
18/08/2025
রেফারেন্সসহ বিস্তারিত আলোচনা কিতাবটিতে বর্ণনা করা হয়েছে।এখানে সারাংশ উপস্থাপন করা হয়েছে।সকলের জানা জরুরী।।
(১) আধুনিক মেডিক্যাল সাইন্সের শিক্ষাগ্রহণের নিমিত্তে মানুষের মরদেহ কাটাছেঁড়া করা অবৈধ, হারাম ও গুনাহের কাজ।
(২) আধুনিক মেডিক্যাল সাইন্সের অধীনে কোনো মানুষের চোখ বা কর্নিয়া দ্বারা অন্ধ ব্যক্তির চিকিৎসা প্রদান করা জায়েয নেই। বরং তা মারাত্মক গুনাহের কাজ। এ ছাড়াও মানুষের যে কোনো অকেজো ও নষ্ট হয়ে যাওয়া অঙ্গের চিকিৎসার্থে অন্য কোনো মানুষের অঙ্গ কাটাছেঁড়া করা জায়েয নেই। যেমন: কলিজা, ফুসফুস, চোখ, ব্রেইন ইত্যাদি কাটাছেঁড়া করা জায়েয নেই।
(৩) নিহত হওয়ার কারণ সনাক্ত করতে মরদেহের শবচ্ছেদ (পোস্টমর্টেম) জায়েয নেই।
(৪) মেডিকেল রিপোর্ট প্রস্তুত করার জন্য লাশ কাটাছেঁড়া করা জায়েয নেই।
(৫) আধুনিক মেডিকেল সাইন্সের শিক্ষা ও অনুশীলনের জন্য জবাইকৃত জন্তর অঙ্গ কিংবা কৃত্রিম অঙ্গের ব্যবহার যেমন সহজ তেমনি জায়েযও।
(৬) কেউ যদি তার অকেজো অঙ্গের চিকিৎসা করতে চায় তাহলে জবাইকৃত জন্তুর অঙ্গ অথবা কৃত্রিম অঙ্গ দ্বারা তা করতে পারবে।
(৭) শূকরের অঙ্গ দ্বারাও চিকিৎসা করা জায়েয আছে। তবে তা একান্ত নিরুপায় অবস্থায় হতে হবে। অন্যথায় জায়েয নেই।
মোটকথা, নিম্নোক্ত অপকারিতাগুলোর কারণে মানবাঙ্গ দিয়ে চিকিৎসা দেয়া এবং নেয়া কোনোটাই জায়েয নেই।
(ক) মানুষের লাশ কাটাছেড়া করলে তার মর্যাদা হানি হয়। অথচ কুরআন হাদিসে মানুষের মর্যাদা ও সম্মানের বজায় রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
(খ) লাশ কাটাছেঁড়া করলে মৃতের কষ্ট হয়। কারণ যে জিনিস দ্বারা জীবিত ব্যক্তির কষ্ট হয়, শরিয়তের দৃষ্টিতে তা দ্বারা মৃত ব্যক্তিরও কষ্ট হয়।
(গ) মৃত্যুর পরও মানুষের দেহের সাথে তার আত্মার সম্পর্ক অবশিষ্ট থাকে। এজন্য কবরস্থানে নিয়ে যাওয়ার সময় মৃত ব্যক্তি চিৎকার করে বলতে থাকে আমাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছ তোমরা?
(ঘ) মানুষের লাশ বা তার অঙ্গ কাটাছেঁড়া মানে মহান আল্লাহর সৃষ্টিতে বিকৃতি সাধন করা। অর্থাৎ এতে মানুষের সৃষ্টি ও জন্মগত অবয়বের বিকৃতি সাধন করা হয়, যা নিষিদ্ধ ও হারাম।
(ঙ) মানুষের অঙ্গ ও লাশ ব্যবহার করা, পরিবর্তন-পরিবর্ধন করা নাজায়েয। আর কাটাছেঁড়া করতে গেলে তাই করতে হয়।
(চ) মানুষের দেহ বা অঙ্গ কাটাছেঁড়া করে তা দ্বারা উপকৃত হওয়া জায়েয নেই।
(ছ) মানবাঙ্গের কাটাছেঁড়ার ক্ষেত্রে উল্লিখিত অসুবিধাগুলো ছাড়াও পর্দাহীনতা হয় এবং নিষিদ্ধ অংশ দেখতে হয়। অথচ একান্ত কোনো প্রয়োজন ছাড়া তা দেখা জায়েয নেই।
(জ) মানুষের দেহ বা অঙ্গকে ঔষধ বা খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা কোনো অবস্থাতেই জায়েয নেই। যদিও তা হয় একান্ত নিরুপায় অবস্থায়।
(ঝ) মানুষ যেভাবে তার মাল-সম্পদের মালিক হতে পারে এবং তার মাঝে স্বাধীন ও নিরঙ্কুশভাবে হস্তক্ষেপ করতে পারে সেভাবে তার দেহ ও অঙ্গের বেলায় পারে না। এগুলোতে কাটাছেঁড়া করা মানে অন্যের (অর্থাৎ আল্লাহর) মালিকানায় অবৈধ হস্তক্ষেপ করা।
(ঞ) যারা মানুষের লাশ কাটাছেঁড়া করে এবং যাদের অনুমতিতে করে কেয়ামতের দিন তাদের সবাইকে জবাবদিহিতা করতে হবে।
(৮) মানবাঙ্গ দান করা বা দানের অসিয়ত করা কোনোটাই জায়েয নেই।
(৯) যদি কেউ কাউকে দান করার অসিয়ত করে, তবে ওয়ারিশদের উপর তা বাস্তবায়ন করা জরুরি নয়, বরং তার উপর আমল করাও জায়েয নেই।
(১০) যদি কেউ অসিয়ত করে আর ওয়ারিশরা তা বাস্তবায়ন করে, তাহলে উভয় শ্রেণির মানুষই গুনাহগার হবে।
(১১) যারা অঙ্গ দান করে তারা বিচার দিবসে বিকলাঙ্গ অবস্থায় উত্থিত হবে। আল্লাহ মাফ না করলে তাকে শাস্তিও ভোগ করতে হবে।
(১২) অভিজ্ঞ ডাক্তার যদি ব্যবস্থাপত্র দেয় যে, রোগীর আক্রান্ত অঙ্গটি কাটাছেঁড়া ও অপারেশন ব্যতীত চিকিৎসা করা সম্ভব নয়। তাহলে রোগীর অনুমতিক্রমে ক্ষতির হাত থেকে দেহ রক্ষার জন্য তা বৈধ হবে। রোগী অপ্রাপ্তবয়স্ক বা প্রতিবন্ধী হলে তার (ওলী) বা অভিভাবকের অনুমতিতে অপারেশন করতে হবে। একান্ত নিরুপায় অবস্থা না হলে, এবং অন্য কোনো সহজ চিকিৎসার ব্যবস্থা থাকতে এমন ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনের রিস্ক নেয়া জায়েয হবে না। যা দ্বারা জীবনের বা কোনো অঙ্গের ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা থাকে।
(১৩) যেক্ষেত্রে বিকল্প চিকিৎসা ব্যবস্থা রয়েছে, সেক্ষেত্রে এমন অপারেশন করা জায়েয হবে না, যাতে প্রাণহানী বা অঙ্গহানীর প্রবল আশঙ্কা রয়েছে। অবশ্য জরুরি অবস্থা দেখা দিলে ভিন্ন কথা।
(১৪) অনেক সময় স্বাভাবিক পরিস্থিতিতে বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছাড়াই ডাক্তাররা গর্ভবতী মহিলাকে সিজার করার পরামর্শ দেয়। এটা মারাত্মক ভুল ও নাজায়েয। কারণ মায়ের পেটে আল্লাহ তায়ালা সন্তান সৃষ্টি করেছেন ও এর প্রসবের ব্যবস্থাও করে রেখেছেন। মানবরচিত একটি পদ্ধতি হলো সিজার। যথাসম্ভব এ থেকে বেঁচে থাকা শরিয়তের দৃষ্টিতে একান্ত জরুরি। মেডিকেল নীতিও এর পক্ষে। অনেক সময় নয় থেকে দশ মাসের মধ্যে বাচ্চা জন্ম না নিলে সিজারকে জরুরি মনে করা হয়, অথচ শরিয়তের দৃষ্টিতে বাচ্চা মায়ের পেটে সর্বোচ্চ দুই বৎসর পর্যন্ত থাকতে পারে। আর তা সম্ভবও। অতএব, একান্ত জরুরি অবস্থা ছাড়া অপারেশন করা বা করানো কোনোটাই ঠিক নয়।
(১৫) তবে যদি রোগীর অবস্থা একেবারে নাজুক হয়, তার জীবনের ক্ষতির আশঙ্কা হয়, অথবা প্রসব বেদনা দুঃসহনীয় পর্যায়ের হয়, তাহলে অপারেশনের অনুমতি দেয়া যেতে পারে। তবে এর সাথে রোগীর সম্মতিও থাকতে হবে। কিন্তু অপারেশন করার সময় নিম্নোক্ত বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রাখা জরুরি।
(ক) প্রথমত: মহিলা ডাক্তার দ্বারা অপারেশন করাতে হবে। যদি মহিলা ডাক্তার পাওয়া না যায় বা মহিলা ডাক্তার অনভিজ্ঞ হওয়ার কারণে রোগীর ক্ষতির প্রবল আশঙ্কা করা হয়, তাহলে অভিজ্ঞ পুরুষ ডাক্তার দ্বারা অপারেশন করা জায়েয হবে।
(খ) প্রয়োজনের অধিক কাটাছেঁড়া করা যাবে না। করলে তা নাজায়েয হবে। সুতরাং চেষ্টা করবে যত কম কাটাছেঁড়ার মাধ্যমে অপারেশন সমাপ্ত করা যায়।
(গ) ডাক্তার পুরুষ হোক বা মহিলা হোক অপারেশনের সময় সতরের প্রয়োজনীয় অংশটুকুই খুলবে। তার অধিক স্থান খোলা জায়েয নেই।
(ঘ) ডাক্তাররা শরিয়তের প্রয়োজনীয় অংশ দেখতে পারবে নিষ্প্রয়োজনীয় অংশ দেখা বা প্রয়োজনের পর খোলা রাখা থেকে বিরত থাকবে।
(১৬) হাসপাতালগুলোতে যে সমস্ত লোক প্রাণ হারায় তাদেরকে মেডিকেল নিয়মানুসারে পোস্টমর্টেম করা হয়, কোনো কারণ থাক বা না থাক। এটা সম্পূর্ণ কুরআন-হাদিস পরিপন্থী নিয়ম। সুতরাং এ পরিস্থিতিতে ডাক্তারদের উচিত হবে তারা যেন লাশ কাটাছেঁড়া থেকে যথাসাধ্য বিরত থাকে। আর আইন প্রণয়নকারী সংস্থাগুলোর কর্তব্য হলো তারা যেন এ ধরনের নিয়মকে বিলুপ্ত করে শরিয়তসম্মত নিয়ম প্রবর্তন করে।
(১৭) মানুষের রক্তের ব্যাপারে গবেষক উলামাদের ফাতাওয়া হলো এই যে, একান্ত অপারগ অবস্থায় জীবন বা অঙ্গ বিনষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা খুব প্রকট হলে রক্তের ব্যবহার জায়েয আছে। কিন্তু যে রক্ত দিবে তার জন্য বিনিময় গ্রহণ করা জায়েয নেই। কিন্তু যার রক্তের প্রয়োজন সে যদি বিনিময় ছাড়া রক্ত না পাওয়া যায়, তাহলে প্রয়োজনের ভিত্তিতে বিনিময় দিয়ে হলেও তার জন্য রক্ত সংগ্রহ করা জায়েয হবে। তবে রক্তদাতার জন্য বিনিময় নেয়া কোনো অবস্থাতেই জায়েয হবে না বরং হারাম হবে।
(১৮) প্রয়োজনের ভিত্তিতে যখন রক্ত দেয়া হবে, তখন ঐ পরিমাণ দেওয়া যাবে, যতটুকু দ্বারা প্রয়োজন মিটে যায়। অতিরিক্ত রক্ত দেয়া কোনোক্রমেই জায়েয হবে না।
(১৯) প্রকাশ থাকে যে, যেখানে যেখানে চিকিৎসার প্রয়োজনের ভিত্তিতে অপারেশনের রোগীকে রক্ত দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়েছে সেখানে ওই অনুমতির উপর আমল করা সংশ্লিষ্ট রোগীর জন্য ওয়াজিব নয়। যদি কোনো রোগী এর উপর সম্মত না হয় এবং এর ফলে সে মারা যায়, তাতে সে গুনাহগার হবে না।