The Crochet Colony

The Crochet Colony Contact information, map and directions, contact form, opening hours, services, ratings, photos, videos and announcements from The Crochet Colony, Digital creator, Chittagong.

 #অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা৩.লোকে বলে অন্তিক অন্তূর চেয়েও সুন্দর, যুবক হিসেবে। ভীষণ মেধাবি ছিল কলেজ জীবনে। আমজাদ...
03/04/2025

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

৩.

লোকে বলে অন্তিক অন্তূর চেয়েও সুন্দর, যুবক হিসেবে। ভীষণ মেধাবি ছিল কলেজ জীবনে। আমজাদ সাহেবের সাথে বাবা-ছেলের সম্পর্ক চমৎকার সুন্দর ছিল। রাবেয়া বেগম বরাবরই সরলা ও অল্প শিক্ষিতা এক বাঙালি সংসারী নারী।

উনার বিপরীতেই আমজাদ সাহেবের গুণগুলোতেই দুটো সন্তান গড়ে উঠেছিল। অন্তূ তখনও ছোট, যখন অন্তিক কৈশোর পেরিয়ে যুবক হচ্ছিল। খুনশুটি, মারামারি, ঝামেলার শেষে আবারও বেহায়ার মতো গিয়ে অন্তূর ঝুঁটি টানার মতো দুষ্টুমির জন্য আমজাদ সাহেবের কাছে শাস্তি কম পেতে হয়নি তাকে।

ভীষণ ডানপিটে আর চঞ্চল, আর সবচেয়ে বেশি জেদি ছিল অন্তিক। তার প্রবল আত্মসম্মানবোধের জন্য মাঝেমধ্যেই এখানে-ওখানে ঝামেলা বাঁধিয়ে এসে মার খেত আব্বুর হাতে।

কলেজ শেষ করে ভার্সিটি ভর্তি হবার পালা এলে অন্তিকের সুযোগ হলো কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার। বাড়ি ছাড়তে হলো শিক্ষার সুবাদে। এরপর যা অঘটন ঘটে গেল।

মার্জিয়া কুষ্টিয়ার মেয়ে। তাকে ভাগিয়ে নিয়ে চলে এসেছিল অন্তিক। তখন সে থার্ড ইয়ারের ছাত্র, বেকার শিক্ষার্থী।
সেই নিয়ে মাস্টারমশাই আমজাদ সাহেবের নামও খারাপ হয়েছিল বিশেষ। আমজাদ সাহেব হাই স্কুলের এক সামান্য শিক্ষক। উনার আদর্শের চূড়াকে মাটিতে মিশিয়ে যে কাজটা অন্তিক করেছিল, তাতে সবচেয়ে ক্ষতি সে নিজের এবং সবচেয়ে বড় কষ্টটা আব্বুকে দিয়েছিল। অথচ এটা বুঝে অনুতপ্ত ও ব্যথিত হবার বদলে সে বিগড়ে গেল।

দুটো থাপ্পর মেরেছিলেন আমজাদ সাহেব ছেলের গালে। কয়েকটা কথা বলেছিলেন, তার মধ্যে অন্তিকের আত্মসম্মানে লাগা কথাটা ছিল, “বউ তো নিয়ি এসেছিস, খাওয়ানোর মুরোদ আছে?ʼʼ

আর বিশেষ কিছু বলেননি। এরপর থেকে অন্তিক বদলেছে, মার্জিয়া নিজেকে প্রকাশ করেছে। শিক্ষিত মেয়ে হওয়া সত্বেও আচরণ খুব উগ্র তার। অন্তূ বলেছিল, “ভাইয়া, তুই যে আত্মসম্মানের বড়াই এখনও করছিস, তা কিন্তু খুঁইয়েই তোর মতো মেধাবি এক ছাত্র প্রেমের মতো ছোট কাজ করেছে, আর তা করেছিস ভালো, এই ভরা ক্যারিয়ারকে গাঙে ভাসিয়ে বাপ-মায়ের মন ভেঙে বউ ঘরে আনাটা কোনো আত্মসম্মানবোধ জ্ঞানের পরিচয় ছিল না।ʼʼ

ব্যাস, আর না প্রাণের আব্বু না অন্তূ। কারও সঙ্গে কথা নেই। কী করছে, কী হচ্ছে সবটাতে নির্লিপ্ত, নিঃশব্দ। অথচ মার্জিয়ার উগ্রতা ও খিটখিটে মেজাজ দিনদিন লাই পাচ্ছে।

অন্তূদের এলাকায় একবার ব্রাক ব্রাঞ্চ পরিচালিত গণশিক্ষার কার্যক্রম এসেছিল। সেখানে বয়স্কদের শিক্ষা দেয়া হয়। সে তখন এইচএসসি পরীক্ষা দিয়ে দিনাজপুরেই টুকটাক কোচিং করছে। শখের বিষয়, বড়ো নিরক্ষর মানুষদের শিক্ষা দেয়া। সেও শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেছিল সেখানে। সেখানেই পরিচয় হয়েছিল তাসিনের সাথে ওর। তাসিন ওর প্রেমে পড়ল। বাড়ির লোকদের সাথে, বিশেষ করে রাবেয়ার সাথে খুব সখ্যতা গড়ে উঠেছিল তার। রাবেয়া মানুষটা যুবকদের সাথে খুব তাড়াতাড়ি মিশে যান। ভোলাভালা, সরল নারী যাকে বলে। এক পর্যায়ে তাসিন যখন প্রস্তাব দিলো বিয়ের, সাফ মানা করেছিল অন্তূ। সে বিয়ে করবেনা, এমনকি সে কখনও তাসিনকে প্রমিকের মতো নজরে দেখেনি। তাসিন নিজে থেকেই উতলা হয়ে পড়েছিল। এরপর কিছুদিন কেটে গেল। তাসিন হাল ছাড়ল, মার্জিয়া নিজের বোন বীথির সাথে তাসিনের বিয়ে দিলো। অথচ এখন কেন তাদের সংসারে অশান্তি তা জানার কথা নয় অন্তূর। তাসিনের সাথে কোনোকালেই তার বিশেষ যোগাযোগ ছিল না।

অন্তূর ধারণা, বীথির সংসারে কোনো ঝামেলা চলছে।আর এটাকেই কেন্দ্র করে মার্জিয়া ভাবছে, পুরোনো এই ব্যাপারটার জের ধরে তাসিন বীথিকে অত্যাচার করছে।

ভার্সিটির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে গেইটের কাছে যেতেই আব্বুর সাথে দেখা হলো। সারারাতের যাত্রায় সকালে বাড়ি ফিরলেন আমজাদ সাহেব।

অন্তূর চোখে-মুখ খেলনা পাওয়া বাচ্চার মতো উদ্ভাসিত হয়ে উঠল, “এই অসময়ে ফিরলে যে!ʼʼ

-“কাজ শেষ হয়ে গেল, ফিরে এলাম। অন্তূ, খেয়ে বের হচ্ছিস নাকি না খেয়ে?ʼʼ

অন্তূ চোরের মতো মাথা নোয়ায়। আমজাদ সাহেব ধমকে ওঠার আগেই অন্তূ বলল, “আব্বু! তোমার গ্রামের জমি বিক্রি করার এমন কী বিশেষ দরকার পড়ল, বলোনি কিন্তু এখনও আমায়!ʼʼ

গম্ভীর মুখে বললেন আমজাদ সাহেব, “সব কথাই শুনতে হবে কেন? পড়ালেখায় মনোযোগ নষ্ট হবে এসব সাংসারিক বিষয় মাথায় আনলে, মন দিয়ে পড়।ʼʼ

অন্তূ অসন্তুষ্ট চিত্তে তাকায় আব্বুর দিকে। তিনি বললেন, “ভাড়া আছে কাছে?ʼʼ

অন্তূ মাথা নাড়ল, “আছে।ʼʼ

আমজাদ সাহেব শার্টের বুকপকেট থেকে পঞ্চাশ টাকা বের করে অন্তূর হাতে দিলেন, “সাবধানে যাবি। ক্লাসশেষে দেরি করবি না, তাড়াতাড়ি ফিরে আসবি।ʼʼ

অন্তূ একটু সপ্রতিভ হলো, “এ কথা বলছ কেন, আব্বু?ʼʼ

-“ক্লাস শেষে কোথাও কাজ আছে কোনো?ʼʼ

-“না, নেই।ʼʼ

-“তাহলে আর দেরি করার কী আছে? এমনিতেও ভার্সিটি চত্বর আজকাল ভালো চলছে না।ʼʼ

রিক্সা থেকে নেমে ভাড়া মিটিয়ে অন্তূ এগিয়ে গেল গেইট দিয়ে। অন্যরকম লাগছে কিছু একটা। জটলা পাকানো লোকজন ক্যাম্পাসে! একস্থানে চেয়ার, ও বেঞ্চি পাতা। জয় বসে আছে পায়ে পা তুলে। পাশেই হামজা। দুজনের পরনেই সাদা পাঞ্জাবী। বসে বসে ঠ্যাং দুলাচ্ছে দুজন।

নভেম্বরের মাঝের সময়টা। শাল জড়ানো গায়ে। দুজনকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে ছাত্র সংগঠনের ছেলেরা। মহান দুই ব্যক্তির পাশে দাঁড়ানোর সুযোগ পেয়ে ব্যাপক ধন্য তারা। হামজা স্বভাবসুলভ গম্ভীর মুখে বসে আছে। জয় এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে। স্থির থাকার স্বভাব নেই।

শঙ্কিত বুক নিয়ে ভিড় ঠেলেঠুলে একটু ভেতরে ঢুকল অন্তূ। জীর্ণ একটা ময়লা কাপড়ে ঢাকা কোনো মেয়ের শোয়ানো দেহ মাঠের ঘাসের ওপর পড়ে আছে। সেই মুহুর্তে কারও ধাক্কায় একটু পিছিয়ে এলো অন্তূ।

মেয়েটা কি আঁখি!? বুকের রক্ত ছলকে উঠল অন্তূর!

সালমা খালার মেয়েটা এত্ত সুন্দর! অভিশাপে ঝরে পড়া চাঁদের টুকরো বুঝি! ঘন চোখের পাপড়ি যেন এখনই ঝাপটে উঠবে! সেই সুন্দর মুখখানা বিবর্ণ, খামছির দাগে ভরতি, ঠোঁটের কোণে রক্ত জমাট বেধে শক্ত হয়ে গেছে, কালশিটে রং ধারণ করেছে। গাছি গাছি চুল ছিড়ে উঠিয়ে ফেলা হয়েছে! বাকি দেহটা এক টুকরো কাপড়ে ঢাকা। সেই কাপড়টুকুর নিচে এতোগুলো মানুষের ভিড়ে কোনো এক মেয়ের নগ্ন দেহ পড়ে আছে। অন্তূর মনে হলো, সে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলছে, যার ফলে শরীরটা ভার ছেড়ে দিতে চাইছে।

তখন কেউ ধমকে উঠল অন্তূকে, “পিছনে সরে দাঁড়ান, এত কাছে এসে দাঁড়াবেন না। সরুন, পিছিয়ে যান।ʼʼ

স্পষ্ট, বিন্যস্ত ভাষা, ভরাট আদেশমূলক কণ্ঠস্বর। কালচে খয়েরী ইন-শার্টে একটা ফর্সা মতো পুরুষ! অন্তূকে উপেক্ষা করে হাতা গোটাতে গোটাতে গিয়ে লাশের মাথার কাছে বসল। ইন্সপেক্টর রশিদ ডাকল তাকে, “মুস্তাকিন! আপনার ফোন বাজছে।ʼʼ

মুস্তাকিন ভিক্টিমের দেহ থেকে চোখ না তুলেই বলল, “পরে এটেন্ড করছি, রেখে দিন।ʼʼ

অন্তূ ভিড় ছেড়ে বেরিয়ে এলো। আব্বু রোজ পত্রিকা পড়ে রেখে দেয়, সেখানে এমন ঘটনাগুলো চোখে পড়ে। আজ সেই পত্রিকা ভেদ করে প্রথমবার কোনো খুবলে খাওয়া মেয়ের মরদেহ সম্মুখে এসে পড়েছে! এগুলো আসলেই হয়!

অন্তূ কাঁদে না। আমজাদ সাহেব কাঁদতে শেখাননি। কিন্তু আজ সেইসব শিক্ষা কাজে লাগল না। অন্তূ নেকাবের নিচ দিয়ে ঝরঝর করে অশ্রু গড়াচ্ছে। আরেকটু দূরে এসে মুখের নেকাবটা খুলে ফেলল। ব্যাগের সাইড থেকে পানির বোতল বের করে পানির ছিটা দিলো মুখে-চোখে। টিস্যু দিয়ে মুখটা মুছে, দুটো শ্বাস নিলো জোরে জোরে।

ধমকাল নিজেকে, আশ্চর্য! এতো ভঙ্গুর হয়ে পড়ছ কেন তুমি, অন্তূ? তুমি তো এমন নও!

কোথা থেকে যেন সালমা খালা বুক চাপড়ে আহাজারি করতে করতে ছুটে এসে ধপ করে বসে পড়লেন মেয়ের লাশের পাশে মাটিতে। অন্তূর চোখ বোধহয় আবার ভরে উঠেছে। নিজের ওপর রেগে উঠল অন্তূ! কী মুসিবত! এভাবে ভেঙে পড়লে জীবনকে মোকাবেলা করবে কী করে? কীসের মোকাবেলা? ওই তো একটা মেয়ের ছিন্নভিন্ন লাশ পড়ে আছে মাঠের ওপর। অন্তূও তো মেয়ে! জঙ্গলের জানোয়ারেরা কবে যে মানুষের মতো রূপ ধরে মানুষের সমাজে বাস করতে লেগে পড়েছে, তাদের মোকাবেলা করতে ভঙ্গুর হলে চলবে কেন?

সামলা খালাকে সামলাতে যে নারীটি ছুটে এলো, অন্তূর চোখ আটকালো তার ওপর। পরনে বিবর্ণ শাড়ি, মুখটাও মলিন। অথচ সেই মুখের সৌন্দর্য অসামান্য! এদের চেহারার আভিজাত্য মিলছে না পরিস্থিতির সঙ্গে।

কে করেছে এসব? জয়, হামজা? তাদের কথাই প্রথমে মাথায় এলো অন্তূর। কিন্তু তা উচিত নয়। অন্তূ টের পেল, এমনটা হবার একটা কারণ আছে—সে আজ ক'দিন যাবৎ ওই দুটো নামে আতঙ্কিত বলেই এমন হয়েছে।

শাড়ি পরা নারীটি চাঁদনী। আঁখির ভাবী। মুস্তাকিন তাকে বলল, “আপনারা ওনাকে ভিক্টিমের কাছ থেকে দূরে নিয়ে যান। আমাদের কাজ করতে দিন, এই স্পটে আপনারা না ঢুকলে সুবিধা হয়।ʼʼ

চাঁদনীর চোখে কেমন অদ্ভুত রহস্য! যেই রহস্যটাও এক প্রকার রহস্য যেন! সে কাঁদছে না, একটুও না। অথচ অপলক চেয়ে আছে নিথর চোখে আঁখির মুখের দিকে। সেই চোখের ভাষা অবর্ণনীয়।

অন্তূর মনে হলো, মুস্তাকিন লোকটা কসাই টাইপের। এমনিতেও সরকারী কর্মকর্তারা তা-ই হয়। মুস্তাকিন একটু আঁখির ভাই সোহেলকে ডাকল। সোহেল একদৃষ্টে বোনের লা শে র দিকে চেয়ে আছে, তার চোখে পানি নেই। সেও শুধু তাকিয়ে আছে। মুস্তাকিনের ডাকে এগিয়ে গেল। মুস্তাকিন কোনোরকম শিরোনাম ছাড়া প্রশ্ন করল, “কবে ফিরেছেন দেশে?ʼʼ

সোহেল আনমনে ছিল, একটু ঝারা মারল যেন নিজেকে, “হ্যাঁ! এইতো চারদিন হলো।ʼʼ

-“কোন দেশে থাকতেন?ʼʼ

-“দুবাই।ʼʼ

-“কী কাজ করতেন সেখানে?ʼʼ

-“রাজমিস্ত্রি আর সাটারিংয়ের কাজ করতাম।ʼʼ

-“আঁখিকে লাস্ট কবে দেখা গেছিল বাড়িতে?ʼʼ

খানিকক্ষণ চুপচাপ মাটির দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, “চাদনী বলে, সপ্তাহখানেক আগে।ʼʼ

-“নিজেদের সামলান। এবং আমাদের সাহায্য করুন তদন্তের কাজে। এভাবে কান্নাকাটি করে কোনোরকম বিচার পাবেন বলে মনে হয়। শক্ত করুন নিজেদের।ʼʼ

এক প্রকার ভয় খেলে গেল সোহেলের চেহারায়, “না স্যার! কোনো বিচার লাগবে না তো। আমরা কোনো বিচার চাইনা, আপনে খালি আমার বোনের লাশ দেন, বাড়ি নিয়ে যাই। কারোর বিরুদ্ধে অভিযোগ নাই আমাদের।ʼʼ

মুস্তাকিন ঠোঁটে ঠোঁট গুজে নিচে তাকাল, “কেউ হুমকি দিয়েছে আপনাদের?ʼʼ

সোহেল মাথা নাড়ল, “না, না হুমকি দিবে কে?ʼʼ

তাদের কথোপকথন ছাত্র-ছাত্রীরা শুনছিল।

মুস্তাকিন দূর থেকে জয় ও হামজার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, “কাউকে সন্দেহ করছেন?ʼʼ

সোহেল আবারও দ্রুত মাথা নাড়ল, “না।ʼʼ কণ্ঠস্বরে প্রাণ নেই, নিষ্প্রভ গলার স্বর।

মুস্তাকিন বামহাত পকেটে গুজে বলল, “এসে থেকে শুনছি, সকলের ধারণা কাজটা পাটোয়ারী পরিবারের দুই ছেলে করেছে! আপনাদের কী ধারণা?ʼʼ

সোহেল দ্রুত জবাব দিলো, “না না, স্যার! উনারা ক্যান করবেন এইসব? উনারা তো সব ঠিক করে দিতে চাইছিলেন! আমরাই উঠি নাই বাড়ি থেকে। এখন চলে যাব, ঝামেলা মিটে যাবে।ʼʼ

অগোছালো, অযাচিত কথা সোহেলের। বোনের মরদেহ পড়ে আছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে। তারা বাড়ি খালি করার স্বীকারক্তি দিচ্ছে! চরম ঘাপলা বিষয়টায়! আবার সহজও বলা চলে। খুব বেশিই ভয় পেয়েছে হয়ত, অথবা কিছু লুকোনোর চেষ্টা, গা বাঁচানোর চেষ্টা!

মেয়েটা গণধর্ষণের শিকার। এবং ধর্ষণটা অপ্রকৃতিতস্থ কারও দ্বারা সংঘটিত হয়েছে! আঁখির দেহ তা-ই বলছে।

মুস্তাকিন গিয়ে হাঁটু ভাজ করে উবু হয়ে বসল চাঁদনীর পাশে। জিজ্ঞেস করল, “আঁখি কবে থেকে নিখোঁজ ছিল?ʼʼ

চাঁদনী ঘর্মাক্ত মুখটা মুছল মলিন শাড়ির আচল দিয়ে, “সপ্তাহখানেক আগে দুপুরে স্কুল থেকে বাড়ি আসছে, টেস্ট পরীক্ষা চলতেছিল এসএসসির, বিকালে বাইর হয়ে গেল কোচিংয়ে যাওয়ার জন্য, এই তো ফিরে আসছে, স্যার!ʼʼ

অন্তূর কলিজায় মনে হলো সজোরে এসে একটা তীর তীব্র বেগে গেঁথে গেল। 'এই তো ফিরে আসছে, স্যার!ʼ

মুস্তাকিন উঠে দাঁড়িয়ে রশিদকে ডাকল, “এদিকে আসুন!ʼʼ

-“জি, স্যার!ʼʼ রশিদ এগিয়ে এলো।

মুস্তাকিন তার হাত থেকে ফোনটা নিতে নিতে বলল, “যত দ্রুত সম্ভব তদন্তের কাজ শুরু করুন। বডিটাকে ফরেন্সিক ল্যাবে পাঠাবার ব্যবস্থা করুন, এজ সুন এজ পসিবল!ʼʼ

রশিদ মাথা নাড়ল, আবার বলল, “কিন্তু স্যার! গার্জিয়ানরা তো লাশ বাড়ি নিতে চাচ্ছে। খুব জিদ ধরে আছে। কোনোভাবেই তারা লা শ কাটাছেঁড়া করতে দেয়া রাজী না। আপনি একটু কথা বলুন ওদের সঙ্গে।ʼʼ

মুস্তাকিন মাথা নাড়ল, “আচ্ছা, কথা বলছি। দ্রুত করুন। ক্যাম্পাসে লোক জড়ো হচ্ছে, একাট হাঙ্গামা হবার চান্স আছে। তার আগেই বডি ট্রান্সফার করুন মর্গে। কখন কে জানে জনতার মাঝে বিক্ষোভ জেগে ওঠে!ʼʼ

প্রফেসর এগিয়ে এলেন মুস্তাকিনের দিকে। হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করলেন মুস্তাকিনের সঙ্গে, “আমি প্রিন্সিপাল ইউসুফ সিরাজীʼʼ

মুস্তাকিন মাথা নাড়ল সামান্য, “সৈয়দ মুস্তাকিন মহান। ইনভেস্টিগেটর— পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ডিপার্টমেন্ট।ʼʼ

প্রফেসর রশিদের সঙ্গে হাত মেলালেন। রশিদ নিজের পরিচয় দিলো, “রশিদ আলম। ইন্সপেক্টর অব থানা পুলিশ।ʼʼ
প্রফেসর দুঃখ প্রকাশ করলেন, “কী যে হচ্ছে ভার্সিটিতে আজকাল! ছেলেমেয়েরা আতঙ্কিত, কারা এসব করেছে কে জানে..ʼʼ

মুস্তাকিন কথার মাঝখানেই ফোন কানে ধরে অন্যদিকে চলে গেল। রশিদ প্রফেসর কথায় অনিচ্ছাকৃত 'হুʼ, 'হ্যাঁʼ ঘাঁড় নাড়াতে থাকল।

মুস্তাকিনকে দেখে হামজা উঠে দাঁড়িয়ে হ্যান্ডশেক করল। জয় কোনোমতো ফোন থেকে মাথা তুলল, “গুড জব, অফিসার!ʼʼ

মুস্তাকিন সামান্য হাসল অদ্ভুত ভঙ্গিতে, “থ্যাংক ইউ!ʼʼ এরপর হুট করেই বলল, “লোকে আপনাদের দিকে আঙুল তুলছে, আপনাদের কী খেয়াল!ʼʼ

হামজা হাসল, “আপনি তুলছেন না আঙুল?ʼʼ

-“আমি আম জনতার থেকে খানিক আলাদা, বলা চলে নিজের পেশার খাতিরেই! প্রমাণ ছাড়া আঙুল তুললে চাকরি থাকবে না।ʼʼ চোখ মারল হামজাকে মুস্তাকিন।

হামজা ছেলেদের চলে যেতে ইশারা করে। সালমা কাঁদছেন, জোরে জোরে কাঁদছেন বুক চাপড়ে, লোকের চাপা গুঞ্জন, আর পরিবেশে অভিশাপের কালশিটে ধোঁয়া ছড়িয়েছে যেন।

জয় জবাব দিলো মুস্তাকিনের, “আপনার চাকরি ধরেন আমি রক্ষা করব, তাইলে আঙুল তুলে জেলে ভরবেন তো?ʼʼ

মুস্তাকিন বসল দুজনের সামনে একটা চেয়ারে। সূর্যের তেজ ও আলো কমে উত্তরে হাওয়া এসে গায়ে লাগছে। কাধে ঝুলিয়ে রাখা ডেনিম জ্যাকেটটা গায়ে চড়িয়ে বলল, “আপনার শখ অথবা শাস্তি সহ্য করার কনফিডেন্স– কোনটা ধরব?ʼʼ

হামজা প্রসঙ্গ বদলালো, “কিছু জিজ্ঞেস করতে চান, অফিসার?ʼʼ

প্রফেসর সিরাজী এসে দাঁড়ালেন পাশে। মুস্তাকিন এবার সরাসরি কথায় এলো, “আপনারা আমাদের ডেকেছেন সকাল আটটার দিকে। তাহলে এখানে লাশ ফেলে রেখে যাওয়া হয়েছিল ঠিক কখন, সে ব্যাপারে কোনো ধারণা আছে?ʼʼ

হামজা মাথা নাড়ল, “তা জানে না কেউ-ই। আমাকে কল করা হয়েছে, তখনও আমি ঘুমে ছিলাম। ছেলেরা কল করে জানালো।ʼʼ

জয়ের দিকে ফিরল মুস্তাকিন। জয় মাথা ঝাঁকালো, “ভাই আমারে জাগায়ে নিয়ে আসছে। আমি ঘুমাচ্ছিলাম।ʼʼ

মুস্তাকিন জিজ্ঞেস করল, “আপনারা একসঙ্গে থাকেন?ʼʼ

জয় মাথা নাড়ল, “উহু! এক বাড়িতে। এক ঘরে থাকতাম, লোক বদনাম করবে জন্য থাকা হয় না। বদনাম তো আর কম নাই এমনিতেইʼʼ

হেসে ফেলল মুস্তাকিন। পরে নিজেকে সামলে বলল, “লাশ এক্সাক্টলি কোথায় ফেলা হয়েছিল সেই জায়গাটি দেখান আমাদের। সেটা তো দেখেছেন?ʼʼ

বিশ্ববিদ্যালয়ের মেইন প্রাঙ্গনের পেছন দিকটা নির্জন, এবং গাছগাছালিতে ছাওয়া। সেখানে সচরাচর লোকের যাতায়াত অতটাও নেই। দিনের বেলা ছেলে-মেয়েরা আড্ডা দিতে নির্জন জায়গাটি বেছে নেয়। রাতে একদম সুনশান। ক্যাম্পাসের অফ-সাইড বলা চলে। সর্ব প্রথম লাশ দেখেছে ঝাড়ুদার। সে প্রথমে বুঝতে পেরেছিল না, ওটা লা শ। কোনোমতো ওড়নাটা জড়ানো ছিল লাশের দেহে। পরে কে বা কারা যেন বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে এনেছে। এটা সকালে এসে থানা পুলিশের কাছ থেকেই শুনেছে সে।

মুস্তাকিন দেখল পুরো আশপাশটা। জয়কে বলল, “আপনার চোখে প্রচুর ঘুম, দেখছি! লালচে হয়ে আছে, রাতে ঘুমাননি মনে হচ্ছে! এখন একটু বিশ্রাম প্রয়োজন!ʼʼ

মুস্তাকিন কথাটা দ্বারা কিছু নির্দেশ করল। জয় চাদরটা গা থেকে খুলে গলায় পেঁচালো ওড়নার মতো করে। হেসে বলল,, “রাতে ঘুমানোর অভ্যাস এমনিতেও নাই আমার, ঘুম আসলে সকালে হয়নি বললে ঠিক হইতো আমার জন্য! সকালে টেনে তুলে আনা হইছে। আসলে আমাদের মতো নেতাকর্মীদের দুঃখ আর পরিশ্রম আপনারা কোনোদিন বুঝবেন না। জনতার মন রাখতে কত যে লোক দেখানো ঢং করতে হয়! যেমন ধরেন, আমার আসতে ইচ্ছে করতেছিল না, কষ্ট হচ্ছেনা বিশেষ মেয়েটা বা তার পরিবারের জন্য। তবুও আসতে হলো, ইভেন ধর্না ধরে বসে থাকতে হচ্ছে হুদাই এইখানে নিরস মুখে। কার বাল লাড়তেছি বসে? মানুষ তো মরবেই, এই অবধারিত বিষয়ে এইসব ঢং কি মনে-ধোনে কোথাও সয়? তবু সওয়া লাগে, কারণ, তথাকথিত সমাজসেবক আমি। ফাক অফ দিজ ইনট্রোডাকশন!ʼʼ

-“আপনি মানছেন আপনি তথাকথিত সমাজসেবক?ʼʼ

জয় চাদরটা গলা থেকে হাতে কব্জিতে জড়াতে জড়াতে বলল, “না মানার কী আছে? আমি ভালো না, তা লোক জানে, আর তা কি আমি জানার আগেই? আমি জানছি, এরপর লোকরে জানাইছি, তখন নৃ লোক জানছে।ʼʼ

মুস্তাকিন কিছুক্ষণ চুপচাপ চেয়ে থেকে জয়কে জিজ্ঞেস করে মুস্তাকিন, “তাহলে আপনাকে সন্দেহের তালিকায় রাখব?ʼʼ

-“উহু! এই কেইসে সাসপেক্ট হিসেবে থাকতে থাকতে উল্টাপাল্টা কিছু প্রমাণ হয়ে গেলে, ফাঁসি হয়ে যাবে, যেহেতু মেয়েটা মরে গেছে। এতো তাড়াতাড়ি মরে কী লাভ? মরব এইরকম কোনো কেইসের দায়েই, তবে একটু বয়সকালে। এখনও বিয়েশাদীই করি নাই, বিশেষত বাসরটা.... এখন মরাটা ঠিক না। এটা থেকে বাদ রাখেন আমায়।ʼʼ

মুস্তাকিন হামজাকে বলল, “কাউন্সিলর সাহেবকে একবার থানায় আসতে বলবেন বিকেলে। আপনি আসলেও পারেন।ʼʼ
হামজা পাঞ্জাবীর হাতার বোতাম খুলে তা কনুইয়ে গোটাতে গোটাতে বলল, “আমি আসতে পারব না, আব্বা যাবে। আমার ব্যস্ত সময় কাটছে— নির্বাচন এগিয়ে আসছে সামনে।ʼʼ

মুস্তাকিন হাঁটতে হাঁটতে আবার পেছন ফিরে দেখল হামজাকে। পায়ের ওপর পা তুলে বসে আছে চেয়ারটায়। মুখে চাপ-দাড়ি, পুরু ঠোঁটের ওপর ঘন গোফ, গায়ে জড়ানো চাদরের প্রান্ত ঝুলছে একপাশে। একটু দূরে দাঁড়িয়ে সিগারেটে টান দিচ্ছে জয়।

জয় তাকিয়ে আছে একটা বোরকা পরা মেয়ের দিকে। মেয়েটির সাথে মুস্তাকিন ধাক্কা খেয়েছিল। মেয়েটা অপলক চেয়ে আছে আঁখির লা"শের দিকে।

লা"শকে ফ্রিজিং গাড়িতে তোলার ব্যবস্থা চলছে, মর্গ থেকে লোক এসেছে।

চলবে...

 #অবরুদ্ধ_নিশীথ #তেজস্মিতা_মুর্তজা২.পরদিন ক্লাস শেষে ভীষণ ক্লান্ত অন্তূ। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ডেকেছেন। ডাকার কারণ স্পষ...
02/04/2025

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

২.

পরদিন ক্লাস শেষে ভীষণ ক্লান্ত অন্তূ। ডিপার্টমেন্টের প্রফেসর ডেকেছেন। ডাকার কারণ স্পষ্ট নয়। অন্তূকে পিয়ন থামালো দরজার সামনে, “দাড়ান আপনে। স্যার বিজি আছে। মিটিং চলতেছে ভিতরে।ʼʼ

ভেতর থেকে প্রফেসর ইউসুফ সিরাজীর কণ্ঠস্বর শোনা গেল, “ভেতরে আসতে দাও ওকে।ʼʼ

অন্তূর একটু সন্দেহ হলো, কোনো গুরুতর বিষয় নয় তো! ভেতরে প্রবেশ করে সালাম জানাল। ইউসুফ সিরাজী মাথা নাড়লেন, “এসো!ʼʼ

আরও কয়েকজন বড়ো বড়ো শিক্ষক রয়েছেন কক্ষে, এবং টেবিলের সামনে ডানপাশে চেয়ারে বসে আছে এক লম্বামতো পুরুষ, পরনে পাঞ্জাবী, মুখে চাপদাড়ি। এলাকায় একনামে বড়ভাই। যার মুখভঙ্গি একদম স্বাভাবিক, নিচের দিকে তাকিয়ে আছে শীতল দৃষ্টি মেলে। একে অন্তূ চেনে, ভার্সিটির ছাত্র সংসদের মেজর মেম্বার— হামজা পাটোয়ারী। ইউসুফ সিরাজী জিজ্ঞেস করলেন, “গতকাল কী হয়েছিল?ʼʼ

অন্তূ ইতস্তত না করে বলল, “আমাকে র‌্যাগ দেয়া হয়েছিল, স্যার!ʼʼ

-“সে তো আর নতুন কিছু নয়। তুমি কী করেছ?ʼʼ কড়া শোনাল প্রফেসরের কণ্ঠস্বর।

অন্তূ দমল না, বলল, “আমাকে সিগারেটে টান...ʼʼ

-“আহ!ʼʼ ব্যাপারটা যেন শুনতে আগ্রহী নন স্যার, বিরক্ত হলেন, “তুমি কী করেছ সেটা বলো!ʼʼ

অন্তূ স্যারের সম্মানে বিনয়ের সঙ্গে তবে দৃঢ় কণ্ঠে বলল, “আমাকে ধূমপান করতে বলা হয়েছিল, স্যার। আর তাতে অভ্যস্ত নই আমি। তাই সিগারেটটা নিয়ে ফেলে পা দিয়ে নষ্ট করে দিয়েছি।ʼʼ

মুখভঙ্গি শক্ত হলো প্রফেসরের। চোখ পাকালেন তিনি, চাপা স্বরে ধমকে উঠলেন, “এই শিখেছ? কার সঙ্গে এই আচরণ করেছ কোনো জ্ঞান আছে সে বিষয়ে? অভদ্র মেয়ে! সিনিয়রদের সঙ্গে এই আচরণ শিখেছ এতদিনে? ভার্সিটিতে আসো বেয়াদবী শিখতে? আদবের বালাই নেই ভেতরে! তুমি জানো, এতে তোমার এডমিশন ক্যানসেল হতে পারে? নাম কী?ʼʼ

অন্তূ অবাক হলো, উল্টো তাকে ব্লেইম করা হচ্ছে! অবশ্য চমকানোর কিছু নেই। দুনিয়ার সংবিধানের নাম যেখানে অরাজকতা ও সুশাসনহীনতা! সেখানে এটা নেহাত স্বাভাবিক ব্যাপার! নাম বলল সে, “মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ।ʼʼ

-“বাবার নাম?ʼʼ

একটু ভয় হলো অন্তূর, এসব আব্বুর কানে গেলে...আব্বু সম্মানী মানুষ, তামাশা নিতে পারবেন না। জবাব দিলো, “আমজাদ আলী প্রামাণিক।ʼʼ

-“স্কুল মাস্টার আমজাদ নাকি?ʼʼ

-“জি!ʼʼ

-“এখনও মাস্টারি করে?ʼʼ

-“জি না। রিটায়ার করেছেন বছরখানেকের মতো।ʼʼ

ইউসুফ সিরাজী হামজাকে জিজ্ঞেস করলেন, “হামজা! তুমি কিছু বলবে?ʼʼ

হামজার মুখভঙ্গি দুর্বোধ্য। বোঝার চেষ্টা করল অন্তূ, অথচ বিশেষ অভিব্যক্তি নেই মুখে। অন্তূর দিকে তাকালও না একবার চোখ তুলে, মৃদু একবার ঘাঁড় নেড়ে দাম্ভিকতার সাথে ডানহাতের তর্জনী আঙুল তুলে ইশারা করল অন্তূকে বের হয়ে যেতে। জলদ গম্ভীর প্রতিক্রিয়া তার। যেন নেহাত অনিচ্ছুক সে অন্তূর সাথে কোনোপ্রকার কথা বলতে।

কক্ষ থেকে বেরিয়ে অন্তূ থমকাল। সে কি কোনো অনিশ্চিত ঝামেলায় জড়িয়ে যাচ্ছে! একটা অজানা বিষণ্নতা টের পেল সে ভেতরে, যা যুক্তিহীন বলেও মনে হচ্ছে, আবার কিছু একটা খোঁচাচ্ছে ভেতরটায় খুব। হামজা পাটোয়ারী কেন বসেছিল ওখানে?

আজ প্রথমবার অন্তূ হামজাকে এতো কাছ থেকে দেখল। আগে দেখেছে বিভিন্ন পোস্টার এবং প্রোগ্রামের ব্যানারে, নয়ত ভার্সিটি প্রোগ্রামে বক্তব্য দেওয়া বা নেতৃত্ব প্রদানের সময়।

শহীদ মিনার চত্বর পেরিয়ে যাবার সময় মেয়েলি ডাক কানে এলো। মেয়েটা পরিচিত, নাম তানিয়া। ওর দুই ইয়ার সিনিয়র। এগিয়ে গিয়ে বলল, “জি, আপু!ʼʼ

-“গতদিন আবার কী হয়েছিল ভার্সিটিতে?ʼʼ

অন্তূ বসল সিড়ির ওপর, “গতদিন আবার? কেন, এর আগেও কি কিছু ঘটেছে নাকি ভার্সিটিতে?ʼʼ

তানিয়া জিজ্ঞেস করল, “কোন ইয়ার যেন তুমি?ʼʼ

-“সেকেন্ড ইয়ার।ʼʼ

-“ও আচ্ছা! ছুটিতে ছিলে তোমরা! ভার্সিটিতে হওয়ার কি আর কোনো কমতি আছে? একের পর এক হয়-ই। তোমার কী হয়েছে গতদিন, জয় আমিরের সঙ্গে?ʼʼ

অন্তূ কপাল জড়াল, “জয় আমির?ʼʼ

প্রশ্নটা খুব অপছন্দ হলো তানিয়ার, বিরক্ত হলো, “দুই বছর ভার্সিটিতে পড়ছো, এবার কি বলবে জয় আমিরকেও চেনো না নাকি? ভার্সিটির ছাত্রলীগের সম্পাদককে চেনো না? কাউন্সিলরের ছেলে হামজা পাটোয়ারীকে চেনো?ʼʼ

-“জি, চিনি।ʼʼ

-“আর জয় কে? হামজার ফুফাতো ভাই, জয় আমির।ʼʼ

-“ও আচ্ছা!ʼʼ একটু দ্বিধান্বিত দেখালো অন্তূকে।

তানিয়ার জয়ের হুলিয়া বর্ণনা করতে শুরু করল, “দুই বছর আগে এখান থেকে অনার্স শেষ করেছে। শ্যামলা বর্ণের লম্বা করে, থুতনির কাছে একটা তিল আছে। গলায় চেইন, তাতে J লেটার আছে। ডানহাতে ঘড়ি পরে আর বামহাতে ব্রেসলেট..ʼʼ

অন্তূর সেসব শুনতে ইচ্ছে করছিল না। বুঝল, যে তাকে সিগারেটে টান দিতে বলেছিল, সে-ই জয়! আর শুনতে চাইল না এই বিশদ বর্ণনা, দ্রুত মাথা নাড়ল, “জি, এবার চিনেছি।ʼʼ

-“কী করেছে ওরা তোমার সঙ্গে?ʼʼ এমনভাবে কথাটা বলল তানিয়া যেন কোনো বিশেষ গোপন রহস্যের ব্যাপারে খোঁজ করছে। অন্তূ বলল, “বিশেষ কিছু নয়, র‌্যাগ দিয়েছিল।ʼʼ

এবার তানিয়া আরও সতর্ক হয়ে উঠল, “আরে! লজ্জা পাচ্ছ কেন? আমি কাউকে কিচ্ছু বলব না, এসব হতেই থাকে, বলো কী করেছে ওরা তোমার সঙ্গে?ʼʼ

অন্তূ অবাক হলো, “আশ্চর্য! লজ্জা পাওয়ার প্রশ্ন কেন উঠছে? বললাম তো, সাধারণ র‌্যাগ দিয়েছে। আর কীসব হয়ে থাকে?ʼʼ

তাচ্ছিল্য করে হেসে উঠল তানিয়াসহ পাশের মেয়েগুলো। তানিয়া মুখ বিকৃত করে বলল, “কেন? তুমি বোধহয় জানো না, র‌্যাগিংয়ে মেয়েদের সাথে কী কী করা হতে পারে?ʼʼ

-“জি, জানি। তবে আমার সঙ্গে তেমন কিছু হয়নি।ʼʼ

তানিয়া কেমন অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকায়, “তাই নাকি? যাক, তা যদি সত্যি হয়, তো ভালো। কিন্তু তুমি কী করেছ? তোমাদের নিয়ে কানাঘুষা চলছে ভার্সিটিতে। তোমার সাহস বেশি হয়েছে নাকি?ʼʼ

-“কানাঘুষা? কানাঘুষার মতো কিছু তো হয়নি! আর সাহসের কী আছে এতে! যা আমার পছন্দ নয়, তাতে আমি সাফ মানা করে দিয়েছি।ʼʼ

তানিয়া চোখ উল্টালো, “মেয়ে, তোমার তো মাথায় দোষ আছে মনে হচ্ছে! তুমি সিনিয়রের সাথে বেয়াদবি করে এসে বলছো কানাঘুষার কিছু হয়নি! হয় তুমি পাগল, নয়ত বোকা অথবা দুঃসাহসী বলা যায়! কিন্তু এখানে দুঃসাহস টেকার না। তুমি সিনিয়রদের সাথে এরকম অবাধ্যতা করলে কোন সাহসে! জয়কে তো দেখছি তাহলে আসলেই চেনোই না তুমি? ভার্সিটিতে কি ঘাস কাটতে আসো, খবর বা রুলস কিছুরই জ্ঞান রাখো না নাকি!ʼʼ

অন্তূর খুব বলতে ইচ্ছে করল, ঘাস কাটতে যদি নাও আসি, তবে এসব পঙ্গপালদের খবর রাখতে নিশ্চয়ই আসি না! আসি পড়ালেখার জন্য, তা শেষ করে ফিরে যাই।

চেপে গেল, শঙ্কিত হয়ে উঠেছে ইতোমধ্যেই ভেতরটা। ভয়টুকু সে চাপল ভেতরে, “কীসের খবর রাখার কথা বলছেন?ʼʼ

মেয়েগুলো একে অপরের দিকে তাকাল, একটু তাচ্ছিল্যে হাসল সকলে। তানিয়া বলল, “এর আগে বহু মেয়ে ভার্সিটি ছেড়েছে জয়ের কারণে, তোমরা তখন এডমিশন নাওনি, তখন জয় সেকেন্ড ইয়ারে ছিল বোধহয়। একটা মেয়ে হলের ছাদ থেকে পড়ে আত্মহত্যা করেছিল। ওরা কী করেছিল মেয়েটার সঙ্গে জানা নেই। কিন্তু একটা কথা পরিস্কার, জয় এক অভিশাপ! আবার ভালোও!ʼʼ

-“আবার ভালোও কেন?ʼʼ

-“রাজনীতির চাল বোঝো না? সমাজসেবার কাজবাজ করে দুই ভাই মিলে। পুরো ছাত্র সংগঠনের বেশ ভালোই যোগান দেয় দুজন। ত্রাণ, চিকিৎসা, স্বাস্থ, দুর্যোগ—এসবে বহুত অবদান আছে ওদের। এরিয়ার লোকের মনোযোগ কেড়েছে নিজের নেতৃত্বের জেরে অথচ বখাটেপনা ছাড়তে পারেনি, তবে সেটার কোনো প্রমাণ থাকে না, বুঝলে!ʼʼ

অন্তূ একটা ছোট্ট শ্বাস ছেড়ে জিজ্ঞেস করল, “আমাদের ছুটির মধ্যে কী হয়েছিল ভার্সিটিতে?ʼʼ

তানিয়া চারদিকে ভালোভাবে তাকাল কয়েকবার, বেশ কিছুক্ষণ চুপ রইল। এরপর নিচু আওয়াজে বলল, “শোনো, তুমি এখনও ছোট। এত বোকার মতো চলবে না। পরিস্থিতি বুঝে চলতে হয়। নয়ত মারা পড়বে।ʼʼ

একটু থেমে বলল, “হামজার বাপ কাউন্সিলর এলাকার, তা তো জানো! আর হামজা রাজনৈতিক নেতাকর্মী। আমাদের কমনরুমের আয়া সালমা খালাকে তো চেনো।

-“জি, চিনি।ʼʼ

-“ওনার বাড়ি হামজাদের ক্লাবের পাশে। ওনার ছোটো ছেলেটার হঠাৎ-ই কী থেকে যেন আঘাত পেয়ে কী হলো! পায়ে ক্যান্সার হলো। এরপর নাকি খালা বাড়ির জায়গা অর্ধেক দাম নিয়ে পাওয়ার-দলিল করে এক হিন্দুর কাছে বন্ধক রেখেছিল, বলা চলে বিক্রিই করেছিল। তবে শর্ত ছিল খালা নির্দিষ্ট সময়ে টাকা পরিশোধ করলে জায়গা ফেরত পাবে, যেহেতু বসত বাড়ি। কিন্তু চিকিৎসা করেও সেই ছেলে বাঁচেনি আর। একবছরের সময় ছিল, খালা সেই সময়ে টাকা পরিশোধ করতে পারেননি। তার ওপর প্রতি মাসের কড়া সুদের টাকা জমে পুরো জমির দাম উসুল হয়ে গেছিল ওই লোকের। ওই লোক এরপর জায়গাটা খালাকে না জানিয়ে অন্য কারও কাছে বেঁচে দিয়েছিল। তারা এসে তাগাদা দিতে থাকল বাড়ি খালি করার। খালা সময় চেয়ে নিয়েছিল। কিন্তু পরে বিচার শালিশ বোর্ডের কাছে চলে গেল। মানে মেয়র, কাউন্সিলর, এলাকার মাতব্বর, সমাজসেবকেরা সব ছিল। সব শেষে নাকি বিশাল ঝামেলা হয়েছিল। পরে হামজা আর জয় মিলে সালমা খালাকে সময় দিয়েছিল আরও কিছুদিন। তখন খালার বড়ো ছেলের বউ বাপের বাড়ি জায়গা বিক্রি করে এনে টাকা দিয়েছিলেন কাউন্সিলর হুমায়ুন পাটোয়ারীর কাছে। পরে আর খালা টাকা নিয়ে আসেনি। এরপর বেশ কয়েকবার হামজা ভাই বাড়ি খালি করতে বলেছিল খালাকে। তারা যায়নি, তাদের যাওয়ার জায়গা নেই। কয়েকদিন হলো খালার মেয়ে আঁখিকে পাওয়া যাচ্ছে না। লোকে বলছে এদের মধ্যেই কেউ হয়ত আঁখিকে তুলে নিয়ে গেছে। জানা নেই মেয়েটার সঙ্গে কী হয়েছে, কী হালে আছে..ʼʼ

ভার্সিটির ক্যাম্পাস থেকে বেরিয়েও বুকের ভেতরে ঢিপঢিপ আন্দোলন চলছে, আওয়াজটা খুব কানে বাজছে, নিকাবের নিচে মুখটা ঘেমে উঠেছে। পানি পিপাসা বোধ করল অন্তূ। সে কি কোনো ভয়ানক পরিণতির আভাস পেল আজ! আঁখি! দেখেনি কখনও মেয়েটাকে, তবু হৃদযন্ত্রটা খুব লাফাচ্ছে! আচ্ছা! আঁখি কোথায়? পাওয়া যাচ্ছে না কেন ওকে?


এরপর দু'দিন আর ভার্সিটিতে যায়নি অন্তূ। তার সাহসে জুটছে না। সেদিন জয়ের সম্মুখে দাঁড়িয়ে ভয় হয়নি, অথচ আজ দু'দিন বুকে ভারী শঙ্কা চেপে আছে। আঁখি মেয়েটাকে সে দেখেনি কখনও, নাম ছাড়া কিছু জানা নেই। তবুও আজ দুটো দিন ঘরে বন্দি হয়ে ওই অপরিচিতা মেয়েটার জন্য পরাণ দাপায়। নিজের পরিণতি সম্বন্ধে মাথায় চেপে বসে অকল্পিত এক ভয়!

বাড়ির দরজায় ধাক্কা পড়ল। অলস ভঙ্গিতে উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিলো সে। মার্জিয়া ভেতরে ঢুকে হাতের ব্যাগটা ধপ করে মেঝেতে রাখল। অন্তূ বলল, “কী হয়েছে, ভাবী! ভাই আনতে যায়নি?ʼʼ

মার্জিয়া জবাব দিলো না। অন্তূ আবার বলল, “আপনি বোরকা খুলে আসুন, আমি খাবার আনছি, একসাথে খাই।ʼʼ

মার্জিয়া খ্যাকখ্যাক করে উঠল, “অ্যাই, নাটক করবা না তো, অন্তূ! সহ্য হচ্ছে না গায়ে।ʼʼ

অন্তূ স্বাভাবিকভাবে বলল, “ঠিক আছে। গায়ে একটু ঠান্ডা পানি ঢেলে আসুন। ভালো লাগবে।ʼʼ

ছ্যাঁত করে উঠল মার্জিয়া, “তোমার মতো ডাইনির মুখে এর চেয়ে ভালো পরামর্শ শোনার আশা রাখিই বা কই আমি? কথাই বলো গা জ্বালানো সব।ʼʼ

-“কী হয়েছে? ক্ষেপে আছেন কেন? কার রাগ আমার ওপর দেখাচ্ছেন?ʼʼ

-“তোমার মতো মা তা রী ননদ থাকতে রাগ আর কার ওপর হবে?ʼʼ

অন্তূর কণ্ঠস্বর দৃঢ় হয়ে উঠল, “মুখ সংযত করুন আপনার। আপনি জানেন, বেশিক্ষণ আমি আপনার অহেতুক কথাবার্তা নিতে পারব না।ʼʼ

-“কী করবা তুমি? আমার বোনের সংসার যেভাবে খাইতে লাগছো তোমরা, আমারেও তাড়াবা এইখান থেকে?ʼʼ

অন্তূ কপাল জড়িয়ে তাকাল ভাবীর দিকে, “তেমন কোনো কথা ওঠেনি, সেটা জানেন আপনিও। আপনি সাধারণ বিষয়কে নিজের ভেতরের জটিলতা দিয়ে অন্য পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন।ʼʼ

রাবেয়া যোহরের নামাজে বসেছিলেন, দ্রুত সালাম ফিরিয়ে উঠে এলেন, “কী হইছে, মার্জিয়া। কীসব কথা এইসব?ʼʼ

মুখ ঝামটি মারল মার্জিয়া, “শখ আমার খুব যে, তাই।ʼʼ

অন্তূ বলল, “ভনিতা না করুন বলুন, আমি কী করেছি? আপনার শখ পরেও মেটাতে পারবেন।ʼʼ

মুখ বিকৃত করল মার্জিয়া, “জানো না তুমি, না? আমার বোনের সংসার তোমাদের জন্যে যদি ভেঙেই যায়, তখন দেখবা আমি তোমারেও এই বাড়িতে শান্তিতে থাকতে নআ দিয়ে কেমন হিরহির করে টেনে বের করে দিয়ে আসি।

রাবেয়া গর্জে উঠলেন এবার মৃদু স্বরে, “আমার মেয়েকে বের করার বা রাখার তুমি কে? আমার মেয়ের বাপ-মা মরে যায় নাই এখনও যে, তুমি আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করবা! এখনও বেঁচে আছে আমার মেয়ের বাপ। কী হইছে, তা বলবা না? না তা তো জানাই নাই তোমার। এত রহস্য করা ক্যান, হ্যাঁ?ʼʼ

মার্জিয়া চিটপিট করে উঠল, বলতে পারলে তো হতোই। বলতে পারিনা তো আম্মা। আর না সইতে পারি। আমার বোনের ঘর ভাঙলে আপনার মেয়েকে দেখি এই বাড়িতে রাখে কে?ʼʼ

অন্তিক বাড়িতে ঢুকল, “কী ব্যাপার! কীসের চেঁচামেচি চলতেছে?ʼʼ

রাবেয়া বললেন, রাবেয়া গর্জে উঠলেন এবার মৃদু স্বরে, “আমার মেয়েকে বের করার বা রাখার তুমি কে? আমার মেয়ের বাপ-মা মরে যায়নি এখনও, যে তুমি আমার মেয়েকে বাড়ি থেকে বের করবা! আমার মেয়েকে তাড়াবা, তার আগে আমি বের করতে পারব না তোমায়? এখনও বেঁচে আছে আমার মেয়ের বাপ।ʼʼমার্জিয়া কী কয়, কিছুই বুঝিনা। এমন অশান্তি কয়দিন দেখা যায় ক তো! কী হয়, কীসের কথা কয়, কিছুর কথাই বুঝিনা। তোর বাপের কানে গেলে ভালো হইতো বিষয়টা?ʼʼ

মার্জিয়া স্বামীর দিকে তাকাল। অন্তিক চোখ ফিরিয়ে চুপচাপ রুমে চলে যায়। বোন, স্ত্রী অথবা মা—কাউকেই একটা শব্দও বলল না।

অন্তূ ঘৃণিত চোখে চেয়ে রইল বড়ো ভাইয়ের চলে যাওয়ার পানে। একরাশ ভাঙাচোরা যন্ত্রণা আর ঘেন্না বোধহয় জড়িয়ে এলো বুকটায়। তরতরে যুবক অন্তিকের এক অ-পুরুষ হয়ে ওঠার গল্পটা অস্পষ্ট তার কাছে।

এভাবেই কতগুলো বছর কাটছে এ বাড়িতে। অন্তিক শুধু একটা দেহ মাত্র, যে গোটাটাই মানসিক অস্তিত্ব ও বিবেকবোধমুক্ত।

সে বহুদিন ভাইয়ের সাথে প্রয়োজনীয় ছাড়া অপ্রয়োজনীয় কথা বলে না, হাসে না, একসাথে খায় না। এক অপরিকল্পিত অনীহা এবং বিতৃষ্ণা জেগেছে সবকিছু বুঝে নির্বিকার থাকা অন্তিকের ওপর। মার্জিয়া অকারণেই চিৎকার চেঁচামেচি করে, কেন করে, কীসব বলে, কিছুই বোধগম্য হয়না। আর না অন্তিক কিছু বলে।

শিক্ষিত, তরতরে যুবক অন্তিক। যার পড়ালেখা, সামাজিক সক্রিয়তা, মেধা, কথাবার্তা, হাসি—একসময় সমাজে আলোচিত বিষয় ছিল। আমজাদ মাস্টারের যোগ্য ছেলে থেকে অযোগ্য বিবেকহীন মূর্খ কাপুরুষের জন্মটা কবে যেন! গোটাটাই রহস্য, ঠিক তেমনই মার্জিয়ার আচরণও!

সকাল থেকে কিছু খাওয়া হয়নি, একটু আগে যে অল্প খিদে পেয়েছিল, তা এখন আর অনুভব হচ্ছে না অন্তূর। আস্তে করে নিজের ঘরে চলে গেল। পেছনে রাবেয়া বেগমের ফুঁপানোর আওয়াজ পেল, ফিরে তাকাল না। অবলা মা তার, আব্বু বাসায় নেই।

পঞ্চগড় গেছেন। আজ ফেরার কথা ছিল, হয়ত ফিরবেন না। অন্তূ পড়ার টেবিলে বসল। অথচ মাথায় আব্বু আর অন্তিকের কথা ঘুরছিল। বই বন্ধ করে টেবিলে মাথা এলিয়ে দিলো। অস্থির লাগছে ভেতরটায়।

চলবে...

29/03/2025

#অবরুদ্ধ_নিশীথ
#তেজস্মিতা_মুর্তজা

এই গল্পটি না পড়লে গল্প পড়া আনকমপ্লিট থেকে যেত মনে হয়।
লেখিকার অসাধারণ এক সৃষ্টি এটি।যার প্রতিটি লাইনে রয়েছে কত শত পাওয়া না পাওয়ার গল্প।🥰🥰🥰 happy reading

১.
রাস্তা পার হওয়ার ক্ষেত্রে অন্তূর তেজ ঠিক বিকেলের রোদের মতোই ক্ষীণ। আব্বু তার হাতটা চেপে না ধরলে চলে না। আব্বু রোজ থাকে না সঙ্গে। আজও নেই। এক পথিক চাচার পেছনে রাস্তাটা পার হয়ে দ্রুত রিক্সা ধরল।

শীতের রোদ, তবু খাড়া দুপুরে তাপ কড়া। বোরকা-হিজাবের আবরণের নিচে ঘামের স্রোত বেয়ে যাচ্ছিল তার।

ভার্সিটিতে ছাত্র পরিষদের কী এক প্রোগ্রাম ছিল। সেসবে অন্তূর ভালো রকমের বিদ্বেষ আছে। কারণ হিসেবে বলা যায়–তাকে শেখানো হয়েছে এবং বাকিটা নিজস্ব।

অন্তূর ধারণা, ছাত্রলীগ—যাদেরকে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ অগ্রদূতের নাম দেয়া হয়েছে, তারা মূলত পঙ্গপাল। দলবদ্ধ হয়ে চলা ঘাসফড়িংয়ের জাতকে পঙ্গপাল বলে। দশ-পনেরো লক্ষ একত্রে চলাচল করে। এবং কোনো বিঘাখানেক জমির ফসলি ক্ষেতকে আক্রমণ করলে খুব অল্প সময়ে ক্ষেতের ফসল খুব ভালোমতো পরিষ্কার। এক শ্রেণির লোক অবশ্য এই ক্ষেত পরিষ্কারকে বরবাদ করাও বলবে। তাদের কথা কানে নেয়া উচিত না। ক্ষেতের ফসল উদ্ভিদের জন্য ভারী। উদ্ভিদকে সস্তি দিতেই হয়ত পঙ্গপাল সব ফসল ভক্ষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করে থাকে।

অন্তূর ধারণা, বাংলাদেশের ছাত্রলীগ নামক পঙ্গপাল দেশটা অর্থাৎ বাংলার আবাদী ক্ষেতের জন্য তেমনই এক দল পঙ্গপালের সমান।

আম্মার কল এসেছে কয়েকবার। তাঁর ভাষায়, খুব জরুরী কাজ। অন্তূ জানে, কোনো জরুরী কাজ-টাজ কিচ্ছু না। কিন্তু ছাত্রনেতাদের মুখ-পেটানো মহাবাণী থেকে মুক্তির একটা ছুঁতো দেয়ায় সে মায়ের প্রতি অল্প কৃতজ্ঞ।

দুপুরের ঝাঁজালো রোদে বাড়ি ফিরে যে জরুরী কাজটা দেখল অন্তূ, তাতে তার মাথাও দুপুরের রোদের মতোই উষ্ণ হলো। তাকে দেখতে আসা হয়েছে। প্রায়ই হয় এমন।

মেহমানদের তাকে দেখার ধরণ সেই জাহিলি যুগের মেয়ে নামক পণ্য কেনা-বেচার মতো। এটা অন্তূর নিজস্ব মত। সে বিষয়টাকে পছন্দ করে না। তারা অন্তূর চুল খুলে ফেলল, একটানে শরীরে জড়ানো ওড়নাটা সরিয়ে গলা, বুক, হাত দেখা হলো। না, মেয়ে ফর্সাই আছে। অন্তূ চোয়ালের পাটি শক্ত করে চুপ করে থাকল। কিন্তু যখন সালোয়ার উঁচিয়ে তুলতে গেল মহিলারা ঠ্যাং দেখবার উদ্দেশ্যে, অন্তূর সীমিত ধৈর্য্যের বাঁধ খসলো। সালোয়ার ছাড়িয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল, তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে স্পষ্ট স্বরে বলল,

-“আপনারা মেয়ে দেখতে এসেছেন নাকি হাঁটে গরু কিনতে এসেছেন?ʼʼ

পাত্রর মা হতভম্ব হলেন, অসন্তুষ্ট মুখে বলে উঠলেন, “ওমা! এ আবার কেমন কথা? মেয়ে দেখতে এসে মেয়ের পা দেখতে চাওয়া কি অপরাধ নাকি?ʼʼ

-“জি না! ঠিক অপরাধ নয়, মূর্খতা। কারণ আমি কোরবাণীর হাঁটে তোলা কোনো প্রজাতির গবাদী পশু নই, যে সবচেয়ে নিখুঁত, আকর্ষণীয় গায়ের রঙওয়ালা, মাংস বেশী, হৃষ্টপুষ্ট দেখে কিনে নিয়ে যাবেন।ʼʼ

স্পষ্ট, ঝরঝরে শুদ্ধ ভাষা অন্তূর মুখে, কিন্তু ভাষা কর্কশ। পাত্রর ফুপু মুখ কেমন করলেন, “কোনদেশি কথা যে, মেয়েকে ভালোভাবে দেখা যাবে না? নাকি কোনো দোষ আছে? তাছাড়া কোনো মেয়ে আছে, যে পাত্রপক্ষের মুখের ওপর এরকম বদমায়েশের মতো কথা বলে? আশ্চর্য মেয়ে তো দেখছি! দেখতে আসছি, তো দেখব না?ʼʼ

-“জি, নিশ্চয়ই দেখবেন। দোষ থাকা চলবে না, দরকার পড়লে মেয়ের দেহের প্রতিটা কোষ পর্যবেক্ষণ করা মেশিন এনে দেখবেন। পরনের সালোয়ার ঠ্যাঙে তুলে তারপর মেয়ের ঠ্যাঙ দেখবেন ফর্সা কি-না? রাইট!ʼʼ

উনারা মুখ বিকৃত করে বসে আছেন। অন্তূ আলতো হাসল, “দুঃখিত, চাচিমা। এটাকে আপনারা মেয়ে দেখা বললেও, আমি ছোটোলোকি বলছি। মেয়ে দেখতে এসে গাল ফেড়ে মেয়ের দাঁত দেখতে হবে, দাঁত উঁচু-নিচু আছে কিনা! মাথার চুল টেনেটুনে দেখতে হবে, চুল আসল না নকল, আছে না নেই, বড়ো না ছোটো? গলা বের করে, ঘাঁড়ের ওড়না খুলে, হাঁটিয়ে, নাচিয়ে এরপর পছন্দ হলে নিয়ে যাবেন! এটাই মেয়ে দেখা? অথচ বলুন তো, আমি যা যা বললাম, তা শুনতে এমন লাগল না, যে কোনো গৃহপালিত পশুর বর্ণনা দেয়া হয়েছে। খরিদ্দার এসেছে গোয়াল থেকে পশু খুলে নিয়ে যেতে!ʼʼ

অপমান, অসন্তুষ্টি এবং বিরক্তি লেগে আছে মুখে তিনজনের। ছেলের ফুপু মুখ খুললেন “তো কীভাবে মেয়ে দেখে? তুমিই শেখাও কীভাবে মেয়ে দেখে?ʼʼ কথাটা বলে মুখ ঝামটি মারলেন মহিলা।

রাবেয়া অন্তূর দিকে চোখ গরম করে তাকাচ্ছেন। ঘরে পাড়ার মহিলাও আছেন কয়েকজন, পাশেই ঘটক মহিলা বসা। তিনি বললেন, “এ কেমনে কতা কও, মেয়ে! দেখতে আইলে একটু ভালো কইরেই দেখে মেয়ে। না দেখে শুনে আবার নিয়ে যায় নাকি? বাড়ির বউ হইবা বলে কথা!ʼʼ

অন্তূর কাছে এ কথার জবাব আছে—দেখেশুনে নিয়ে যাওয়াটা দোষের নয়। তবে দেখার মধ্যে মার্জিত এবং শালীনতার ব্যাপার তো আছে? মহিলাগুলো রীতিমতো তাকে অসম্মানমূলক ভাবে মেয়ে দেখার নামে এক প্রকার অপমান করছেন। একটা মেয়ের পাত্রপক্ষের সম্মুখে মেয়ের আত্মমর্যাদা-মূল্য শব্দের অস্তিত্ব নেই। শুধুই একটি জড় সামগ্রী, যাকে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে, বাজিয়ে, দরদাম করে, পছন্দ হলে দয়া করে কিনে নিয়ে যাওয়া হবে।

এই কথাগুলো চেপে গিয়ে ঘটক মহিলাটির কথার জবাবে চমৎকার হাসল, “বাড়ির বউ হব? কে বলেছে, আমি বলেছি? আমি এখনও অন্যের মেয়ে। আর অন্যের মেয়েকে বাজারের পণ্যের মতো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখা, দরদামের কথায় আসা যদি বিয়ের উদ্দেশ্যে মেয়ে দেখা হয়, তাহলে বিয়ে বোধহয় আমার জন্য না। আর আমার ধারণা আপনারদের আমাকে দেখেশুনে পছন্দ হলে যৌতুকের কথাও তুলবেন। এক্ষেত্রেও দুঃখিত, চাচি। আব্বু আমাকে খাইয়ে-পরিয়ে, আদর-যত্ন করে, এতগুলো বছর সুশিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন যৌতুকের বদলে বিয়ে দিয়ে আমার বোঝা নামাতে নয়। তাছাড়া আমিও ইচ্ছুক নই, আমার জন্য পয়সা দিয়ে কোনো খেলনা পুরুষ কিনতে।ʼʼ

পাত্রর মা অন্তূর মায়ের দিকে তাকিয়ে এবার কড়া স্বরে, তাচ্ছিল্যে করে মুখ বিকৃত করলেন, “আপা! সে আপনি মেয়েকে যতই শিক্ষিত করেন, আদর্শ শিখাইতে পারেন নাই। এরকম মেয়ে কার ঘরে যাবে, আল্লাহ মাবুদ জানে। আপনার কপালে কী আছে এই মেয়ে নিয়ে, আল্লাহ-ই জানে! অন্তত কোনো ভদ্র পরিবারে তো যাবে না।ʼʼ

অন্তূ দীর্ঘশ্বাস ফেলল, “আত্নসম্মানহীনতা যদি আদর্শ হয়, আমি বরাবর অভদ্র এবং জঘন্য আদর্শে পালিত এক মেয়ে। ক্ষমা করবেন এই বেয়াদবকে।ʼʼ

অন্তূ আর বসল না। সকলের বিভিন্নরকম দৃষ্টিকে পেছনে ফেলে এগিয়ে গেল নিজের রুমের দিকে।

তার নামে সমাজে রটা কথা নেহাত কম না। প্রতিনিয়তই লোকে তাকে আলোচনায় রেখেছে–অন্তূকে তার মা-বাপ মিনসের মতো মানুষ করছে। নষ্টা মেয়ে, ভ্রষ্টা মেয়ে, বেয়াদব, অসভ্য, আদর্শহীন, ভার্সিটিতে পরিয়ে মিনিস্টার বানাতে চায় মেয়েকে… পাড়ার লোকের দেয়া টাইটেলের অভাবের পড়েনা অন্তূর ভাগে।

কিছুক্ষণ পর সকলকে বিদায় করে রুমে এলেন রাবেয়া বেগম। তিনি কিছু বলতে যাবেন, তার আগেই অন্তূ বলল, “এরকম লোকদের সামনে বসানোর জন্য তুমি আমায় টিউশনি কামাই করিয়ে বাড়ি ডেকে আনলে? তোমার আক্কেলকে আর কতটা সাধুবাদ জানাব আমি, আম্মা!ʼʼ

রাবেয়া বেগম অসন্তুষ্ট স্বরে বললেন, “একটা থাপ্পড় মারব, বেয়াদব মেয়ে! দিনদিন বেলেহাজ হয়ে যাইতেছ তুমি? বেশি লাই দিয়ে ফেলতেছি নাকি আমি? আর কয়টা পাত্রর সামনে আমার মান-ইজ্জত নষ্ট করবি তুই? মা হিসেবে তোকে পার করতে চাওয়ার কোনো হক নাই আমার? পাড়ার লোকে একের পর কথা কথা বলতে ছাড়তেছে না প্রতিদিন। সে-সবই তো শুনতেছি। তুই পরিস্থিতি বুঝবি কোনোদিন? বেকায়দা মেয়েলোক জন্মেছে আমার পেটে!ʼʼ

অন্তূ দীর্ঘশ্বাস লুকিয়ে হাসল, “আম্মা, তোমার তো সবসময় আমার উপর অভিযোগ থাকে। ধরে নিয়ে আসো এসব মূর্খ, ছোটো মানসিকতার লোকদের! তোমার কী ধারণা, যার তার গলায় ঝুলে পড়ব আমি? আব্বু তো বলেনা বিয়ের কথা, তুমি কেন কান দাও মানুষের কথায়? আব্বু এজন্যই বলে, তোমার বিবেকে ইমপ্রুভমেন্ট দরকার।ʼʼ

-“তোর বিবেক কাজে লাগা। তা লাগালেই তো মিটে যেত সব। এই দিয়ে কতগুলার সাথে এমন হইলো? পাড়ার লোকে খুব ভালো কয় এতে, তাই না? ভার্সিটিতে পড়াচ্ছি তা নিয়ে কত কথা শুনলাম, এখন বিয়ে করাচ্ছি না তা নিয়ে লোকে কানাঘুষা শুরু করছে, এই যে এসব আচরণ করিস, লোকের কানে যায় না? তোর বাপ তো শিক্ষিত অন্ধ। তার আর কী?ʼʼ

টেবিলের ওপর বইখাতা ছিটিয়ে আছে। সেগুলো গোছাতে গোছাতে অন্তূ বলল, “আম্মু! তুমি দু'দিন না খেয়ে থাকো, কেউ তা নিয়ে আলোচনা করবেনা, আর না এক মুঠো ভাত দিয়ে তোমায় সান্ত্বণা দিতে আসবে। কিন্তু যখন তুমি নিজের মতো করে কিছু করতে চাইবে, সেটা তাদের আলোচনার খোরাক জোগাবে। তাহলে যেই মানুষেরা তোমার কষ্টকে আলোচনা করে সুখের রূপ দিতে পারেনা, তাদেরকে তোমার ভালো থাকাকে কেন খারাপ থাকাতে বদলাতে সুযোগ দেবে?ʼʼ

শেষের দিকে কঠিন হলো অন্তূর কণ্ঠস্বর। রাবেয়া বেগম বললেন, “তুই এতো অবুঝ ক্যান, অন্তূ? মেয়ে মানুষের এতো মুখরা হতে নেই। সমাজে কথা হয়। বোবার কোনো বিপদ থাকেনা। চুপ থাকলে নাজাত রে আম্মা।

সোজা হয়ে দাঁড়ায় অন্তূ, চোখে-মুখে দ্যুতিময় দৃঢ়তা ফুটে ওঠে, “আমার নাজাত চাই আখিরাতে। বেঁচে থাকতে কীসের নাজাত, আম্মা? যেখানে জীবনটাই টানপোড়েনের এক সমষ্টি মাত্র!ʼʼ

রাবেয়া আস্তে করে এসে মেয়ের পাশে বসে বললেন, “এখন বিয়ে যদি নাও যদি করিস, পরে করবি তো! তখন যখন লোকে তোর ব্যাপারে শুনতে আসবে আশেপাশে, কী বলবে লোকে? মেয়েলোকের ঠান্ডা মেজাজের, নরম হইতে হয়। এতো কথা, এতো যুক্তি, এতো প্রতিবাদ! তুই বুঝিস না, এইসব বিপদ আনে খালি। এইসব কি পড়ালেখা থেকে আসতেছে? আমি কি এতদূর তোরে পড়ালেখা করায়ে ভুল করছি?ʼʼ

কিছুক্ষণ চুপ থেকে মুচকি হেসে শান্ত-স্বাভাবিক কণ্ঠে বলল,
“আমাকে অন্তূ থেকে– অ্যাডভোকেট মাহেজাবিণ আরমিণ অন্তূ হতে এমন বহু চড়াই-উৎড়াই পেরোতে হতে পারে। একজন আইনজীবীর জীবন মুখবন্ধ আর নির্ঝঞ্ঝাট চলতে পারেনা, আম্মা!ʼʼ


সারারাত পড়ার পর সকালের দিকে ঘুমানো হয় রোজ।সেদিন ক্লাসটেস্ট পরীক্ষা ছিল। মাসখানেকের ছুটির পর ক্লাস শুরু ভার্সিটিতে। আজকাল ঘনঘন ছুটি চলে। দেশের পরিস্থিতি ভালো না। চারদিক উত্তাল।

ফজরের নামাজও কামাই হয়ে গেছে। উঠে গিয়ে রান্নাঘরে উঁকি দিলো, “কিছু খাওয়ার আছে নাকি, আম্মু?ʼʼ

তরকারী চুলায় বসাতে বসাতে বললেন রাবেয়া, “কী থাকবে? আব্বুর কাছে যা, দেখ বারান্দায় মুড়ি-চানাচুর দিছি।ʼʼ

আমজাদ সাহেব খবরের কাগজে ঢুকে গেছেন। অন্তূ পাশে বসল, “কী দেখছো?ʼʼ

আমজাদ সাহেব গম্ভীর স্বরে বললেন, “সেই গ্রেফতার, বাসে আগুন, হরতাল....ʼʼ ওর দিকে চায়ের কাপ এগিয়ে দিয়ে বললেন, “নে। এত রাত জাগতে বলে কে? বলি, সন্ধ্যায় পড়তে বসবি। চোখ-মুখের কী হাল হয়েছে? আজ থেকে আমি বসব পড়ার টেবিলে।ʼʼ

অন্তূ অল্প মুখ ফুলিয়ে বলল, “আমি এখনও বাচ্চা নেই, আব্বু।ʼʼ

আমজাদ সাহেব ভরাট গলায় বললেন, “টোস্ট নে। গলা দিয়ে খাবার নামতে চায়না? চা-টুকু শেষ কর।ʼʼ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আনমনে মুচকি হাসলেন আমজাদ সাহেব, “মা বলতো, 'ও আমজাদ যার শইরে মাংস লাগেনা, তার মাতায় পড়ালেহা ছাই ঢুকবো? আয় তো পাকা আম আনছে তোর আব্বা। দুধ-ভাত মাখাইছি, আয়। পরে পড়বি।ʼʼ

দাদিকে অন্তূ দেখেনি। আব্বুর দিকে অনিমেষ চেয়ে থাকল। গম্ভীর এই মানুষটা যখন কদাচিৎ সল্প হাসেন, সৌম্য পৌঢ়া চেহারায় যে জ্যোতি ফুটে ওঠে, আর ওই মেহেদি দেয়া দাড়ির নিচে চকচকে সাদা দাঁতের মসৃণ হাসি, অন্তূর বুকে কাঁপন ধরে যায়। এই মানুষটাকে ছাড়া সে সর্বনিঃস্ব!

-“আমাকে আজ নামিয়ে দিয়ে যাবে একটু ভার্সিটিতে?ʼʼ

আমজাদ সাহেব টান করে ধরে খবরের কাগজের পৃষ্ঠা উল্টালেন, “তোর ভার্সিটি সেই দশটায়, আমি সাড়ে আটটার ট্রেন ধরব, এখনই বের হব। রিক্সা ঠিক করে দিয়ে যাব। খেয়ে যাবি।ʼʼ

অন্তূ ঠোঁটে ঠোঁট গুজল, “দরকার নেই রিক্সার। শোনো, তুমি গোসল করে যাবে। রোদ ভালোই বাইরে। প্রেশার বাড়বে নয়ত।ʼʼ

আমজাদ সাহেব জিজ্ঞেস করলেন, “ভার্সিটি থেকে নাকি হলে থাকার কথা বলেছে?ʼʼ

-“আম্মা কি আর রাজী হবে তাতে?ʼʼ

আমজাদ সাহেব গম্ভীর চোখে তাকিয়ে অন্তূর কপাল ছুঁলেন। কিছু লেগে ছিল, তা সযত্নে মুছে ভারী গলায় বললেন, “সেকেন্ড ইয়ারের ফাইনাল কবে?ʼʼ

-“ক্লাস টেস্ট চলছে, খুব তাড়াতাড়ি ডেইট পড়বে মনে হয়।ʼʼ

খবরের কাগজটা অন্তূর হাতে দিয়ে উঠে পড়লেন আমজাদ সাহেব। অন্তূ পিছু ডাকে, “আব্বু!ʼʼ

পিছে মুড়লেন তিনি, “হু!ʼʼ

অসহায় দেখায় অন্তূর মুখটা, “কবে ফিরবে তুমি?ʼʼ

-“দু'দিন দেরি হবে হয়ত। কাজ না থাকলে ফিরে আসবি ক্লাস শেষে। কোথাও দেরি করবি না।ʼʼ

অন্তূ আস্তে কোরে মাথা নাড়ে, “হু।ʼʼ

সামনে ফিরে সামান্য হাসলেন। অন্তূ থাকতে পারেনা উনাকে ছাড়া, তার তেজস্বী মেয়ে এই এক জায়গায় কাবু। অথচ পাগলি বোঝেনা, চিরকাল এই আব্বুটা সাথে থাকবে না। সামনের পথ তাকে একা পাড়ি দিতে হবে।


ভার্সিটির সামনে এসে রিক্সা থামল। ক'দিন আগেই তুমুল আন্দোলন হয়ে গেছে ছাত্রপরিষদের। দেশটা ভালো চলছে। রোজ খু"ন-গুম-কারাবরণ অবিরাম। থামাথামি নেই, সরকারের ক্লান্তিও নেই। খুব পরিশ্রম করছে দেশটাকে নিজের মতো চালাতে। মানুষজন একটু দুশ্চিন্তায় আছে অবশ্য, তবে সরকার ভালো আছে। সে তার মনমতো দেশ চালাচ্ছে। কেউ ভয়ে বিরোধিতা করে না। করলে কারাগার নেহাত কম নয় দেশে। অস্ত্র এবং দেশপ্রেমিক সৈনিকের সংখ্যাও বেশ।

ফটকের ওপর বড় বড় অক্ষরে লেখা— হাজি মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়। দিনাজপুরের বাঁশেরহাট থেকে খুব বেশি দূরে নয় অন্তূদের বাড়ি। হলে থাকার প্রয়োজন পড়ে না বিশেষ।

শহীদ মিনার চত্বরের আশপাশটা বেশ ভালো লাগে অন্তূর। জায়গাটা পার করার সময় পেছন থেকে ডাকল কেউ। অন্তূর পিছু ফিরে দেখল, ছয়জন যুবক। তার সিনিয়র হবে নিশ্চিত। সামনে যে দাঁড়িয়ে, তাকে চেনা চেনা লাগল। আগে দেখা মুখ, তবে মনে নেই বিশেষ কিছু।

সে এগিয়ে এসে হাতের সিগারেটটা অন্তূর দিকে বাড়িয়ে বলল, “নাও, একটা টান দাও!ʼʼ

অন্তূ নিঃসংকোচ হাতে নিলো সিগারেটটা। তার একটা দোষ আছে। সে ভেতর আর বাহির আলাদা করতে পারে না। যেমন মনে ঘৃণা রেখে মুখে হাসা যায়। কিন্তু তার সেই দক্ষতা বা অভিজ্ঞতা নেই। সিনিয়রদের প্রতি তার বিদ্বেষ পুরোনো। তা সেদিন বেরিয়ে এসছিল ভুলক্রমে।

অন্তূ আধখাওয়া সিগারেটটি ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখে বলেছিল, “টান না-হয় দেব একটা, কিন্তু এতে ফযিলতটা কী?ʼʼ

পাখির মতো চঞ্চল দৃষ্টি লোকটার। অন্তূর চোখে চোখ গেঁথে হেসে উঠল সে, “ফযিলত? এই যে আমি তোমারে টান দিতে বলতেছি, এর চাইতে বড়ো ফযিলত বা হাকিকত কিছু নাই, সিস্টার! আর জরুরী তো মোটেই না যে সবকিছুতে ফযিলত থাকা লাগবে! এক টান মারো। স্বাদ ভালো। ব্যান্সন এন্ড হেজেস।ʼʼ

অন্তূ যথাসম্ভব শান্ত কণ্ঠে বলল, “কিন্তু আপনি টান দিতে বললেই দিতে হবে, তা কেন? এটা আশিভাগ মুসলিমের দেশ, বাংলাদেশ। সেক্ষেত্রে আমিও পশ্চিমা সংস্কৃতির মেয়ে না। সিগারেটে অভ্যস্ত নই আমি।ʼʼ

সে কপালটা সামান্য জড়িয়ে হাসল। হাসার সময় তার গা দুলে ওঠে, ভঙ্গিমাতে বড় বেপরোয়াপনা। সে বলল, “তবু এক টান মারো দয়ালের নামে।ʼʼ

অন্তূ দু-একবার আশপাশে তাকাল বোকার মতোন। কেউ আসার নেই বোধহয় তাকে বাঁচাতে। এর অবশ্য কারণ আছে। মানুষের দৃষ্টিকোণ থেকে সে কোনো বিপদে পড়েনি। কিন্তু তারা এসে অন্তূর পক্ষে এবং সামনের জনের বিপক্ষে কথা বললে যা হবে সেটা বিপদ।

হিজাবের আড়ালে অন্তূর শরীরটা দু-একবার ঝাঁকুনি খেলো। তবু পরিষ্কার গলায় বলল, “তবু কেন?ʼʼ

পেছন থেকে কবীর ক্যাটক্যাট করে বলে উঠল, “কারণ আমরা সিনিয়র। এরপর আর কোনো ফযিলতের খোঁজ করলে তুমি নিখোঁজ হয়ে যাবা। ঠিক বলিনি ভাই?ʼʼ

পেছনের ছেলেরা হাসল। সে বলল, “আলবাৎ সহি কথা কইছিস।ʼʼ

সকলে দেখছে ওদের। অন্তূ মাথা নাড়ল, “উমমম! সাংঘাতিক ব্যাপার দেখছি! তবে সিনিয়রের মতো আচরণ আপনাদের একজনেরও নয়।ʼʼ

সে ভ্রু নাচিয়ে বাহবা দিয়ে এগিয়ে অন্তূর মুখের ওপর ঝুঁকে এলো, “তুমি তা জানাবা, ডিয়ার?ʼʼ

অন্তূ ঘৃণায় মুখটা পিছিয়ে নেয়। ভোক ভোক করে গন্ধ আসছে তার মুখ থেকে। অন্তূ নিজ গরিমায় বলে ওঠে মাড়ি শক্ত করে, “জানাতেই পারি। শিক্ষার বয়স হয় না। বলা হয়, দোলনা থেকে কবর পর্যন্ত জ্ঞান অর্জন করো।ʼʼ

কবীর কিন্তু সহৃদয় ব্যক্তি। সে সাবধান করল, “হুঁশিয়ারী করছ? সিনিয়রদের সামনে মুখ চালাচ্ছ? মারা পড়বে, মেয়ে! কবে ভর্তি হয়েছ, কে বড়ো কে ছোটো বিষয়টা বুঝে উঠতে পারোনি মনে হচ্ছে?ʼʼ

কবীরের খুব হাসি পাচ্ছে ছোট্ট মেয়েটার দুঃসাহসের ওপর। বড় ইচ্ছে করছে নেকাবটা টেনে ছিঁড়ে ফেলতে। ফেলাও তো উচিত। মেয়েটা বেয়াদব।

অন্তূ হাসল, “কুকুর ছোটো হোক অথবা বড়ো, তাকে কুকুর বলার সৎসাহসটুকু থাকা অবশ্যই ভালো গুণ! কী বলেন সিনিয়র মশাই!ʼʼ কথাটা অন্তূ, ঘাঁড় বাঁকা করে তাকিয়ে থাকা সেই সিগারেটওয়ালা লোকটার দিকে তাকিয়ে বলল।

সে ভ্রু কিঞ্চিৎ জড়ায়, যা খুব সূক্ষ্ণ। তার খুব আনন্দ লাগছে। নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা এটা। তাদের সামনে কেউ তো কথা বলে না। মেয়েটা নিশ্চিত তাকে চেনে না।

অন্তূ আবার বলল, “একটা মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে, তাকে ডেকে সিগারেট টানতে বলা, পানির বোতল ভরানো, জুতো পরিস্কার করানো, আজেবাজে কথা চিরকুটে লিখে তা অন্যকে দেওয়ানো, হ্যারাস করা, হুমকি দেয়া, হলে ডেকে নেয়া–এসব আপনাদের কাছে সিনিয়রের সংজ্ঞা? অথচ আমি যে বই থেকে সিনিয়রের সংজ্ঞা পড়েছিলাম, সেখানে লেখা ছিল–সিনিয়র হলো শিক্ষক, যে জুনিয়রকে আদব শেখাবে, শিষ্টাচার বোঝাবে, একটা ভুল করলে ধমক দিয়ে ভুলটা শুধরে দেবে, কোনো প্রয়োজনে সাহায্য করবে ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছুই লেখা ছিল। সেই বই আপনাদের হাতে পড়েনি। দুঃখজনক। মূলত আপনারা রাজনৈতিক পাওয়ার শো করতে এসেছেন, ভুল বলিনি আমি নিশ্চয়ই!ʼʼ

সিগারেটটা মাটিতে ফেলে পা দিয়ে চেপে পিষে ক্লাসের দিকে এগিয়ে গেল। ছেলেগুলো ধরতে যায় অন্তূকে। সে বাঁধ সাধল, “উহু! বয়েজ, কুল কুল! মালটা তো একদম আলাদা রে! সবার চাইতে আলাদা। তার সাথে খেলাটাও হবে একদওওম আলাদা! শালার রাজনীতিতে আসার পর কত্ত ভদ্ররনোক হয়ে গেছি আমি, ভাবা যায়? আমাকে চেনেনি মনেহয়। পাত্তাই দিলো না, ছেহ!ʼʼ

আস্তে করে মুখটা তুলে আকাশের দিকে তাকাল, “কুকুর বলেই খালাস হয়ে গেলে, মেয়ে! পেটে যে কুকুরের ভীষণ খিদে, সেইটা খেয়াল করলে না! নট ফেয়ার, নোপ! দিস ইজ নট ফেয়ার!ʼʼ

হুট করে আবার আসমান থেকে চোখ নামিয়ে ঘাঁড় নাড়ল দুদিকে, “চ্যাহ! উহহ কী তেজ! আমি ডিস্টার্বড রে!ʼʼ

সিগারেটটা সে তুলল। সেটা কবীরকে দেখিয়ে বলল, “রেখে দে এটা যত্ন করে। পাখি শিকার করার পর একবার করে এটা দেখব, আর... তাই বলে আমার সাথে এভাবে? এ ও আমাকে চেনে? চেনে রে আমাকে?ʼʼ

সামনের দাঁতক পাটি ঘষল মৃদু। ঘাঁড়ে হাত বুলিয়ে আড়চোখে সামনে তাকিয়ে দেখল। আবার আকাশের পানে তাকাল, “সামনে ইলেকশন! নিজেকে বাঁচিয়ে চলছি, তাতে দেখতেছি ম্যালা লোকই রঙ্গ-তামাশা দেখায়ে চলে যাচ্ছে! এইটা কি ঠিক হচ্ছে, বল তো! ইলেকশন তো শেষ হবে তাই না? এরপর কী হবে, তা ভাবছে না কেন এরা?ʼʼ

উন্মাদের মতো হাসল সে। ভার্সিটি চত্বরে লোকজন কম এখন। ক্লাসের ফুল টাইম চলছে। লোক থাকলেও তার যায়-আসার কথা নয়। যে পাশ কাটাচ্ছে, সালাম ঠুকে যাচ্ছে তাকে। সে আবার তাকাল অন্তূর দিকে। অন্তূ ততক্ষণে ঢুকে পড়েছে সমাজবিজ্ঞান বিভাগের বিল্ডিংয়ে।

চলবে…

[১. উপাখ্যানটিতে অকথ্য গালিগালাজ, আঞ্চলিকতা, নৃশংসতার বর্ণনা রয়েছে। সুতরাং যারা এ ব্যাপারগুলোতে অস্বস্তিবোধ করেন, তাদেরকে না পড়ার পরামর্শ রইল।এছাড়াও টুকটাক রাজনৈতিক বিষয়াদি রয়েছে, যা দ্বারা প্রভাবিত না হলেই ভালো।

২. উপাখ্যানে স্থান ও সময়কাল কিছু ক্ষেত্রে অ-কাল্পনিক থাকবে। কিন্তু তার সঙ্গে শতভাগ বর্ণনার ধারা মিলবে না, এবং সেটা ধারা গঠনের স্বার্থেই। এখানে যে বিশ্ববিদ্যালয়টির নাম উল্লেখ করা হয়েছে, সেটা শুধুই বর্ণনার প্রয়োজনে। কোনো ভার্সিটি এবং বাস্তবতাকে অবমাননা বা ইন্ডিকেট করে নয়। ভুলত্রুটি ক্ষমা করবেন।]

Address

Chittagong

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when The Crochet Colony posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Share