12/12/2023
চান্দিনা মুক্ত দিবস: ১২ ডিসেম্বর
------------------------------
বিজয় অর্জন করাটা মহান কিন্তু বিজয়ের জন্য সংগ্রাম করাটা মহত্তর। প্রতিটি বিজয়ের জন্য প্রয়োজন কঠোর সংগ্রাম। বাংলাদেশের বিজয় অর্জনের পেছনে রয়েছে হাজার হাজার মানুষের সুদীর্ঘ সংগ্রাম ও আত্মদানের ইতিহাস। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পাকিস্তানের দুটি অংশের সৃষ্টি হয়, হাজার মাইলের ব্যবধান থাকা সত্ত্বেও পশ্চিম পাকিস্তানিরা(বর্তমানে পাকিস্তান) নানাভাবে পূর্ব পাকিস্তানের(বর্তমানে বাংলাদেশ) জনগণের উপর শাসন, শোষণ ও নির্যাতন চালাতে থাকে। সামাজিক, অর্থনৈতিক, চিকিৎসা, খাদ্য, শিক্ষা এমনকি মাতৃভাষার প্রশ্নেও বাঙালি তার নিজের অধিকার প্রয়োগ করতে পারে নি। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর থেকে বাঙালি বুঝে যায় সংঘবদ্ধ আন্দোলন ছাড়া এই নিপীড়ন থেকে রেহাই পাওয়া সম্ভব নয়। বাঙালি জাতি তা করেও দেখিয়েছে। ১৯৫২ সাল থেকে ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন পর্যন্ত তাদের সংঘবদ্ধ আন্দোলন নিজেদের মধ্যে স্বাধীনতার স্পৃহা জাগিয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে বাঙালি তার অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে অপারেশন সার্চলাইটের মাধ্যমে শুরু হয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম। দীর্ঘ নয় মাসের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের শেষের দিকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর কূটকৌশলে পাক হানাদার বাহিনী কোণঠাসা হয়ে পড়ে। ১৬ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক বিজয় অর্জনের পূর্বেই তারা বিভিন্ন এলাকা ছাড়তে শুরু করে। আমাদের চান্দিনারও রয়েছে স্বাধীনতার গৌরবময় ইতিহাস। তৎকালীন কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট ছিল পাক বাহিনীর অন্যতম সেনা ক্যাম্প। চান্দিনা উপজেলা এই সেনানিবাসের সন্নিকটে হওয়ার কারণে চান্দিনাবাসিও মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার হয়েছে বহুবার। তবে জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীর সাথে মুখোমুখি যুদ্ধ করে চান্দিনাকে শত্রুমুক্ত করে। চান্দিনা শত্রুমুক্ত হওয়ার দুটি ঘটনা আমি বিভিন্ন জায়গায় খুঁজে পাই। এই দুটি ঘটনারই বর্ণনা নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
প্রথমত, ১৯৭১ সালের রক্তঝরা এ দিনে কুমিল্লার চান্দিনার বীর মুক্তিযোদ্ধারা পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে এ উপজেলাকে। ময়নামতি সেনানিবাসে মিত্রবাহিনীর সেলিং এর কারণে ১১ ডিসেম্বর ভোরে পাক হানাদার বাহিনী ময়নামতি সেনানিবাস থেকে বরুড়া হয়ে চান্দিনার উপর দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার সময় বিভিন্ন স্থানে হামলা, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করতে থাকে। আর ওই ঘটনাটি চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধাদের কাছে খবর এলে মিত্রবাহিনীর সহযোগিতায় চান্দিনার মুক্তিযোদ্ধারা মানসিকভাবে শক্তিশালী হয়ে পাকিবাহিনীকে প্রতিহত করতে এগিয়ে যায়। দুপুরে উপজেলা সদরের হারং গ্রামের উদালিয়ার পাড় এলাকায় পাক বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযোদ্ধাদের মুখোমুখী সংঘর্ষ হয়।
১১ ডিসেম্বর দুপুর থেকে গভীর রাত পর্যন্ত গোলাগুলির এক পর্যায়ে পাক বাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে ১২ ডিসেম্বর ভোরে আত্মসমর্পণ করে প্রায় ১৭ শতাধিক পাকি হানাদার বাহিনী। উল্লাসিত মুক্তিযোদ্ধারা পাক হানাদার বাহিনীকে ধরে নিয়ে আসে বর্তমান চান্দিনা পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে।
অপরদিকে ১১ ডিসেম্বর হারং উদালিয়ায় মুক্তিযোদ্ধাদের ধাওয়ায় ৬ জন পাকবাহিনী পালিয়ে যাওয়ার সময় করতলা গ্রামের একটি কেওড়াতলায় আটকে যায়। তখন মুক্তিকামী জনতা তাদেরকে দেখে মুক্তিযোদ্ধাদের খবর দিলে মুক্তিযোদ্ধাসহ শতাধিক মুক্তিকামী জনতা তাদেরকে আটক করার সময় পাকিবাহনী চারদিকে গুলি ছুড়তে শুরু করে।
এসময় ২ জন মুক্তিযোদ্ধাসহ ৪ জন মুক্তিকামী জনতা নিহত হয়। পাকিবাহিনীর গোলাবারুদ শেষ হয়ে গেলে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে নিহত হয় ৬ জন পাকবাহিনী। রক্তঝরা এ দিনে বীরমুক্তিযোদ্ধারা চান্দিনাতে উত্তোলন করে স্বাধীন বাংলার লাল সবুজের পাতাকা। দিনটি একদিকে যেমন আনন্দের, অপরদিকে স্বজনহারাদের জন্য বেদনার দিন। দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধের সময় চান্দিনা ও তার আশ-পাশের বিভিন্ন স্থানে খন্ডযুদ্ধ সংগঠিত হয়। এতে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ১০ মুক্তিযোদ্ধাসহ প্রায় শতাধিক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন।
সূত্র : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থা(বাসস)
দ্বিতীয়ত, ১৯৭১ সালের রক্তঝরা দিনগুলোতে মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর যৌথ আক্রমনে হানাদার মুক্ত হয়েছিল কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চল। তারই ধারাবাহিকতায় চান্দিনা এলাকা হানাদার মুক্ত হয়েছিল ১২ ডিসেম্বর। এ দিনটিকে “ চান্দিনা মুক্ত দিবস” হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় উদযাপন করা হয়।
মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর যৌথ অভিযানে ওইদিন হানাদারদের বিরুদ্ধে আক্রমন পরিচালনা করে। ৩ডিসেম্বর রাতে মুক্তিবাহিনী ‘ঢাকা - চট্রগ্রাম’ মহাসড়কের কাঠের সেতুটি মাইন বিষ্ফোরনে উড়িয়ে দেয়। মিত্রবাহিনীর ২৩ মাউন্ড ডিভিশনের মেজর জেনারেল আর.ডি বিহারের নেতৃত্বে বৃহত্তর কুমিল্লায় এই অভিযান পরিচালিত হয়। মিত্রবাহিনীর একটি ট্যাংক বহর চান্দিনা আসে। হানাদাররা ওই রাতেই চান্দিনা ছেড়ে কুমিল্লা সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। ধীরে ধীরে মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন গ্রুপ চান্দিনার বিভিন্ন গ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এরই মধ্যে মিত্র বাহিনীর ট্যাংক বহরটি দেবিদ্বার থেকে চান্দিনা রোডে ঢাকা অভিমুখে যাওয়ার সময় মোহনপুর এলাকায় ভুল বোঝাবুঝির কারনে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে গুলি বিনীময় হলে মিত্রবাহিনীর ৬ সেনা সদস্য নিহত হয়। এই দিনে চান্দিনা উল্লাসিত জনতা ও মুক্তিযোদ্ধারা স্বাধীন বাংলার পতাকা নিয়ে বিজয় উল্লাসে ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানে মেতে উঠে। দুপুর পর্যন্ত ওইদিন হাজার হাজার জনতা বিজয় উল্লাসে উপজেলা সদর প্রকম্পিত করে তোলে।
সূত্র: বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।
[তবে প্রথমোক্ত ঘটনাটি অনেক আগে থেকেই আমার গ্রামের প্রবীণ বয়স্কদের কাছ থেকে শুনে এসেছি।]
জাতির সূর্যসন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি আমাদের স্বাধীনতা। জাতীয়ভাবে ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালিত হলেও আজকের এই দিনটি চান্দিনাবাসীর জন্য গৌরবের। যাঁদের ত্যাগ -তিতিক্ষা ও রক্তের বিনিময়ে আমরা এই গৌরবের অধিকারী হয়েছি, তাঁদের সেই আত্মোৎসর্গের কথা মনে রেখে আমাদেরও সেই চেতনায় উদ্বুদ্ধ হতে হবে। তবেই বিজয়ের মহিমা অর্থবহ হবে।
-কামরুল হাছান,
শিক্ষার্থী- কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজ, কুমিল্লা।
১২ ডিসেম্বর ২০২৩