01/08/2025
"আশার এক টুকরো মুরগি"
গ্রামের এক কোণায় খড়ের ছাউনিতে গড়ে ওঠা ছোট্ট একটা ঘর। দেয়ালে শিক ধরে কালো হয়ে গেছে, কুঁচকে গেছে চালের টিনগুলো। ঘরের ভেতর যেন অভাবের হাওয়া নিরবধি বয়ে চলে। ঘরে বাস করে তিনজন—সুদর্শন, তার স্ত্রী মালতী আর সাত বছরের মেয়ে আশা।
সুদর্শন প্রতিদিন সকাল হতেই অন্যের জমিতে খাটতে চলে যায়। মালতী, গরিব হলেও কাজ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। কারো বাড়িতে ঝিয়ের কাজ, কোথাও কাপড় কাঁচা—যা পায়, তাতেই ঘরের হেঁশেল জ্বলে।
আশা প্রতিদিন স্কুলে যায়। মাথায় দুটো বিনুনি করে বইয়ের ব্যাগ পিঠে নিয়ে হেঁটে যায় পাশের গ্রাম পর্যন্ত। সবার মতো তারও সাধ, তারও শখ—বিশেষ করে একটা শখটা বারবার মাথা চাড়া দেয়।
—“মা, কবে মুরগির মাংস রান্না করবে? আমি মুরগির ডিম নয়, মাংস খেতে চাই।”
মালতী আঁচলে মুখ লুকিয়ে বলে,
—"কাল এনে দিবো মা... কাল।"
এই “কাল”টা আশার জীবনে দিনের পর দিন ঘুরে ফিরে আসে, কিন্তু কখনো বাস্তব হয় না।
দুপুরে খেয়ে নেওয়া মুড়ির খটখটে আওয়াজে সেই "কাল"-টা ঢেকে যায়। কোনো দিন পান্তা, কোনো দিন শুধু নুন-ভাত, আর কোনো দিন শুধু জল খেয়েই আশা ঘুমিয়ে পড়ে। তবুও সে মুরগির কথা ভুলে না।
---
সেদিন হঠাৎ সকালে সুদর্শনের মুখে একটু অন্যরকম আলো। বউয়ের হাতে একশো টাকার দুটো নোট দিয়ে বলে,
—“দেখো মালতী, ওর জন্য মুরগি নিয়ে আসি আজ। আর দেরি নয়।"
মালতী বিস্মিত, চমকে ওঠে। সুখের আশায় তার বুক কেঁপে ওঠে।
—"তুমি পারবে?"
—"হ্যাঁ। আজ জমির মালিক অগ্রিম মজুরি দিয়েছে। আজ আশার জন্য মাংস হবে।"
দুপুরে বাজার থেকে একজোড়া পা বেঁধে সুদর্শন মুরগি নিয়ে এলো। মেয়েটা তখন স্কুলে। মালতী কেটে ধুয়ে মাংস রান্না শুরু করল। গরম ভাতে সেই ঝালঝাল মুরগির ঝোল—তার মন ভরে উঠছে এক অপার্থিব আনন্দে।
ঘরের চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে মাংসের ঘ্রাণ।
মালতী হাঁসফাঁস করতে করতে বলে,
—"আজ মেয়েটা খুশিতে পাগল হয়ে যাবে।"
---
কিন্তু হঠাৎই ভেসে আসে এক বিভীষিকাময় খবর।
স্কুল থেকে ফেরার পথে রাস্তা পার হতে গিয়ে আশাকে একটা ট্রাক ধাক্কা দেয়। এক মুহূর্তে থেমে যায় তার নিঃশ্বাস।
মালতী ছুটে যায় মাঠ ছেড়ে। সুদর্শন এক দৌঁড়ে ছুটে যায় সেখান থেকে, আশার নিথর দেহ জড়িয়ে ধরে।
ঘরে তখনও হাঁড়িতে ফুটছে মাংস।
চোখে জল, মুখে কান্না, কিন্তু চুলোর আগুন আর নেভে না।
সেদিন আর কেউ মাংস খায়নি।
একটি থালা শুধু পড়ে ছিল, যেটা মালতী সাজিয়ে রেখেছিল তার ছোট্ট রাজকন্যার জন্য।
আর রান্নাঘরের কোনায়, পড়ে ছিল মুরগির একটা ভাঙা ঠ্যাং।
"যার নামেই ছিল আশার আলো, তারই চলে যাওয়ায় ঘরটা যেন চিরকাল অন্ধকার হয়ে গেল। আর রান্না হয়ে থাকা মাংসটা—সেটা হয়ে রইল শুধু এক টুকরো অপূর্ণতা, এক চিরন্তন অপেক্ষা..."