
18/09/2025
আমার_হৃদয়ে_তুমি_আজীবন
#পর্ব_৩৭ ( অবশিষ্টাংশ )
দুই পক্ষের হাতাহাতিতে ওষ্ঠাগত অবস্থা উভয় পক্ষের। কেউ কারো থেকে কম যায়না। অপরপক্ষের সংখ্যা অনেক হলেও আদ্র একা। তবে আজ একাই সে বীর বিক্রমে লড়াই করে চলেছে। নিজেকে বাঁচানোর লড়াই, মায়াকে বাঁচানোর লড়াই। হাতাহাতির এক পর্যায়ে ক্লান্ত সবাই। বসে পড়ল মাটিতে। আদ্রকে ঘিরে সবাই বসল তবে একটু দূরে। এই ছেলে যে তাদের এত মারবে সেটা তাদের ধারণার বাইরে ছিল। নইলে আরও লোক নিয়ে হাজির হতো।
মায়া এতক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখছিল, চাইলেও সে থামাতে পারবেনা এসব। আদ্রকে বারবার বলছিল থামার জন্য। কিন্তু সে থামলে তো! আদ্রের মুখ, ঠোঁট ফেটে রক্ত পড়ছে। মায়ার বুকটা মোচড় দিয়ে উঠলো আদ্রকে দেখে। নিজেকে অসহায় মনে হল বড্ড। সে যদি আজ আদ্রকে সাহায্য করতে পারত কতই না ভালো হতো। তার জন্যই তো মার খেয়েছে সে। মায়া নিজেকে সামলাতে পারল না, এবার শব্দ করে কেঁদে দিল। কি করবে সে! এই পরিস্থিতিতে তার কি করা উচিত তার ধারণার বাইরে। আহত ছেলেদের সরিয়ে মাটিতে বসা আদ্রের কাছে গেল। চোখে মুখে হাত বুলিয়ে দিতে লাগল আলতো ভাবে। আদ্র আবেশে বন্ধ করে নিল তার নেত্রযুগল। ক্ষীণ দৃষ্টিতে তাকালো মায়ার দিকে। এই যে মায়া কাঁদছে! তার কি ভালো লাগছে? একদম লাগছে না।
কাঁদলে তোকে একদম পেত্নীদের মত লাগে। কান্না থামা। নইলে সবাই ভয় পেয়ে যাবে। মায়ার কান্নার বেগ আরও বেড়ে গেল, বসা অবস্থায় জড়িয়ে ধরলো আদ্রকে। তাতেই যেন আদ্রের সব কষ্ট লাঘব হল। এই মেয়ে যে তার সকল কষ্ট দূর করার ওষুধ, সেটা সে আগে থেকেই জানে।
আজ বাঁচবে কিনা জানেনা। তবে মরার আগে হলেও প্রিয়তমার ছোঁয়া সে পেয়েছে। জুড়িয়ে গেছে তার হৃদয়। এখন তো মরেও শান্তি।
মায়া আদ্রের দিকে তাকিয়ে বলল,
আমার জন্যই সব হল। আমার জন্যই ফাহিমের সাথে তোর শত্রুতা। এখন মনে হচ্ছে তোর সাথে আমার দেখা না হলেই হয়তো ভালো হতো। অন্তত আজ তোকে এই দিনটা দেখতে হতো না।
আদ্র হাসল, কার সাথে কার পরিচয় হবে, কে কার আপন হবে সেটা তো ঠিক করবেন সৃষ্টিকর্তা। আমরা তো সাধারণ মানুষ। আমাদের কি আর সে সব ঠিক করার সাধ্য আছে? নেই!
মায়া আস্তে আস্তে দাঁড় করালো আদ্রকে। হাতাহাতিতে অনেকটাই আহত হয়েছে সে। তবে শরীরের আঘাতের থেকে মনের আঘাত তীব্র। এই যে মায়া নিজের ইচ্ছায়, শুধুমাত্র তাকে বাঁচানোর জন্য ওদের হাতে ধরা দিতে চাইছিল, সেটা তার পছন্দ হয়নি। মেনে নিতে পারছেনা কিছুতেই। বারবার মায়ার এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্য চোখের সামনে ফুটে উঠছে। নিজের জীবন বাঁচাতে, কখনই সে মায়াকে ওদের হাতে তুলে দেবেনা।
এদের দুজনের কথা সহ্য হচ্ছে না ফাহিমের। আলগোছে উঠে দাঁড়ালো সে। মাটিতে পড়ে থাকা পিস্তল উঠিয়ে তাক করলো আদ্রের দিকে। আগে পিছে না ভেবেই গুলি করল। চিৎকার করে উঠলো মায়া।আদ্রকে সরিয়ে দিল, সঙ্গে সে নিজেও পড়ে গেল মাটিতে। গুলি লাগতে গিয়েও লাগল না। বাতাসে ভেসে গেল নিমেষেই। ফাহিম মাটির উপর নিজের পা দিয়ে লাথি মারলো, গুলি করতে গেল পুনরায়। না এবার এর হল না, পিস্তলের গুলি শেষ। ইতিমধ্যে দুটি বন্দুকের এগারোটা গুলি শেষ করে ফেলেছিল। অবশিষ্ট গুলিটাকেও কাজে লাগাতে না পেরে, মেজাজ হারালো। মারতে গেল আদ্রকে। আদ্র, মায়া দুজনেই তখনও মাটিতে পড়ে। কিন্তু ওদের কাছে যেতেই আশেপাশে থেকে মানুষের আওয়াজ ভেসে আসতে লাগল। তবে একটা দুটো না, প্রায় বিশ-পঁচিশ জন মানুষের আওয়াজ। এই ফাঁকা মাঠের মধ্যে এই লোকগুলো কোথা থেকে এল, বুঝলোনা তারা। তবে আদ্র- মায়া শুকরিয়া আদায় করল সৃষ্টিকর্তার কাছে। নিজেদেরকে বাঁচিয়ে নেওয়ার সেই আশা ফুটে উঠল তাদের মাঝে।
লোকগুলো কাছে আসতেই তারা করল ফাহিমদের। ফাহিম তো আগেই সুযোগ বুঝে কেটে পড়েছে। কারণ সে পরিচিত মুখ, তাকে মানুষ সহজেই চিনে ফেলতে পারে। পার্টির হয়ে অনেক স্লোগান, মিছিল করেছে সে। ভোটের আগে নিউজ চ্যানেলে তার অহরহ উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। তাই তো আগেই পালিয়ে গেছে। তবে যাওয়ার আগে আদ্রকে বলে গেছে "আজ বেঁচে গেছিস মানে এটা ভাবিসনা পরের বারও বেঁচে যাবি।" তোর জান আর এই মায়া দুটোই আমার হবে। পারলে বাঁচিয়ে নিস। আজ তোর লাক ভালো। তবে প্রতিবার সেটা হবেনা। আদ্র হাসল ফাহিমের দিকে ফিরে। তার গা জ্বালানো হাসি দেখে আরো জ্বলে উঠল ফাহিম। তবে এখন তাকে যেতেই হবে।
গ্রামের লোকের তাড়া খেয়ে পালিয়ে গেল ফাহিমের ভাড়া করা ছেলে গুলো। সঙ্গে তার ডানহাত আলফাজ। এমনিতেও মার খেয়ে তার বেহাল অবস্থা তার উপর এমন দৌঁড়ানি। সব মিলিয়ে যায় যায় অবস্থা তার।
কয়েকটা মহিলা ও পুরুষ ছুটে আসল মায়া ও আদ্রের দিকে। ধরে তুলল তাদের। শেষ বার পড়ে যাওয়ার ফলে তীব্র ব্যথা পেয়েছে আদ্র। অতি কষ্টে উঠে দাঁড়ালো সে। তবে হাত বাড়িয়ে মায়াকে টেনে নিল নিজের কাছে। জড়িয়ে নিল বুকে। যেন ছেড়ে দিলেই হারিয়ে যাবে। মায়াও আজ বাঁধা মানলো না। ভুলে গেল আরশাফুল শেখকে দেওয়া কথা। জড়িয়ে ধরে রাখলো আদ্রকে। আশেপাশে কে আছে, কি ভাবছে সে সবে খেয়াল নেই দুই মানব মানবীর। তারা এখন অনুরাগের প্রহরে ব্যস্ত। সে কি অত সহজে শেষ হওয়ার?
একজন বয়সজ্যেষ্ঠা লোক অনেকক্ষণ ধরে পর্যবেক্ষণ করছে তাদেরকে। তার প্রখর দৃষ্টিই বলে দিচ্ছে কি ভাবছে সে দুজনকে নিয়ে। এবার তিনি প্রশ্ন করে বসলেন,
তোমরা কারা? আর এত রাতে এখানেই বা কি করছো? আগে তো কখনও এদিকে দেখিনি!
আদ্র-মায়ার ধ্যান ভাঙলো এবার। মায়া লজ্জায় পড়ে গেল এতগুলো মানুষের সামনে। তবে আদ্রের মাঝে সে সবের হেলদোল নেই। এমন ভাব করে দাঁড়িয়ে আছে যেন কিছুই হয়নি।
আমাদের বাড়ি কলকাতায়! একটা বিয়ে উপলক্ষে এখানে এসেছিলাম, কিন্তু পথে মধ্যে কিছু দুষ্কৃতির কবলে পড়ি। তাই এই রাস্তায় এসে পড়েছি। আপনারা না আসলে আজ আমাদের অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেত। মেরে ফেলত ওরা আমাদের। আপনাদেরকে অনেক অনেক শুকরিয়া। আদ্র ভেঙে আসা কন্ঠে বলল, তার আর ক্ষমতা নেই দাঁড়িয়ে থাকার। মায়া বুঝল আদ্রের অবস্থা, আগলে নিল নিজের দুহাতে। মায়ার এই যত্নে মুগ্ধ হল আদ্র। মেয়েটা তাকে কষ্ট না দিতে সবার সামনেই আগলে নিয়েছে। আর কি চাই! চাই তো অবশ্যই। পুরো মেয়েটাকেই যে চাই তার।
একটা মহিলা মায়াকে দেখে বলে উঠল,
এই মেয়ে তুমি ওকে এমন ভাবে ধরে আছ কেন? কে হয় ও তোমার? মহিলার রাগি কণ্ঠের কথা শুনে মায়া কি বলবে বুঝতে পারল না! সত্যিই তো কে হয় আদ্র ওর? শুধুই তো বন্ধু! এছাড়া তো আর কোনো সম্পর্ক নেই তাদের মাঝে।
কি হলো? চুপ করে আছো কেন? উত্তর দাও। মায়া কিছু বলতে যাওয়ার আগেই আদ্র বলে উঠল,
ও আমার ওয়াইফ,বউ আমার।
আদ্রের মুখে " ও আমার ওয়াইফ, বউ আমার"- কথাটা শুনে মায়ার শিরদাঁড়া বরাবর শীতলতা বয়ে গেল। ফর্সা গালের চিবুক রক্তিম বর্ণ ধারণ করেছে।
বললেই হল! আজকাল ছেলে মেয়েদের কিভাবে বিশ্বাস করব? তোমরা যে আকাম করতে গিয়ে মার খাওনি, তার কোনো প্রমাণ আছে? এই মেয়েকে দেখে তো কোনদিক থেকেই মনে হচ্ছে না যে, সে বিবাহিত। বিবাহের কোনো চিহ্নই তো তার মাঝে নেই।
মহিলার কথা শুনে বেশ রাগ হলো মায়ার। এ যেন পুরো শেলেনা বেগম। অন্তত কথার ধরণ তো তাই বলে। তবে রাগ হলেও মায়া নিজেকে সামলে নিল,
এদের জন্যই তো আজ তারা বেঁচেছে। তাই এমন হাজার কথাও ঠিক হজম করে নেবে।
বিবাহের কোন চিহ্ন থাকুক বা না থাকুক, সত্যিটা তো আর পালটে যাবেনা। ও আমার বউ, বউই থাকবে। আপনাদের মানা, না মানাতে কিছু যায় আসবে না। আমরা আপনাদের কাছে কৃতজ্ঞ আমাদের বাঁচানোর জন্য। এখন যেতে দিন আমাদের।
এই ছেলে এই! এত বড় বড় কথা কোথা থেকে আসছে তোমার! এখন তো আমাদের সত্যিই মনে হচ্ছে কোনো ঘাপলা আছে তোমাদের মধ্যে। নইলে রাতের বেলা এই নির্জন মাঠে কি করবে তোমরা?
সেটা আপনাদের বিকৃষ্ট মস্তিষ্কের ধারণা। আপনারা মনে করেন,
রাতের বেলা দুটো ছেলে মেয়ে একসঙ্গে দেখা মানেই তাদের মধ্যে কোনো খারাপ সম্পর্ক আছে। আর যদি সত্যিই থাকত তাহলে ওই ছেলেগুলো এভাবে পালিয়ে যেত না। ওরাই ধরিয়ে দিত আমাদের আপনার কাছে। কিন্তু সেটা তো করেনি। উলটে পালালো।
আদ্রের কথাটা সবাইকে ভাবালো। সত্যিই তো। এরা যদি সত্যিই খারাপ কিছু করে থাকত তাহলে ওরা কেন পালিয়ে যাবে!
বয়স্ক লোকটি আদ্রের সামনে এসে দাঁড়ালো। অস্ফুটে বলল,
মানলাম ওরা তোমাদের ক্ষতি চাইছিল কিন্তু এতে তো এটা প্রমাণিত হয়না যে, তোমরা বিবাহিত!
আচ্ছা আংকেল একটা কথা বলুন তো, ধরে নিন আমরা বিবাহিত নই, আমরা বন্ধু। তাও দুজন একসাথে ট্রাভেল করছিলাম। এখন, আজ আমাদের সাথে যা যা ঘটেছে। যদি সেগুলোই ঘটত। তাহলে আপনারা এক্সাক্ট কি করতেন আমাদের সাথে?
অবশ্যই তোমাদের বিয়ে দিয়ে দিতাম।
"বিয়ে দিয়ে দিতাম" কথাটা শোনা মাত্রই চমকে উঠল মায়া। কি বলছেন এরা এসব? চেনা নেই , জানা নেই। শুধুমাত্র বিপদে পড়েছিল, আর দুজন ছেলে-মেয়ে বলেই এদের বিয়ে দিয়ে দেবে? কেমন মানুষ এরা?
বাহ আংকেল বাহ। এটাই আশা করা যায় আপনাদের থেকে। ভাবতেই অবাক লাগে, আপনারা এখনও সেই পুরানো যুগেই পড়ে আছেন। দুটো ছেলে মেয়েকে একসাথে দেখলাম, নে লাগিয়ে দে বিয়ে। ওরা নিশ্চয় কোনো আকাম করে বেড়াচ্ছিল! তাই না?
তারা যে কতটা বিপদের মধ্যে থেকে নিজেদের বাঁচিয়েছে সেই খোঁজ কেউ রাখেনা! শুনুন আংকেল যদি আকাম করারই থাকতো তাহলে ভালো ভালো হোটেল ছিল, আপনার এই পাড়াগাঁয়ে আসার প্রয়োজন পড়ত না। আর এভাবে দুজনকে বিয়ে দিয়ে আপনারা কি প্রমাণ করতে চান? আপনারা খুব বড় মনের মানুষ! খুব ভালো কাজ করেছেন? তো শুনে রাখুন, আপনারা সম্পূর্ণ ভুল। আর আপনাদের ভুলের মাশুল দিতে হয় দুটো নিরপরাধ ছেলে মেয়েকে। আপনারা তো বিয়ে দিয়ে খালাস। কিন্তু কখনও ভেবে দেখেছেন, তারা তাদের পরবর্তী জীবন কীভাবে কাটাবে? তারা তো শুধুমাত্র পরিস্থিতির শিকার হয়ে বিয়েটা করতে পারে! মেনে নিতে পারলে ভালো, নইলে আর কি ডিভোর্স। সম্পর্ক তো ছিন্ন হয়ে যাবে কিন্তু যে চরিত্রের দাগ দিয়ে আপনারা জোর করে ওদের বিয়ে দিয়ে দেন, সেই আপনাদের কি কখনও ক্ষমা করে তারা? করেনা। করতে পারেনা। কষ্ট হয়তো কেটে যায়। কিন্তু তার দাগ সারাজীবন মনেই রয়ে যায়। বরং যতবারই মনে পড়বে ততবারই অভিশাপের শিকার হবেন।
মায়া মনোযোগ দিয়ে শুনছে আদ্রের কথা। এই ছেলের মানসিকতা মুগ্ধ করছে তাকে। কত সুন্দর ভাবে বাস্তবতার প্রতিটি মুহূর্ত ব্যক্ত করল সে। হুমায়রা থাকলে হয়তো পুনরায় প্রেমে পড়ে যেত। কিন্তু সে কি পড়েনি? পড়েছে তো। আবার নতুন করে পড়ে গেছে আদ্রের প্রেমে, জড়িয়ে গেছে তার মায়ায়।
এই ছেলে! ভুল করে আবার বড় বড় কথা? আর আমাদের পাপ, অভিশাপের কথা শেখাচ্ছ? বাঁচাতে চাইছো নিজেদের?
কোনটা ভুল! আমাকে দেখে, আমার অবস্থা দেখে কি আপনার মনে হচ্ছে আমি ওসব কাজ করতে এসেছিলাম? আর তাও যদি বিশ্বাস না হয়ে থাকে তো পাশেই আমাদের গাড়ি আছে। আপনারা নিজেরা যান আর চেক করে নিন। চাকায় গুলি পেলেও পেতে পারেন। কিন্তু দয়া করে আমাদের সম্পর্ককে নোংরা জায়গায় দাঁড় করাবেন না। আমাদের সম্পর্ক পবিত্র সম্পর্ক তাতে কোনো নোংরার ছায়া পর্যন্ত নেই। আশা করব আপনি বা আপনারা আমাদের সম্পর্ককে কুলষিত করবেন না। আদ্র আর কথা বলতে পারছে না। ধরে আসছে তার গলা। শরীরটা বড্ড খারাপ লাগছে।
আদ্র পড়ে যেতে নেয়, মায়া তার নরম হাতে আদ্রকে আগলে রাখলেও বলিষ্ঠ শরীরের সঙ্গে পেরে ওঠেনা। আদ্রকে পড়ে যেতে দেখে বয়স্ক লোকটি তাকে ধরে নেয়। হাত, পা থেকে রক্ত ঝরছে প্রচুর। কয়েকজন লোক ধরাধরি করে নিয়ে গেল আদ্রকে। পিছন পিছন আসল মায়া। তার জীবনে যেন কষ্টের শেষ নেই। লোকে যেন পণ করেই রেখেছে, মায়ার কাছের মানুষদের কষ্ট দেবে, আঘাত করবে। শেষে হয়তো মেরেও ফেলবে। মায়া তো একবার সহ্য করে নিয়েছে। কিন্তু বার বার পারবেনা। সম্ভব না তার দ্বারা।
আদ্রকে ধরে নিয়ে যাওয়ার মধ্যেও সে নিজের হাত বাড়িয়ে দিল মায়ার দিকে। মায়া এসে আঁকড়ে ধরলো আদ্রের হাত। আদ্রের তাতেই শান্তি। গ্রামে ঢুকে একটা বাড়িতে আনা হলো আদ্রকে। বাড়িটা করিম মিয়ার, অর্থাৎ বয়স্ক লোকটির। তিনি এই বাড়িতে একাই থাকেন। স্ত্রী অনেক বছর হলো গত হয়েছেন। একমাত্র ছেলে কাজের সূত্রে শহরে থাকে, বিয়ে করে সেখানেই একরকম ঘাঁটি গেড়েছে। আর দুই মেয়ে শ্বশুরবাড়ি। মাঝে মাঝে আসে, খবর নেয়। দু একদিন থেকে যায়।
আদ্রকে শুইয়ে দেওয়া হল একটি খাটে। মায়া এখনও তার হাত ধরে আছে। আদ্রের সারা শরীরে পরখ করে দেখছে কোথায় কোথায় চোট লেগেছে। নিজের ওড়না দিয়ে আলতো ভাবে মুছে দিচ্ছে রক্ত।
আপনারা একটু ডেটল বা সেভ্নল আর একটু সুতি কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিতে পারবেন? আসলে ওর ক্ষত গুলো ড্রেসিং করা দরকার। নইলে ইনফেকশন হয়ে যেতে পারে।
তার দরকার নেই আরু। আমি ঠিক আছি।
একদম চুপ। কি ঠিক আছি হ্যাঁ? কতটা জখম হয়েছিস তার কোনো খেয়াল আছে? বেশি কথা বললে খাট থেকে ফেলে দেব।
মায়ার কথায় হাসল আদ্র! এই মেয়ে তাকে চোখ রাঙাচ্ছে!
বয়স্ক লোকটি ঘরে থাকা সবাইকে ইশারা করে বাইরে যেতে বলল। আর একজন মহিলাকে ডেটল আর সুতি কাপড়ের ব্যবস্থা করতে বলে দিল। সবাই চলে যেতেই বয়স্ক লোকটি বলল,
বরকে এভাবে তুই করে বলতে নেই। তুমি করে বলবে! তুমি বলার মধ্যে কিন্তু একটা আলাদায় ভালোলাগা থাকে।
ঠিক বলেছেন আংকেল। এটা আপনি ওকে বোঝান তো। কতবার বললাম তুমি করে বলতে। কিন্তু এই মেয়ে বললে তো।
লোকটি হাসল। আমাকে ক্ষমা করে দিও তোমরা! সত্যি বলতে আমরা কখনও এমন ভাবে ভেবে দেখিনি। আজ বুঝতে পারলাম। পারলে মাফ কোরো। আসলে সেই পুরানো যুগের মানুষ তো। এসবে অভ্যস্ত নই আমরা।
না না আংকেল। মাফ চাইবেন না। আপনি মুরুব্বী মানুষ, আমাদের লজ্জা দেবেন না।
আদ্রের আন্তরিকতায় বেশ খুশি হলেন লোকটি। আজকাল মানুষকে কিছু না বললেও তারা কথা শুনিয়ে চলে যান। অথচ তারা এই ছেলে মেয়েকে কতই না খারাপ কথা বলেছে। তাও তারা নিঃশ্চুপ। বরং কত ভালোবেসে কথা বলছে।
খুব ভালো লাগলো তোমাদের সাথে কথা বলে। আজ এখানেই থেকে যাও। তোমাদের গাড়িটা গ্যারেজে পাঠিয়ে দিয়েছি। এত রাতে তো আর ঠিক হবেনা, তবে কাল সকাল সকাল ওরাই ঠিক করে দেবে। আর টেবিলে তোমার ফোন আর চার্জার রেখেছি। ওটা গাড়ির মধ্যেই ছিল। তাই আমাদের গ্রামের এক ছেলে এনে দিয়েছে।
আংকেল আপনি প্লীজ ফোনটা একটু চার্জে বসিয়ে দিতে পারবেন? আসলে বাড়িতে একটু কথা বলতাম।
হ্যাঁ হ্যাঁ নিশ্চয়। লোকটি আদ্রের ফোনটা চার্জে বসিয়ে বেড়িয়ে গেল। ততক্ষণে মহিলাটি ডেটল, সুতি কাপড়ের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। মায়া দরজা বন্ধ করে আদ্রের ক্ষত স্থানে ড্রেসিং করিয়ে দিল। তবে আদ্র একবারও আর মায়ার দিকে তাকালো না বা কথা বলল না।
এই তো সব ঠিক ছিল। এই ছেলের আবার কি হলো? আদ্র তোর কি কোথাও কষ্ট হচ্ছে?
হচ্ছে তো। ঠিক এখানে, আদ্র নিজের ডান হাতের একটা আঙ্গুল বুকে ঠেকিয়ে বলল। মায়া আঁতকে উঠল। কি বলছিস? ওখানে কি মারপিট করতে গিয়ে লেগেছে? কই দেখি! মায়া আদ্রের বুকে হাত দিতে গেলে আদ্র মায়ার হাত সরিয়ে দেয়।
বাইরের আঘাত না হয় দেখা যায়, কিন্তু ভিতরের আঘাত? সেটা কি দেখা যায়?
মায়া বুঝলোনা আদ্রের কথা। নির্বাক চেয়ে রইল তার দিকে। আমার কি কোনো ভুল হয়েছে আদ্র?
ভুল না। অন্যায়। অন্যায় করেছিস তুই। যার ক্ষমা নেই। তাই চুপ থাক।
মায়া কেঁদে ফেলল,
তবে সেই কান্না আদ্রকে গলাতে পারলো না। বরং মায়ার কান্নায় রাগ উঠে গেল তার। কাঁদতে হলে বাইরে গিয়ে কাঁদ। ভালো লাগছে না আমার। জাস্ট লিভ।
মায়া কেঁপে উঠল। আদ্রের এমন রুড ব্যবহারের কারণ তার অজানা।
আমি বাইরে যাবনা। আগে কি করেছি সেটা বলতে হবে। অন্যায় যখন করেছি, তখন সেই অন্যায়টাও জানতে চাই। এই অপরাধীর অপরাধের কারণটা কি জানতে পারি?
তুই কোন সাহসে নিজের সম্মান ওই ফাহিমের হাতে তুলে দিচ্ছিলিস? তোর বুক একবারও কাঁপেনি? যেই তুই, সেদিন নিজেকে বাঁচাতে এত কিছু করলি! এমনকি গাড়ির নীচেও পড়লি। আর আজ শুধু আমাকে বাঁচাতে চলে যাচ্ছিলিস ওদের কাছে? কেন? হোয়াই হোয়াই হোয়াই? আনসার মি ড্যামেড! গর্জে উঠল আদ্র!
আমি তো শুধু!
কোনো অজুহাত না! আজ কোনো অজুহাত না। যেই আমি চেষ্টা করছিলাম তোকে বাঁচাতে, আর সেই তুই কি করলি? চলে যেতে চাইছিলিস! তোর কি মনে হয় তোকে পেয়ে গেলে ওরা আমাকে ছেড়ে দিত? বোকা তুই? ফাহিমকে চিনিস না! তাও কেন?
মায়ার কান্নার বেগ বেড়েই চলেছে। চোখ, মুখ লাল সত্যিই সে ভুল করেছে, না না ভুল না অন্যায়। কিন্তু সে তো শুধু তার ভালোবাসার মানুষকে বাঁচাতে চেয়েছে। তার জন্যই নিজেকে সপে দিতে চেয়েছে ওই শয়তানদের হাতে।
আমি তো শুধু তোকে বাঁচাতে?
আমাকে বাঁচাতে কেন? মরে যেতাম আমি। মরতে দিতিস। মায়া আদ্রের মুখ চেপে ধরলো।
এমন বলিসনা আদ্র। তোর কিছু হয়ে গেলে আমি......
আমার কিছু হয়ে গেলে যেত তাও এটা ভেবে খুশি হতাম অন্তত আমি বেঁচে থাকতে কেউ তোর কোনো ক্ষতি করতে পারেনি। কিন্তু না... তুই সেটা হতে দিলে তো। নিজের সম্মান একটা মেয়ের কাছে কতটা কোমলীয় সেটা তুই খুব ভালো করে জানিস। তাহলে কেন?
আর কখনও করব না। বিশ্বাস কর। তাতে যায় হয়ে যাক না কেন?
আদ্র এবার একটু শান্ত হল। আমার কি বিশ্বাস করা উচিত তোর কথায়?
মায়া মাথা নাড়ল। হাসল আদ্র। মুখে প্রকাশ না করলেও আজ সে সত্যিই ভয় পেয়ে গেছিল। এই মেয়েটাকে হারানোর ভয় তার হৃদয়ে জেঁকে বসেছিল। শুধুমাত্র সৃষ্টিকর্তার অশেষ রহমতে তারা আজ সুস্থ, নিরাপদ। বাকি রইল দেহের ক্ষত সে তো অল্প সময়েই ঠিক হয়ে যাবে।
*****
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে সময়টা ভোররাত। আদ্র রাকিবকে ফোন করে জানিয়েছে লিজাকে তাদের বাড়িতে নিয়ে যেতে। তারা একটু পিছনে পড়ে গেছে, তাই ফিরতে লেট হবে। রাতের ব্যাপারটা সে সম্পূর্ণ চেপে গেছে। আপাতত রাকিবের সাথে দেখা হলে সে এই নিয়ে ডিসকাস করবে। এখন অযথায় আর টেনশন দিতে চাইছে না। আরু!
গাড়ি ঠিক হলেই আমরা বেরিয়ে পড়বো। আর শোন বাড়িতে কাউকে কিছু বলার দরকার নেই এই বিষয়ে। অযথায় টেনশন করবেন ওরা।
কাউকে বলবনা। তুই চিন্তা করিসনা। গাড়ি ঠিক হলে যথাসময়ে তারা বেরিয়ে পড়ল কলকাতার উদ্দেশ্যে।
চলবে.....