
03/04/2025
#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা
৩.
লোকে বলে অন্তিক অন্তূর চেয়েও সুন্দর, যুবক হিসেবে। ভীষণ মেধাবি ছিল কলেজ জীবনে। আমজাদ সাহেবের সাথে বাবা-ছেলের সম্পর্ক চমৎকার সুন্দর ছিল। রাবেয়া বেগম বরাবরই সরলা ও অল্প শিক্ষিতা এক বাঙালি সংসারী নারী।
উনার বিপরীতেই আমজাদ সাহেবের গুণগুলোতেই দুটো সন্তান গড়ে উঠেছিল। অন্তূ তখনও ছোট, যখন অন্তিক কৈশোর পেরিয়ে যুবক হচ্ছিল। খুনশুটি, মারামারি, ঝামেলার শেষে আবারও বেহায়ার মতো গিয়ে অন্তূর ঝুঁটি টানার মতো দুষ্টুমির জন্য আমজাদ সাহেবের কাছে শাস্তি কম পেতে হয়নি তাকে।
ভীষণ ডানপিটে আর চঞ্চল, আর সবচেয়ে বেশি জেদি ছিল অন্তিক। তার প্রবল আত্মসম্মানবোধের জন্য মাঝেমধ্যেই এখানে-ওখানে ঝামেলা বাঁধিয়ে এসে মার খেত আব্বুর হাতে।
কলেজ শেষ করে ভার্সিটি ভর্তি হবার পালা এলে অন্তিকের সুযোগ হলো কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বাড়ি ছাড়তে হলো শিক্ষার সুবাদে। এরপর যা অঘটন ঘটে গেল।
মার্জিয়া কুষ্টিয়ার মেয়ে। তাকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল অন্তিক। তখন সে থার্ড ইয়ারের ছাত্র, বেকার শিক্ষার্থী।
সেই নিয়ে মাস্টারমশাই আমজাদ সাহেবের নামও খারাপ হয়েছিল বিশেষ। আমজাদ সাহেব হাই স্কুলের এক সামান্য শিক্ষক। উনার আদর্শের চূড়াকে মাটিতে মিশিয়ে যে কাজটা অন্তিক করেছিল, তাতে সবচেয়ে ক্ষতি সে নিজের এবং সবচেয়ে বড় কষ্টটা আব্বুকে দিয়েছিল। অথচ এটা বুঝে অনুতপ্ত ও ব্যথিত হবার বদলে সে বিগড়ে গেল।
দুটো থাপ্পর মেরেছিলেন আমজাদ সাহেব ছেলের গালে। কয়েকটা কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে অন্তিকের আত্মসম্মানে লাগা কথাটা ছিল, “বউ তো নিয়ি এসেছিস, খাওয়ানোর মুরোদ আছে?ʼʼ
আর বিশেষ কিছু বলেননি। এরপর থেকে অন্তিক বদলেছে, মার্জিয়া নিজেকে প্রকাশ করেছে। শিক্ষিত মেয়ে হওয়া সত্বেও আচরণ খুব উগ্র তার। অন্তূ বলেছিল, “ভাইয়া, তুই যে আত্মসম্মানের বড়াই এখনও করছিস, তা কিন্তু খুঁইয়েই তোর মতো মেধাবি এক ছাত্র প্রেমের মতো ছোট কাজ করেছে, আর তা করেছিস ভালো, এই ভরা ক্যারিয়ারকে গাঙে ভাসিয়ে বাপ-মায়ের মন ভেঙে বউ ঘরে আনাটা কোনো আত্মসম্মানবোধ জ্ঞানের পরিচয় ছিল না।ʼʼ
ব্যাস, আর না প্রাণের আব্বু না অন্তূ। কারও সঙ্গে কথা নেই। কী করছে, কী হচ্ছে সবটাতে নির্লিপ্ত, নিঃশব্দ। অথচ মার্জিয়ার উগ্রতা ও খিটখিটে মেজাজ দিনদিন লাই পাচ্ছে।
অন্তূদের এলাকায় একবার ব্রাক ব্রাঞ্চ পরিচালিত গণশিক্ষার কার্যক্রম এসেছিল। সেখানে বয়স্কদের শিক্ষা দেয়া হয়। সে তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিনাজপুরেই টুকটাক কোচিং করছে। শখের বিষয়, বড়ো নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষা দেয়া। সেও শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেছিল সেখানে। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল তাসিনের সাথে ওর। তাসিন ওর প্রেমে পড়ল। বাড়ির লোকদের সাথে, বিশেষ করে রাবেয়ার সাথে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তার। রাবেয়া মানুষটা যুবকদের সাথে খুব তাড়াতাড়ি মিশে যান। ভোলাভালা, সরল নারী যাকে বলে। এক পর্যায়ে তাসিন যখন প্রস্তাব দিলো বিয়ের, সাফ মানা করেছিল অন্তূ। সে বিয়ে করবেনা, এমনকি সে কখনও তাসিনকে প্রমিকের মতো নজরে দেখেনি। তাসিন নিজে থেকেই উতলা হয়ে পড়েছিল। এরপর কিছুদিন কেটে গেল। তাসিন হাল ছাড়ল, মার্জিয়া নিজের বোন বীথির সাথে তাসিনের বিয়ে দিলো। অথচ এখন কেন তাদের সংসারে অশান্তি তা জানার কথা নয় অন্তূর। তাসিনের সাথে কোনোকালেই তার বিশেষ যোগাযোগ ছিল না।
অন্তূর ধারণা, বীথির সংসারে কোনো ঝামেলা চলছে।আর এটাকেই কেন্দ্র করে মার্জিয়া ভাবছে, পুরোনো এই ব্যাপারটার জের ধরে তাসিন বীথিকে অত্যাচার করছে।
ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেইটের কাছে যেতেই আব্বুর সাথে দেখা হলো। সারারাতের যাত্রায় সকালে বাড়ি ফিরলেন আমজাদ সাহেব।
অন্তূর চোখে-মুখ খেলনা পাওয়া বাচ্চার মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, “এই অসময়ে ফিরলে যে!ʼʼ
-“কাজ শেষ হয়ে গেল, ফিরে এলাম। অন্তূ, খেয়ে বের হচ্ছিস নাকি না খেয়ে?ʼʼ
অন্তূ চোরের মতো মাথা নোয়ায়। আমজাদ সাহেব ধমকে ওঠার আগেই অন্তূ বলল, “আব্বু! তোমার গ্রামের জমি বিক্রি করার এমন কী বিশেষ দরকার পড়ল, বলোনি কিন্তু এখনও আমায়!ʼʼ
গম্ভীর মুখে বললেন আমজাদ সাহেব, “সব কথাই শুনতে হবে কেন? পড়ালেখায় মনোযোগ নষ্ট হবে এসব সাংসারিক বিষয় মাথায় আনলে, মন দিয়ে পড়।ʼʼ
অন্তূ অসন্তুষ্ট চিত্তে তাকায় আব্বুর দিকে। তিনি বললেন, “ভাড়া আছে কাছে?ʼʼ
অন্তূ মাথা নাড়ল, “আছে।ʼʼ
আমজাদ সাহেব শার্টের বুকপকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে অন্তূর হাতে দিলেন, “সাবধানে যাবি। ক্লাসশেষে দেরি করবি না, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।ʼʼ
অন্তূ একটু সপ্রতিভ হলো, “এ কথা বলছ কেন, আব্বু?ʼʼ
-“ক্লাস শেষে কোথাও কাজ আছে কোনো?ʼʼ
-“না, নেই।ʼʼ
-“তাহলে আর দেরি করার কী আছে? এমনিতেও ভার্সিটি চত্বর আজকাল ভালো চলছে না।ʼʼ
রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে অন্তূ এগিয়ে গেল গেইট দিয়ে। অন্যরকম লাগছে কিছু একটা। জটলা পাকানো লোকজন ক্যাম্পাসে! একস্থানে চেয়ার, ও বেঞ্চি পাতা। জয় বসে আছে পায়ে পা তুলে। পাশেই হামজা। দুজনের পরনেই সাদা পাঞ্জাবী। বসে বসে ঠ্যাং দুলাচ্ছে দুজন।
নভেম্বরের মাঝের সময়টা। শাল জড়ানো গায়ে। দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা। মহান দুই ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে ব্যাপক ধন্য তারা। হামজা স্বভাবসুলভ গম্ভীর মুখে বসে আছে। জয় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। স্থির থাকার স্বভাব নেই।
শঙ্কিত বুক নিয়ে ভিড় ঠেলেঠুলে একটু ভেতরে ঢুকল অন্তূ। জীর্ণ একটা ময়লা কাপড়ে ঢাকা কোনো মেয়ের শোয়ানো দেহ মাঠের ঘাসের ওপর পড়ে আছে। সেই মুহুর্তে কারও ধাক্কায় একটু পিছিয়ে এলো অন্তূ।
মেয়েটা কি আঁখি!? বুকের রক্ত ছলকে উঠল অন্তূর!
সালমা খালার মেয়েটা এত্ত সুন্দর! অভিশাপে ঝরে পড়া চাঁদের টুকরো বুঝি! ঘন চোখের পাপড়ি যেন এখনই ঝাপটে উঠবে! সেই সুন্দর মুখখানা বিবর্ণ, খামছির দাগে ভরতি, ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেধে শক্ত হয়ে গেছে, কালশিটে রং ধারণ করেছে। গাছি গাছি চুল ছিড়ে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে! বাকি দেহটা এক টুকরো কাপড়ে ঢাকা। সেই কাপড়টুকুর নিচে এতোগুলো মানুষের ভিড়ে কোনো এক মেয়ের নগ্ন দেহ পড়ে আছে। অন্তূর মনে হলো, সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে, যার ফলে শরীরটা ভার ছেড়ে দিতে চাইছে।
তখন কেউ ধমকে উঠল অন্তূকে, “পিছনে সরে দাঁড়ান, এত কাছে এসে দাঁড়াবেন না। সরুন, পিছিয়ে যান।ʼʼ
স্পষ্ট, বিন্যস্ত ভাষা, ভরাট আদেশমূলক কণ্ঠস্বর। কালচে খয়েরী ইন-শার্টে একটা ফর্সা মতো পুরুষ! অন্তূকে উপেক্ষা করে হাতা গোটাতে গোটাতে গিয়ে লাশের মাথার কাছে বসল। ইন্সপেক্টর রশিদ ডাকল তাকে, “মুস্তাকিন! আপনার ফোন বাজছে।ʼʼ
মুস্তাকিন ভিক্টিমের দেহ থেকে চোখ না তুলেই বলল, “পরে এটেন্ড করছি, রেখে দিন।ʼʼ
অন্তূ ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আব্বু রোজ পত্রিকা পড়ে রেখে দেয়, সেখানে এমন ঘটনাগুলো চোখে পড়ে। আজ সেই পত্রিকা ভেদ করে প্রথমবার কোনো খুবলে খাওয়া মেয়ের মরদেহ সম্মুখে এসে পড়েছে! এগুলো আসলেই হয়!
অন্তূ কাঁদে না। আমজাদ সাহেব কাঁদতে শেখাননি। কিন্তু আজ সেইসব শিক্ষা কাজে লাগল না। অন্তূ নেকাবের নিচ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়াচ্ছে। আরেকটু দূরে এসে মুখের নেকাবটা খুলে ফেলল। ব্যাগের সাইড থেকে পানির বোতল বের করে পানির ছিটা দিলো মুখে-চোখে। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে, দুটো শ্বাস নিলো জোরে জোরে।
ধমকাল নিজেকে, আশ্চর্য! এতো ভঙ্গুর হয়ে পড়ছ কেন তুমি, অন্তূ? তুমি তো এমন নও!
কোথা থেকে যেন সালমা খালা বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে ছুটে এসে ধপ করে বসে পড়লেন মেয়ের লাশের পাশে মাটিতে। অন্তূর চোখ বোধহয় আবার ভরে উঠেছে। নিজের ওপর রেগে উঠল অন্তূ! কী মুসিবত! এভাবে ভেঙে পড়লে জীবনকে মোকাবেলা করবে কী করে? কীসের মোকাবেলা? ওই তো একটা মেয়ের ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে মাঠের ওপর। অন্তূও তো মেয়ে! জঙ্গলের জানোয়ারেরা কবে যে মানুষের মতো রূপ ধরে মানুষের সমাজে বাস করতে লেগে পড়েছে, তাদের মোকাবেলা করতে ভঙ্গুর হলে চলবে কেন?
সামলা খালাকে সামলাতে যে নারীটি ছুটে এলো, অন্তূর চোখ আটকালো তার ওপর। পরনে বিবর্ণ শাড়ি, মুখটাও মলিন। অথচ সেই মুখের সৌন্দর্য অসামান্য! এদের চেহারার আভিজাত্য মিলছে না পরিস্থিতির সঙ্গে।
কে করেছে এসব? জয়, হামজা? তাদের কথাই প্রথমে মাথায় এলো অন্তূর। কিন্তু তা উচিত নয়। অন্তূ টের পেল, এমনটা হবার একটা কারণ আছে—সে আজ ক'দিন যাবৎ ওই দুটো নামে আতঙ্কিত বলেই এমন হয়েছে।
শাড়ি পরা নারীটি চাঁদনী। আঁখির ভাবী। মুস্তাকিন তাকে বলল, “আপনারা ওনাকে ভিক্টিমের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যান। আমাদের কাজ করতে দিন, এই স্পটে আপনারা না ঢুকলে সুবিধা হয়।ʼʼ
চাঁদনীর চোখে কেমন অদ্ভুত রহস্য! যেই রহস্যটাও এক প্রকার রহস্য যেন! সে কাঁদছে না, একটুও না। অথচ অপলক চেয়ে আছে নিথর চোখে আঁখির মুখের দিকে। সেই চোখের ভাষা অবর্ণনীয়।
অন্তূর মনে হলো, মুস্তাকিন লোকটা কসাই টাইপের। এমনিতেও সরকারী কর্মকর্তারা তা-ই হয়। মুস্তাকিন একটু আঁখির ভাই সোহেলকে ডাকল। সোহেল একদৃষ্টে বোনের লা শে র দিকে চেয়ে আছে, তার চোখে পানি নেই। সেও শুধু তাকিয়ে আছে। মুস্তাকিনের ডাকে এগিয়ে গেল। মুস্তাকিন কোনোরকম শিরোনাম ছাড়া প্রশ্ন করল, “কবে ফিরেছেন দেশে?ʼʼ
সোহেল আনমনে ছিল, একটু ঝারা মারল যেন নিজেকে, “হ্যাঁ! এইতো চারদিন হলো।ʼʼ
-“কোন দেশে থাকতেন?ʼʼ
-“দুবাই।ʼʼ
-“কী কাজ করতেন সেখানে?ʼʼ
-“রাজমিস্ত্রি আর সাটারিংয়ের কাজ করতাম।ʼʼ
-“আঁখিকে লাস্ট কবে দেখা গেছিল বাড়িতে?ʼʼ
খানিকক্ষণ চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “চাদনী বলে, সপ্তাহখানেক আগে।ʼʼ
-“নিজেদের সামলান। এবং আমাদের সাহায্য করুন তদন্তের কাজে। এভাবে কান্নাকাটি করে কোনোরকম বিচার পাবেন বলে মনে হয়। শক্ত করুন নিজেদের।ʼʼ
এক প্রকার ভয় খেলে গেল সোহেলের চেহারায়, “না স্যার! কোনো বিচার লাগবে না তো। আমরা কোনো বিচার চাইনা, আপনে খালি আমার বোনের লাশ দেন, বাড়ি নিয়ে যাই। কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই আমাদের।ʼʼ
মুস্তাকিন ঠোঁটে ঠোঁট গুজে নিচে তাকাল, “কেউ হুমকি দিয়েছে আপনাদের?ʼʼ
সোহেল মাথা নাড়ল, “না, না হুমকি দিবে কে?ʼʼ
তাদের কথোপকথন ছাত্র-ছাত্রীরা শুনছিল।
মুস্তাকিন দূর থেকে জয় ও হামজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাউকে সন্দেহ করছেন?ʼʼ
সোহেল আবারও দ্রুত মাথা নাড়ল, “না।ʼʼ কণ্ঠস্বরে প্রাণ নেই, নিষ্প্রভ গলার স্বর।
মুস্তাকিন বামহাত পকেটে গুজে বলল, “এসে থেকে শুনছি, সকলের ধারণা কাজটা পাটোয়ারী পরিবারের দুই ছেলে করেছে! আপনাদের কী ধারণা?ʼʼ
সোহেল দ্রুত জবাব দিলো, “না না, স্যার! উনারা ক্যান করবেন এইসব? উনারা তো সব ঠিক করে দিতে চাইছিলেন! আমরাই উঠি নাই বাড়ি থেকে। এখন চলে যাব, ঝামেলা মিটে যাবে।ʼʼ
অগোছালো, অযাচিত কথা সোহেলের। বোনের মরদেহ পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। তারা বাড়ি খালি করার স্বীকারক্তি দিচ্ছে! চরম ঘাপলা বিষয়টায়! আবার সহজও বলা চলে। খুব বেশিই ভয় পেয়েছে হয়ত, অথবা কিছু লুকোনোর চেষ্টা, গা বাঁচানোর চেষ্টা!
মেয়েটা গণধর্ষণের শিকার। এবং ধর্ষণটা অপ্রকৃতিতস্থ কারও দ্বারা সংঘটিত হয়েছে! আঁখির দেহ তা-ই বলছে।
মুস্তাকিন গিয়ে হাঁটু ভাজ করে উবু হয়ে বসল চাঁদনীর পাশে। জিজ্ঞেস করল, “আঁখি কবে থেকে নিখোঁজ ছিল?ʼʼ
চাঁদনী ঘর্মাক্ত মুখটা মুছল মলিন শাড়ির আচল দিয়ে, “সপ্তাহখানেক আগে দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি আসছে, টেস্ট পরীক্ষা চলতেছিল এসএসসির, বিকালে বাইর হয়ে গেল কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য, এই তো ফিরে আসছে, স্যার!ʼʼ
অন্তূর কলিজায় মনে হলো সজোরে এসে একটা তীর তীব্র বেগে গেঁথে গেল। 'এই তো ফিরে আসছে, স্যার!ʼ
মুস্তাকিন উঠে দাঁড়িয়ে রশিদকে ডাকল, “এদিকে আসুন!ʼʼ
-“জি, স্যার!ʼʼ রশিদ এগিয়ে এলো।
মুস্তাকিন তার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে বলল, “যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের কাজ শুরু করুন। বডিটাকে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন, এজ সুন এজ পসিবল!ʼʼ
রশিদ মাথা নাড়ল, আবার বলল, “কিন্তু স্যার! গার্জিয়ানরা তো লাশ বাড়ি নিতে চাচ্ছে। খুব জিদ ধরে আছে। কোনোভাবেই তারা লা শ কাটাছেঁড়া করতে দেয়া রাজী না। আপনি একটু কথা বলুন ওদের সঙ্গে।ʼʼ
মুস্তাকিন মাথা নাড়ল, “আচ্ছা, কথা বলছি। দ্রুত করুন। ক্যাম্পাসে লোক জড়ো হচ্ছে, একাট হাঙ্গামা হবার চান্স আছে। তার আগেই বডি ট্রান্সফার করুন মর্গে। কখন কে জানে জনতার মাঝে বিক্ষোভ জেগে ওঠে!ʼʼ
প্রফেসর এগিয়ে এলেন মুস্তাকিনের দিকে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন মুস্তাকিনের সঙ্গে, “আমি প্রিন্সিপাল ইউসুফ সিরাজীʼʼ
মুস্তাকিন মাথা নাড়ল সামান্য, “সৈয়দ মুস্তাকিন মহান। ইনভেস্টিগেটর— পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ডিপার্টমেন্ট।ʼʼ
প্রফেসর রশিদের সঙ্গে হাত মেলালেন। রশিদ নিজের পরিচয় দিলো, “রশিদ আলম। ইন্সপেক্টর অব থানা পুলিশ।ʼʼ
প্রফেসর দুঃখ প্রকাশ করলেন, “কী যে হচ্ছে ভার্সিটিতে আজকাল! ছেলেমেয়েরা আতঙ্কিত, কারা এসব করেছে কে জানে..ʼʼ
মুস্তাকিন কথার মাঝখানেই ফোন কানে ধরে অন্যদিকে চলে গেল। রশিদ প্রফেসর কথায় অনিচ্ছাকৃত 'হুʼ, 'হ্যাঁʼ ঘাঁড় নাড়াতে থাকল।
মুস্তাকিনকে দেখে হামজা উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। জয় কোনোমতো ফোন থেকে মাথা তুলল, “গুড জব, অফিসার!ʼʼ
মুস্তাকিন সামান্য হাসল অদ্ভুত ভঙ্গিতে, “থ্যাংক ইউ!ʼʼ এরপর হুট করেই বলল, “লোকে আপনাদের দিকে আঙুল তুলছে, আপনাদের কী খেয়াল!ʼʼ
হামজা হাসল, “আপনি তুলছেন না আঙুল?ʼʼ
-“আমি আম জনতার থেকে খানিক আলাদা, বলা চলে নিজের পেশার খাতিরেই! প্রমাণ ছাড়া আঙুল তুললে চাকরি থাকবে না।ʼʼ চোখ মারল হামজাকে মুস্তাকিন।
হামজা ছেলেদের চলে যেতে ইশারা করে। সালমা কাঁদছেন, জোরে জোরে কাঁদছেন বুক চাপড়ে, লোকের চাপা গুঞ্জন, আর পরিবেশে অভিশাপের কালশিটে ধোঁয়া ছড়িয়েছে যেন।
জয় জবাব দিলো মুস্তাকিনের, “আপনার চাকরি ধরেন আমি রক্ষা করব, তাইলে আঙুল তুলে জেলে ভরবেন তো?ʼʼ
মুস্তাকিন বসল দুজনের সামনে একটা চেয়ারে। সূর্যের তেজ ও আলো কমে উত্তরে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। কাধে ঝুলিয়ে রাখা ডেনিম জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে বলল, “আপনার শখ অথবা শাস্তি সহ্য করার কনফিডেন্স– কোনটা ধরব?ʼʼ
হামজা প্রসঙ্গ বদলালো, “কিছু জিজ্ঞেস করতে চান, অফিসার?ʼʼ
প্রফেসর সিরাজী এসে দাঁড়ালেন পাশে। মুস্তাকিন এবার সরাসরি কথায় এলো, “আপনারা আমাদের ডেকেছেন সকাল আটটার দিকে। তাহলে এখানে লাশ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল ঠিক কখন, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে?ʼʼ
হামজা মাথা নাড়ল, “তা জানে না কেউ-ই। আমাকে কল করা হয়েছে, তখনও আমি ঘুমে ছিলাম। ছেলেরা কল করে জানালো।ʼʼ
জয়ের দিকে ফিরল মুস্তাকিন। জয় মাথা ঝাঁকালো, “ভাই আমারে জাগায়ে নিয়ে আসছে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম।ʼʼ
মুস্তাকিন জিজ্ঞেস করল, “আপনারা একসঙ্গে থাকেন?ʼʼ
জয় মাথা নাড়ল, “উহু! এক বাড়িতে। এক ঘরে থাকতাম, লোক বদনাম করবে জন্য থাকা হয় না। বদনাম তো আর কম নাই এমনিতেইʼʼ
হেসে ফেলল মুস্তাকিন। পরে নিজেকে সামলে বলল, “লাশ এক্সাক্টলি কোথায় ফেলা হয়েছিল সেই জায়গাটি দেখান আমাদের। সেটা তো দেখেছেন?ʼʼ
বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন প্রাঙ্গনের পেছন দিকটা নির্জন, এবং গাছগাছালিতে ছাওয়া। সেখানে সচরাচর লোকের যাতায়াত অতটাও নেই। দিনের বেলা ছেলে-মেয়েরা আড্ডা দিতে নির্জন জায়গাটি বেছে নেয়। রাতে একদম সুনশান। ক্যাম্পাসের অফ-সাইড বলা চলে। সর্ব প্রথম লাশ দেখেছে ঝাড়ুদার। সে প্রথমে বুঝতে পেরেছিল না, ওটা লা শ। কোনোমতো ওড়নাটা জড়ানো ছিল লাশের দেহে। পরে কে বা কারা যেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এনেছে। এটা সকালে এসে থানা পুলিশের কাছ থেকেই শুনেছে সে।
মুস্তাকিন দেখল পুরো আশপাশটা। জয়কে বলল, “আপনার চোখে প্রচুর ঘুম, দেখছি! লালচে হয়ে আছে, রাতে ঘুমাননি মনে হচ্ছে! এখন একটু বিশ্রাম প্রয়োজন!ʼʼ
মুস্তাকিন কথাটা দ্বারা কিছু নির্দেশ করল। জয় চাদরটা গা থেকে খুলে গলায় পেঁচালো ওড়নার মতো করে। হেসে বলল,, “রাতে ঘুমানোর অভ্যাস এমনিতেও নাই আমার, ঘুম আসলে সকালে হয়নি বললে ঠিক হইতো আমার জন্য! সকালে টেনে তুলে আনা হইছে। আসলে আমাদের মতো নেতাকর্মীদের দুঃখ আর পরিশ্রম আপনারা কোনোদিন বুঝবেন না। জনতার মন রাখতে কত যে লোক দেখানো ঢং করতে হয়! যেমন ধরেন, আমার আসতে ইচ্ছে করতেছিল না, কষ্ট হচ্ছেনা বিশেষ মেয়েটা বা তার পরিবারের জন্য। তবুও আসতে হলো, ইভেন ধর্না ধরে বসে থাকতে হচ্ছে হুদাই এইখানে নিরস মুখে। কার বাল লাড়তেছি বসে? মানুষ তো মরবেই, এই অবধারিত বিষয়ে এইসব ঢং কি মনে-ধোনে কোথাও সয়? তবু সওয়া লাগে, কারণ, তথাকথিত সমাজসেবক আমি। ফাক অফ দিজ ইনট্রোডাকশন!ʼʼ
-“আপনি মানছেন আপনি তথাকথিত সমাজসেবক?ʼʼ
জয় চাদরটা গলা থেকে হাতে কব্জিতে জড়াতে জড়াতে বলল, “না মানার কী আছে? আমি ভালো না, তা লোক জানে, আর তা কি আমি জানার আগেই? আমি জানছি, এরপর লোকরে জানাইছি, তখন নৃ লোক জানছে।ʼʼ
মুস্তাকিন কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে জয়কে জিজ্ঞেস করে মুস্তাকিন, “তাহলে আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখব?ʼʼ
-“উহু! এই কেইসে সাসপেক্ট হিসেবে থাকতে থাকতে উল্টাপাল্টা কিছু প্রমাণ হয়ে গেলে, ফাঁসি হয়ে যাবে, যেহেতু মেয়েটা মরে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি মরে কী লাভ? মরব এইরকম কোনো কেইসের দায়েই, তবে একটু বয়সকালে। এখনও বিয়েশাদীই করি নাই, বিশেষত বাসরটা.... এখন মরাটা ঠিক না। এটা থেকে বাদ রাখেন আমায়।ʼʼ
মুস্তাকিন হামজাকে বলল, “কাউন্সিলর সাহেবকে একবার থানায় আসতে বলবেন বিকেলে। আপনি আসলেও পারেন।ʼʼ
হামজা পাঞ্জাবীর হাতার বোতাম খুলে তা কনুইয়ে গোটাতে গোটাতে বলল, “আমি আসতে পারব না, আব্বা যাবে। আমার ব্যস্ত সময় কাটছে— নির্বাচন এগিয়ে আসছে সামনে।ʼʼ
মুস্তাকিন হাঁটতে হাঁটতে আবার পেছন ফিরে দেখল হামজাকে। পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে চেয়ারটায়। মুখে চাপ-দাড়ি, পুরু ঠোঁটের ওপর ঘন গোফ, গায়ে জড়ানো চাদরের প্রান্ত ঝুলছে একপাশে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে জয়।
জয় তাকিয়ে আছে একটা বোরকা পরা মেয়ের দিকে। মেয়েটির সাথে মুস্তাকিন ধাক্কা খেয়েছিল। মেয়েটা অপলক চেয়ে আছে আঁখির লা"শের দিকে।
লা"শকে ফ্রিজিং গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা চলছে, মর্গ থেকে লোক এসেছে।
চলবে...