12/08/2025
পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০: প্রেক্ষাপট, বৈশিষ্ট্য ও সমকালীন প্রাসঙ্গিকতা
পার্বত্য চট্টগ্রাম, বাংলাদেশের এক-দশমাংশ ভূখণ্ড জুড়ে বিস্তৃত এক বৈচিত্র্যময় ও সংবেদনশীল অঞ্চল। এর ভূ-প্রকৃতি, সমাজব্যবস্থা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য সমতলভূমি থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই ভিন্নতাকে স্বীকার করে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক সরকার ১৯০০ সালে এক বিশেষ আইন প্রণয়ন করে, যা ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম শাসনবিধি, ১৯০০’ বা ‘চিটাগং হিল ট্র্যাক্টস রেগুলেশন, ১৯০০’ (Act I of 1900) নামে পরিচিত। এই আইনটি ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ভূমি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য রক্ষার একটি আইনি বর্ম এবং একই সাথে এই অঞ্চলে ব্রিটিশ প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার এক অনন্য কৌশল। এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হলো পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০-এর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট, মূল বৈশিষ্ট্য, উদ্দেশ্য এবং সময়ের বিবর্তনে এর কার্যকারিতা ও বর্তমান প্রাসঙ্গিকতা বিশ্লেষণ করা।
ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট:
১৮৬০ সালে ব্রিটিশরা পার্বত্য চট্টগ্রামকে ব্রিটিশ ভারতের অংশ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করে। কিন্তু এই অঞ্চলের দুর্গম ভৌগোলিক অবস্থান এবং এখানকার জুম্ম জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র জীবনধারা ব্রিটিশদের জন্য এক নতুন প্রশাসনিক চ্যালেঞ্জ তৈরি করে। প্রথমদিকে, ব্রিটিশরা সমতলের মতোই সাধারণ আইনকানুন প্রয়োগের চেষ্টা করে, যা স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সাথে সংঘাতের জন্ম দেয়। বিশেষ করে কুকি ও লুসাই জনগোষ্ঠীর ক্রমাগত আক্রমণ ব্রিটিশ প্রশাসনকে ভাবিয়ে তোলে। তারা উপলব্ধি করে যে, এই অঞ্চলের শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে হলে একটি বিশেষায়িত প্রশাসনিক কাঠামো প্রয়োজন, যা স্থানীয় প্রথা ও ঐতিহ্যকে সম্মান করবে।
এই উপলব্ধির ফলশ্রুতিতে বেশ কিছু পরীক্ষামূলক পদক্ষেপের পর ১৯০০ সালের ১লা মে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০’ কার্যকর করা হয়। এর প্রধান স্থপতি ছিলেন ক্যাপ্টেন টি. এইচ. লুইন (Captain T.H. Lewin), যিনি এই অঞ্চলের মানুষের জীবনযাত্রা গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করেছিলেন। এই রেগুলেশন প্রণয়নের মাধ্যমে পার্বত্য চট্টগ্রামকে একটি ‘Excluded Area’ বা ‘ব্যতিক্রমী এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়, যার অর্থ হলো ব্রিটিশ ভারত বা বাংলার সাধারণ আইনসমূহ এখানে সরাসরি প্রযোজ্য হবে না।
রেগুলেশনের মূল উদ্দেশ্য :
এই শাসনবিধি প্রণয়নের পেছনে ব্রিটিশদের দ্বিমুখী উদ্দেশ্য ছিল:
১. প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা: একটি স্বল্প খরচে ও কার্যকর প্রশাসনিক ব্যবস্থার মাধ্যমে এই অস্থির অঞ্চলকে নিয়ন্ত্রণে আনা এবং রাজস্ব (বিশেষত জুম কর) আদায় নিশ্চিত করা।
২. আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে সুরক্ষা প্রদান: সমতলের বাঙালি মহাজন ও ব্যবসায়ীদের অর্থনৈতিক শোষণ এবং ভূমি আগ্রাসন থেকে আদিবাসী জুম্ম জনগণকে রক্ষা করা। ব্রিটিশরা মনে করেছিল যে, আদিবাসীরা সরল প্রকৃতির হওয়ায় আধুনিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থার সঙ্গে тя тя тя тя тя পাল্লা দিতে পারবে না, তাই তাদের জন্য একটি সুরক্ষা বলয় তৈরি করা প্রয়োজন।
রেগুলেশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য ও বিধানসমূহ :
পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ ছিল একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ আইন, যা এই অঞ্চলের প্রশাসন, ভূমি ব্যবস্থাপনা, বিচার ব্যবস্থা এবং সামাজিক কাঠামোকে নিয়ন্ত্রণ করত। এর প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো নিম্নরূপ:
১. বিশেষ প্রশাসনিক কাঠামো:
রেগুলেশন অনুযায়ী, পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রশাসনিক প্রধান ছিলেন একজন ডেপুটি কমিশনার (DC)। তাকে সহায়তা করার জন্য তিনজন সার্কেল চিফ বা রাজা (চাকমা রাজা, বোমাং রাজা ও মং রাজা), প্রতিটি মৌজার জন্য একজন হেডম্যান এবং গ্রামের জন্য কারবারি নিয়োগ করা হতো। এই ত্রি-স্তরীয় প্রথাগত প্রশাসনিক কাঠামোকে আইনি স্বীকৃতি দেওয়া হয়, যা ছিল ব্রিটিশদের ‘পরোক্ষ শাসন’ (Indirect Rule) নীতির এক চমৎকার উদাহরণ। ডেপুটি কমিশনারের হাতে ব্যাপক ক্ষমতা থাকলেও দৈনন্দিন শাসনকাজে রাজারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতেন।
২. ভূমি ব্যবস্থাপনা ও অধিকার:
এই রেগুলেশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল ভূমি ব্যবস্থাপনার নিয়মকানুন।
জমির মালিকানা: পার্বত্য চট্টগ্রামের সমস্ত জমির মালিকানা রাষ্ট্র বা সরকারের হাতে ন্যস্ত করা হয়। আদিবাসী জনগণ জমিতে স্থায়ী মালিকানা পেত না, বরং তাদের ভোগদখলের প্রথাগত অধিকার (Customary Rights) স্বীকার করে নেওয়া হয়।
অ-আদিবাসীর কাছে ভূমি হস্তান্তর নিষিদ্ধ: রেগুলেশনের ৩৬ নম্বর ধারায় স্পষ্টভাবে বলা হয় যে, ডেপুটি কমিশনারের পূর্বানুমতি ছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের কোনো জমি কোনো অ-আদিবাসী বা বহিরাগতের কাছে হস্তান্তর, বিক্রয় বা ইজারা দেওয়া যাবে না। এই বিধানটি ছিল আদিবাসীদের ভূমি সুরক্ষার মূল ভিত্তি।
৩. বিচার ব্যবস্থা:
পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য একটি পৃথক বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। দেওয়ানি এবং ছোটখাটো ফৌজদারি মামলার নিষ্পত্তির ক্ষমতা সার্কেল চিফ ও হেডম্যানদের দেওয়া হয়, যারা মূলত স্থানীয় প্রথাগত আইন (Customary Law) অনুযায়ী বিচার করতেন। গুরুতর অপরাধের বিচার করতেন ডেপুটি কমিশনার। এর ফলে প্রচলিত ব্রিটিশ ভারতীয় বিচার ব্যবস্থা থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা রাখা সম্ভব হয়েছিল।
৪. বহিরাগতদের প্রবেশে নিয়ন্ত্রণ:
পার্বত্য চট্টগ্রামে বহিরাগতদের প্রবেশ, বসবাস এবং ব্যবসা-বাণিজ্যের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়। ডেপুটি কমিশনারের অনুমতি ছাড়া কোনো অ-পার্বত্য বাসিন্দা এই অঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসবাস বা ব্যবসা করতে পারতেন না। এর উদ্দেশ্য ছিল অঞ্চলের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক ভারসাম্য রক্ষা করা এবং আদিবাসী সংস্কৃতিকে বাইরের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা।
৫. রাজস্ব আদায়:
রাজস্ব আদায়ের প্রধান উৎস ছিল জুম চাষের ওপর ধার্য করা কর। এই কর আদায়ের দায়িত্ব ছিল হেডম্যানদের, যারা আদায়কৃত কর সার্কেল চিফের মাধ্যমে সরকারি কোষাগারে জমা দিতেন।
ঔপনিবেশিক শাসনের পর রেগুলেশনের অবনমন
১৯৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাকিস্তান এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ আমলে এই রেগুলেশনের কার্যকারিতা ধীরে ধীরে ক্ষয় হতে শুরু করে।
পাকিস্তান আমল: পাকিস্তান সরকার পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ মর্যাদাকে উপেক্ষা করতে শুরু করে। ১৯৬২ সালের সংবিধানে এই অঞ্চলকে ‘উপজাতীয় এলাকা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও রেগুলেশনের স্বকীয়তা খর্ব করা হয়। সবচেয়ে বড় আঘাত আসে কাপ্তাই বাঁধ নির্মাণের মাধ্যমে। ১৯৫৭ থেকে ১৯৬২ সালের মধ্যে নির্মিত এই বাঁধের ফলে প্রায় ৫৪,০০০ একর উর্বর কৃষি জমি (যা মোট কৃষি জমির ৪০%) এবং ৪০,০০০ আদিবাসী পরিবার তাদের ভিটেমাটি থেকে উচ্ছেদ হয়। এটি ছিল রেগুলেশনের ভূমি সুরক্ষা নীতির সরাসরি লঙ্ঘন।
বাংলাদেশ আমল: ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর ১৯৭২ সালের সংবিধানে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিশেষ কোনো স্বীকৃতি রাখা হয়নি। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারণার ওপর ভিত্তি করে প্রণীত এই সংবিধানে আদিবাসীদের স্বতন্ত্র পরিচয় উপেক্ষিত হয়। পরবর্তীকালে বিভিন্ন সময়ে রেগুলেশনে এমন কিছু সংশোধনী আনা হয়, যা এর মূল উদ্দেশ্যকে ব্যাহত করে। বিশেষ করে, সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় আশির দশকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ব্যাপকভাবে বাঙালি বসতি স্থাপন করানো হয়, যা এই অঞ্চলের জনসংখ্যাতাত্ত্বিক কাঠামোকে পুরোপুরি বদলে দেয় এবং ভূমি নিয়ে সংঘাতকে তীব্র করে তোলে। এই সময় থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামে দীর্ঘ দুই দশকের সশস্ত্র সংঘাতের সূচনা হয়।
পার্বত্য শান্তি চুক্তি ও বর্তমান প্রেক্ষাপট:
দীর্ঘ রক্তক্ষয়ী সংঘাতের অবসানের লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালের ২রা ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকার এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির মধ্যে ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম চুক্তি’ স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তিতে পার্বত্য চট্টগ্রামকে ‘উপজাতীয় অধ্যুষিত অঞ্চল’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং এর প্রশাসনিক কাঠামোতে বড় ধরনের পরিবর্তন আনা হয়। চুক্তির আলোকে পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ এবং তিনটি পার্বত্য জেলা পরিষদ (রাঙ্গামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবান) গঠিত হয়। এই পরিষদগুলোকে ভূমি ব্যবস্থাপনা, আইন-শৃঙ্খলা, উন্নয়নসহ বিভিন্ন বিষয়ে ক্ষমতা অর্পণ করার কথা বলা হয়েছে।
চুক্তি পরবর্তী সময়ে ১৯০০ সালের রেগুলেশনের আইনি বৈধতা নিয়ে বিতর্ক তৈরি হয়। একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১০ সালে এই রেগুলেশনকে ‘মৃত আইন’ (Dead Law) বলে রায় দেয়। তবে আপিল বিভাগ এই রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ জারি করে, ফলে আইনগতভাবে এটি এখনও কার্যকর। বাস্তবে, পার্বত্য জেলা পরিষদ আইন এবং আঞ্চলিক পরিষদ আইন প্রণীত হওয়ার পর রেগুলেশনের অনেক বিধানই কার্যকারিতা হারিয়েছে। কিন্তু ভূমি ব্যবস্থাপনার মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে জেলা পরিষদগুলোকে পূর্ণ ক্ষমতা না দেওয়ায় এবং চুক্তির অনেক ধারা বাস্তবায়িত না হওয়ায় এখনও ১৯০০ সালের রেগুলেশনের প্রাসঙ্গিকতা রয়ে গেছে।
উপসংহার:
পার্বত্য চট্টগ্রাম রেগুলেশন, ১৯০০ ছিল একটি ঐতিহাসিক দলিল, যা একটি নির্দিষ্ট সময়ের প্রয়োজনে ঔপনিবেশিক প্রেক্ষাপটে তৈরি হয়েছিল। এর মধ্যে যেমন ছিল সুরক্ষার paternalistic দৃষ্টিভঙ্গি, তেমনি ছিল নিয়ন্ত্রণের সাম্রাজ্যবাদী কৌশল। এটি একদিকে যেমন প্রায় অর্ধশতাব্দী ধরে পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসী সমাজ ও সংস্কৃতিকে বাইরের আগ্রাসন থেকে রক্ষা করেছিল, তেমনি তাদের জাতীয় মূল স্রোত থেকে বিচ্ছিন্নও করে রেখেছিল।
স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় নীতির কারণে এই রেগুলেশন তার কার্যকারিতা হারালেও এর মূল চেতনা—অর্থাৎ আদিবাসীদের ভূমি, সংস্কৃতি ও প্রথাগত অধিকারের স্বীকৃতি—এখনও পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। পার্বত্য শান্তি চুক্তির মাধ্যমে এই চেতনাকেই একটি আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রূপ দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছে। তাই, ১৯০০ সালের রেগুলেশন আজ আর সক্রিয় আইন হিসেবে পূর্ণাঙ্গভাবে কার্যকর না থাকলেও, এর ঐতিহাসিক তাৎপর্য এবং এর মধ্যে নিহিত ভূমি ও আত্মপরিচয়ের অধিকারের দাবি পার্বত্য চট্টগ্রামের জুম্ম জনগোষ্ঠীর কাছে এখনও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। এই ঐতিহাসিক আইনের যথাযথ মূল্যায়ন ও এর মূলনীতিগুলোর সম্মানজনক বাস্তবায়নই পারে পার্বত্য চট্টগ্রামে স্থায়ী শান্তি ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে।