18/07/2020                                                                            
                                    
                                                                            
                                             #আরশি_জ্বীননাত
 #পর্ব_০৪_০৫
আস্থা রাহমান শান্ত্বনা (দ্বীনের গল্প)
"একটা আয়নার জ্বীন আমার পিছনে পড়েছে। এর থেকে কিভাবে মুক্তি পাব বুঝতে পারছিনা।" নেওয়ালের কথা শুনে প্রিয়া অবাক হয়ে বলল, "হুশে আছিস! কি আবোল-তাবোল কথা বলছিস! এসব বলতে কিছু হয় নাকি। জ্বীন তাও আয়নার তোর পিছনে কেন পড়বে?"
-- জানতাম বিশ্বাস করবিনা, কিন্তু এটা সত্যি। এই যে আয়নাটা দেখছিস এটা থেকে জ্বীনটা বের হয়। আমার রুপ ধরে আমার সামনে আসে, কথা বলে।
প্রিয়া ভালো করে আয়নার দিকে তাকিয়ে বলল, "তোর মাথা খারাপ হয়ে গেছে, আয়নায় জ্বীন থাকতে পারে! আর যদি থাকত ও সে এখন বেরিয়ে আসতনা।"
-- তুই যে তখন বললি তোকে কেউ সুড়সুড়ি দিচ্ছে, এটা সেই জ্বীনের ই কাজ। আমি বাসায় তোকে নিয়ে এসেছি এটা তার পছন্দ হয়নি। এই জ্বীন চায় আমি তাকে সঙ্গ দিই কিন্তু এটা কি করে সম্ভব বল! এই যে আমার ক্ষতি করবেনা তার কি গ্যারান্টি আছে।
-- আচ্ছা সত্যি যদি জ্বীন থেকে থাকে, তবে সে আমার সামনে আসছেনা কেন? নাকি তার ওই হিম্মত নেই প্রিয়ার সামনে এসে দাড়ানোর!
-- এসব কেন বলছিস? সামনে আসলে খুব খারাপ কিছু একটা করবে। এই জ্বীন নিজেই বলেছে সে একটা খারাপ জ্বীন। তোকে নাকি নাকানি-চুবানি খাইয়ে তাড়াবে!
-- এত্ত সোজা! কোথাকার কোন শক্তিধর এলেন রে!
বলতে না বলতে প্রিয়ার গায়ে একজোড়া আরশোলা এসে পড়ল। প্রিয়া ভয় পেয়ে সেগুলো ঝাড়তে গিয়ে ওইগুলো জামার ভিতরে ঢুকে গেল। নেওয়াল ভয়ার্ত গলায় বলল,
-- ঠিক এই ভয়টাই পেয়েছিলাম।
প্রিয়া লাফাতে লাফাতে জামা খোলার জন্য ওয়াশরুমে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর তার চিৎকারের আওয়াজ শুনে নেওয়াল এগিয়ে এসে দেখে প্রিয়ার মুখে-গায়ে কমেডের ময়লা লেগে আছে।নেওয়াল ওখান থেকে দ্রুত আয়নার সামনে এসে বলল, "আপনি এসব বন্ধ করুন। এমন করলে আমি কিন্তু দোয়া পড়তে বাধ্য হব।"
আয়নায় থাকা ওর প্রতিবিম্বটা বলে উঠে, "সে হিম্মত দেখতে চেয়েছিল তাই কমেডের ফ্লাশে তাকে চুবিয়ে সেটা দেখিয়েছি। আমাকে সাবধান না করে তাকে কর, জ্বীনের শক্তি নিয়ে সন্দেহ পোষণ করার ফল এমন ই হবে।"
-- দয়া করে আর কোনো ঝামেলা করবেননা।
প্রিয়া ফ্রেশ হয়ে ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে ব্যাগপ্যাক করে বের হওয়ার প্রস্তুতি নেয়। নেওয়াল তার হাত টেনে বলে,
-- এত রাতে কোথায় যাচ্ছিস?
-- এখানে আর এক মূহুর্ত ও আমি থাকবনা। এই ভয়ংকর জ্বীনের আস্তানায় তুই থাক, আমি গেলাম।
প্রিয়া তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ না দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে চলে যায়।
নেওয়াল ব্যালকুনিতে চুপচাপ বসে আছে, মাথার মধ্যে তার হাজারটা চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে। পাশে কেউ বসে আছে টের পেয়ে মুখ তুলে তাকায়। এই কয়েকদিন নিজের প্রতিবিম্বকে এতবার মুখোমুখি দেখেছে যে এখন আর দেখলে ভয় হয়না।
-- আপনি নিজের আসল রুপে আসতে পারেননা?
-- কফি খাবি? নেওয়াল বড় বড় চোখ করা তাকায়। কিছু বলার আগে কফিভর্তি কাপ তার মুখের সামনে ধরে রাখে জ্বীনটা। নেওয়াল নিবে কি নিবেনা চিন্তায় পড়ে যায়। একটু পরে কাপটা নিয়ে চুমুক দেয়, কফিটা ভালোই বানিয়েছে।
-- আপনি আসলে কে বলুন তো? কেন ই বা আমার সঙ্গ চাচ্ছেন?
-- আমার পরিচয় একটাই আমি একজন খারাপ জ্বীন। মানুষের সঙ্গ পেতে ইচ্ছে হল তাই চাচ্ছি। এত কথার দরকার কি তোর! আমি তোর কোনো ক্ষতি করবনা, তবে কোনো চালাকি করলে কিন্তু খুব খারাপ হবে।
নেওয়াল দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে কফির কাপ নিয়ে রুমে চলে আসে। যা হচ্ছে হতে দেওয়াটাই ভাল হবে। এই জ্বীন খুব ভয়ানক, যা খুশি করে বসতে পারে। আপাতত এর কথা অনুযায়ী চলা যাক, ভাবগতিক দেখে ব্যবস্থা নেওয়া যাবে।
নেওয়াল তার মা মিথী আনোয়ারের দিকে তাকিয়ে বলল,
-- খালা কি পুরোপুরি সুস্থ এখন? সত্যি কি জ্বীন ভর করেছিল তার উপর! তার মা জবাব দিলেন,
--হ্যা দেখে তো সেটাই মনে হয়েছিল। এখন সুস্থ অবশ্য, তবে কারো সাথেই কথা বলছেনা। হঠাৎ হঠাৎ চিৎকার-চেচামেচি করে বাড়ী মাথায় তুলছে।
তোর মামীরা ভয়ে তাকে রাখতে চাচ্ছেনা, বলছে সাথী থাকলে তার জ্বীন ওদেরকে মেরে ফেলবে। পাগলাগারদে পাঠিয়ে দেওয়ার চিন্তা করছে, ওঝা ডেকে চিকিৎসা করানোর ও কথা উঠছে। আমি চেয়েছি আমার সাথে নিয়ে আসতে, তোর নানু কিছুতেই দিলেননা। তার ও ভয় সাথীর জ্বীন এখানে আসলে আমাদের ক্ষতি করবে।
নেওয়ালের কেন জানি খালার জন্য আফসোস হচ্ছে। মানুষটা কত ভালো, কেন যে বারবার তার সাথেই এমন হচ্ছে আল্লাহ জানেন!
নেওয়ালের প্রতিবিম্ব এক পায়ের উপর অন্য পা তুলে দেয়ালের দিকে তাকিয়ে গুনগুন করছিল। নেওয়াল ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে এই দৃশ্য দেখে দ্রুত রুমের দরজা লক করে দিল। তারপর হাতের তোয়ালেটা বিছানায় ছুড়ে ফেলে বলল, "আপনি এখন এখানে বসে আছেন কেন? বাসায় মা আছে, যদি একসাথে কখনো এভাবে দেখে নেয় কি হতে পারে বুঝেন?" প্রতিবিম্বটা ছোট্ট একটা হাসি দিয়ে বলল,
-- আমাকে তুই ছাড়া আর কেউ ই দেখতে পায়না। তারা ই আমাকে দেখে যাদের আমি স্বেচ্ছায় দেখা দিই।
নেওয়াল জ্বীনটার সাথে কিছুটা সহজ হয়ে গেল। যদি মাঝে মাঝে জ্বীনটার পাগলামিতে সে অতিষ্ঠ হয়ে যায়। সেদিন রাতের বেলা বলে, আমাকে মিষ্টি খাওয়া তো একটু। বাসায় ও সেদিন মিষ্টি ছিলনা, তার যে কি পাগলামী! পরে ইউটিউব দেখে অল্প সময়ের মধ্যে হালুয়া বানিয়ে দেওয়ায় তবে সে শান্ত হয়েছে। একটা জ্বীন এত পাগলামী করতে পারে, এত চঞ্চল হতে পারে তার জানার বাহিরে ছিল।
নেওয়াল বসে বসে ল্যাপটপে নোটস রেডি করছে। তার রূপে থাকা জ্বীনটা মুখোমুখি বসে বলল,
" চল, একটু বেরিয়ে আসি।" নেওয়াল চোখ বড় বড় করে তার দিকে তাকাল। অস্ফুটস্বরে বলল,
-- এখন রাত ১:৪৫ বাজে।
-- তাতে কি হয়েছে? এখন রাস্তায় মানুষ থাকবেনা, ঘুরতে ভালোই লাগবে।
-- পারবনা আমি। বাসায় আজ মা আছে, তার উপর আমার নোটসগুলো কমপ্লিট হয়নি। কথাটা বলামাত্রই জ্বীনটা তার দিকে রাগান্বিত চোখে তাকায়। তারপর তাকে শূণ্যে ভাসিয়ে ব্যালকুনি দিয়ে ফেলে দেয়। নেওয়ালের তখন মনে হচ্ছিল সে বোধহয় নিচে পড়ে এক্ষুণি মরে যাবে, চিৎকার করার চেষ্টা করছিল বারবার। ভয়ে চোখ বুজে ফেলেছিল, একটু পর চোখ খুলে দেখে না সে নিচে পড়েনি। মাটি থেকে কিছুটা দূরত্বে ভাসছে। কেউ যেন আস্তে করে তাকে মাটিতে দাড় করিয়ে রাখল।
-- বারবার বলেছি আমাকে রাগাবিনা। যা বলি তা শুনবি। নাহলে আমি কিন্তু অনেক খারাপ কিছু করে ফেলব। চল, ফাকা রাস্তায় হাটি কিছুক্ষণ। 
নেওয়াল মন খারাপ করে মাথা নিচু করে হাটতে থাকে। রাস্তাটা এই সময় বেশ ফাকা, মাঝে মাঝে দু-একটা গাড়ি যাতায়াত করছে শুধু। মোড়ে মোড়ে ল্যাম্পপোস্টগুলো জ্বলতে থাকা রাস্তা আলোতে পরিপূর্ণ। ওপাশ থেকে প্রশ্ন আসে, "মন খারাপ করেছিস?"
নেওয়াল উত্তর দেয়না, দিনদিন জ্বীনের অত্যাচারগুলো অসহ্য পর্যায়ে চলে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে তার ইচ্ছে নিজের মাথায় নিজে আঘাত করে মরে যাক। সেদিনের পর থেকে প্রিয়া ও তার সাথে কথা বলেনা, তার ধারণা কোনো ক্ষোভ থেকে সে ইচ্ছে করে প্রিয়াকে জব্দ করার জন্য জ্বীন এনেছিল। ইদানিং ও কারো সাথে কথা বলতে পারেনা, মনে হয় যেন জ্বীনটা তার কোনো ক্ষতি করে ফেলবে।
এখন তো সে বাড়ী থেকে বেরিয়েও জ্বীনের হাত থেকে নিস্তার পায়না। জ্বীনটাও তার সাথে সাথে সবজায়গায় যায়। সেদিন পছন্দের মানুষটিত সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল, সে তাকে একসাথে কফি খাওয়ার জন্য বলেছিল। কিন্তু জ্বীনটা ওপাশ থেকে তার হাত ধরে টানাটানি করছিল, তার মাথাটাকে এদিক ওদিক নাড়িয়ে দিয়ে অসম্মতিসূচক ভঙ্গি প্রকাশ দিয়েছিল। ঘটনা এখানেই শেষ হয়নি, পাবলিক প্লেসে পছন্দের মানুষটিকে চড়-গুতো, সুড়সুড়ি দিয়ে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল জ্বীনটা। এরপর থেকে সে মানুষটি তাকে দেখলে আর কোনো কথা ই বলেনা, এড়িয়ে চলে।
একে একে এসব ঘটনায় ক্ষোভ জমে গেছিল নেওয়ালের মনে। এখন সে ঠিক করে ফেলেছে, সে হুজুর ডেকে যে করে হোক জ্বীনের ব্যাপারটা বন্ধ করবে। এসব আর নেওয়া যাচ্ছেনা।
আনমনে ভাবতে ভাবতে অনেকটা দূর চলে আসে নেওয়াল। এক পর্যায়ে থমকে দাঁড়িয়ে আশেপাশে জ্বীনটার অস্তিত্ব খুজে, কিন্তু জ্বীনটা তার কাছে-কিনারায় নেই। একা রাস্তায় দাঁড়িয়ে না থেকে বাসার দিকে রওনা দেয় সে৷ 
এমনসময় দুইটা বাইকভর্তি ছেলেরা তাকে দূর থেকে দেখে শিস বাজায়, নেওয়াল ভয়ে দ্রুত হাটা দেয় কিন্তু ছেলেগুলো ওকে চারপাশ থেকে ঘিরে ওড়না আর হাত ধরে টানাটানি করতে থাকে। নেওয়াল চিৎকার করতে থাকে, এক পর্যায়ে একজনের হাতে কামড় বসিয়ে দৌড়াতে থাকে। ছেলেগুলোর চোখ ফাকি দিয়ে একটা চিপা গলির ভিতরে ঢুকে যায়। ভয়ে এখনো তার বুক ধুকপুক করছে। অন্ধকার গলিতে নিজেকে নিরাপদ মনে হচ্ছে, আপাতত কিছুটা সময় এখানে দাড়াতে হবে। ছেলেগুলো চলে গেলে বেরিয়ে বাসায় চলে যাবে।
কিন্তু তার মনে হচ্ছে এখানে সে ছাড়াও আরো একজন আছে যার বুকের কাছে সে লেপ্টে আছে, কিন্তু অন্ধকারে তার চেহারা দেখতে পাচ্ছেনা। কিছু জিজ্ঞেস করতে যেতেই একটা বলিষ্ঠ হাত তার মুখ চেপে ধরে হুস শব্দ করে চুপ থাকতে বলে। নেওয়াল হতভম্ব হয়ে যায়! হাতটা তার মুখ ছেড়ে হাত ধরে গলি থেকে বাহিরে নিয়ে এসে হাটা ধরে।
নেওয়াল অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে থাকে। ছেলেটা তাকে কোথায় নিয়ে যাচ্ছে, কেন নিয়ে যাচ্ছে এসবে তার খেয়াল নেই।
একপর্যায়ে ছেলেটা তার হাত ছেড়ে দিয়ে বলল,
-- বাসা কোনটা আপনার? নেওয়াল ধ্যান ভাঙ্গল, সে এইদিক ওদিকে চেয়ে দেখল সে তার বাসার পাশেই দাঁড়িয়ে আছে। সে ভালো করে ছেলেটার দিকে তাকাল। সাদা রঙ্গের টি শার্ট আর একটা ট্রাউজার পড়ে আছে ছেলেটা, বেশ মায়াবী চেহারার ফর্সা ধরণের-গাল দুটো লাল হয়ে আছে। চোখের পাপড়ি আর মনি মেয়েদের মত বড় বড়। গালে হালকা চাপদাড়ি, চুলগুলো এলোমেলো হয়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে উচ্চবিত্ত কোনো ঘরের ছেলে।
নেওয়াল কিছু না বলে আঙ্গুল দিয়ে বাসা ইশারা করে দেখাল। ছেলেটা "বাসায় যান" বলে উলটো দিকে হাটা ধরে।
নেওয়াল কিচ্ছুক্ষণ ঘোরের বশে সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে তারপর বাসায় ঢুকে যায়।
নেওয়াল চুপচাপ ড্রয়িংরুমে বসে আছে, এদিকে মিথী আনোয়ার বকাবকি করেই চলেছে "এতরাতে কোথায় বেরিয়েছিলি!" নেওয়াল কি উত্তর দিবে ভেবে পায়না, যখন বেরিয়েছিল তখন তো জ্বীনটা তাকে ব্যালকুনি দিয়ে নামিয়েছিল। বাসায় ঢোকার সময় কথাটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিল, তার ফল হিসেবে এখন তার মায়ের এত প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হচ্ছে। মিথী আনোয়ার একটু চুপ থেকে মেয়ের পাশে গিয়ে বসে, কিছুক্ষণ মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার মেয়ে বেশ প্রাণোচ্ছল-চঞ্চল, কিছুদিন ধরে লক্ষ্য করছেন সে কিছু একটা নিয়ে চিন্তিত থাকেন। কাজের চাপে মেয়েকে তেমন সময় দিতে পারেননা, অনেকদিন মন খুলে কথাও বলা হয়না। আজ যেন মেয়ের পরিবর্তনটা খুব চোখে পড়ছে তার। মেয়ের মুখটা অনেকটা চুপসে গেছে, উজ্জ্বল শ্যামলা চেহারায় চোখের নিচে কালিগুলো স্পষ্ট।
" নেওয়াল, তুই কি কিছু নিয়ে খুব আপসেট?" নেওয়াল চোখ তুলে মায়ের দিকে তাকায়, এত আবেগঘন দিয়ে মা জিজ্ঞেস করেছে তাকে, তার ইচ্ছে করছে জ্বীনের ব্যাপারটা এক্ষুনি মাকে বলে দিতে। কিন্তু মা এসব জানলে খুব চিন্তায় পড়ে যাবে, এমনিতেও খালাকে নিয়ে আতঙ্কে আছে।
" তেমন কিছুনা মা, পড়াশুনার চাপটা একটু বেড়েছে। এই যে দেখো, এখন বের হতে হল এক্সট্রা এ ফোর পেপারের জন্য।"
মিথী আনোয়ার সন্তোষজনক উত্তর পেয়েও যেন আশ্বস্ত হতে পারলেননা। গভীর আবেশে মেয়েকে বুকের কাছে টেনে নেন।
নেওয়ালের প্রতিবিম্বটা অনেকক্ষণ ধরে নেওয়ালের থেকে কিছুটা দূরত্বে বসে আছে। নেওয়ালের দিকে বারবার তাকিয়ে ভ্রু কুচকাচ্ছে, তাতে নেওয়ালের কোনো ভ্রক্ষেপ নেই। সে আপনমনে নোটস রেডি করছে। হঠাৎ তার নোটস পেপারের উপর অনেকটা রক্তের ছিটকে এসে পড়ে, সে আতকে উঠে প্রতিবিম্বের দিকে তাকায়। প্রতিবিম্বটা ভয়ানক হাসি দিয়ে বলল, "আমাকে চোখে পড়েছে তাহলে?"
নেওয়ালের রাগ উঠে যায়, এর বাড়াবাড়ি আর মানা যাচ্ছেনা
" কি সমস্যা কি আপনার? যখন যা ইচ্ছে তা করবেন! কাল রাতে কি করেছিলেন আপনি? একা একটা মেয়েকে বের করে রাস্তায় বিপদে ফেলে চলে গিয়েছেন। লজ্জা করেনা? ওহ আপনার জাতিতে তো আবার লজ্জা নেই। আমার ই ভুল আপনার মত একজন কাপুরুষকে সঙ্গ দেওয়া।"
এক নিঃশ্বাসে কাপা গলায় কথাগুলো বলে থামল নেওয়াল। প্রতিবিম্বটার চোখ প্রচন্ড লাল হয়ে গেছে, দাত-মুখ খিচে খুব জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেলছে ঘনঘন। নেওয়ালের বুকটা ভয়ে কাপতে লাগল, নিজের এত ভয়ানক রুপ সে আর কখনোই দেখেনি। তার মনে হচ্ছে জ্বীনটা এক্ষুনি তার উপর আক্রমণ চালাবে। জ্বীনটা হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে গেল, এরপর পুরো ঘরে তান্ডব চলতে লাগল। কোথা থেকে দমকা হাওয়া এসে সব জিনিসপত্র ভেঙ্গেচুরে ফেলতে লাগল, মেঝেতে রক্তের ছড়াছড়ি। নেওয়াল কান দুটো দুহাতে চেপে ধরে চিৎকার করে বলতে লাগল, "এসব থামান বলছি।"
তাতে যেন তান্ডব আরো জোরালো হল। নেওয়াল আর সহ্য করতে পারছিলনা, বেডটেবিল থেকে ল্যাম্পটা নিয়ে আয়না বরাবর ছুড়ে মারল। মূহুর্তে আয়নাটা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে চারদিকে ছিটে গেল। এক টুকরো এসে নেওয়ালের কপাল একপাশ বরাবর ঢুকে গেল, ব্যথায় সে মেঝেতে বসে পড়ল। ততক্ষণে তান্ডব থেমে পরিস্থিতি শান্ত হয়ে গেছে।
তার ভীষণ কান্না পাচ্ছিল, এমনসময় দরজায় কেউ কড়া নাড়ল। নেওয়াল মা এসেছে ভেবে দৌড়ে গিয়ে দরজাটা খুলল, আজ মাকে সবকিছু বলবে সে। এই আতংকে সে আর দিন কাটাতে পারছেনা, আজ জ্বীনটা প্রচন্ড রেগে গেছে ওকে ছাড়বেনা এটা সে নিশ্চিত।
দরজা খুলেই সে জড়িয়ে ধরল। বেশ কিছুক্ষণ মন খুলে কাদতে লাগল, "মা আমাকে বাচাও, আমি আর এসব নিতে পারছিনা। ওই আমাকে ছাড়বেনা।"
একটা কোমল ঠান্ডা হাত তাকে ভরসা দিয়ে বলল,
" শান্ত হোন।" গলাটা পুরুষের বুঝতে পেরে নেওয়াল তাকে ছেড়ে দিয়ে পিছনে সরে যায়। অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে এ তো সেই ছেলেটা, যে কাল রাতে তাকে বাসায় পৌছে দিয়েছে।
নেওয়াল এক নজরে ছেলেটার বুকের দিকে তাকায়, তার কপালের রক্ত ছেলেটার সাদা টি-শার্টে ছড়াছড়ি হয়ে গেছে।
কোনোরকম নিজেকে সামলে নিয়ে বলল,
-- আপনি এখানে?
-- মিথী আনোয়ার নামে এক মহিলার কাছে এসেছিলাম। এটা কি উনার ই বাসা? 
-- জ্বী। কিন্তু উনি তো এখনো বাসায় ফিরেননি। আপনি ভিতরে এসে বসুন। মা একটুবাদেই চলে আসবেন।
ছেলেটা ভিতরে না এসে নেওয়ালের দিকে সরে এসে কপাল থেকে একটানে কাচটা খুলে নেয়, তাতে যেন রক্ত আরো গলগল করে পড়তে লাগল।
" বাসায় এড ফাস্ট বক্স আছে? ইমিডিয়েটলি নিয়ে আসুন।"
নেওয়াল যেন হতভম্ব হয়ে বক্স নিয়ে এসে ছেলেটার হাতে দিল। ছেলেটা খুব দ্রুততার সাথে নেওয়ালের কপালে ব্যান্ডেজ করে দিল।
-- কালকের ব্যাপারটার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানানো হয়নি। অনেক ধন্যবাদ। নেওয়ালের কথার প্রতিউত্তরে ছেলেটা কিছু বললনা। চুপচাপ বাসা থেকে বেরিয়ে গেল, নেওয়াল বুঝতে পারলনা মূহুর্তে কি হল!
নেওয়াল রুমের সবকিছু পরিষ্কার করে বিছানায় বসে আয়নার দিকে তাকাল। এই পছন্দের আয়নাটা তার জীবনে কাল হয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল সে আয়নাটা আর এখানে রাখবেনা। মিস্ত্রী লোক ডাকিয়ে আয়নাটা পুরোটা ভেঙ্গে সরিয়ে ফেলে। এতে কিছুটা আশ্বস্ত হয় সে। আর কখনো হয়ত সেই জ্বীনের ছায়া তার উপর পড়বেনা।
ভাবতে ভাবতে ব্যালকুনিতে এসে দাঁড়ায় সে, এতদিন পর নিজেকে বেশ হালকা লাগছে। মুক্ত পাখির মত এদিক ওদিক উড়াউড়ি করতে ইচ্ছে হচ্ছে।
হঠাৎ চোখ পড়ল তার বরাবর পাশের ব্যালকুনিটায়। সেই অদ্ভুত ছেলেটা এখানে দাঁড়িয়ে একা একা বিড়বিড় করছে। নেওয়াল চিন্তায় পড়ে গেল, ছেলেটা এখানে কি করছে! 
-- এই যে, শুনছেন।
ছেলেটা একবার তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল। কি একটা ভেবে ব্যালকুনি থেকে রুমের দিকে চলে গেল। নেওয়াল ছেলেটার এমন অদ্ভুত আচরণের কারণটা বুঝতে পারলনা।
" মা কাল একটা ছেলে তোমার খোজে এসেছিল। তোমাকে না পেয়ে চলে গেছে।"
" দেখা হয়েছিল আমার সাথে। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটটায় ও ভাড়া নিয়েছে বেশ কিছুদিন আগে। কাল উঠে যাওয়ার কথা ছিল, বাসার মালিক আমার কাছে চাবি দিয়ে গিয়েছিল সেটা নিতেই এসেছিল। কেন তোর কি পছন্দ হয়েছে নাকি?" বলেই মিথী আনোয়ার অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
-- কিসব স্কুল পড়ুয়া বাচ্চাদের মত কথা বলো! খালার কোনো খবর পেলে তুমি?
-- তোর খালাকে পাগলাগারদে পাঠিয়ে দিয়েছে, এত করে বললাম সবাইকে কেউ আমার কথা রাখেনি। তোর মামারা উপরন্তু আমাকে ধমকেছে। আমার কলিজাটা ছিড়ে যাচ্ছে বিশ্বাস কর, কি থেকে কি হয়ে গেল! ও আমাদের সবার চোখের মনি ছিল। হঠাৎ কি এক পরিবর্তন ওকে আমাদের সবার থেকে দূরে নিয়ে গেছে।
নেওয়াল বিছানায় হাত-পা মেলে শুয়ে আছে, এতটুকু নড়ার শক্তি নেই তার মধ্যে। তার উপর ভেসে আছে সেই জ্বীনটা। অন্ধকারে তার চেহারা নেওয়াল দেখতে পাচ্ছেনা, তবে এইটুকু আন্দাজ করল সে এখন আসল রুপে ই নেওয়ালের সামনে উপস্থিত। বিচ্ছিরি হাসি দিয়ে বলল,
" আমার থেকে এত সহজে তোর নিস্তার নেই। আয়না সরিয়ে দিলেও আমাকে তুই তোর থেকে কখনো সরাতে পারবিনা। এতদিন আমার ভালো রুপ টাই তোকে দেখিয়েছি, কোনো জোর-জবরদস্তি করিনি। কিন্তু তুই সেটাকে গুরুত্ব দিলি না।
আজ আমি তোর উপর জোর খাটাব শুধু আজ নয়। আজ থেকে প্রতিদিন একটু একটু করে তোকে তিলে তিলে শেষ করব।"
নেওয়াল বারবার ঠোট নাড়িয়ে কিছু বলার চেষ্টা করছে, কিন্তু কোনো আওয়াজ ই বের হচ্ছেনা মুখ থেকে। জ্বীনটা হাসতে হাসতে বলল, "আজ কিছুই বলতে পারবিনা, বাধাও দেওয়ার ক্ষমতা নেই তোর। এখন আমি তোর সাথে শারীরিক সঙ্গম করব, আজ থেকে প্রতিরাত তুই আমার কাছে ধর্ষিত হবি।
এটাই হচ্ছে তোর গুরুতর শাস্তি। প্রচন্ড কষ্ট আর যন্ত্রণা দিয়ে তোর সাথে শারীরিক মিলন করব।"
বলেই অন্ধকারে হিংস্র চোখগুলো জ্বলজ্বল করে উঠে। হাতটা নেওয়ালের শরীরের দিকে এগিয়ে আসে, গায়ের ওড়নাটা সরিয়ে নেয় আর ব্যস্ত হয়ে পড়ে তাকে বিবস্ত্র করার, তার শরীরে নখ দিয়ে হাত বুলানোর। নেওয়ালের চোখ বয়ে পানি ঝরতে থাকে, এই মূহুর্তে তার মনে হচ্ছে কিছু একটা দিয়ে নিজেকে সে নিজে শেষ করে দেয়।
(চলবে)