06/09/2025
ক্রমাগত পরিবর্তিত সময়ের ভেতর মুহূর্তেই পাল্টে যাচ্ছে ধারণা, সময়ের অভিঘাত। নানামাত্রিক এই বদল প্রভাব রাখছে যাপনে, রুচিতে। ফলে সৃজনের দুনিয়ায় বহুলচর্চিত মাধ্যমের সাথে পেছনে থাকারাও সামনে আসছে সমান হেডম নিয়ে। অণুগল্পের জনপ্রিয়তা মূলত সময়কেন্দ্রিক হেরফেরের সাথে বাস্তবিক রুচিবোধকেও চিহ্নিত করে। অস্থির এবং অপরিমেয় যাপনের চারপাশে এত এত শ্লেষ ও দায়, তা মানুষ বিশদে দেখার সময় আর পকেটে রাখছে না। ফলে, তাকে হিসেবে রাখতে হয় যাত্রাপথের খুচরো সময়, দীর্ঘ কর্মের ফাঁকতালে পাওয়া লাল-চা আর ধোঁয়া উড়ানোর কিঞ্চিৎ অবসর। এর ব্যতিক্রম, বলা চলে, আয়োজন করে রস আস্বাদনের মানুষ কিছু আছে, তবুও সর্বোত বাণিজ্যিক প্রয়াসের কালে অণুগল্প এক বিশাল বৃক্ষের ছায়া ও প্রভাব হয়ে দাড়াচ্ছে। এর বড় একটা কারণ এই, মানুষ ছায়া দেখলেই কায়ার অনুমান করে রাখে আর পছন্দ করে কল্পনার বিস্তৃত আকাশ। অনেক আশার ভেতর সামান্য পাওয়ার মতোই অণুগল্প সামান্যতেই অনেকান্ত আদর-অনুভব দিতে পারে।
আমরা জানি, অণুগল্প বর্তমান বিশ্বসাহিত্যে জনপ্রিয় এক টার্ম। তার চর্চা ও জনপ্রিয়তায় আছে পেছনের ইতিহাস। কিন্তু আমাদের অবাক করে এই, ব্রিটেনের মতো জায়গায় 'ন্যাশনাল ফ্লাশফিকশন ডে' পালিত হয়ে আসছে অর্ধযুগের বেশি সময় ধরে। নিউজিল্যান্ড ও আরো কোথাও অণুগল্পকে সামনে রেখে বিশেষ দিবস পালিত হচ্ছে। যেটা আগেই বলতে চেয়েছি, মানুষের সময়হীনতাই এই টার্মকে মানুষের কাছাকাছি নিয়ে যাচ্ছে। জাতকের গল্প, ঈশপের গল্প অথবা লোকচলিত বিভিন্ন রূপকথায়ও আমরা অণুগল্পের ছায়া দেখতে পাই। কাফকা, হেমিংওয়ে, চেখবের মতো বিখ্যাত লেখকেরা অণুগল্প চর্চা করেছেন। কেউবা ছোটগল্পের পাশাপাশি অণুগল্প চর্চা করেই পেয়েছেন ম্যান অব বুকার কি পুলিৎজার পুরস্কার। বাংলা অণুগল্পের কথা বললে প্রথমেই আসে বনফুলের নাম। স্বপ্নময় চক্রবর্তীর কাজ অণুগল্পকে করেছে সমৃদ্ধ। এদেশে মুম রহমান অণুগল্পের ভূবনে অগ্রগণ্য। বিভিন্ন লিটলম্যাগ কি দৈনিকের পাতা অণুগল্পকে মান্যতা দিয়ে বিভিন্ন আয়োজন রাখলেও এখানে রনি অধিকারী সম্পাদিত 'অনুভূতি' লিটলম্যাগই অণুগল্প নিয়ে প্রথম পরিকল্পিত ও সমৃদ্ধ বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করে। এই সংখ্যাটির জন্য সম্পাদক যেমন কুর্নিশ পাবেন তেমনি এদেশের অণুগল্প চর্চাও গতি পাবে বলে আশা করি। এই ছিলছিলায় বলা যায়, মোহাম্মদ হোসেন এর 'এপিটাফ' একটা উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
মোহাম্মদ হোসেন গল্পকার হিসেবে পরিচিত; দুটো গল্পবইও ইতোমধ্যে বেরিয়েছে তার। এবার বোধহয় কোমর বেধেই অণুগল্পকে ধরবার কোশেশ করেছেন তিনি। 'এপিটাফ' নাম শুনলে অতীতের বিখ্যাত লিটলম্যাগের কথা মনে পড়ে কিন্তু গল্পকার অতীতকে মনে রেখেই পাঠকের সামনে তুলে ধরেন নয়া বাস্তবতা, অণুগল্পের আলপথ ধরে। একচল্লিশটি অণুগল্পের সমাহারে চমৎকার একটা গ্রন্থ সাজিয়েছে দ্বিমত পাবলিশার্স। এর ভেতরে কী আছে? এই প্রশ্ন আমাদের তাড়িয়ে বেড়ায় বটে। সামাজিক নিঠুর বাস্তবতা, রাজনৈতিক ছিনালিপনা, ক্ষুধা ও কাম, করোনা নামের অতিমারি, চারপাশের নিখাদ জোচ্চুরি, সাংসারিক রংধুন, লেনাদেনা ও লোভ সব মিলিয়ে চূড়ান্ত একটা প্যাকেজের নাম 'এপিটাফ'। কোনো কোনো গল্পে আড়াল রেখেছেন গল্পকার, কোথাওবা খোলামেলা। চরিত্রের প্রয়োজনে সংলাপ বির্নিমাণে গল্পকারের মুন্সিয়ানা চোখে পড়ার মতো। ভাষা ব্যবহারে স্থানিক ও ব্যক্তিক সেন্স এত নিখুঁতভাবে ধরেছেন মোহাম্মদ হোসেন তা অণুগল্পের জমিনে উর্বরা ফসল হিসেবে পরিগণিত হবে ভাবিকালে। 'প্রেম' গল্পটাকে কারো কারো গদ্যকবিতা বলে ভ্রম হতে পারে; অন্তত ছন্দ না-জানা কবিদের থেকে এই অণুগল্প ঢের গুণ বেটার ফিল দেয়। 'প্রিয়তমা' গল্প আমাদের সামনে তুলে আনে করোনা নামক অতিবাস্তবতার নিঠুর এক চিত্র। স্বামী আসছে ইতালি থেকে আর বউ পালিয়ে বাঁচে করোনার দোহাই দিয়ে। তেমনি 'মা' গল্পটাও চোখে জল আনে। এই দুটো গল্প পাঠে আমাদের কাছে এই বার্তা পরিস্কার হয় যে, গল্পকার সমাজস্থিত মানুষ, মানুষের কোনো কিছুই তার চোখ এড়ায় না। 'খুশবু' কি আমাদের ক্ষুধাপিড়িত দারিদ্র্য জনগোষ্ঠীর নিয়তিকে বিদ্রুপ করে না? আর 'উদবেগ' ভন্ড ও চেচ্চড়দের প্রতিনিধিত্ব করে। 'দরদি'র ডাক্তার নামের কসাইগুলো চারপাশে জেগে আছে উচ্চতর ডিগ্রি ও রোশনাইমাখা সাইনবোর্ড নিয়ে। 'আকুতি' গল্পটা পড়া যাক, '- বিষ দাও।/ -কেন?/ -বাঁচতে চাই।' মূলত এ কারণেই অণুগল্প আজ এত জনপ্রিয়। বিন্দুর ভেতর সিন্ধুর আভাস দিতে পারে অণুগল্প। মোহাম্মদ হোসেন তথাকথিত মিডিয়াপুষ্ট, বন্ধু-ভাগ্যে উচ্চকিত ফাঁকা-বাহবা পাওয়া, সংঘের আশীর্বাদধন্য, আড্ডারুর পরিচয়ে ভুল বাক্য জায়েজ করা সৃজনকার নন। ফলে তার বই নিয়ে বইমেলায় লাইভ হয় না, বকোয়াবাজি চলে না নানা মাধ্যমে, এমনকি কোথাও দৃশ্যমান হয় না তার মুখ। কিন্তু দায়িত্ব নিয়ে এই কথা বলা যায়, বাংলা অণুগল্পে মোহাম্মদ হোসেন এর নাম নিতেই হবে 'এপিটাফ'র কল্যাণে। 'এপিটাফ' আমাদের অণুগল্পের ভূবনে নতুনতর বিভা।
'হেরা অহন মরণের অভাবে বাইচা থাকব, স্যার।' এরকম মহার্ঘ্য জীবনঘনিষ্ট উচ্চারণের সাথে 'এপিটাফ'-এ গলাগলি হবে পাঠকের। উপলব্ধীজাত নানারকম ভাবনা নিজস্ব প্রকাশভঙ্গিতে মোহাম্মদ হোসেন আমাদের সামনে আনেন। 'অস্বচ্ছতা' গল্পে আয়নার এই উচ্চারণ, 'কারণ তোমরা মানুষরা অস্বচ্ছ, ঘোলাটে' এরচে বড় সত্য আর কী হতে পারে মানুষের? 'আগুন', 'জঠরজ্বালা' ক্ষুধার কাছে মানুষের অসহায়ত্বকে প্রচার করে। 'অভিশাপ' এদেশের ট্রাফিক সিস্টেম ও তার সাথে যুক্ত রাজা-উজিরদের ন্যাংটা করে দেয় একেবারে। এরকম বহু গল্পের উদাহরন সামনে আসে কিন্তু অণুগল্পের শরীরের মতোই আমাদের বাসনাকে সংক্ষিপ্ত করতে হয়। মোহাম্মদ হোসেন যেটা করেছেন, একেবারে নির্বাচিত শব্দপুঞ্জে গল্পের শরীর নির্মাণের চেষ্টা; আর আছে ঝানুচোখে পরিপার্শ্বকে দেখানোর প্রয়াস। এই চেষ্ঠায় তার সততার অভাব নেই। ফলে গল্পগুলো আর গল্পকারের একার থাকে না; হয়ে ওঠে আমপাঠকের। অনুভূতি ও অভিজ্ঞতাকে সমান্তরালে আনতে গিয়ে কখনো কখনো গল্পকার সত্তার সাথে ব্যক্তি মোহাম্মদ হোসেনেরও সাক্ষাৎ হয়েছে। কবুল করতে হয়, এই সাক্ষাৎ কিছুটা হলেও শিল্পগুণ ক্ষুণ্ন করেছে। তবুও 'এপিটাফ'র মাস্তানি শেষ হবার নয়। জীবনের সমস্ত মাস্তি দেখে নিয়ে তা যে কায়দায় প্রাগুক্ত গ্রন্থে উল্লাসিত হয় তা অন্যরকম দ্যোতনায় ভাস্বর। নানা ইশারাভাষ্যে, ইঙ্গিতে, সুনির্বাচিত শব্দে অণুগল্প যেভাবে জীবনের ক্লেদ ও কুসুমকে জারিত করেছে মোহাম্মদ হোসেন এর হাতে তা দীর্ঘতর হতে থাকুক। সময়ের প্রয়োজনে, জান্তবকালে যেভাবে প্রতিবাদ ও প্রকাশ্য করা যায় শৈল্পিক কায়দায় তার বিশদ আছে 'এপিটাফ'-এ। অণুগল্পের এই জার্নিতে যুক্ত হোক আরো আরো নতুন ঢেউ। পাঠককে 'এপিটাফ'র জগতে স্বাগতম।
── ইলিয়াস বাবর [গল্পকার]
📚 অণুগল্প | ৪৮ পৃষ্ঠা | ১৫০৳
২৫% ছাড়ে সরাসরি প্রকাশনা থেকে নিতে ১১০৳ + ৪০৳ শিপিং চার্জ (দেশের যে-কোনো স্থানে) 01812-043015 নম্বরে বিকাশ/নগদ করে কুরিয়ার ডিটেইল দিলে আপনার অর্ডারটি কনফার্ম হবে। পরবর্তী ২ কর্মদিবসের মধ্যে আপনার পারসেল পৌঁছে যাবে।