
24/07/2025
চাঁদাবাজির বিবর্তন: সময়ের প্রেক্ষিতে একটি বিশ্লেষণ
🔸 ভূমিকা
চাঁদাবাজি সমাজের এক জটিল এবং বহুমাত্রিক সমস্যা। এটি কেবল একটি অপরাধ নয়, বরং একটি সামাজিক ব্যাধি যা অর্থনীতি, রাজনীতি এবং সাধারণ মানুষের নিরাপত্তাকে বিপর্যস্ত করে তোলে। সময়ের পরিক্রমায় চাঁদাবাজির ধরণ ও কৌশলে ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে। প্রাচীন শাসন ব্যবস্থায় যেখানে খাজনা আদায়ের নামে জুলুম চলত, আধুনিক যুগে তা পরিণত হয়েছে সুশৃঙ্খল ও প্রযুক্তিনির্ভর অপরাধে। এই প্রবন্ধে আমরা চাঁদাবাজির বিবর্তন এবং এর বহুমাত্রিক প্রভাব নিয়ে আলোচনা করব।
---
🔸 প্রাচীন যুগের চাঁদাবাজি
ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, প্রাচীন যুগে রাজা-জমিদার বা সামন্ত প্রভুরা প্রজাদের কাছ থেকে কর বা খাজনা আদায়ের নামে অতিরিক্ত অর্থ আদায় করতেন। এটি অনেক সময় জোরপূর্বক আদায় হতো, যা আজকের পরিভাষায় চাঁদাবাজিরই একটি রূপ। জনগণ বাধ্য হয়ে এই অর্থ দিত, কারণ বিরোধিতা মানেই ছিল শাস্তি বা সমাজচ্যুতি।
---
🔸 ঔপনিবেশিক যুগে শোষণের রূপ
ব্রিটিশ শাসনামলে জমিদারি প্রথা ও খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা এমনভাবে গড়ে তোলা হয় যাতে কৃষক সর্বদা ঋণগ্রস্ত থাকত। দালাল শ্রেণির উত্থান ঘটে, যারা ইংরেজ শাসকদের হয়ে কৃষকদের ওপর চাঁদার বোঝা চাপিয়ে দিত। অনেক জায়গায় সশস্ত্র জোর করে অর্থ আদায়ও সাধারণ ঘটনা ছিল।
---
🔸 স্বাধীনতা পরবর্তী রাজনৈতিক চাঁদাবাজি
স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক দলগুলোর প্রসারে সাথে সাথে এক ধরনের নতুন চাঁদাবাজির রূপ দেখা যায়। ছাত্র সংগঠন কিংবা শ্রমিক ইউনিয়নের নামে ব্যবসায়ী, ঠিকাদার এমনকি সাধারণ মানুষও চাঁদার শিকার হতে থাকে। রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তি এবং ক্ষমতার ছত্রছায়ায় এইসব কর্মকাণ্ড ‘নিরাপদ অপরাধ’ হিসেবে গড়ে ওঠে।
♦️কনসার্ট বা সামাজিক অনুষ্ঠানের নামে চাদাবাজি
পাড়া বা মহল্লায়, শহর বা গ্রামে বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠান (কনসার্ট, মেলা, জাতীয় দিবস, যাত্রাপালা) ইত্যাদির পালনের নামে প্রভাবশালী গ্রুপ চাদাবাজি
করে থাকে।
♦️ ধর্মের নামে, ওয়াজ মাহফিলের নামে চাদাবাজি
অনেক সময় দেখা যায়, ধর্মের নামে বিভিন্ন প্রভাবশালী গ্রুপ চাদা উত্তোলন করে থাকে। বিশেষ করে ওয়াজ মাহফিলের নামে কোটি টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করে।
🔸 আধুনিক ও ডিজিটাল যুগের চাঁদাবাজি
প্রযুক্তির বিকাশের সঙ্গে সঙ্গে চাঁদাবাজির পদ্ধতিতেও পরিবর্তন এসেছে:
সাইবার চাঁদাবাজি: হ্যাকিং করে বা গোপন তথ্য ফাঁস করে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে অর্থ আদায় করা হয়।
মোবাইল চাঁদাবাজি: বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো মোবাইল পেমেন্ট প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে হুমকি দিয়ে টাকা নেওয়া হয়।
অনুমোদন বা লাইসেন্স জিম্মি করে চাঁদা আদায়: অনেক সময় ব্যবসার লাইসেন্স, টেন্ডার, অনুমতি পত্র পেতে গেলে ঘুষ বা চাঁদা দিতে বাধ্য করা হয়।
---
🔸 সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রভাব
চাঁদাবাজির কারণে:
ব্যবসায়িক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
সাধারণ মানুষ নিরাপত্তাহীনতায় ভোগে।
রাজনীতির প্রতি মানুষের আস্থা কমে যায়।
সুশাসন বাধাগ্রস্ত হয়।
বিশেষ করে যুব সমাজের একটি অংশ যখন চাঁদাবাজি করে রাতারাতি টাকার মালিক হয়ে ওঠে, তখন শিক্ষিত ও পরিশ্রমী মানুষের মনোবল ভেঙে পড়ে।
---
🔸 প্রতিরোধ ও করণীয়
চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হলে প্রয়োজন—
সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি শক্তিশালী আইনের প্রয়োগ,
রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও দুর্নীতিমুক্ত প্রশাসন,
প্রযুক্তির সদ্ব্যবহার (যেমন: সিসিটিভি, ডিজিটাল ট্র্যাকিং),
জনগণের অংশগ্রহণমূলক প্রতিবাদ ও সাহসিকতা।
---
🔸 উপসংহার
চাঁদাবাজির বিবর্তন আমাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ বার্তা দেয়— যদি আমরা সময়মতো ব্যবস্থা না নেই, তবে এটি কেবল ব্যক্তি নয়, গোটা রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। তাই, রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তিগত স্তরে চাঁদাবাজির বিরুদ্ধে সম্মিলিত প্রতিরোধ গড়ে তোলা এখন সময়ের দাবি।
---
✍️ লেখক: [মু. আরিফুল ইসলাম ]
🗓️ প্রকাশকাল: জুলাই ২০২৫
ছবি: প্রথম আলো থেকে নেয়া।