
09/07/2025
#মেহেরুন
পর্ব-৪
সময় তার আপন গতিতে চলতে থাকে!....দেখতে দেখতে ৬মাস পেরিয়ে যায়!... ছোট্ট মেহেরুন এখন একটু একটু বসতে শিখেছে। তার ফোকলা দাঁতের হাসিতে পুরো ঘর আলোকিত হয়ে উঠে।কাশেম মিয়া তো চোখে হারান তার ছোট্ট মেহেরুন কে।এরই মধ্যে একদিন রহিমা বিবি প্রাকৃতিক কাজ সারতে রাত ১০টায় বাহিরে যান, সোহাগী আর শিউলি তখন ঘুমিয়ে পড়েছে, সিরাজ আর মিরাজ তাদের নিজেদের রুমে, কাশেম মিয়া ও বাড়ি ফিরেনি। রহিমা বিবি বাহির থেকে এসে দেখে ছোট্ট মেহেরুন জানালার দিকে ফিরে বসে আছে আর কি যেন দেখে খিলখিলিয়ে হাসছে, দেখে মনে হচ্ছে কেউ তার সাথে কথা বলছে কিংবা খেলা করছে।রহিমা বিবি কিছুটা ঘাবড়ে গিয়ে মেহেরুন কে নাম ধরে ডাকে কিন্তু মেহেরুন আগের মতন ই হাসছে আর হাত-পা নাড়াচ্ছে বসে বসে! রহিমা বিবি দৌড়ে গিয়ে কোলে নিতেই তার সেকি কান্না! রহিমা অনেকটা আতংকিত হয়ে যায়,এদিকে কাশেম মিয়া ও বাড়ি ফিরে আসেন,তিনি ঘরের কাছে আসতেই দেখেন জানালার পাশের বেল গাছটা দুলছে আর জানালার কপাট ও খোলা কিন্তু বাহিরে কোন হাওয়া বইছেনা।কাশেম মিয়ার কিছুটা খটকা লাগে।ঘরে গিয়ে রহিমা বিবির কোলে মেহেরুন কে কাদতে দেখে তিনি বুঝতে পারেন কি হয়েছে! তিনি তৎক্ষনাৎ তিন কুল পড়ে মেহেরুনের শরিরে ফু দেওয়ার সাথে সাথে বাচ্চার কান্না বন্ধ হয়। এভাবেই মাঝে মধ্যে মেহেরুন একা একা খেলতো আর হাসতো,দেখে মনে হতো কেউ তার পাশে আছে! দিন যত যায় মেহেরুনের সুন্দর্য তত ফুটে উঠে।তাকে দেখলে আলাদা একটা প্রশান্তি কাজ করে মনের মধ্যে।বিশেষ করে মেহেরুনের চোখ! তার চোখের দিকে তাকালে যে কেউ তার মায়ায় পড়ে যাবে। মেহেরুনের জন্মের পর থেকে রহিমা বিবির উপর আর দুষ্ট জিন ভর করে না! এ নিয়ে রহিমা বিবি ও অনেক খুশি অনুভব করেন।আগে ঘুম থেকে উঠলেই তার গা,হাত-পা এত ব্যথা হয়ে থাকতো মনে হতো যেন তাকে কেউ বেধড়ক পিটিয়েছে আর মাঝে মাঝে তিনি বিভিন্ন রকমের ঘ্রান পেতেন।কখনো ফুলের ঘ্রান আবার কখনো ময়লা পঁচা গন্ধ! তিনি আশেপাশে সবাইকে জিজ্ঞেস করতেন কোন গন্ধ পাচ্ছে কি না! কিন্তু সবাই না জবাব দিতো।অল্প বয়সে বিয়ে হওয়ার সুবাদে অত কোরান-হাদিস যানতেন না তিনি তাই দোয়া পড়ে নিজেকে দুষ্ট জিন থেকে হেফাজত করতে পারতেননা কিন্তু এখন তিনি আগের মতন তেমন কিছু টের পান না! তিনি তো আর যানেন না তার উপর ভর করা জিন তার ছোট্ট মেয়ের দিকে নজর দিয়েছে। এদিকে চারদিক থেকে সোহাগীর জন্য বিয়ের ঘর আসতে থাকে।রহিমা বিবি কোলের বাচ্চাটার জন্য সোহাগীকে এখন বিয়ে দিতে নারাজ কিন্তু সময় কি আর বাধ মানে! ভালো সমন্ধ পেয়ে কাশেম মিয়া তা হাত ছাড়া করতে নারাজ। ভালো দিনক্ষন দেখে একদিন সোহাগীর বিয়ে হয়ে যায়।পালকি করে ছোট ছোট ভাই-বোনদের কাদিয়ে সোহাগী পরের ঘরে চলে যায়।সোহাগীর শশুর বাড়ি যাওয়াতে বেশি কষ্ট পায় শিউলি। রহিমা বিবি শিউলির কষ্ট লাঘব করতে তাকে মেহেরুন কে দেখা-শুনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।এতদিন সোহাগী বুবুর জন্য মেহেরুন কে দেখা-শুনা করার সুযোগ পেতোনা শিউলি কিন্তু এখন মেহেরুনের সব দায়িত্ব তার, বড় মেয়ে কে বিদায় দেওয়ার পর রহিমা বিবি ঘরের কাজে এত বেশি মশগুল থাকে যে মেহেরুনকে তেমন সময় দিতে পারে না। রাতে যখন মেহেরুন কে ঘুম পাড়ায় তখন অজস্র চুমুতে ভরিয়ে দেন মেয়েকে তিনি। আস্তে আস্তে শিউলি ও চোখের পলকে বড় হতে থাকে। সদ্য কৈশরে পদার্পন করা শিউলি এখন বেশি একটা ঘরে থাকতে চায় না! এই ছুতো অই ছুতো দিয়ে বনে বাদাড়ে ঘুরে-ফিরে আর মায়ের বকা যেন না শুনতে হয় তাই মেহেরুন কে সাথে করে নিয়ে যায়।একদিন শিউলি মেহেরুন কে বাগানে নিয়ে গিয়ে গাছ থেকে পেয়ারা পাড়তে থাকে। সাথে তার অন্যান্য বান্ধুবিরাও ছিল।সবাই যখন পেয়ারা খেতে ব্যস্ত!মেহেরুন তখন এক পা দু পা করে পুকুরের একেবারে কাছে চলে আসে, আর এক পা এগুলেই সে পানিতে পড়ে যাবে এমন, আচমকাই মেহেরুনের হাতে টান পড়ে! ছোট্ট মেহেরুন পেছন ফিরে দেখে এক অতি সুদর্শন যুবক তার হাত ধরে ফেলেছে, সে কিছু বুঝে উঠার আগেই তাকে টানতে টানতে শিউলিদের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। বোনকে অপরিচিত কেউ ধরে রেখেছে দেখে শিউলি হকচকিয়ে যায়, দ্রুতই বোনের কাছে দৌড়ে যেতেই সেই সুদর্শন যুবক মেহেরুনের হাত ছেড়ে দেয় আর গম্ভির কন্ঠে বলে-আমি না ধরলে এক্ষুনি পানিতে পইড়া যাইতো বাচ্চাডা! শিউলি অনেক ঘাবড়ে যায় আর দ্রুত মেহেরুন কে নিজের কাছে নিয়ে আসে, মেহেরুনের হাত ছেড়ে দিয়ে সেই যুবক বাগানের ভেতরের রাস্তা ধরে হাটতে হাটতে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়, শিউলি তার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে হঠাৎ দেখে তাকে আর দেখা যাচ্ছে না! শিউলি তেমন একটা মাথা ঘামায় না আর দ্রুতই বাড়িতে চলে আসে। রাতে মেহেরুনের অনেক জ্বর আসে! শিউলি মায়ের বকার ভয়ে দুপুরের ঘটে যাওয়া ঘটনার কিছুই প্রকাশ করে না।……………. এভাবেই দেখতে দেখতে পাচ বছর কেটে যায়। মেহেরুনের এখন ৬বছর।সে সারাদিন ই মায়ের আগে পিছে ঘুর ঘুর করে আর শিউলি হচ্ছে তার সমস্ত আবদারের জায়গা।এখন শিউলি ও বিবাহ উপযুক্ত, তার জন্যে ও চারদিক থেকে বিয়ের প্রস্তাব আসে।সিরাজ এখন শহরে কাজ করে,ছুটি পেলে দুই চার দিনেদ জন্য বাড়ি আসে আর মিরাজ তার বাবার দোকানে বসে। রহিমা বিবি দুই মেয়েকে নিয়ে সারাদিন একা একাই থাকে। শিউলি ও সোহাগীর মরন পুরো সংসারের দেখা-শুনা করে। একদিন দোকান থেকে ফিরে এসে কাশেম মিয়া রহিমা বিবি কে বলে-শিউলির লাইগা ভালো একখান বিয়ার প্রস্তাব আইসে! পোলা বিদেশ থাকে,ছয় মাসের ছুটিতে বাড়িত আইসে, শিউলিরে ইশকুলে যাইতে দেইখা পোলার পছন্দ হইসে আর আমি ও পোলারে চিনি, অখন ছেলে পক্ষ এই সপ্তাহে বাড়ি আইবার চায় এখন তোমার কি মত? রহিমা বিবি উত্তর দেয়- সোহাগী আর সিরাজের লগে কথা কইলে ভালা হয় না! রহিম মিয়া বলে-ঠিক আসে সোহাগীরে খবর পাঠাও আর আমি সিরাজ রে ফোন দিয়া বিস্তারিত কমু। দরজার পেছন থেকে শিউলি আর মেহেরুন সব শুনছিল, মেহেরুন দরজার পেছন থেকে বেরিয়ে এসে রহিম মিয়াকে জাপটে ধরে বলে-আব্বা শিউলি বু রে বিয়া দিলে শিউলি বু ও কি বড় বুবুর মতন আমগো বাড়িতে আইতে পারবো না! কাশেম মিয়া মেয়ের মাথায় হাত রেখে বলে-কে কইসে আইতে পারবো না! আব্বা নিজে যাইয়া লইয়া আসমু তোর শিউলি বু রে, অবুজ মেহেরুন তার বাবাকে প্রশ্ন করে -আব্বা আমার বিয়া হইবো কবে? কাশেম মিয়া এক গাল হেসে উত্তর দেয়- তোমারে তো আমি বিয়াই দিমু নাহ! তোমার বিয়া হইয়া গেলে তুমি আমার কাছ থেইকা শশুর বাড়ি যাইবা গা এইডা আমি সহ্যই করতে পারুম নাহ……….চলবে?