03/02/2023
এক সময় মক্কা-মদিনার অধিকাংশ আবাসিক হোটেল মহররম থেকে শাবান পর্যন্ত ইরানিদের কাছে ভাড়া থাকত ৷ বাদশাহ সালমান ক্ষমতায় আসার পর বিভিন্ন ইস্যুতে মনোমালিন্যের জের ধরে ইরান সৌদিকে শিক্ষা দেওয়ার জন্য হজ্ব এবং ওমরাহ্তে আসা বন্ধ করে দেয় ৷ আমাদের দেশের অনেকে মনে করেন, সৌদি আরব হজ্ব ও ওমরাহ থেকে বিশাল অংক আয় করছে ৷ তারা মনে করেন, হজ্ব ও ওমরাহ্ বন্ধ হলে সৌদি ইয়াহুদি দালালরা (তাদের ভাষায়) বিশাল একটা শিক্ষা পাবে ৷ ব্যাপারটা মসজিদ কমিটির সাথে রাগ করে মসজিদে যাওয়া বন্ধ করার মতো ৷
"হজ্জ থেকে কত টাকা আয় করে সৌদি আরব?" এই শিরোনামে বিবিসির ফার্সি বিভাগের আলী কাদিমি ৩ আগস্ট ২০১৭ তে এক বিশেষ প্রতিবেদন তৈরি করে ৷ আর আমাদের দেশের সবগুলো পত্রিকা এটি কপি করতে থাকে ৷ যারা এসব পড়েই প্রচার শুরু করেন তারা একটুও ভাবেন না এই মিডিয়া কার? সাংবাদিক কে? ইরানের জরাথুস্ট্রীয়দের (এরা অগ্নি পূজারী) নাম অনেকটা মুসলমানের মত হওয়ায় এদের নাম শোনে ধর্ম বোঝা যায় না ৷ আলী কাদমি শিয়া, না সুন্নী মুসলিম, না জরাথুস্ট্রীয়?
হজ্ব থেকে সৌদি আরবের আয় নিয়ে কুয়েতে নিযুক্ত সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূত ড. আব্দুল আজিজ আল ফায়েজ বলেন, "সৌদি আরব হজ্জ ভিসার কোন বিনিময় নেয় না, ভিসা সম্পূর্ণ রূপে ফ্রি, আমরা জানতে পেরেছি কিছু অসৎ এজেন্সি মালিক হাজীদের কাছ থেকে ফি নিচ্ছে সৌদি এ্যাম্বাসির কথা বলে, যারা এর বিনিময় নেয় এবং দাবি করে সৌদি এ্যাম্বাসি ভিসার ফি নিচ্ছে তারা চোর ৷"
হজ্ব এবং ওমরাহ্ বাবত সৌদি আরব কোন অর্থ নেয় কিনা এটি জানার জন্য আপনি, hajj & umrah লিখে গুগলে সার্চ দিতে পারেন ৷ এছাড়া সৌদি আরবের বিভিন্ন পেজে খোঁজ নিতে পারেন ৷ হজ্জ ও ওমরাহ্ থেকে সৌদি আরবের রাজস্ব আয় শুধুমাত্র ৩% । আর সর্বশেষ হারাম শরীফের সংস্কারে ব্যয় এর থেকেও বেশি । হজ্জের সময় আড়াই লক্ষ সৈন্য, ৩০ হাজার পরিচ্ছন্ন কর্মী, ৬০ হাজার কর্মকর্তা, ১৮ হাজার হাজীদের জন্য যানবাহন, শত শত এ্যাম্বুলেন্স ও হাজার হাজার স্বাস্হ্যকর্মী এবং ব্যবস্হাপনার জন্য ডজন খানেক হেলিকপ্টার নিয়োগ করে । যারা মনে করতেন হজ্জ সৌদি আরবের রাজস্বের উৎস, করোনাকালীন সময়ে সৌদি কর্তৃপক্ষ হজ্ব ও ওমরাহ্ বন্ধ রেখে তাদের সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণ করে দিয়েছে ৷
হজ্ব ও ওমরাহ্ নিয়ে আমাদের দেশের মানুষ প্রায় সময় সে প্রশ্নটা করে থাকেন, "হজ্ব-ওমরাহ্ ভিসার জন্য যদি সৌদি সরকার টাকা পয়সা না রাখে তাহলে, বাংলাদেশ থেকে যেতে লক্ষ লক্ষ টাকা লাগে কেন?"
এই টাকা মুলত যারা হজ্ব ও ওমরাহ্ এজেন্সির দায়িত্বে আছেন তারা নিয়ে থাকেন, হাজীদের নানা ধরনের সুযোগ সুবিধার বিনিময়ে । বিমানের টিকেটের দাম, মক্কা মাদিনাতে থাকা, খাওয়া+ যাতায়াত খরচ বাবত ৷ এখানে আমাদের দেশে বেশি অর্থ আদায় করা হচ্ছে কি না, তা একটু দেখার বিষয় ৷ ইন্ডিয়া থেকে একজন লোক ১৫ দিনের প্যাকেজে ওমরাহ্ করতে আসলে তার খরচ হয় মাত্র পঞ্চান্ন থেকে পঁয়ষট্টি হাজার রুপি (১ রিয়াল=১৮ রুপি) ৷ পাকিস্তান থেকে একই প্যাকেজে খরচ হয় পঁচাত্তর থেকে আশি হাজার রুপি (১ রিয়াল= ৩০ রুপি) ৷ বাংলাদেশ থেকে এক সপ্তাহের প্যাকেজে খরচ হয় সর্বনিম্ম আশি হাজার টাকা ৷
কারেন্সীর হিসাবে তিনদেশের খরচটা প্রায় সমপর্যায়ের হলেও ফারাকটা অন্যখানে ৷ পঁয়ষট্টি হাজার রুপির মাঝে ইন্ডিয়ান একজন হাজীকে তিন বেলা খাবার দেওয়া হয় ৷ সকালের খাবারের আইটেমে থাকে দুধ, কর্ণ, মধু, জেলি, পরোটা, পাউরুটি, পায়া, সব্জী, ডিম, চা ৷ দুপুরে- ভাত, সব্জী, গরু বা মুরগীর মাংশ, ডাল, ক্ষীর, ফল, চা; রাতেও প্রায় একই মেনু ৷ এর মাঝে এজেন্সীর পক্ষ থেকে দুই বা তিন বার তাদের কাপড়গুলো লন্ড্রী থেকে ওয়াশ করে আনা হয় ৷ পাকিস্তানিদের খাবারে অত আইটেম না থাকলেও ভাত, মাংশ, ডাল, চা থাকে ৷ আমাদের সমস্যাটা কোথায়? সেটা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন ৷
কেয়ার টেকার সরকারের সাবেক সেনা প্রধান মইন ইউ আহমেদ তার "শান্তির স্বপ্নে সময়ের স্মৃতিচারণ" গ্রন্থে আফসোস করে বলেছিলেন, "বাংলাদেশে প্রায় দুইশত ত্রিশটি হজ এজেন্সী আছে ৷ এসব এজেন্সির মধ্যে ২০০৭ সালে বিভিন্ন অনিয়মের জন্য পঁচাশিটি হজ এজেন্সীর বিরূদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ উত্থাপিত হয় ৷ এসব অভিযোগ তদন্তের পর পঁয়ষট্টিটি এজেন্সি অভিযুক্ত হয়ে শাস্তির মুখোমুখি হয়েছিল ৷ কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য যে, অভিযুক্ত এজেন্সিগুলোকে বাঁচাতে হ্যাব (হজ অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ) শাস্তি প্রত্যাহারে সরকারকে বাধ্য করতে ২০০৮ সালে হজ বয়কট করার হুমকি দেয় ৷ হাজিদের দূর্দশা লাঘবে তারা কোনো ভূমিকা রাখে নি কিন্তু নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় ঠিকই একত্রিত হয়েছিলো ৷ অর্থলিপ্সা আমাদের এমনই যে, এজন্য আমরা আমাদের ধর্মবিশ্বাসকে ব্যবহার করতেও কুন্ঠাবোধ করি না ৷"
কোন দেশ বা কেউ যদি মনে করেন যে, হজ্ব-ওমরাহ্ বন্ধ হলে সৌদি সরকার না খেয়ে মারা যাবে তিনি ভুল ভাবছেন ৷ করোনাকালীন সময়ে হজ্ব ও ওমরাহ্ বন্ধ থাকায় মক্কা ও মদিনার আশেপাশের আবাসিক হোটেলে কর্মরত অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যাওয়ায়, তাদের স্ব স্ব দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে ৷ এতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে সেখানে কর্মরত বাংলাদেশী শ্রমিকরা ৷ সৌদি আরবের যে কোন প্রকার ক্ষতি যে প্রত্যক্ষভাবে আমাদের আঘাত হানবে, তা আমাদের দেশের যারা সৌদি সম্পর্কে বিরূপ ধারণা পোষণ করেন তাদের অনেকের কল্পনারও বাইরে ৷
রাজনৈতিক আদর্শ আর ধর্মীয় আদর্শ দু'টো ভিন্ন বিষয়৷ দু'টোকে এক করতে গিয়ে অনেকে দুধ আর ছনা মিশিয়ে ফেলেন ৷ না হতে পারে ধার্মিক, না হতে পারে রাজনীতিবিদ ৷ আমাদের দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের আলেমদের লেজে গোবরে অবস্থা! এদের অনেকেই বিভিন্ন ট্রাভেল এজেন্সীর ব্যবসার সাথে জড়িত ৷ দূর্নীতিটা যে বাংলাদেশের এজেন্সী থেকে হচ্ছে ওরা ভালো করেই জানে ৷ কমিশন কমে যাবে তাই হজ অ্যাসোসিয়েশনের দূর্নীতি নিয়ে কিছু বলবে না ৷ সাধারণ মানুষকে বুঝিয়ে দেয় সব সৌদি আরবের সরকারের কারসাজি ৷ আমাদের দেশে সব ফেরেশতার বসবাস ৷
সাধারণ মানুষের কথা যদি বলি হাজীদের সতর্ক করার দায়িত্ব নিয়ে সৌদি সরকার হজ্ব, ওমরাহ্, তাওহীদ, নামায পড়ার নিয়ম সহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে বই প্রকাশ করে সেগুলো বিভিন্ন ভাষায় অনুবাদ করে বিনামূল্যে বিতরণ করে থাকে ৷ হাজী সাহেব লক্ষ টাকা খরচ করে ওমরাহ্ করছেন, ৫০-৬০ কেজি মাল নিয়ে দেশে যাচ্ছেন, তার কাছে আপনি কখনো ৫০০ গ্রামের একটা বই পাবেন না ৷ কারণ আমাদের অত কিছু জানার দরকার নেই ৷ হুজুর বলেছেন, নেতা বলেছেন, আমির বলেছেন, চিলে কান নিয়ে গেছে, আমাকে চিলের পিছনে ছুটতে হবে ৷
লিখেছেন- ✒️🖊️ 'Sayedur Rahman'