14/09/2025
''রামসাগর দীঘি'' দিনাজপুর জেলার তাজপুর গ্রামে অবস্থিত বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় মানবসৃষ্ট দিঘি হিসেবে পরিচিত। দিনাজপুর শহর থেকে মাত্র ৭–৮ কিলোমিটার দূরে এই দীঘি প্রতিদিন অসংখ্য ভ্রমণপিয়াসী মানুষকে টেনে নেয়।
রামসাগরের আয়তন প্রায় ৪,৩৭,৪৯২ বর্গমিটার। দৈর্ঘ্য ১,০৩১ মিটার, প্রস্থ ৩৬৪ মিটার এবং গড় গভীরতা প্রায় ১০ মিটার। পাড়ের উচ্চতা ১৩.৫ মিটার। দীঘিটির পশ্চিম পাড়ে রয়েছে বেলেপাথর দিয়ে তৈরি একটি ঘাট, যার কিছু অংশ এখনো বিদ্যমান। বিশাল বিস্তৃত জলরাশি ও চারপাশের সবুজ গাছপালা মিলিয়ে এক মনোমুগ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
ঐতিহাসিক দলিল অনুযায়ী, দিনাজপুরের বিখ্যাত রাজা রামনাথ (রাজত্বকাল: ১৭২২–১৭৬০ খ্রি.) পলাশীর যুদ্ধের আগে (১৭৫০–১৭৫৫ খ্রিষ্টাব্দে) এই দীঘি খনন করেন। খনন কাজে খরচ হয়েছিল প্রায় ৩০,০০০ টাকা এবং এতে শ্রম দিয়েছিলেন প্রায় ১৫,০০,০০০ মানুষ। রাজার নামানুসারেই এর নাম হয় রামসাগর।
রামসাগর নিয়ে প্রচলিত আছে নানান লোককাহিনী। একটি কাহিনী অনুযায়ী, ভয়াবহ খরার সময় পানির অভাবে প্রজারা কষ্টে পড়লে রাজা দীঘি খনন করেন। কিন্তু পানি না উঠলে রাজার স্বপ্নে দৈববাণী আসে, প্রিয় সন্তান রামকে বলি দিলে পানি উঠবে। কথিত আছে, রাজপুত্র রাম দীঘির মাঝখানে নির্মিত মন্দিরে প্রবেশ করতেই অঝোর ধারায় পানি উঠতে থাকে এবং চোখের পলকে ভরে যায় বিশাল দিঘি। আরেক মতে, রামের নামে এক স্থানীয় যুবক প্রাণ বিসর্জন দেন, আর তার নামেই দিঘির নাম হয় রামসাগর।
১৯৬০ সালে দীঘিটি বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে আসে। ১৯৯৫–৯৬ সালে এটিকে আধুনিক পর্যটনকেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলা হয়। পরবর্তীতে ২০০১ সালের ৩০ এপ্রিল রামসাগরকে জাতীয় উদ্যান ঘোষণা করা হয়। বর্তমানে এটি পর্যটন বিভাগের তত্ত্বাবধানে রয়েছে।
রামসাগর দীঘিকে ঘিরে গড়ে উঠেছে রামসাগর জাতীয় উদ্যান। এখানে রয়েছে একটি মিনি চিড়িয়াখানা, যেখানে অজগর, হরিণ, বানর, হনুমান এবং ময়ূরসহ নানা প্রাণী সংরক্ষিত আছে। শিশুদের বিনোদনের জন্য রয়েছে একটি আকর্ষণীয় পার্ক। পিকনিকের সুবিধার জন্য আছে ৭টি পিকনিক কর্নার, টয়লেট ও ক্যাফেটেরিয়া।
এছাড়া ২০১০ সালের ১০ অক্টোবর ব্যক্তি উদ্যোগে গড়ে তোলা হয় রামসাগর গ্রন্থাগার, যেখানে রয়েছে ৮ শতাধিক বইয়ের সংগ্রহ। প্রবেশের জন্য নির্ধারিত টিকিটমূল্য মাত্র ২০ টাকা।
পূর্ণিমার রাতে রামসাগরের পাড়ে বসে চাঁদের সৌন্দর্য উপভোগ করা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। অনেকে এখানে ক্যাম্পিং করতেও আসেন।
তবে দুঃখজনকভাবে, সঠিক তদারকির অভাবে এখানে মাঝে মাঝে অসামাজিক কার্যকলাপ, সন্ত্রাসী ও মাদকসেবীদের আনাগোনার অভিযোগ পাওয়া যায়। পিকনিক কর্নারগুলোও কিছুটা অবহেলায় নষ্ট হচ্ছে।
তবুও ইতিহাস, লোককথা আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের মিশে আছে রামসাগর দীঘি বাংলাদেশের এক অনন্য দর্শনীয় স্থান, যা প্রতিটি ভ্রমণপিপাসুর জন্য অবশ্যই দেখা উচিত।
স্থানটি সম্পর্কে আপনার মতামত কমেন্টে জানাতে পারেন !! (ধন্যবাদ)