
06/05/2025
#নীল_আকাশের_চিঠি
#ইমরান_হোসেন
(পর্ব ২)
কিছুক্ষণ নীরবতা। তারপর অরিত্রি ধীরে ধীরে বলল, “আবির, ভালোবাসা কেবল অনুভব না, এক বিশাল দায়িত্ব। আমি এখনো ঠিক জানি না আমি প্রস্তুত কি না। কিন্তু আমি এটা জানি—তোমার কথা আমার হৃদয়ে দাগ কাটে। আমার নিঃসঙ্গতা এখন আর আগের মতো নয়।”
আবির হাসল। সে জানত, প্রত্যুত্তর না পেলেও আজ সে নিজের মনকে মুক্ত করেছে। আর তাতেই এক অদ্ভুত প্রশান্তি।
সেইদিনের পর থেকে অরিত্রি কিছুটা চুপচাপ হয়ে যায়। ক্লাসে ঠিকই আসে, হাসে, কথাও বলে, কিন্তু আবির বুঝতে পারে—কিছু একটা তাকে গুটিয়ে রেখেছে।
একদিন ছুটির বিকেলে তারা বটতলায় বসে ছিল। ক্যাম্পাস প্রায় ফাঁকা। চারপাশে ঝিরঝির হাওয়া, গাছের পাতায় রোদের আলো। আবির বলল, “তোমার মনটা আজকাল কেমন যেন খালি খালি লাগে। কি হয়েছে, বলবে আমাকে?”
অরিত্রি কিছুক্ষণ চুপ থেকে ব্যাগ থেকে একটা পুরনো ডায়েরি বের করল। “এটা পড়ো। এরপর আমার কথা বুঝতে পারবে।”
ডায়েরির পাতাগুলো পুরনো, কিছু পাতায় চোখের জল শুকিয়ে দাগ হয়ে গেছে। আবির পড়তে শুরু করল—
“আমি তখন ক্লাস সেভেনে পড়ি। বাবা হঠাৎ একদিন আর অফিস থেকে ফেরেনি। পরে জানলাম, তিনি নিজেই নিজের জীবন শেষ করেছেন। মা সেই ধাক্কা কখনোই সামলাতে পারেনি। মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। বাড়িটা নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কেউ আর গান গায় না, কেউ আর গল্প বলে না।
আমি অনেক ছোট ছিলাম, কিন্তু তখন থেকেই বড় হয়ে গিয়েছিলাম। আত্মীয়রা মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিল, প্রতিবেশীরা করুণার চোখে তাকাত। আমি মায়ের হাত ধরে দিন পার করতাম, আর রাতভর ছাদের কোণায় বসে আকাশ দেখতাম—ভাবতাম, আমার জন্য কেউ আসবে কি?”
ডায়েরির সেই শব্দগুলো আবিরের হৃদয়কে কাঁপিয়ে দিল। সে ডায়েরি বন্ধ করে চুপচাপ বসে রইল। কিছু বলার মতো ভাষা ছিল না তার কাছে।
অরিত্রি হেসে বলল, “তুমি তো এমন চোখে দেখছো, যেন আমি কোন দুঃখের চরিত্র।”
আবির ধীরে বলল, “তুমি সাহসী। এমন জীবন যাদের থাকে, তাদের বুকের ভেতর যে কী পরিমাণ লড়াই, সেটা কেউ বোঝে না। আমি আজ থেকে শুধু তোমার পাশে থাকতে চাই। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই।”
অরিত্রির চোখে জল চলে এল, কিন্তু সে দ্রুত মুখ ঘুরিয়ে নিল। “আমি কাউকে আবার বিশ্বাস করতে ভয় পাই, আবির। যারা ভালোবাসার কথা বলে, তারা মাঝপথে ফেলে চলে যায়।”
আবির শান্ত গলায় বলল, “আমি চলে যাওয়ার লোক নই। আমি তোমার সেই নীল আকাশ, যার নিচে তুমি ডায়েরি লিখেছিলে।”
সে রাতে অরিত্রি অনেকক্ষণ চুপ করে ছিল। এরপর ধীরে ধীরে সে আবিরের দিকে ফিরে তাকিয়ে বলল, “আমার গল্প জানলে কি তোমার ভালোবাসা কমে যাবে না?”
আবির একটুও না ভেবে উত্তর দিল, “তোমার অতীত তোমাকে তৈরি করেছে। আর আমি ভালোবেসেছি পুরো তোমাকে, টুকরো নয়।”
সেই রাতে ক্যাম্পাসের আকাশে তারা ছিল না, কিন্তু আবির ও অরিত্রির মাঝে যে আলোর রেখা জ্বলেছিল, তা ছিল চিরকালীন।
সেই রাত যেন আবির ও অরিত্রির সম্পর্কের মোড় ঘুরিয়ে দিল। অরিত্রির চোখে আবির কেবল এক বন্ধু নয়—এক নির্ভরতার প্রতিচ্ছবি। আর আবিরের কাছে অরিত্রি ছিল ভালোবাসার সেই ভাষা, যা শব্দ ছাড়াও হৃদয় বোঝে।
পরবর্তী কয়েকদিন তারা যেন আরেকটা জগতে বাস করছিল। ক্লাস শেষে একসঙ্গে লাইব্রেরির চুপচাপ কোণে বসে থাকা, হাঁটতে হাঁটতে ছোটখাটো গল্পে হারিয়ে যাওয়া, কিংবা বিকেলের শেষ আলোয় বসে থেকে চোখে চোখ রাখা—সবকিছুতেই এক অলিখিত সম্পর্কের গভীরতা ফুটে উঠছিল।
এক বিকেলে চারুকলার পাশে দেয়ালে পিঠ দিয়ে বসে ছিল তারা। আবির বলল, “জানো, আমি ভাবি, তুমি যদি আমার জীবনে না আসতে, আমি কীভাবে এত রঙ চিনতাম?”
অরিত্রি হেসে বলল, “তোমার চোখেই তো এখন আমার জন্য একটা আকাশ তৈরি হয়েছে।”
তারা একে অপরের দিকে তাকিয়ে রইল। কথা বলার দরকার ছিল না—নীরবতাই অনেক কিছু বলে দিচ্ছিল।
এরপরের দিনগুলোতে আবির অরিত্রিকে তার ছোট গ্রামে নিয়ে গেল। অরিত্রি প্রথমবারের মতো নদীর ধারে বসে বলল, “তোমার গ্রামের আকাশ এত নীল কেন, বলো তো?”
আবির বলল, “কারণ এখানে কেউ কষ্ট জমিয়ে রাখে না। আমি চাই, তুমি এই আকাশের নিচে আবার নিজেকে খুঁজে পাও।”
অরিত্রি আবিরের হাত ধরল—ধীরে, কিন্তু দৃঢ়ভাবে। “আমি তোমাকে বিশ্বাস করতে শিখেছি, আবির। আমার জীবন একটা খোলা খাতা ছিল না, কিন্তু তুমি শব্দ হয়ে এসে আমাকে পূর্ণ করেছো।”
গ্রামের সেই দুই রাত, তারা একসঙ্গে নৌকায় চড়ে গান শুনল, ছাদে শুয়ে তারা গুনল। প্রথমবারের মতো অরিত্রি হাসল মন খুলে—নির্ভার, নিঃশঙ্ক।
তারা দুজনেই জানত, ভালোবাসা কেবল কাব্যের মতো না, তা জীবনের প্রতিটি বাঁকে পাশে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি।
সেই প্রতিশ্রুতিই এখন তাদের চোখে, কথায়, নীরবতায়—সবখানে জ্বলছিল।
আবির আর অরিত্রির মাঝে সবকিছুই যেন ঠিকঠাক চলছিল। কিন্তু জীবনের মতোই ভালোবাসার গল্পেও হঠাৎ অজানা বাঁক এসে যায়।
সেমিস্টার ফাইনাল ঘনিয়ে এলো। ক্লাস, প্রেজেন্টেশন, পার্ট-টাইম কাজ—সব মিলিয়ে আবির ব্যস্ত হয়ে উঠল। আগের মতো সময় পাওয়া যাচ্ছিল না। ফোনে কথা কমে গেল, দেখা হওয়ার সুযোগও কম।
অন্যদিকে অরিত্রির মা হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সে হোস্টেল ছেড়ে বাসায় চলে যেতে বাধ্য হয়। আবির জানত না, অরিত্রি এখন দিনে দিনে আরও ক্লান্ত, ভীত, আর একা হয়ে পড়ছে।
একদিন হঠাৎ এক বন্ধুর মাধ্যমে আবির জানতে পারে, অরিত্রি ফেসবুকে “In a relationship” স্ট্যাটাস মুছে দিয়েছে। তার বুকটা ধক করে উঠল।
রাতে সে বারবার ফোন করল অরিত্রিকে, কিন্তু অরিত্রি রিসিভ করল না। অবশেষে একটি ছোট্ট মেসেজ এল:
“আমি কিছু সময় চাই, আবির। নিজেকে খুঁজে পেতে। প্লিজ, আমাকে বোঝার চেষ্টা করো।”
আবির চুপ করে ফোনটা রাখল। মাথার মধ্যে হাজারো প্রশ্ন, ভয়, সন্দেহ। সে জানে অরিত্রি ভালোবাসে তাকে। কিন্তু এই দূরত্ব, এই নিঃশব্দতা—সবকিছু যেন এক অচেনা অন্ধকারের ইঙ্গিত দিচ্ছে।
চলবে.............
লেখকের পেজhttps://www.facebook.com/share/1AU6Tfc76z/