02/05/2025
collected post
এই লোকটাকে দেখতে মনে হচ্ছে না—কত সুন্দর নূরানী চেহারা! নিশ্চয়ই একজন আলিম হবেন! আল্লাহ ওয়ালা কেউ! কিন্তু এই লোক একটা বিশ্ব প্রতারক।
এক চিল্লার জন্য বের হয়েছিলো আমার ছোট ভাই। তাদের জামায়াতে সেই একমাত্র আলিম ছিলো। আর বাকি সবাই মুরুব্বি। ঈশার নামাজের পরে বয়ান করতেছিলো। এরমধ্যে এই লোক মসজিদে প্রবেশ করে। চারপাঁচ দিন এভাবে মসজিদে তালিমে বসে। একদিন তালিমের ফাঁকে সামনে এসে জিজ্ঞেস করে বাবাজি তোমার নাম কী?
‘আশিক এলাহী।’
লোকটা বলে, ‘ঠিক তোমার মতো দেখতে আমার একটা ছেলে আছে। তোমার মতোই মাথায় বাবরিচুল। চেহারাও কিছুটা তোমার মতো। তার ছেলের ছবি দেখালো। আসলেই ছেলেটা দেখতে আশিকের মতো ছিলো কিছুটা।
আমার ছেলে মদিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়ে। এভাবে কয়েকদিন ভাইয়ের সাথে এই লোকের আলাপচারিতা হয়। বাসা কোথায়, বাবা কী করে, কয় ভাইবোন, তার ফিউচার প্ল্যান কী? আশিক সবকিছু উত্তর দেয়।
লোকটা বলে সে আমেরিকার বুস্টান শহরে থাকে। তখন আমার ভাইয়েরও নিউইয়র্কে যাওয়ার কথাবার্তা হচ্ছিলো। কিন্তু সেটা ফাইনাল ছিলো না।
এসব কথাবার্তা বলার দুইতিন দিন পরে বলল, বুস্টান শহরে তার শ্বশুরের একটা মসজিদ আছে। শ্বশুর আমেরিকান। সেই মসজিদের ইমাম সাহেব বৃদ্ধ হয়ে অসুস্থ হয়ে পড়ায় এখন ইন্সট্যান্ট ইমাম নিবে। আমার ভাইয়ের তেলাওয়াত শুনে তার ভালো লাগে। তারপর সে প্রস্তাব দেয় আমি চাই তোমাকে বুস্টানে নিয়ে যেতে। সেরকম খরচ লাগবে না।
তারপর লোকটা বলে এসব কথাবার্তা তো মসজিদে বসে বলা যায় না, চলো আমরা কোনো রেস্টুরেন্টে বসি। তার ব্যবহার, কথাবার্তা এতটা অমায়িক ছিলো যে কেউ তার ভক্ত হতে বাধ্য৷ তারপর রেস্টুরেন্টে নিয়ে চাউমিন খেতে দেয়। ভাই বলে আঙ্কেল আমি এটা খেতে পারবো না। লোকটা এমনভাবে অনুরোধ করলো তারপর সে বাধ্য হলো খেতে।
আমার ভাইয়ের থেকে আব্বুর নাম্বার নিলো লোকটা। তারপর আব্বুকে সব খুলে বলল। জানিনা লোকটার কথায় কী জাদু ছিলো, আমার জ্ঞানী আব্বুও এই লোকের কথা বিশ্বাস করে নেয়। কেমন যেন জিম্মি হয়ে যায়।
আমার ভাইকে যদি বলা হতো লোকটার বাসা কোথায়, তার আত্মিয়স্বজন কে কে আছে খোঁজ নিতে সে কেন যেনো রেগে যেতো। তারপর পাসপোর্ট করলো। বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা যেতে নাকি অনেক কাটখোড় পোহানো লাগবে, দালালরা অনেক টাকা খাবে। এজন্য দিল্লি থেকে যেতে চাইলো। যেখানে আমেরিকা যেতে ২৫/৩০ লাখ লেগে যায় সেখানে ১৫ লাখ লাগবে। কারণ লোকটা ফ্যামিলি ভিসায় নিতে চেয়েছে।
বিশ্বাস করার অনেক কারণ ছিলো, সে ওমরা গিয়ে কাবা ঘরের সামনে, তাওয়াফ করার সময়, সায়ী করার সময়, মদিনা গিয়ে আমার আব্বুর সাথে, ভাইয়ের সাথে ভিডিও কলে কথা বলতো। কাবার গিলাফের কাছে গিয়ে বলেছে ভাইজান চিন্তা করবেন না আপনার ছেলেকে আমি আমার নিজের সন্তানের মতো জানি। বিশ্বাস অর্জনের জন্য যা যা লাগে সব করেছে সে।
দেশে এসে আমার ভাইকে সে বলল, ভাইপো, আমাকে চিংড়ি মাছ গিফট করো। আমাদের এলাকা চিংড়ির জন্য বিক্ষাত। আমার দয়ালু বাবা ১৫ কেজি গলদা চিংড়ি উপহার দেয়। সেটা নাকি সে আমেরিকা পাঠাবে।
তারপর ভিভো নতুন ফোন কিনালো, এটা নাকি লাগবে এম্বাসিতে দেখানোর জন্য। ব্লাড কানেক্টেড ছাড়া অন্য কারো সাথে কথা বলা যাবে না। কারণ দিল্লির চেকপোস্টে এগুলো চেক করে। এগুলো মাথার উপর দিয়ে যায় আমাদের। ভিসা নেওয়ার সময় এম্বাসিতে নতুন ফোন জমা দিতে হবে। প্রথম পর্যায়ে ব্যাংকের মাধ্যমে ৫ লাখ টাকা পাঠায়। এটা ভিসার কাজে লাগবে। যা যা করানো লাগে সবই করে, মেডিকেল থেকে শুরু করে যাবতীয় সবকিছু ঢাকা থেকে করে। কিন্তু ভিসাটা দিল্লি থেকে করতে হবে। দিল্লি হয়ে গেলে সুবিধা।
লোকটা বারবার বলতো, বাংলাদেশের মানুষ হলো কুত্তা। এরা টাকার কুত্তা। সব দালাল, সব জায়গায় ঘুষ খায়। বলতো, ঘুষ আমি খাবো না। এসব আমি পছন্দ করি না। খাবারও বেছে চলতো। এমনভাবে বলতো মনে হতো সে একজন আল্লাহর ওলী।
৫ লাখ টাকা ডলার করে বেনাপোল থেকে দিল্লিতে যায়। সেখানে একটা হটেল বুকিং করে আশিককে রাখে। সেখানে মিট আইটেম কিছুই যেন না খায় সে ব্যাপারে সতর্ক করতো। মাছ সবজী এসব যেন খায়। মাংস তো হালাল হবে না।
দিল্লি এম্বাসিতে ঢোকার সাথে সাথে সেখানে চেক করে বলে এগুলো কিসের ডলার? এটা বলার সাথে সাথে এই লোকটা ভাইয়ের থেকে ডলার গুলো নিয়ে বলে এগুলো কিছু না। এই ছেলেটা আমার রিলেটিভ। ভিসা হতে তিনদিন লাগবে। কোনো সমস্যা নেই সবই ঠিক আছে।
তিনদিন দিল্লিতে বসে কী করবে এজন্য লোকটা ট্যুরিস্ট বাস বুকিং করে বলে, ‘আশিক, আজ সারাদিন দিল্লি শহর ঘুরে দেখো। একা একা ভালো লাগবে না। লোকটা নিজের সাথে আশিককে রাখলো না। কারণ লোকটার সাথে তার স্ত্রী ছিলো। স্ত্রী হলো আমেরিকান মহিলা। আগে অমুসলিম ছিল, পরে মুসলিম হয়ে এই লোককে বিবাহ করে। তার স্ত্রী আসার কারণ হলো সে যেহেতু সরাসরি আমেরিকান এজন্য ভিসা হতে সময় লাগবে না।
সারাদিন দিল্লিতে ঘুরে রাতে হোটেলে ফিরে চোখটা লেগে আসে আশিকের৷ রাত ২ টার সময় তার ফোনে ম্যাসেজ আসে, বাবাজি আমার শ্বাশুড়ি মারা গেছে, সে তো অসুস্থ ছিলো কয়েকমাস ধরে। তোমার আন্টিই তাদের একমাত্র মেয়ে। তোমার আন্টি একদম ভেঙ্গে পড়েছে। এজন্য তাকে নিয়ে ইন্সট্যান্ট টিকিট কেটে আমেরিকা চলে যাচ্ছি। ইনশাআল্লাহ ৩ মাস পরে এসে আমরা তোমাকে নিয়ে যাবো। আমার ভাই তো তখন সর্বশান্ত। তার হাতে ২ হাজার টাকা ছাড়া কিছু নেই। বাংলাদেশ থেকে টাকা পাঠানোর পরে সে দেশে আসে।
তারপর ৩ মাস গেলো, তখন আরেকটা অযুহাত দেখালো। একবার তার শ্বাশুড়ি মরলো, আরেকবার তার বউ অসুস্থ হলো, শেষে তার হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ম্যাসেজ আসলো, ‘বাবাজি আমি তোমার আঙ্কেলের বোন ফুপু বলতেছি। তোমার আঙ্কেল মারা গেছে। আমরা তোমাদের ১০ লাখ টাকা ফেরত দিতে চাই। ব্যাংক আকাউন্টের নাম্বার পাঠাও, আমার ভাই একাউন্ট নাম্বার পাঠালো। আজ দেব, কাল দেব করে দেয়নি।
যে ম্যাসেজ এসেছিলো সেই ম্যাসেজের ধরণ এই লোকের ম্যাসেজের মতোই ছিলো। সে মারা গেলো কী করে!
এই খবর শোনার পরে আমার ভাই, আব্বু ভেঙ্গে পড়েছিলো একদম। আমার মনে হচ্ছিলো, কী যেন হয়ে গেলো। কয়েকমাস আমাদের পরিবার একটা ট্রমার ভেতর ছিলো। তাদের বিরুদ্ধে কী পদক্ষেপ নিবে! কোনো পদক্ষেপই নেয়নি। খোঁজ নিয়ে যেটা বের হয়, লোকটার নাম বলেছিলো আব্দুর রহমান। কিন্তু ব্যাংক একাউন্টে নাম ছিলো হেলাল উদ্দীন। এটা একটা গ্যাং, যার সাথে অনেক হিন্দু জড়িত।
আমাদের এসবে যখন সন্দেহ হতো তখন বলতাম লোকটা যদি ফ্রড হয়? এই কথা বললে আমার ভাই এবং আব্বু দুজনই কেনো যেন রেগে যেতো। এখানে রেগে যাওয়ার কোনো কারণ আছে বলে মনে হয় না। আমার আব্বু কখনোই কাউকে এভাবে বিশ্বাস করে টাকা দেয়নি। এই লোকটাকে কেনো বিশ্বাস করলো তিনি এখনো বুঝে উঠতে পারেননা। আমার ভাই তো এক প্রকার উন্মাদ ছিলো। তার আচরণ ছিলো অন্যরকম।
আমাদের অনেক আত্মিয়স্বজন আমেরিকা আছে। জেঠা, মামাদের অনেকেই আছে। আব্বু তাদের সাথেও শুরুতে এই লোকের কথা বলে, তারাও বলল হয়তো ভালো হবে। কিন্তু এত বড় ফাঁদ বুঝলো না। লেবাস আর কথায় বিশ্বাস করেছে। সে নিজেকে আলিম পরিচয় দিয়েছিলো। কথাবার্তাও আলিমের মতোই ছিলো।
শেষে একটাই সান্ত্বনা তারা আমার ভাইকে দিল্লি নিয়ে মেরে ফেলেনি এটাই অনেক। টাকা গেছে এটা পরোকালে পাবোই৷ ভাই যে সুস্থসবলে ফিরে এসেছে এটাই অনেক।
আমাদের জন্য একটা শিক্ষা—লেবাস আর মিষ্টি কথা দেখে আমরা গলে যাই। আল্লাহ ভিরুতা দেখে আমরা ওলী ভাবি, কাবা ঘরের গিলাফ ধরেও বিশ্বাস নিয়ে যে খেলে সে সাক্ষাত একটা কাঞ্জুস, মুনাফিক। আল্লাহ এসব মুনাফিকদের বিচার নিজ হাতে করবেন।
Fatima Afrin