
19/03/2025
⛔⭕কামিনী⛔⭕
রাত তখন গভীর। গ্রামের শেষ সীমানায় ডাকবাংলোর পাশের পুরোনো রাস্তা ধরে কেউ একজন এগিয়ে যাচ্ছে। দূর থেকে ঝিঁঝিঁ পোকার ডাক ভেসে আসছে, মাঝে মাঝে শিয়ালের হুয় হুয় চিৎকার। বাতাসে ভাসছে একটা মিষ্টি কিন্তু ভারী সুগন্ধ।
রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল গাছ, তার অসংখ্য শাখা-প্রশাখা যেন রাতের অন্ধকারে ছায়ার মতো ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। তার ফুলের গন্ধ নেশার মতো, কামিনীর মতো আকর্ষণীয়— এই জন্যই গাছের নাম "কামিনী"।কিন্তু এই গাছকে ঘিরে অজস্র ভয়ানক গল্প প্রচলিত আছে।
শোনা যায়, এই গাছের ফল যে একবার ছোঁয়, তার জীবনে নামে বিভীষিকা। শুধু সে-ই নয়, তার সঙ্গে জড়িত প্রতিটি মানুষ ধ্বংস হয়ে যায়।
শহর থেকে সদ্য আসা তরুণ প্রকৃতি গবেষক অর্ঘ্য এসব গল্পে বিশ্বাস করত না। সে এই গ্রামে একটা পুরোনো ভাড়া বাড়িতে থাকতে এসেছে, কারণ প্রকৃতি নিয়ে গবেষণা করাই তার কাজ।
প্রথম দিনেই বাড়ির মালিক বৃদ্ধ রামকৃষ্ণ তাকে সাবধান করে দিয়েছিলেন—"বাবু, কামিনীর গাছের কাছে যেও না। গন্ধ নিতে পারো, কিন্তু ফল ছুঁবে না।"অর্ঘ্য হাসল, "আধুনিক যুগে এসেও এত কুসংস্কার!"
রামকৃষ্ণ কিছু বললেন না, কিন্তু তার চোখের গভীরে ছিল এক অস্পষ্ট আতঙ্ক।
এক রাতে বাড়ি ফিরছিল অর্ঘ্য। আকাশে পূর্ণিমার আলো, রাস্তা জনশূন্য। সে যখন কামিনী গাছের কাছে এসে দাঁড়াল, তখন হঠাৎ তার চোখ আটকে গেল।
গাছের এক ডালে ঝুলে আছে একটি কালচে লাল ফল। চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে। অদ্ভুত এক মোহ ছড়াচ্ছে তার চারপাশে।
অর্ঘ্য জানত, এটা সাধারণ ফল নয়। কিন্তু সে এসব কুসংস্কার মানত না। এক অদ্ভুত নেশায় হাত বাড়াল সে…
ফলটা ছুঁতেই শিরদাঁড়া বেয়ে এক শীতল স্রোত বয়ে গেল। যেন কিছু একটা তার শরীরের ভেতরে ঢুকে গেল! মুহূর্তের মধ্যে চারপাশের বাতাস থমকে গেল। কোথাও কোনো শব্দ নেই, এমনকি পোকামাকড়ের ডাকও বন্ধ হয়ে গেছে!
অর্ঘ্য দ্রুত ফলটা ব্যাগে ভরে বাড়ি ফিরল।সেদিন রাতেই দুঃস্বপ্ন শুরু হলো।
সে স্বপ্নে দেখল, তার ঘরের কোণে কেউ দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ার মতো, কিন্তু তীব্র এক উপস্থিতি। অন্ধকারের মাঝেই ফিসফিস করে বলছে—"ফেরত দাও…ফেরত দাও…"
ঘুম ভেঙে গেল অর্ঘ্যের। সারা শরীর ঘামে ভিজে গেছে। সে বুঝতে পারল, কিছু একটা সত্যিই অস্বাভাবিক হচ্ছে।
পরদিন থেকে বাড়ির পরিবেশ বদলাতে লাগল।
রান্নাঘরের বাসনপত্র নিজে নিজেই পড়ে যাচ্ছিল। বন্ধ দরজা রাতের বেলা নিজে থেকেই খুলে যাচ্ছিল। দেয়ালে যেন আঁচড়ের দাগ পড়ছিল প্রতিদিন।বাড়ির অন্যরাও অদ্ভুতভাবে বদলে যেতে লাগল।
অর্ঘ্যের স্ত্রী রাত্রি ক্রমশ অসুস্থ হয়ে পড়ছিল। মাঝরাতে সে জেগে উঠে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে থাকত জানালার বাইরে, যেখানে কামিনী গাছের ছায়া পড়ত।
এক রাতে রাত্রি হঠাৎ বিড়বিড় করে বলতে লাগল—"ওরা এসেছে… ওরা আমাদের নিয়ে যাবে…"
সেদিন রাতে হঠাৎ করেই রান্নাঘর থেকে বিকট শব্দ হলো। সবাই দৌড়ে গিয়ে দেখল, মেঝেতে ভাঙা কাচ ছড়িয়ে আছে, আর তার ওপরে বসে কাঁপছে রাত্রি।
তার হাত কেটে গেছে, রক্ত ঝরছে। কিন্তু তার মুখে অদ্ভুত হাসি—"ওরা এসেছে… আমায় নিতে এসেছে…"
বৃদ্ধ রামকৃষ্ণ এ ঘটনা শুনে আতঙ্কে চিৎকার করে উঠলেন।"তুই ফলটা ছুঁয়েছিস, তাই না?"অর্ঘ্য অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, "আপনি জানলেন কী করে?"
রামকৃষ্ণ থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বললেন—"এই বাড়ির আগের বাসিন্দা অরুণও ঠিক তোর মতো করেছিল। সে ফল এনেছিল, তারপর একে একে তার পুরো পরিবার শেষ হয়ে গেল।"
অর্ঘ্য চমকে উঠল।"তারপর?""তারপর এক রাতে সে ফলটা ফেরত দিতে গেল… পরদিন সকালে তার লাশ পাওয়া গেল গাছের নিচে। তার চোখদুটো ফাঁকা ছিল!"
এই কথা শুনে অর্ঘ্যের গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল। সে সিদ্ধান্ত নিল, ফলটা ফেরত দেবে।
রাত তখন গভীর।
অর্ঘ্য এক হাতে অভিশপ্ত ফল ধরে কামিনী গাছের দিকে ছুটল। বাতাস থমথমে, চারপাশে অদ্ভুত নিস্তব্ধতা। যেন গাছের ছায়ার ভেতর থেকে কেউ তাকে লক্ষ্য করছে।
গাছের নিচে এসে ফলটা রেখে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গে চারপাশের বাতাস ভারী হয়ে উঠল। কেমন যেন একটা পচা গন্ধ নাকে এলো— যেন পোড়া মাংসের গন্ধ!কিন্তু ঠিক তখনই অর্ঘ্য অনুভব করল…কিছু একটা তার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে।
তার পায়ের পাতা জমে গেল ঠান্ডায়। নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে।কান ফাটানো এক বিকট গলায় কেউ বলে উঠল—"এত সহজে মুক্তি নেই…"
পরদিন সকালে গ্রামের লোকেরা কামিনী গাছের নিচে অর্ঘ্যের নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখল।
তার মুখ ফ্যাকাশে, চোখদুটো ফাঁকা…ঠিক যেমনটা হয়েছিল আগের শিকারের।
বাতাসে কামিনী ফুলের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। গাছটা আবার নতুন ফুলে ভরে উঠেছে। যেন নতুন শিকারের অপেক্ষায়…