19/06/2023
ঢেঁকি যখন স্বর্গে
কথায় আছে ঢেঁকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে। কারণ এটাই তার কাজ। কাজেই স্বর্গ কিংবা নরক ঢেঁকি যেখানেই যাক, সুযোগ পেলে সে তার কাজ করবেই। এই কথাগুলো কেন বলছি? সেটা নিচের গল্পটা পড়লেই বুঝতে পারবেন।
প্রায় ৬ বছর আগে কথা। তখন সারারাত জেগে কাজ করতাম। প্রচুর ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট পেতাম। একদিন মাঝরাতে দেখি হুবহু আমার আব্বার নামের এক প্রফাইল থেকে ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট এসেছে। আব্বা মারা গিয়েছেন অনেক দিন হয়ে গেছে, কিছুটা ইমোশনাল হয়ে পড়লাম, আমি সাধারণত মিউচুয়াল ফ্রেন্ড ১০০+ না থাকলে ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট একসেপ্ট করতাম না। কিন্তু এই প্রফাইলটা বিশেষ কিছু ছিল, তাই মিউচুয়াল ফ্রেন্ড মাত্র কয়েকজন থাকার পরেও, তার ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট একসেপ্ট করলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই দেখি সে মেসেজে নক দিল। আমি তার ফ্রেন্ড রিকয়েস্ট গ্রহন করাতে সে খুবই অভিভূত এবং আনন্দিত, সে আমার লেখার একজন গুনমুগ্ধ পাঠক, সে আমার সাথে একটু কথা বলতে চায়। আমি কল দিলাম, দুজনে বেশ কিছুক্ষণ কথা হল, সে তার উচ্ছ্বাসের কথা বলল, আমি আমার আবেগের কথা বললাম, কারণ তার নাম আর আমার আব্বার নাম সেম। সেই হল শুরু। প্রায় প্রতি সপ্তাহেই কয়েকবার কথা হত।
সে একজন ফ্রিল্যান্সার এসিও আর ডিজিটাল মার্কেটিং নিয়ে কাজ করত। মূলত আপওয়ার্কে বেশি কাজ করত, মোটামুটি কাজ করত, লংটারম কিছু কন্টাক ছিল সেটা দিয়ে চলে যেত, ফাইভারে শুরু করে কিছু দিনের মধ্যেই সে ভাল করছিল, কিন্তু তার এক কাজিনের ভুলের কারনে তার একাউন্টটা ব্যান হয়। সেই কাজিনকে সে হাতে ধরে কাজ শেখাচ্ছিল, ফাইভার মার্কেটপ্লেসে একাউন্ট খুলে দিয়েছিল, একদিন সেই কাজিন তার অনুপস্থিতিতে তার ল্যাপটপে তার একাউন্ট লগইন করে প্রফাইল চেক করার জন্য। ফলাফল দুইজনের একাউন্টই ব্যান। বেচারা এই ঘটনায় মুষড়ে পড়েছিল। প্রায়ই তার হতাশার কথা বলত। তার ইচ্ছা ছিল বিদেশে চলে যাবার, আমি তাকে নিরুৎসাহিত করতাম। তখন আমার ফাইভারের গিগের র্যাঙ্ক চান্দের দেশে চলে গেছে, তাকে বললাম যেহেতু আপনি ফ্রি আছেন, কাজেই আবার গিগের একটু মার্কেটিং করে দেন। আপনাকে আমি পে করব, সে রাজি হল, কিন্তু পেমেন্ট সে নেবে না। প্রায় দুই সপ্তাহ সে আমার গিগের অরগানিক মার্কেটিং করেছিল, প্রচুর ক্লিক ভিউ পেয়েছিলাম সাথে কিছু অর্ডারও পেয়েছিলাম। বুঝতে পারলাম সে আসলেই একজন অভিজ্ঞ লোক, এর জন্য আমি তার কাছে কৃতজ্ঞ।
এভাবেই চলছিল, মাঝে মাঝে কথা হত। একদিন সে হঠাৎ করে একটা শুখবর দিল, সেটা হচ্ছে, সে বাংলাদেশ ওভারসিজ এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড সার্ভিসেস লিঃ (বোয়েসেল)এ এপ্লিকেশন করে রেখেছিল, সে মালয়েশিয়া যাবার জন্য সিলেক্টেড হয়েছে। আমি তাকে মালয়েশিয়া যেতে নিষেধ করলাম। তাকে বললাম আপনি এত ভাল এসিও এবং ডিজিটাল মার্কেটিং পারেন, আপনি দেশে বসেই অনেক কিছু করতে পারবেন। কিন্তু কে শোনে কার কথা, সে পণ করেছে বিদেশে চলে যাবেই, ধারনা করি ছ্যাকা ট্যাকা খেয়েছিল, যদিও সে আমার কাছে এসব স্বীকার করেনি। কিছু দিনের মধ্যে সে মালয়েশিয়া চলে গেল। মালয়েশিয়া যেতে মাত্র ৭০ হাজার টাকার মত তার খরচ হয়েছিল, যেহেতু সে সরকারী ভাবে গিয়েছিল। মালয়েশিয়া পৌঁছে সে আমাকে একবারই নক দিয়েছিল। এর পরে বেশ কিছুদিন যোগাযোগ নেই। ধারনা করেছিলাম সে হয়ত সব কিছু গোছগাছ করতে ব্যাস্ত।
বেশ অনেক দিন পর সে যোগাযোগ করল। জিজ্ঞেস করলাম কেমন আছেন? সে উচ্ছ্বসিত হয়ে উত্তর দিল যে সে খুবই ভাল আছে। এবং সে যে গল্প শোনালো তার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না। সেই মজার গল্পটা তাহলে আপনাদের খুলেই বলি। সে সহ আরো বাংলাদেশি যারা সিলেক্টেড হয়েছিল, তারা সবাই প্যানাসনিক কোম্পানির মালয়েশিয়ান শাখার মেইন ওয়ারহাউজে কাজ পেয়েছিল। বড় বড় ফ্রিজ, টিভি বিভিন্ন ধরনের ইলেক্ট্রনিক্স আইটেম এগুলো লোড করা আনলোড করা সহ, আরো অনেক ধরনের শারীরিক পরিশ্রমের কাজ তাদের করতে হত। বলা যায় সারাদিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খাটতে হত, এর থেকে দেশে সে অনেক আরামেই ছিল। বিদেশে যাবার ভুত এক সপ্তাহেই তার ঘাড় থেকে নেমে গেল, এখন দেশে যে ফেরত যাবে, তার কোন সুযোগও নেই। যা হোক এভাবেই ১ সপ্তাহ চলে গেল। তাদের বিশাল গুদামের এক কোনে কাচ দিয়ে ঘেরা ছোট্ট একটা অফিস ছিল, সেখানে মূলত মালয়েশিয়ান, ইন্ডীয়ান, তামিল আর চাইনিজরা অফিশিয়াল কাজ করত। তাদের বস ছিল এক চাইনিজ। একদিন কি একটা কাজে সে সেই অফিসে গিয়েছিল, অফিসে ইংরেজির ভাল প্রচলন ছিল, যেহেতু দেশি বিদেশি অনেকেই কাজ করত। সে যখন দাড়ীয়ে আছে তখন সে দেখতে পেল যে, সেই চাইনিজ বস এক মালয়েশিয়ান মহিলা এমপ্লিয়ির উপর খুব রাগ ঝাড়ছে। কারণ আর কিছুই না, তাদের পেজ থেকে অরগানিক ভিজিটর আসছে না, বুস্টীং করেও তেমন কোন অর্ডার আসছে না। সব মিলিয়ে সে হতাশ।
সে দেখল এই একটা সুযোগ, পিসিতে তাদের ফেসবুক পেজ ওপেন করাই ছিল। সে এক পলক সেটা দেখেই, ইংরেজিতে চাইনিজ বসকে বলতে লাগল যে, তাদের পেজে বেশ কিছু টেকনিক্যাল সমস্যা আছে, সেগুলো সমাধান করলে ১ সপ্তাহেই অরগানিক ভিজিটর দীগুণ বাড়ানো সম্ভব। একজন সাধারণ বাংগালির মুখে এই কথা শুনে চাইনিজ বস প্রথমে বিশ্বাস করতে চায়নি, কারন এরা সাধারণত লেবারের কাজ করেই অভ্যাস্থ। এরা আবার টেকনিক্যাল কাজ কবে থেকে করা শুরু করল? বস জিজ্ঞেস করল তুমি এসব কিভাবে জানলে? উত্তরে সে বলল দেশে থাকতে সে এই ধরনের কাজই করত, বসের বিশ্বাস অর্জনের জন্য সে তার আপওয়ার্ক প্রফাইল দেখাল। এসব দেখে বস বেশ খুশি হল। তাকে একটা চ্যালেঞ্জ দিল, সেটা হচ্ছে ১ সপ্তাহের মধ্যে তাদের ফেসবুক পেজের ভিজিটর দিগুণ করতে হবে, আর সেল বাড়াতে হবে। যদি সে এটা পারে তবে সে এখানেই কাজ করবে। শুরু হলে তার চ্যালেঞ্জ। তার আত্মবিশ্বাস ছিল সে এটা পারবে, কারণ তার এই কাজের ভাল অভিজ্ঞতা আছে। ১ সপ্তাহ সে মনোযোগ দিয়ে কাজ করতে লাগল। ফলাফল হচ্ছে ফেসবুক পেজের লাইক ভিউ কয়েকগুন বেড়ে গেল, অর্ডার সংখ্যায় দীগুণের বেশি হল, এবং এগুলো সব অরগানিক ভাবে কাজ করেই। আসলে এর আগে এই পেজে প্রফেশনালি তেমন কোন কাজই হয় নাই, ফলে এটা তার জন্য ছিল বিশাল একটা প্লাস পয়েন্ট। সে সহজেই তার কাজের ম্যাজিক বসকে দেখাতে পেরেছিল।
চাইনিজ বস প্রচন্ড খুশি হয়ে তার অফিসে পারমানেণ্টলি কাজের ব্যাবস্থা করে দিল। বেতনও বাড়ীয়ে দিল। সে এসি রুমে বসে কফি খেতে খেতে পিসির সামনে বসে কাজ করতে লাগল। যে কাজ আসলে সে দেশেও একই ভাবে করত। ঢেঁকি কেন স্বর্গে গেলেও ধান ভানে, কথাটা আসলে কেন বুঝাতে চেয়েছি সেটা আশা করি এতক্ষণে বুঝে গিয়েছেন। মাঝে মাঝে সে উদাস হয়ে কাচের ওপাশে বাংলাদেশি ভাইদের অমানুষিক পরিশ্রম করা দেখত। তারও সেখানেই কাজ করার কথা ছিল, কিন্তু পরিশ্রম আর ভাগ্য তাকে কাঁচের দেয়ালের এপাশে নিয়ে এসেছে। সে চেস্টা করেছিল তার বাংলাদেশি ভাইদেরকে বুঝাতে যেন তারা টেকনিক্যাল কাজগুলো শেখে। কিন্তু কে শোনে কার কথা, তারা তাদের কাজ নিয়ে সন্তুষ্ট। কাজেই তার আর কথা বাড়াবার কোন সুযোগ নেই।
এভাবে মাঝে মাঝেই তার সাথে কথা হত। তার সাফল্যের গল্প শুনতাম। ছুটীর দিনগুলোতে সে পার্টটাইম কাজ করত। এভাবে প্রায় ১ বছর পার হয়ে গেল। এই কোম্পানির কাজের অভিজ্ঞতা দিয়ে সে মালয়েশিয়ার সব থেকে বড় ইকমারস সাইট Lazada তে জব পেয়ে গেল। বেতন আর সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। এই কয়েক বছরেই সে বাড়ীতে সে জমি রেখেছে, বাড়ী করার কাজে হাত দিয়েছে, তার জন্য পাত্রি দেখা হচ্ছে, সব কিছু সে আমার সাথে শেয়ার করত। বুঝতে পারি সে আমাকে আসলে কতটা ভালবাসে। তার ভালবাসাটা টের পেলাম, সেদিন যেদিন সে ফোন করে আমাকে তাদের কোম্পানিতে গ্রাফিক ডিজাইনার হিসাবে যোগদানের জন্য জব অফার করল। বেতন ৮০ হাজার টাকা, বছর ঘুরতেই লাখ টাকা হয়ে যাবে। আসা যাওয়া সব খরচ কম্পনির। তার বস তাকে অনুমতি দিয়েছে সে যাকে সিলেক্ট করবে তাকেই নেয়া হবে। সে মনে মনে আমাকেই সিলেক্ট করেছে। তার ভালবাসা অনুভব করতে পারলাম। তখন আমার কাজের রমরমা অবস্থা, এছাড়া আমি সংসারি মানুষ, এই বয়সে আমার বিদেশ যাওয়া মানায় না। তাক বললাম এই অফার আরও ১০ বছর আগে এলে আমি চোখ বন্ধ করে গ্রহন করতাম। কিন্তু অবস্থা এখন অনুকুলে নেই। সে সব বুঝতে পারল, মন খারাপ করলেও কিছু করার ছিল না।
করোনার আগে দেশে এসে বিয়ে করার কথা ছিল, আমাকে অগ্রিম দাওয়াত দিয়ে রেখেছিল। একজন মানুষকে চিনি না জানি না অথচ কতটা আপন হলে এভাবে অগ্রিম দাওয়াত দেয়, আসলে তার সাথে দেখা করার জন্য মনটা খুবই উচাটন হয়ে পড়েছিল। কিন্তু করোনাকাল এসে সব কিছু এলোমেলো করে দিল। সে মালয়েশিয়াতে আটকা পড়ে গেল দেশে আসা বন্ধ, তার পরেও মাঝে মাঝে কথা হত। আস্তে আস্তে যোগাযোগ কম হতে লাগল। আমি আমার কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম, সে তার কাজ নিয়ে। করোনার পরে হয়ত সে দেশে এসেছিল, বিয়েও হয়ত হয়ে গেছে। আমি থাকতে পারিনি এটা নিয়ে কোন আফসোস নেই। তার জন্য দোয়া এবং শুভ কামনা সব সময় থাকবে।
তার এই ঘটনা থেকে একটা শিক্ষা আমরা নিতে পারি, সেটা হচ্ছে যদি সুযোগ থাকে তবে যে কোন টেকনিক্যাল বিষয়ে অভিজ্ঞতা নিয়ে রাখুন। এটা কখনো বিফলে যাবে না। সে যখন দেশে পাকপাকি ভাবে চলে আসবে তখন সে কি করবে, সেটাও সে ভেবে রেখেছিল, তাই সে মালয়েশিয়াতে বসেই আপওয়ার্কের কাজ টুকটাক চালিয়ে যাচ্ছিল, যেন সে দেশে এসে আবার পুরাদমে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে পারে।
যে যেখানেই থাকুক দোয়া করি সে যেন ভাল থাকে, আমি জানি এই লেখা তার চোখে পড়বে, কারণ সে আমার সব লেখা মনোযোগ দিয়ে পড়ে, আর এই লেখা চোখে পড়লে সে অবশ্যই নক দেবে। চাইলেই তাকে ইনবক্সে নক দিতে পারতাম, কিন্তু তার প্রতি আমার ভাললাগা মুগ্ধলাগা এভাবে হয়ত ইনবক্সে প্রকাশ করতে পারতাম না। তাই এই লেখার মাধ্যমে তার প্রতি সামান্য একটু সম্মান জানালাম