15/11/2025
সাভারের বাইপাস রোড ধরে সামান্য ভেতরে গেলেই একটা সরু গলি।
গলিটায় আজও বাতাসে মিশে থাকে রুক্ষ ধুলোর গন্ধ, পুরোনো সিমেন্টের শীতলতা, আর এক ধরনের অজানা কাঁপন।
ঠিক সেখানেই একসময় দাঁড়িয়ে ছিল সাত নম্বর বিল্ডিং।
এখন শুধু ভাঙা পিলারের কঙ্কাল, মরিচা ধরা লোহার কাঠামো, আর এক গভীর, কান্নার মতো নীরবতা।
মানুষ তাকে "রানা প্লাজা" বলে চেনে।
কিন্তু স্থানীয়রা আজও নামটা মুখে আনে না।
ওদের কাছে এটা একটা অভিশাপ।
তারা শুধু বলে—
“ওই জায়গাটা... ওই দিকটা... ওই অভিশাপ…”
মনে হয়, নামটা উচ্চারণ করলেই মাটির নিচে ঘুমিয়ে থাকা পুরোনো কোনো পাপ আবার জেগে উঠবে।
আমি একজন লেখক।
আমি ভূত খুঁজতে যাই না, আমি খুঁজে ফিরি সত্য।
আর সেই সত্যের মুখোমুখি হয়েছিলাম ২০২৩ সালের মার্চের এক বিকেলে।
বিকেল তখন ফুরিয়ে আসছে।
আকাশজুড়ে কমলা-লাল আলো, যা ভাঙা রডের মাথায় পড়ে রক্ত জমাটের মতো ঝলমল করছিল।
খবর করার জন্য নয়— নিছক কৌতূহলেই গিয়েছিলাম।
ভাঙা বিল্ডিংয়ের পাশে ছোট্ট একটা চায়ের দোকান চালান আবদুল করিম চাচা।
বয়স সত্তরের কাছাকাছি, চোখের কোণে জমে থাকা বহু বছরের ঘুমহীন রাতের ছাপ।
আমি চায়ের কাপ হাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম—
“চাচা, এখানে এখনো কেউ আসে?”
চাচা ধীরে চা চুমুক দিয়ে বললেন,
“মানুষ আসে না বাবা… সাহস করে না কেউ। তবে শব্দ আসে।”
আমি অবাক হয়ে বললাম, “শব্দ?”
চাচা চারপাশে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললেন—
“রাতে মনে হয় সেলাই মেশিন চলে। চিঁ চিঁ চিঁ... টক টক টক... যেন কেউ খুব তাড়াহুড়ো করে কাজ শেষ করতে চাইছে।”
আমি হেসে বললাম, “হয়তো পাশের কোনো ফ্যাক্টরির শব্দ হবে।”
চাচা মাথা নাড়লেন জোরে।
“না রে বাবা, এই দিকের সব ফ্যাক্টরি বন্ধ। রাতে এখানে শুধু কুকুর ডাকে।
কিন্তু ওই বিল্ডিং থেকে আসে সেলাই মেশিনের শব্দ। মনে হয়... তারা এখনো কাজ শেষ করেনি।”
তার চোখে তখন ভয় আর একরাশ বিষণ্ণতার ছায়া।
আমার হাসিটা মিলিয়ে গেল।
রাত নেমে এলো দ্রুত।
চারপাশটা যেন এক বিশাল কালো ক্যানভাস, আর তার মাঝখানে ভাঙা বিল্ডিংটা অভিশাপের মতো দাঁড়িয়ে।
আমি টর্চ আর ক্যামেরা নিয়ে ভেতরে ঢুকলাম।
বাতাসটা অদ্ভুত ঠান্ডা— যেন গ্রীষ্মের দুপুরেও এখানে বরফ জমে থাকে।
প্রতিটি ধাপে মনে হচ্ছিল মাটির নিচে কোথাও কেউ শ্বাস নিচ্ছে।
ভাঙা সিঁড়ি, ছেঁড়া তারের জাল, কাদামাখা নীল পাড়ের একটা শাড়ির টুকরো…
মনে হলো কেউ পড়ে গেছে, কেউ চেয়েছিল উঠতে— কিন্তু পারেনি।
হঠাৎ টর্চের আলো পড়ল দেয়ালে।
সাদা ধুলোর ওপর স্পষ্ট পাঁচটা আঙুলের ছাপ—
যেন শেষ মুহূর্তে কেউ বাঁচতে চেয়ে থেমে গিয়েছিল।
তবুও সবচেয়ে ভয়ংকর দৃশ্যটা তখনো বাকি।
তৃতীয় তলায় উঠতেই শুনলাম, খুব ক্ষীণ কিন্তু স্পষ্ট এক শব্দ—
চিঁ চিঁ চিঁ... টক টক টক...
ঠিক যেন কেউ দ্রুত সেলাই করছে।
আমি থেমে গেলাম। বাতাস থেমে গেল।
তারপর খুব কাছে, ঠিক কানের পাশে কেউ ফিসফিস করে বলল—
“তুমি রিপোর্ট করতে এসেছো?”
আমি টর্চ ঘুরিয়ে দেখলাম— কেউ নেই।
শুধু আধভাঙা একটা সেলাই মেশিন আর তার পাশে মরিচা ধরা নামফলক—
“শিউলি বেগম, লাইন–৭।”
আমার শরীর ঠান্ডা হয়ে গেল।
পরের দিন সকালে আমি পাশের বস্তিতে গেলাম।
সেখানে রুমা নামে এক মেয়েকে পেলাম—
সে সেই দিনই কাজ করছিল ঐ ভবনে।
তার চোখের নিচে কালচে দাগ, মুখে নিস্তেজ ক্লান্তি।
সে বলল,
“আগের দিনই বিল্ডিংয়ে ফাটল পড়েছিল। আমরা সবাই ম্যানেজারকে বলেছিলাম কাজ বন্ধ করতে।
কিন্তু সে চিৎকার করে বলল— ‘একদিন কাজ না করলে বেতন কাটা যাবে!’
আমরা নিরুপায় হয়ে ঢুকেছিলাম।”
তার গলা কেঁপে উঠল।
“সকাল ৮টা ৫৭-তে ভবনটা ধসে পড়ে। আমার পাশের মেয়েটা, শিউলি... বাঁচেনি।
ওর হাতের ঘড়িটা থেমে গেছিল ঠিক ৯টা ৬ মিনিটে…”
আমি নিঃশব্দে বসে রইলাম।
কারণ আগের রাতেই আমি সেই নামটা দেখেছিলাম ধুলোর ভেতরে।
রাতের আঁধারে আবার ফিরে গেলাম সেখানে— ভয়েস রেকর্ডার হাতে।
বিল্ডিংয়ের ভেতরে এখন লতাগুল্ম গজিয়েছে, তবুও বাতাসে ঝুলে আছে অচেনা ধুলোর ভার।
রেকর্ডার চালাতেই শোনা গেল—
চিঁ চিঁ চিঁ... টক টক টক...
তারপর ক্ষীণ এক নারীকণ্ঠ—
“আমরা এখনো কাজ করছি…”
আমার হাত কাঁপছিল। টর্চ পড়ে গেল।
আলোয় দেখলাম, কেউ নেই—
শুধু বাতাসে উড়ছে ছেঁড়া কাপড়ের টুকরো, যেন কেউ সেলাই করছে অদৃশ্যভাবে।
আরেকটা কণ্ঠ এল—
“লাইন বন্ধ কোরো না… পিস শেষ হয়নি…”
আমার মনে হলো, ওরা চিরকাল এখানে আটকে আছে—
একটা অসমাপ্ত কাপড়ের টুকরো সেলাই করে যেতে,
যেন কাজ শেষ না হলে আজও তাদের বেতন কাটা যাবে।
এক সপ্তাহ পর শহরে ফিরে রেকর্ডটা বিশ্লেষণ করালাম।
সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ার বিস্ময়ে বলল,
“এটা শুধু মেশিনের শব্দ না। এর মধ্যে মানুষের হার্টবিট ফ্রিকোয়েন্সি আছে—
যেন কেউ আতঙ্কে দ্রুত শ্বাস নিচ্ছে।”
আমি চুপ করে রইলাম।
কারণ আমি জানতাম— ওরা এখনো আছে।
ওরা ফিরে আসে প্রতি বছর ২৪ এপ্রিল রাতে,
যখন নতুন বিল্ডিংয়ের লাইট নিভে যায়, তখন একঘরে সেলাই মেশিন নিজে থেকেই চলতে শুরু করে।
ওরা কাজ থামায় না।
ওরা এখনো সেই অসমাপ্ত পিসটা শেষ করতে চায়।
বিদায় নেওয়ার সময় করিম চাচা আমার হাত ধরলেন।
চোখের কোণে অদ্ভুত শান্তি নিয়ে বললেন—
“তুমি কি জানো বাবা, যে মাটিতে শত শত মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছিল,
সেই মাটিতেই যখন নতুন কারখানা হয়—
প্রথম কাপড়টা কে সেলাই করে?”
আমি উত্তর দিতে পারিনি।
শুধু দেখলাম— সূর্যের শেষ আলো ভাঙা কাঁচে প্রতিফলিত হচ্ছে।
মনে হলো, ভেতরে বসে আছে শিউলি বেগম।
সেলাই করছে, নরম গলায় গুনগুন করছে—
নিজের পুরোনো স্বপ্নগুলো সেলাই করে জোড়া লাগাতে চায়।
আর তার গানের তালে বাজছে সেই চেনা শব্দ—
চিঁ চিঁ চিঁ... টক টক টক... টক...
তুমি জানো?
সাভারের সাত নম্বর বিল্ডিং আজও নীরব নয়।
হয়তো ওরা এখনো সেলাই করছে সেই শেষ না হওয়া পিসটা...
যেন তাদের বেতন না কাটা যায়।
এই গল্পটা শেয়ার করো—
হয়তো শিউলি বেগমের কাজটা এবার সত্যিই শেষ হবে।
#সাত_নম্বর_বিল্ডিং