে, অভিমানে, আর সেই দহনশীল হিংসায়।আমার মনে হলো, আমার সামনে কেউ দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্নটাকে তিলে তিলে মাটি চাপা দিয়ে দিচ্ছে। আমার মনে হচ্ছিল,ও একটা ছুরি হাতে নিয়ে আমার নিঃশব্দ ভালোবাসার দেহটাকে টুকরো টুকরো করে কেটে নিচ্ছে, হাসিমুখে।
আমি কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলাম। মুখে কোনো শব্দ ছিল না, কিন্তু বুকের ভেতরে ঝড় হচ্ছিল একটা নীরব, নির্মম ঝড়। হঠাৎ আগুনের শিখা দাউদাউ করে জ্বলে ওঠে।চোখে একটা অন্ধকার নেমে আসে। হিংসা, হতাশা একত্রে আমার মনকে কুরে কুরে খেতে শুরু করে। যে মেয়েটা আমার প্রথম ভালোবাসা, বেস্ট ফ্রেন্ড আজ সেই মেয়েটাকে আমার সবচেয়ে কাছের বন্ধু নিজের করে পেতে চায়।ভেতরটা ধীরে ধীরে পুড়ে উঠল এক হিংসাত্মক দম্ভে। বন্ধুত্বের সম্পর্ক যেন এক নিমেষে সরে গিয়ে জায়গা করে নিলো প্রতিদ্বন্দ্বিতা।
আমি ঠাণ্ডা চোখে তাকায় সোহানের দিকে, কিন্তু ভেতরে ভেতরে সে তখন ঠিক করে ফেলি,
" ওকে আর বেশি দূরে এগাতে দেয়া যাবে না।ওকে এখানেই থামাতে হবে।তবে খুব ঠান্ডা মাথায়।ও আমার ছিলো, আমার আছে আর আমারই থাকবে।এই লড়াই এখন ভালোবাসার নয়, এটা নিজের অধিকার ছিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। যা আমার, তা আমি কাউকে ছুঁতে দেবো না।হোক সে আমার বেস্ট ফ্রেন্ড।
এই হিংসাটাই আমার মনে প্রতি হিংসার জন্ম দিতে শুরু করে। আমার ভেতরের মানুষটা ধীরে ধীরে বদলাতে শুরু করে।আমি বুঝি, এখন আর কিছুতেই পিছু হটার জায়গা নেই। সোহানকে হারাতে হবে কোনো দয়া, কোনো বন্ধুত্ব,কোনো কিছুই আমার ভালোবাসার পথে বাঁধা হতে পারবে না।
তারপর বহুদিন ধরে ভেবেচিন্তে আমি একটা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছাই। এমন কিছু করতে হবে যাতে সাপও মরে আবার লাঠিও না ভাঙে।যাতে কেউ টের না পায়, কিন্তু খেলাটা আমার নিয়ন্ত্রণেই থাকে।আমি রাতজেগে গুগল ঘাঁটি, ফোরাম খুঁজি, অন্ধকার ওয়েবসাইটে ঢুঁ মারি। এবং এক পর্যায়ে খুঁজে পাই Scopolamine নামের এক ভয়ংকর ড্রাগের তথ্য। এটার আরেক নাম The Devil’s Breath,”শয়তানের নিঃশ্বাস’। একটা মানুষের শরীরে এই ড্রাগ প্রবেশ করলেই সে নিজের ইচ্ছাশক্তি হারিয়ে ফেলে। তার স্মৃতি, যুক্তি, চিন্তা সব কুয়াশার ভেতর ডুবে যায়। সে তখন অন্য কারও নিয়ন্ত্রণে, অন্য কারও নির্দেশেই সবকিছু করে ফেলে। জ্ঞান থাকে, কিন্তু ইচ্ছা থাকে না। মস্তিষ্ক বন্দী হয়ে যায় অন্যের নিয়ন্ত্রনাধীন, আর শরীরটা হয়ে যায় একটা পুতুল।
আমি আর দেরি করি না। কিছু খোঁজখবর নিয়ে এক ড্রাগ ডিলারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। উচ্চমূল্যে সেই ভয়ংকর ড্রাগ সংগ্রহ করি।আর সেদিন থেকেই শুরু হয় আমার আসল খেলা।নীরব, নিখুঁত, আর প্রতিহিংসার আগুনে জ্বলে ওঠা এক খেলা।যেখানে নিয়ন্ত্রণ থাকে শুধু আমার হাতে।
#চলবে…