30/06/2025
মাইজভাণ্ডারের মহাপুরুষদের সাধনার প্রকৃতি এবং ধারাক্রম সম্পর্কে আলোচনা করার যোগ্যতা আমার সীমিত। এই রচনায় আমি যা বলব, সবগুলো বাইরের কথা। আধ্যাত্মিক সাধনার এই বিশেষ তরিকাটি বিকশিত হয়ে ওঠার ফলে ইসলাম ধর্মের নতুন একটি ব্যাখ্যা সুষ্ঠুরূপ ধারণ করেছে। মাইজভাণ্ডার ছাড়াও আরো অনেক সাধু- পুরুষ ইসলামের সেবায় তাঁদের মন-প্রাণ উৎসর্গ করেছিলেন। প্রকৃত প্রস্তাবে আমাদের এই বাঙলা মুলকে ইসলামের প্রচার-প্রসারে রাজানুগ্রহের চেয়ে আউলিয়া-দরবেশদের প্রচারের ভূমিকা যে অনেক বেশি সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না।
এই অঞ্চলে ইতিহাসের নানা পর্যায়ে যে সকল ইসলাম-প্রচারক ইসলাম প্রচারের কাজে আত্মনিয়োগ করেছিলেন, তাঁদের কর্মপদ্ধতি একরকম নয়। কেউ কেউ জেহাদের মাধ্যমে ইসলাম প্রচার করেছেন। কেউ মানবিক সাম্যের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরে বর্ণবাদী হিন্দু-সমাজের নিষ্পেষিত অংশের মধ্যে মানবিক মর্যাদাবোধ প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। কোনো কোনো সাধক জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি মানবপ্রেম বিতরণ করার মধ্য দিয়ে ইসলামের সেবা করার প্রয়াস পেয়েছেন।
মাইজভাণ্ডার তরিকার প্রতিষ্ঠাতা হজরত মাওলানা শাহ্ সুফী আহমদ উল্লাহর জন্ম ১৮২৬ সালে এবং তিনি লেখাপড়া করেছিলেন ওয়ারেন হেষ্টিংস প্রতিষ্ঠিত কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসায়। গভীর সাধনায় নিমগ্ন হওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি যশোরে কাজীর চাকরী করেছেন। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুর মধ্যবর্তীকালীন সময়টির কথা বিবেচনায় আনলে একথা মেনে নিতে হবে, তিনি অপেক্ষাকৃত আধুনিককালের মানুষ। সেই সঙ্গে একথাও অস্বীকার করার উপায় নেই, তিনি সুফীপন্থী সাধক ছিলেন। বাঙলা দেশে যে সময় থেকে সুফীদের আগমন ঘটতে থাকে, তাঁদের বিশ্বাস এবং আকিদার মর্মবস্তুর অভিন্নতা সত্ত্বেও একেক ঘরানা এবং যুগের সাধকদের সাধনার ধারা একরকম নয়। রস-রূপ এবং রঙ একরকম নয়।
হযরত মাওলানা শাহ সুফী আহমদ উল্লাহ সাধনার যে পদ্ধতিটি উদ্ভাবন করেছিলেন তার কতিপয় প্রণিধানযোগ্য বৈশিষ্ট্য অবশ্যই রয়েছে। মাওলানা সাহেব ইসলামের হুকুম-আহকাম অক্ষরে অক্ষরে পালন করেও মানবমুক্তির এমন একটা পন্থা উদ্ভাবন করেছেন, যেখানে ধর্মে-ধর্মে, সম্প্রদায়ে-সম্প্রদায়ে বিরোধ এবং সংঘাতের বদলে অন্তর্নিহিত ঐক্যের প্রশ্নটি অগ্রাধিকার লাভ করেছে।
মাওলানা হজরত আহমদ উল্লাহ সাহেবের ধর্ম-সাধনার প্রকৃতিটি কি রকম ছিল একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে সে বিষয়ে একটা ধারণা গঠন করা সহজ হবে। একবার ধনঞ্জয় বড়ুয়া নামধেয় একজন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী আসেন মাওলানা সাহেবের কাছে এবং ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হওয়ার কথা বলেন। মাওলানা সাহেব জবাবে জানান, 'তুমি তোমার ধর্মে থেকে যাও, আমি তোমাকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করলাম।'
ইসলামের যে মর্মশাস তার বিস্তার-সাধন আর আক্ষরিক অর্থে টুপিধারী মুসলমানের সংখ্যা বৃদ্ধি করা এক জিনিস নয়। এটাই হজরত মাওলানা আহমদউল্লাহর ধর্মসাধনার প্রধান বৈশিষ্ট্যসমূহের একটি।
'লাকুম দিনুকুম ওলয়াদিন' অর্থাৎ ধর্মের ব্যাপারে কোনরকম জোর-জবরদস্তি নেই। সুফী-সাধকেরা কোরানের এই শিক্ষাটির ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তাদের প্রায় সকলেই অহিংস পদ্ধতিতে প্রচারকাজ চালিয়ে গেছেন।
আজমিরের খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি রাহমাতুল্লাহ আলাইহেকে বলা হয়ে থাকে হিন্দুস্থানের পয়গম্বর। কারণ তাঁর কাছ থেকেই প্রথম হিন্দুস্থানের মানুষ ইসলামের পাঠ গ্রহণ করেছে। তিনি তাঁর শিষ্যদের বলতেন: 'তোমরা গাছের মতো ছায়া দেবে, বহতা নদীর মতো করুণা বিলিয়ে যাবে।' এখনো পর্যন্ত তাঁর তিরোধান-দিবসে যে ওরশ হয়, তাতে আমিষ জাতীয় কোনো খাদ্যদ্রব্য রান্না করা হয় না। নিশ্চয়ই খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি লক্ষ্য করেছিলেন, খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যেহেতু হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রতিনিয়ত বাদ-বিসংবাদের সৃষ্টি হয়, ব্যক্তিগত জীবনে সম্পূর্ণরূপে আমিষ বর্জন করে এই বিরোধের একটা সমাধান তিনি করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছিলেন, 'খাদ্যাভ্যাস' এবং 'ধর্ম' এক বস্তু নয়। মৃত্যুর পূর্বে অসিয়ত করে গিয়েছিলেন, তাঁর অবর্তমানে এই বিষয়টি যেন প্রধান হয়ে না দাঁড়ায়। সেই কারণে তার স্মরণোৎসবে সব ধরনের আমিষ বর্জন একটা রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে।
একটু অপ্রাসঙ্গিক হবে, তথাপি একটি বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। এই পর্যন্ত এই উপমহাদেশে যত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাঙ্গামা রয়েছে তার শতকরা আশিভাগ দুটি মূল বিষয়কে কেন্দ্র করে ঘটেছে। একটি হলো গরু জবাই এবং অন্যটি মসজিদের সামনে বাজনা বাজানো। এই প্রেক্ষিত থেকে বিচার করলে অবশ্যই ধরা পড়ার কথা হিন্দুস্থানে ইসলাম প্রচারের প্রারম্ভিক সময়ে হজরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্ম এবং খাদ্যাভ্যাসের মধ্যে ভেদরেখাটি কি রকম স্পষ্ট করে নির্নয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
কথায় কথা টেনে আনে। এখানে আমার একটি উপলব্ধির কথা সসংকোচে প্রকাশ করতে চাই। সসংকোচে বললাম, কারণ কোনো সাক্ষ্য-প্রমাণ বা প্রামাণ্য কোনো গ্রন্থের সন্ধান আমি পাইনি। শুধু মরহুম হুমায়ুন কবির একবার নিখিল ভারত দর্শন সম্মেলনে পঠিত প্রবন্ধসমূহের ভূমিকা লিখতে যেয়ে ভারতীয় উদারনৈতিক ধর্মসাধনার ইতিহাসে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির যে একটি অনন্য ভূমিকা আছে সেকথা উল্লেখ করেছিলেন। আমার বিচারে ভগবান বুদ্ধের পরে খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি (রঃ) হলেন ভারতবর্ষের সর্বশ্রেষ্ঠ মানবতাবাদী ব্যক্তিত্ব। তাঁর চিন্তা এবং কর্মের সুদূরপ্রসারী প্রভাব ভারতীয় ধর্মসমূহের ওপর এতদূর ক্রিয়াশীল হয়েছে যে, কবীর, নানক, দাদু, তুকারাম, সাইদাস, রামদাস থেকে শুরু করে শ্রী চৈতন্য পর্যন্ত তাবৎ সাধকদের মধ্যে খাজা মঈনুদ্দীনের সাধনার সম্প্রসারিত রূপ অনায়াসে প্রত্যক্ষ করা যায়।
মাইজভাণ্ডারের মাওলানা হজরত আহমদ উল্লাহ যে সাধন-পদ্ধতিটি প্রবর্তন করেছিলেন, মর্মবস্তুর দিক দিয়ে সেটা হজরত মঈনুদ্দীন চিশতির পন্থাটির চেয়ে ভিন্ন। নয়। তথাপি সময় এবং পরিস্থিতির বিচারে মাইজভাণ্ডারী তরিকার স্বাদ-রঙ এবং রস একটু আলাদা একথা বলা বোধকরি অন্যায় হবে না। সুফী-সাধকের সাধনার প্রকাশরূপের মধ্যে একটি সাধারণ লক্ষণ বর্তমান সে কথাও বলার অপেক্ষা রাখে না। বাইরের দিক দিয়ে দেখলে মাওলানা মঈনুদ্দীন চিশতি এবং মাওলানা আহমদ উল্লাহর সাধন-পদ্ধতির আঙ্গিকের মধ্যে একটা সৌসাদৃশ্য অনায়াসে লক্ষ্য করা যাবে। তথাপি দেশকালের পরিপ্রেক্ষিতে সমস্ত সুফী-সাধকদের সাধনার রঙ এবং দাহিকা-শক্তি একরকম নয়। মাওলানা হজরত আহমদ উল্লাহ হজরত মঈনুদ্দীন চিশতির সাধনপন্থার সঙ্গে হজরত আব্দুল কাদের জিলানীর সাধনপন্থার একটি সম্মিলন ঘটিয়েছিলেন। এ দু'তরিকার সম্মিলনে সৃষ্টি হয়েছে মাইজভাণ্ডারী তরিকা। কাদেরীয়া, চিশতীয়া, নকশে বন্দিয়া, মুজাদ্দেদীয়া এই চার প্রধান তরিকার কথা প্রায়শ বলা হয়ে থাকলেও প্রকৃত প্রস্তাবে তরিকার সংখ্যা অসংখ্য। তরিকা শব্দের সহজ অর্থ হলো 'পথ'। প্রতিজন সাধকের আলাদা একটি ব্যক্তিত্ব রয়েছে এবং সেই ব্যক্তিত্ব বিকাশ-প্রকাশের আলাদা একেকটি পন্থাও রয়েছে।
মাইজভাণ্ডারের সাধন-পদ্ধতির গভীরতা এবং ব্যাপ্তি সম্বন্ধে কোনো গাঢ় অনুভবের কথা উচ্চারণ করার ক্ষমতা এবং অধিকার এই নিবন্ধ লেখকের থাকার কথা নয়। মধুর স্বাদ মিষ্টি এই ধারণা যেমন মধু খেয়ে দেখে অর্জন করতে হয় তেমনি অধ্যাত্ম সাধনার মধ্যে ডুবে গিয়েই এই বিষয়ে অভিজ্ঞতা অর্জন করা সম্ভব। সাধনার নিরঞ্জন স্বরূপ সম্বন্ধে বাইরের মানুষের কথা বলা অসম্ভব। মাইজভাণ্ডারের বিশেষ ধারাটি সমাজকে কিভাবে প্রভাবিত করেছে এবং সংস্কৃতি-চর্চার ক্ষেত্রে কি বিশেষ অবদান রেখেছে বড়জোর সে বিষয়ে কিছু কথাবার্তা বলা যেতে পারে।
হজরত মাওলানা আহমদ উল্লাহর সাধনার ধারা তাঁর জীবনাবসানের সঙ্গে সঙ্গে নিঃশেষ হয়ে যায়নি। পরবর্তী কয়েক পুরুষ-পরম্পরা অগ্নিশিখার মতো উজ্জ্বল একদল সাধক-পুরুষের জন্ম সম্ভব করে তুলেছে মাইজভাণ্ডার। তাঁরা নিজ নিজ সাধন ক্ষেত্রে সকলেই অনন্য এবং অধ্যাত্মজগতে এক-একটি মর্যাদার আসন অধিকার করে আছেন।
হজরত মাওলানা আহমদ উল্লাহ হলেন মাইজভাণ্ডারের উচ্চতম মহিমাশিখর, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র হজরত মাওলানা গোলাম রহমানের স্থানও সাধক হিসেবে অনেক উঁচুতে। হজরত দেলোয়ার হোসেন এবং জিয়াউল হোসেন এই সকল ব্যক্তিত্ব মাইজভাণ্ডারী সিলসিলায় পূর্বপুরুষের পবিত্রতার নিষ্ক্রিয় অনুগ্রহভোগী ব্যক্তিমাত্র ছিলেন না। সাধন-মার্গের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক হিসেবে নিজ নিজ আলোক বিচ্ছুরিত করে গেছেন তাঁরা সকলে। ব্যক্তিগত পবিত্রতার ক্ষেত্রেও তাঁরা সকলেই একেকটি গৌরবময় আসনের দাবীদার।
কয়েক পুরুষ ধরে মাইজভাণ্ডারের সাধকেরা, সারাদেশে ছড়ানো তাঁদের খলিফাবৃন্দ অখণ্ড অনুরাগে এমন একটি সাধনপন্থার মাধ্যমে জগৎ-জীবনের অর্থ সন্ধান করেছেন, তার মর্মবেগ, তার চিত্তদোলা আমাদের দেশের জনগণের মনে এক অচিন্তিতপূর্ব অধ্যাত্ম জাগরণের সূচনা করেছে।
সাধনার এই ধারাটি অদ্যাবধি সজীব এবং সক্রিয়। যুগের পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে তার গতিবেগ তীব্রতা হারাতে বসেনি। অন্তত কোটিখানেক মানুষের অন্তরে মাইজভাণ্ডার ভক্তিসাধনার হিতাগ্নি জ্বালিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে। পুরুষানুক্রমিক অধ্যাত্ম-সাধনার একটি নঞর্থক দিকের কথা অবশ্যই উল্লেখ করতে হবে। পীর নামধারী ব্যক্তিরা সকলেই সমান পবিত্র অগ্নির ধারক হতে পারেন না। অনেক সময়েই দেখা যায় একেকজন অলোকসামান্য সাধকের সাধনাকে মূলধন করে তার আপোগণ্ড অলস উত্তরাধিকারীর দল পুরুষানুক্রমিকভাবে বিনা মূলধনের ব্যবসাদারি পেতে বসে আছে।
মাইজভাণ্ডার তরিকার অনুসারীদের মধ্যে যান্ত্রিক ভক্তিবাদ এবং ভক্তি সর্বস্বতা আশ্রয় করেনি, একথা বললে ঠিক হবে না। পীর-মুরিদী সম্পর্কে তেজারতির প্রতিযোগিতায় মাইজভাণ্ডারী তরিকার উত্তরাধিকারীদের অনেকেই আসল সাধনপন্থা থেকে বিচ্যুত হয়ে একটি অভ্যস্ত অভ্যাসে লোকঠকানোর চমৎকার ক্রীড়ায় মেতে ওঠেননি তা-ও সবসময়ে সত্য নয়। বস্তুত বর্তমানে মাইজভাণ্ডারী তরিকার অনুসারীর দাবীদার উত্তরাধিকারীদের নানা শরীকের মধ্যে কে সঠিক পথে রয়েছেন, কে বিচ্যুত হয়ে জাগতিকতার মধ্যে আত্মসমর্পন করেছেন, পরখ করার উপায় কি? তবে একটি বিশেষ ব্যাপার আমি এখানে উল্লেখ করতে চাই। মাইজভাণ্ডারী তরিকার ভক্তিসাধনা এই অঞ্চলের সমাজে কি ধরনের প্রভাব ফেলেছে সে বিষয়ে কিছু না বললে অন্যায় করা হবে। মাইজভাণ্ডারের পীরেরা এই অঞ্চলে ইসলামের একটি অভিনব ব্যঞ্জনা স্পষ্ট করে তুলেছেন। কোরান-হাদীসের শিক্ষা এবং পূর্ববর্তী সাধক-পুরুষদের যে সাধনা, প্রকৃতিগত দিক দিয়ে দেখতে গেলে মাইজভাণ্ডারী তরিকা তার একটি অগ্রবর্তী সম্প্রসারণ মাত্র। তথাপি ধর্মীয় বদ্ধমত এবং সাম্প্রদায়িক গোঁড়ামির পথ মাইজভাণ্ডার সম্পূর্ণরূপে পরিহার করেছে।
ওয়াহাবী আন্দোলনের প্রভাবজনিত কারণে কিনা আমার পক্ষে নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়, ধর্মীয় আচারের কঠোরতা এই অঞ্চলের ইসলামকে অনেকদিন পর্যন্ত একটি জল-অচল কুঠুরিতে পরিণত করে ফেলেছিল। তার প্রভাব মুসলিম সমাজে এমন দীর্ঘস্থায়ী হয়েছে অদ্যাবধি তার জের সমানে ক্রিয়াশীল রয়েছে। প্রাণহীন আচার- সর্বস্বতা এবং নিরেট যান্ত্রিকতার মধ্য থেকে ইসলামের প্রেমধর্মের মর্মবাণী সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে স্থাপন করাই হলো মাইজভাণ্ডারী তরিকার সর্বপ্রধান বৈশিষ্ট্য। সংস্কৃতির সঙ্গে ধর্মের যখন বিচ্ছেদ ঘটে ধর্ম তখন প্রাণহীন আচার-সর্বস্বতা এবং নিছক যান্ত্রিকতায় পর্যবসিত হয়। স্বতঃস্ফূর্ততার দ্যোতনা তখন ধর্ম সৃষ্টি করতে পারে না। মাইজভাণ্ডারী তরিকা এই অঞ্চলের জনগণের মধ্যে নতুনতর একটি স্বতঃস্ফূর্ততার দ্যোতনা সৃষ্টি করতে পেরেছে। ধর্মের সঙ্গে যদি আনন্দ-সাধনার সংযোগ না ঘটে তাহলে ধর্ম বিধিনিষেধের ছককাটা মৌমাছিতন্ত্রের রূপ নেয়। মাইজভাণ্ডার ধর্মের সঙ্গে আনন্দ ও রসচর্চার সংযোগ ঘটিয়ে ধর্মের একটি ইতিবাচক অর্থ সর্বসাধারণের মধ্যে মূর্ত করে তুলেছে। সংস্কৃতির পরিপ্রেক্ষিতের মধ্যে স্থাপন করা সম্ভব হয়েছিল বলেই ইসলাম একটি নতুন জীবনাবেগ নিয়ে জীবনের নতুন মহিমা ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছে, তা সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব অস্বীকার করে না, কিন্তু সম্প্রদায়কে কখনো প্রধান করে তোলে না।
রামকৃষ্ণ যেমন বলেছিলেন, 'যত মত তত পথ।' ধর্মগুলোর অন্তর্নিহিত যে প্রেরণা তার মধ্যে একটা মর্মগত ঐক্য অবশ্যই বিদ্যমান। এটা মুখে বলা সহজ বটে, কিন্তু আধ্যাত্মিক সাধনার মধ্য দিয়ে এই সত্য আবিষ্কার করা বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে আইনষ্টাইনের আপেক্ষিকতত্ত্ব আবিষ্কারের মতোই দুরূহ এবং কঠিন। মাইজভাণ্ডারের সাধকেরা এই কঠিনের সাধনা করেছিলেন এবং সাধনায় সিদ্ধিও লাভ করেছিলেন।
কে কিভাবে নেবেন জানিনে, আমি মাইজভাণ্ডারের সঙ্গে নবদ্বীপের তুলনা করতে চাই। নবদ্বীপ বৈষ্ণবদের ভক্তি-সাধনার ক্ষেত্রে হিন্দু সমাজে যে একটি নতুন আধ্যাত্মিক চেতনা সঞ্চার করতে সক্ষম হয়েছিল, বাঙলার সাংস্কৃতিক বিকাশে তার প্রভাব অত্যন্ত সুদূরপ্রসারী হয়েছিল। বৈষ্ণব সাধকদের লিখিত গীতিকবিতাগুলো বাঙলার কাব্যলোকের এমন এক অক্ষয় সম্পদ, পৃথিবীর সাহিত্যের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে তার তুলনা মেলা ভার হবে। এই গীতিকবিতাগুলো কালের কণ্ঠে ইন্দ্রমনির হারের মতো দুলছে। বলা হয়ে থাকে, প্রেমাবতার শ্রীচৈতন্য দেব স্বয়ং একটি বাক্য না লিখেও একটি বিরাট সাংস্কৃতিক বিপ্লব ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন। তুলনা জিনিসটি সব সময় ভালো নয়। তুলনার মাধ্যমে একটা সাদৃশ্যবোধ জন্মানো সম্ভব হলেও তাতে আসল সত্য পরিস্ফুট করা হয় না। প্রতি প্রজন্মের বংশধরের যেমন একটি নিজস্ব জীবন রয়েছে, তেমনি প্রতিটি আন্দোলন এবং জাগরণের একটি নিজস্ব প্রাণপ্রবাহ এবং অভিব্যক্তি রয়েছে। তথাপি আমি মাইজভাণ্ডারের সঙ্গে নবদ্বীপের তুলনা করেছি, যাতে চট করে একটা ধারণা গঠন করা সম্ভব হয়।
মাইজভাণ্ডারের পীরেরা কেউ সরাসরি সাহিত্যচর্চা বা সঙ্গীত সাধনা করেননি। কিন্তু তাঁদের সাধনাকে উপলক্ষ করে সঙ্গীতের এমন এক বিপুল ভাণ্ডার রচিত হয়েছে তাঁর সঠিক সংখ্যা কত হবে অদ্যাবধি নিরূপণ করা সম্ভব হয়নি। মাইজভান্ডারকে উপলক্ষ করে উর্দু-ফার্সী ভাষায় গজল ও কাওয়ালী গান যেমন অজস্র লেখা হয়েছে, তেমনি সরল গ্রাম্য মানুষের বোধ এবং অনুভবগম্য বাংলা ভাষায় এমন কি চট্টগ্রামের আঞ্চলিক ভাষাতেও হাজার হাজার গান লেখা হয়েছে। ভারতবর্ষের নানা জায়গায় ছড়ানো- ছিটানো সুফী সাধকদের খানকাহ্ এবং মাজারে যে গজল, যে কাওয়ালী গান গীত হত, সাধনার একটি বিশেষ অঙ্গ হিসেবে বিবেচিত হত, তার সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করেই প্রাথমিক পর্যায়ে মাইজভাণ্ডারে উর্দু-ফার্সী ভাষায় গজল, কাওয়ালী লিখিত হয়েছে এবং গীত হয়েছে। একথা তো নতুন নয়, মুসলিম সুফী-সাধকদের সাধনার সঙ্গে কাওয়ালী গজলের অঙ্গাঙ্গি সম্পর্ক রয়েছে।
কাওয়ালী প্রথম চালু করেছিলেন হজরত আমির খসরু ফার্সী ভাষায়। পরে উর্দু ভাষায় কাওয়ালী লিখিত এবং গীত হতে থাকে। সুফী-সাধনা পদ্ধতির এই আদি রূপটি মাইজভাণ্ডারেও অনুসৃত হয়েছে, তাতে অবাক বা বিস্মিত হবার কিছু নেই। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, চট্টগ্রামে কালু, পেয়ারু এবং আবু কাওয়াল এই সকল জনপ্রিয় কাওয়ালী গায়কের যে আবির্ভাব ঘটেছিল তার সঙ্গে মাইজভাণ্ডারের একটি প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সম্পর্ক অস্বীকার করার উপায় নেই।
কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় সত্য যে, আজকের দিনে ধর্মজিজ্ঞাসু জনগোষ্ঠীর বাইরে সমগ্র বাংলা ভাষাভাষী অঞ্চলে মাইজভাণ্ডারের যে প্রসার এবং পরিচিতি, মাইজভাণ্ডারের সাধনরীতিকে উপলক্ষ করে লেখা হাজার হাজার বাংলা গানই তার মুখ্য কারণ। এই পানগুলো মাইজভাণ্ডারের একটি নতুন ভাবমূর্তি সকলের সামনে উজ্জ্বল-প্রোজ্জ্বলভাবে তুলে ধরেছে। গান দিয়ে মাইজভাণ্ডারের সাধনা এবং গানেই মাইজভাণ্ডারের পরিচয়। মাইজভাণ্ডারী গানের একটি বিশেষ দাহিকাশক্তি, একটি অন্তরাবেগ, একটি বিশেষ সুর এবং বিশেষ ধরনের তাল-লয় রয়েছে। যেদিক দিয়েই বিচার করা হোক না কেন, মাইজভাণ্ডারী গানে বাঙালী সঙ্গীত-সাধনার একটি বিশেষ রসময় ধারা বাণীমূর্তি লাভ করেছে। মাইজভাণ্ডারী গানের কথা বাদ দিলে বাঙালীর সঙ্গীত-সাধনার প্রতি সুবিচার করা কখনো সম্ভব হবে না। এটা তর্কাতীত সত্য যে, মাইজভাণ্ডারী গান বাঙলার সঙ্গীতকে আশাতীতভাবে সমৃদ্ধ করেছে। মাইজভাণ্ডারী গান ভাব, ভাষা, বাণী, সুর এবং তাল সর্বদিক দিয়ে অভিনব ও একক পরিচয়ে চিহ্নিত হওয়ার দাবী রাখে।
নন্দনতাত্ত্বিক মানদণ্ডে মাইজভাণ্ডারী উৎকর্ষ-অপকর্ষ নির্ধারণের প্রক্রিয়াটি এখনো শুরু হয়নি। মাইজভাণ্ডারী গানের উপযোগবাদিতার দিকটাই সকলের সামনে আসতে পেরেছে। যেহেতু অধিকাংশ গান লিখেছেন মাইজভাণ্ডারের ভক্তবৃন্দ, তাঁদের শিক্ষা- সংস্কৃতির অধিকারের বিষয়টিও বিবেচনার মধ্যে আনতে হবে। কাদের উদ্দেশ্যে এই গানগুলো লিখিত হয়েছে সেকথাও স্মরণে রাখতে হবে। অতি সাধারণ গ্রাম্য সরল মানুষের রুচির দিকে লক্ষ্য রেখে অধিকাংশ মাইজভাণ্ডারী গান লিখিত হয়েছে। এই গানে ভাবটাই প্রধান, ভাষাগত উৎকর্ষ বা প্রকাশভঙ্গী মুখ্য হয়ে উঠতে পারেনি। তারপরেও একটি কথা বলা যায়, এই স্বল্পশিক্ষিত মানুষদের ভক্তির কোনো কোনো গান এমন দীপ্তি নিয়ে জ্বলে উঠেছে যেগুলো অমরতার দাবী করতে পারে। ভাববাণীতে সমৃদ্ধ এরকম শত শত গান মাইজভাণ্ডারকে উপলক্ষ করে লিখিত হয়েছে।
মরমী সাধক মনোমোহন দত্ত প্রথম মাইজভাণ্ডার শরীফ থেকেই গান রচনার পুলকিত প্রেরণা লাভ করেছিলেন। অবিস্মরণীয় সংগ্রামী কবিয়াল রমেশ শীল সারাজীবন শুধু মাইজভাণ্ডারী গান রচনা করেই ব্যয় করেননি, মাইজভাণ্ডারী তরিকার আদর্শ তাঁর সমগ্র জীবনের পাথেয় হয়ে উঠতে পেরেছিল। জীবনান্তেও। এই আদর্শ থেকে তিনি বিচ্যুত হননি।
আহমদ ছফা।
১৯৯৪