02/07/2025
মাইকেল মধুসূদন দত্তের দাম্পত্য জীবন
মধুসূদন দত্ত মনে করতেন, বাঙ্গালী মেয়েরা সৌন্দর্য অথবা গুণের দিক দিয়ে ইংরেজ মেয়েদের একশো ভাগের এক ভাগও নয় ৷ বাঙ্গালী মহিলারা অশিক্ষিত বলে তাদের সঙ্গে স্বামীদের সম্পর্ক কখনো পরিপূর্ণ হয়ে উঠে না ৷ তিনি প্রথম দৃষ্টিতে প্রেমে পড়ায় বিশ্বাসী ছিলেন ৷ যেকালে ছেলেরা অভিভাববকের পছন্দ করা মেয়েকে বিয়ে করে সুখী হতেন, মধুসূদন সেকালে প্রেম করে বিয়ে করার স্বপ্নে বিভোর ৷ ইংরেজী সাহিত্যের ছাত্র হওয়ায়, ইংরেজ সাহিত্যিকদের জীবনী পড়ে পড়ে তিনি মনে মনে এই পণ করেছিলেন ৷
মা-বাবার একমাত্র আদরের সন্তান হওয়ায় সীমাহীন আদরে মানুষ হলেও, মূল্যবোধ এবং মনোভাবের দিক দিয়ে তিনি যে পিতামাতার কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছিলেন সেদিকে তাঁর পিতামাতা সচেতন ছিলেন না ৷ তাঁর পিতা রাজনারায়ন যশোর থেকে কলকাতায় এসে ওকালতি করে গরীব অবস্থা থেকে ধনী হয়েছেন ৷ কলকাতার শিক্ষিত ধনীদের সাথে তার উঠাবসা ৷ মধু তার একমাত্র ছেলে ৷ ছেলের জন্য তিনি কলকাতায় সবচেয়ে আধুনিক শিক্ষার ব্যবস্থা করেছেন ৷ ইংরেজিতে তুখোড়, ভালো ছাত্র হিসেবে স্কলারশীপ পেয়েছে ৷ কিন্তু প্রচলিত ধর্ম, পূজা পার্বন, সামাজিকতায় ছেলের অনীহা রাজনারায়নকে শঙ্কিত এবং চিন্তিত করে তোলে ৷
সে যুগে বাঙ্গালি সমাজে উঠতি বয়সী তরুণদের আচরণে বা মানসিক কোন সমস্যা দিলে, অভিভাবকগণ বিয়েকে আচ্ছা দওয়াই মনে করতেন ৷ নব্য ধনীর একমাত্র পুত্র হওয়ায় পাত্রী পেতে তেমন কোন সমস্যা হলো না ৷ কিন্তু বিয়ের কথা শোনে তিনি খুশি না হয়ে ঘাবড়ে গেলেন ৷ তাঁর বয়স তখন ঊনিশ ৷ যদিও এই বয়সে তাঁর সহপাঠী বন্ধুরা অনেকে বাচ্চার বাপ হয়ে গেছে, কিন্তু তাঁর চিন্তাধারা ছিলো ভিন্ন ৷ তাঁর স্বপ্ন, প্রথম দেখাতে কোন "নীননয়না"র প্রেমে পড়বেন এবং পরে তাকে বিয়ে করবেন ৷ তখনো এমন কারো দেখা পেয়েছেন বলে মনে হয় না, আর পেলেও কিছু করার ছিলো না ৷ যেহেতু পিতার আয়ের উপর নির্ভরশীল তাই পিতার আদেশ অমান্য করার মত কোন হিম্মত তাঁর ছিলো না ৷
তিনি যখন যে আবদার করেছেন, মা-বাবা তার সবটাই পূরণ করেছেন ৷ জীবনে এই প্রথম তিনি সত্যিকারের একটা সমস্যার মুখোমুখি হলেন ৷ অতি আদরের সন্তান হলেও বাবার সামনে সরাসরি কথা বলার সাহস ছিলো না ৷ মা কে বলেছিলেন, কিন্তু মা বুঝতে পারলেন না, ছেলে কেন পরীর মত সুন্দরী মেয়েকে বিয়ে করবে না! সব ছেলেই বিয়ের আগে এমন না না করে, বিয়ের পরে ঠিক হয়ে যায়; তাই মা জাহ্নবী দেবীও তাঁর কথাকে গুরুত্ব দিলেন না ৷ মা-বাবা এবং অন্যদের কাছে এটি কোন সমস্যা না হলেও, তাঁর কাছে এটি ছিলো জীবন মরণ সমস্যা ৷ সমস্যা সমাধানে মধু ভিন্ন পথ বেছে নেন ৷
তিনি ভাবলেন, মিশনারিদের কাছে গিয়ে তিনি যদি খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করেন, তাহলে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি শিকার হবে ৷ ধর্মান্তরিত হওয়ায় বিয়ে ভেঙ্গে যাবে ৷ খৃষ্টান সমাজ এবং ইংরেজ কর্মকর্তাদের সহযোগিতা পাবেন ৷ সুপ্রতিষ্ঠিত লোকদের ছেলেরা খৃষ্ট ধর্ম গ্রহণ করলে মিশনারিরা সম্মানের বিষয় হিসেবে গণ্য করত ৷ এতে তাঁর বিলেত গিয়ে ইংরেজ কবি গিয়ে হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথ সুগম হবে ৷ তিনি কলকাতার যে কলেজে পড়তেন সে কলেজের নাম হিন্দু কলেজ হলেও এটি খৃষ্টান মিশনারীদের দ্বারা পরিচালিত হত ৷ সে সুবাধে খৃষ্ট ধর্মের প্রতি আগেই তাঁর দূর্বলতা ছিলো ৷
১৮৪৩ সালের ১৩ই ফেব্রুয়ারি বিয়ের মাত্র ১৫ দিন পূর্বে ওল্ড মিশন চার্চে গিয়ে তিনি খ্রিষ্টধর্ম গ্রহণ করেন । তাঁকে দীক্ষিত করেছিলেন পাদ্রী ডিলট্রি । মধুসূদন দত্ত পরিচিত হন "মাইকেল মধুসূদন দত্ত" নামে ৷ ধর্মান্তরের মাধ্যমে আয়োজিত বিয়ের ফাঁস থেকে মুক্তি পেলেন, ডিলট্টির সাথে তাঁর ইংল্যান্ড যাওয়া ঠিকও হলো, কিন্তু রাজনারায়ন তাকে আশ্বস্ত করলেন তিনি নিজ খরচে মধুকে বিলেত পাঠাবেন ৷ ছেলে ধর্মান্তরিত হওয়ায় সামাজিক রোষানলের ভয়ে সরাসরি সম্পর্ক না রাখলেও তিনি তাঁর পড়ালেখার খরচ বহন করতেন ৷ ভেবেছিলেন, এক সময় ছেলে ভুল বুঝতে পেরে স্বধর্মে ফিরে আসবে ৷ জন্ম দিলেও তিনি ছেলের মন বুঝতে ব্যর্থ হন ৷
ধর্মান্তরিত হওয়ার পরেও রাজনারায়ন তিন বছর তাঁর পড়ালেখার খরচ বহন করেন ৷ তিনি যখন বুঝতে পারলেন ছেলেকে ফেরানোর সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ, তখন টাকা-পয়সা দেওয়া বন্ধ করে দেন ৷ রাজনারায়নের আর কোন সন্তান ছিলো না, ওদিকে জাহ্নবী দেবীরও আর সন্তান হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই ৷ তাই আরেকটি সন্তানের জন্য রাজনারায়ন শিবসুন্দরী নামে এক মেয়েকে বিয়ে করেন ৷ বিয়ের কয়েক দিন পরেই শিবসুন্দরী মারা যায় ৷ লেখাপড়ার খরচ বন্ধ হতে পারে সেটা মাইকেল ধর্মান্তরিত হওয়ার পর পরই বুঝেছিলেন ৷ চিরকাল বিলাসের মাঝে বড় হওয়া মানুষ এবার কঠিন বাস্তবের মুখোমুখি হলেন ৷
জীবিকার জন্য তিনি "মাদ্রাজ মেইল এ্যান্ড ফিমেইল অরফ্যান অ্যাসাইলাম অ্যান্ড বয়েজ ফ্রী ডে" তে সহকারী শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন ৷ যেসব ইউরোপিয়ান বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান যথেষ্ঠ সঞ্চয় না রেখে অপ্রাপ্ত সন্তান রেখে মারা যেত তাদের সন্তানদের লেখাপড়ার জন্য এটি স্থাপিত হয়, দেশীয় ভাষায় যাকে বলে অনাথ আশ্রম ৷ তাঁর বেতন ছিলো মাত্র ৪৬ টাকা ৷ এই প্রতিষ্ঠানেরই অনাথ ছাত্রী রেবেকা ৷ শৈশব থেকে কবি যে নীল নয়নার স্বপ্ন দেখতেন, এবার যেন তার বাস্তব অবয়ব সামনে এসে দাঁড়ালো ৷ রেবেকার সাথে পরিচয়ের পর তাঁর প্রেমে পড়তে রোমান্টিক মাইকেলের দেরি হয়নি ৷ এবার বিয়ের পালা ৷
তখন পর্যন্ত ইংরেজ এবং এ্যাংলো ইন্ডিয়ান শ্বেতাঙ্গরা দেশীয় মেয়েদের বিয়ে বা রক্ষিতা হিসেবে ব্যবহার করলেও কোন দেশী কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে শ্বেতাঙ্গ মেয়েদের বিয়ে করেনি ৷ সেকালে বর্ণ বিদ্বেষ চরম ছিলো ৷ শ্বেতাঙ্গ সমাজ কৃষ্ণাঙ্গ সমাজকে মানুষের মর্যাদা দিতে কুন্ঠাবোধ করত ৷ তাই এটি ছিলো অসম্ভব ব্যাপার ৷ স্থানীয় শ্বেতাঙ্গ এ্যাংলো ইন্ডিয়ান সমাজ বিয়েতে বাধা দিলো ৷ অনেক বাধা বিপত্তি পেরিয়ে অরফ্যান অ্যাসাইলামের হেড মাষ্টার জেসি রে এবং পরিচালক রবার্ট পসনেটের সহায়তায় ১৮৪৮ সালে ৩১ শে জুলাই কবি রেবেকাকে বিয়ে করেন ৷
বিয়ের পর সংসারের চাপে কবির অর্থকষ্ট বাড়ছিলো ৷ খৃষ্টান হওয়ার পরেও যিনি বাবার কাছ থেকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা হাত খরচ পেতেন (মায়ের কাছে থেকে যা নিতেন তার কোন হিসাব নেই ) মাসে পঞ্চাশ টাকার চেয়েও স্বল্প আয় দিয়ে তাঁর পক্ষে কি সংসার করা সম্ভব! যদিও সংসারে নিদারুণ অভাব, তবু মাইকেল রেবেকার ভালোবাসায় কোন অভাব ছিলো না ৷ তাদের প্রণয়ের ফসল হিসেবে জন্ম নেয় প্রথম সন্তান ব্যর্থা ব্লানশ ৷ সন্তান জন্মের পর আর্থিক অনটনে তিনি অস্থির হয়ে পড়েন ৷ লেখালেখির অভ্যাস আগেই ছিলো, তাই বাড়তি আয়ের জন্য পত্রিকায় লেখালেখি শুরু করেন ৷
সন্তান জন্মদানের পর রেবেকার স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিলো ৷ তাই, স্বাস্থ্য পুনরূদ্ধরারের আশায় রেবেকা তাঁর জন্মস্থানে নাগপুরে স্বজনদের কাছে বেড়াতে যান ৷ দাম্পত্য জীবনের এক বছর সাত মাসের মধ্যে এই প্রথম স্বামী-স্ত্রী একজন আরেকজন থেকে দূরে অবস্থান করছেন ৷ কবির কাছ থেকে রেবেকা এই প্রথম দূরে অবস্থান করলেও এই সময় এমন এক ঘটনা ঘটে যা পরবর্তীতে তাদের দু'জনকে চিরদিনের মত দূরে সরিয়ে দেয় ৷
১৮৫১ সালে দ্বিতীয় কন্যা ফীবির জন্ম ৷ একই বছর কবির মা জাহ্নবী দেবী মারা যান ৷ জাহ্নবী দেবীর মৃত্যুর পর তাঁর পিতা রাজনারায়ন সন্তানের আশায় আরো দু'টি বিয়ে করেন ৷ ওদিকে রেবেকা তৃতীয় বারের মত গর্ভবতী হন ৷ এতে কবির অভাববোধ তীব্রতর হতে থাকে ৷ তিনি অনাথ আশ্রম ছেড়ে মাদ্রাজ স্কুলে জয়েন করেন ৷ সহকর্মী জর্জ হোয়াইটের সঙ্গে তাঁর পূর্ব থেকেই বন্ধুত্ব ছিলো ৷ শিক্ষকতার পাশাপাশি জর্জ হোয়াইট কবি যে অনাথ আশ্রমে কাজ করতেন তার পরিচালক মন্ডলীর সদস্য ছিলেন ৷
রেবেকা যখন প্রথম স্বজনদের বাড়িতে বেড়াতে যান, তখন জর্জ হোয়াইটের স্ত্রী মারা যায় ৷ স্ত্রী মারা যাবার কয়েক দিনের মধ্যে চল্লিশোর্ধ্ব জর্জ হোয়াইট ষোল বছরের এক কিশোরীকে বিয়ে করেন ৷ জর্জ হোয়াইটের প্রথম স্ত্রীর ঘরে তিন ছেলে-মেয়ে ৷ তার বড় মেয়ে অ্যামেলিয়া হেনরিয়েটা সাফাইয়ার বয়স সতের ৷ বয়সের কারনে বা বিমাতা সুলভ স্বভাবের কারনে, জর্জ হোয়াইটের দ্বিতীয় স্ত্রীর সাথে তার প্রথম স্ত্রীর সন্তানদের সাথে সম্পর্কটা ভালো ছিলো না ৷ বন্ধু সহকর্মীর সন্তানদের বিমাতার সংসারে অশান্তির ভূক্তভোগী হতে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কবির দরদ উথলে উঠে ৷ দুঃখ কাতর হেনরিয়েটাও এই সহানুভূতি গ্রহণ করতে দ্বিধা করেননি ৷ এই সহানুভূতি থেকে ক্রমে দু'জনের মধ্যে প্রণয়সম্পর্ক গড়ে উঠে ৷ এরই মাঝে রেবেকা চতুর্থ বারের মত মা হন ৷
স্ত্রী এবং চারটি সন্তানকে নিয়ে কবি যখন মাদ্রাজে সংসার গুচিয়ে বসেছেন, তখন কলকাতা থেকে বন্ধু গৌরদাস তাঁর পিতার মৃত্যু সংবাদ জানিয়ে চিঠি পাঠান ৷ পিতার প্রতি যতই মনঃকষ্ট থাকুক, পিতা নেই; এমন সংবাদে যে কোন সন্তানই বিচলিত হয় ৷ গৌরদাস আরো জানান, তাঁর বাবার সম্পত্তি নিয়ে অন্যরা কাড়াকাড়ি করছে ৷ জাহ্নবী দেবী ছাড়া রাজনারায়নের অন্য তিন স্ত্রীর ঘরে কোন সন্তান হয়নি, তাই মাইকেলই ছিলেন একমাত্র উত্তরাধিকারী ৷ সম্পত্তি ভোগ দখলের আশায় তাঁর আত্মীয়-স্বজনদের মাঝে কেউ কেউ রটিয়ে দেন মাইকেল মারা গেছেন, কেউ রটিয়ে দেন রাজনারায়ন তাকে ত্যাজ্য করেছেন ৷ এমতাবস্থায় চিঠি পেয়ে তিনি গৌরদাসকে লিখেন—
"প্রিয়তম গৌর, তুমি তো জানো কলকাতায় যাওয়া চাট্টিখানি কথা নয়! দারুণ খরচসাপেক্ষ, বিশেষ করে আমার মতো হতভাগার জন্য! তবে তুমি যদি আশ্বাস দাও যে, বাবার সম্পত্তি থেকে আমার যাবার খরচ উশুল হবে, তা হলে কলকাতা, আমার পুরোনো কলকাতার উদ্দেশ্যে পাল তুলতে রাজি আছি ৷"
গৌরদাসের চিঠি থেকে সম্পত্তির পরিমাণ এবং তা পাওয়ার ভরসা পেয়ে, তিনি দ্বিতীয় বারের মত কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেন ৷ ঠিক এমন সময়েই তাঁর সুখের সংসারে ঝড় উঠে ৷ সে ঝড় তাকে এতদূর নিয়ে যায় যে বাকি জীবন তিনি প্রিয়তমা স্ত্রী রেবেকা আর চার সন্তানের কাছে ফিরতে পারেননি ৷ সহকর্মী জর্জ হোয়াইটের মেয়ে হেনরিয়েটার প্রতি যে তাঁর যে সহমর্মিতা প্রেমে রূপ নিয়েছিলো তা জানাজানি হয়ে যায় ৷
সমাজ, সংসার, আত্মীয়, স্বজন সবার বাধাকে তুচ্ছ করে শ্বেতাঙ্গ রেবেকা নাম পরিচয়হীন, কৃষাঙ্গ নিঃস্ব কবিকে বিয়ে করেছিলেন ৷ যার ভালোবাসা যত গভীর তার ঘৃণাও তত গভীর ৷ কবির এমন বিশ্বাসঘাতকতায় রেবেকা মানসিকভাবে মারাত্মক আহত হন ৷ তাই কবি বেশ কয়েকবার কলকাতায় আসার আহবান করলেও রেবেকা তাঁর ডাকে সাড়া দেননি ৷ কবির যেসব শ্বেতাঙ্গ বন্ধু-বান্ধব মাদ্রাজে তাকে বিয়েতে সহায়তা করেছিলেন, স্ত্রীর প্রতি প্রবঞ্চনার খবর প্রকাশিত হওয়ার পর তাঁর আর তাদের সামনে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর উপায় ছিলো না ৷ তাই অসম্মানের ভয়ে তিনিও মাদ্রাজে যেতে পারেন নি ৷ বার বার রেবেকার কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে কবি হেনরিয়েটাকে কলকাতায় আসার আমন্ত্রণ জানায় ৷
১৮৫৮ সালের কোন এক সময় হেনরিয়েটা কলকাতায় আসেন ৷ প্রায় ছয় বছর প্রণয়লীলা চলার পর কবির সাথে তাঁর মিলন হয় ৷ কলকাতায় আসার পর কবি পৈতৃক সম্পত্তি পুনরূদ্ধার করেন, লেখক হিসেবে তাঁর আসনও মোটামুটি পাকাপোক্ত হয় ৷ কিন্তু তিনি যে মাদ্রাজে সহায়হীন স্ত্রী এবং সম্বলহীন চার চারটি সন্তান রেখে এসেছিলেন তাদের কোন খোঁজ খবরই রাখলেন না ৷ সে সময় মাদ্রাজকে পরবাস বলা হত ৷ কলকাতা করে জাহাজে করে মাদ্রাজে যেতে হত বলে, কবির কোন শুভাকাংখী বন্ধু তাঁর ঐ সন্তানদের কোন খোঁজ খবর রাখেননি ৷ আর কবি ছাড়া কেউ তাদের ব্যাপারে জানত না বিধায় তাদের আর কোন খোঁজ পাওয়া যায়নি ৷
জগত সংসারে কিছু কিছু মানুষ আছেন, যারা সুখে থাকলে ভূতে কিলায় ৷ কবিও তাদের একজন ৷ কেবল কর্পদকহীন কবি খ্যাতি নিয়ে তিনি সুখী হতে চাননি ৷ আইনজীবী হিসেবে পিতাকে প্রচুর অর্থ উপার্জন করতে দেখেছেন, তাই তিনিও আইন পড়ায় মনোনিবেশ করলেন ৷ তখন কলকাতায় প্রায় ৩০ জন ব্যরিষ্টার এবং ৮৪ জন অ্যাটর্নী ছিলেন ৷ কিন্তু তাদের সবাই ইংরেজ বা অ্যাংলো ইন্ডিয়ান ৷ কবি ভাবলেন, তিনি যদি বিলেত থেকে ব্যারিষ্টার হয়ে আসতে পারেন তাহলে, প্রচুর অর্থ উপার্জনের পাশাপাশি প্রথম বাঙ্গালী ব্যরিষ্টার হিসেবে খ্যাতি অর্জন করতে পারবেন ৷ তাঁর ঘাড়ে বিলেত যাবার সেই পূরনো ভূত চেপে বসলো ৷
তাঁর দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন বিলেত যাবার জন্য তিনি কিছু পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করলেন ৷ যে সকল আত্মীয়- স্বজন তাকে সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত করার ষড়যন্ত্র করেছিলো, সম্পত্তি থেকে প্রাপ্ত আয়ের একটা অংশ প্রদান করার শর্তে তাদেরকে কিছু সম্পত্তি দেখাশোনার দায়িত্ব অর্পণ করে স্ত্রী সন্তানদের কলকাতায় রেখে তিনি ইংল্যান্ডে পাড়ি জমান ৷ তাঁর যেসব জ্ঞাতি ভাইদের কাছে তিনি সম্পত্তি দেখাশোনার ভার দিয়েছিলেন তারা চুক্তি মোতাবেক কোন অর্থতো প্রদান করেনি, উল্টো বিভিন্নভাবে হেনরিয়েটা এবং তার সন্তানদের ভয়-ভীতি প্রদর্শণ করতে লাগলো ৷ তারা ভেবেছে, মাইকেল দেশ ছাড়া, এই অবস্থায় যদি তাঁর স্ত্রী সন্তানদের দেশ ছাড়া করা যায় তাহলে সম্পত্তি আবার তারা ভোগ দখল করতে পারবে ৷
এই পরিস্থিতিতে নিরুপায় হয়ে কবি কলকাতা ত্যাগ করার সাড়ে নয় মাস পর ১৮৬৩ সালের মার্চ মাসের শেষ দিকে হেনরিয়েটা কলকাতা ত্যাগ করে লন্ডনের পথে যাত্রা করেন ৷ পরিবার লন্ডনে যাবার ফলে কবির বিপদ বেড়ে যায় অনেকগুণ ৷ অর্থাভাবে তাঁর ব্যরিষ্টারি পড়ায় ভাটা পড়ে ৷ লন্ডনের চেয়ে ফ্রান্সে জীবন যাত্রার ব্যয় কম হওয়ায় লন্ডন ছেড়ে তিনি ফ্রান্সের ভার্সাইতে বাস করতে শুরু করেন ৷ সেখানে প্রায় আড়াই বছরের মত বাস করলেও তিনি কোন কাজ পাননি ৷ বাড়িওয়ালা, পাড়ার দোকানদার, দাতব্য সংস্থা সহ বিভিন্ন জনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলতে থাকেন ৷ জ্ঞাতি ভাই এবং অন্যান্যদের কাছে পাওনা টাকা চেয়ে পত্র পাঠালেও তাদের কোন সাড়া পাননি ৷ অবশেষে বিস্তারিত জানিয়ে পাওনা টাকা আদায়ের জন্য ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সাহায্য কামনা করেন ৷
বিদ্যাসাগর মাইকেলের জ্ঞাতি ভাইদের কাছ থেকে কোন সদুত্তর না পেয়ে নিজের পকেট থেকে তাঁর জন্য টাকা পাঠান ৷ এরপর বিদ্যাসাগরকে সম্পত্তির পাওয়ার অব এ্যাটর্নি দান করে সেগুলো বিক্রি করে দিতে বলেন ৷ তিনি সম্পত্তি বিক্রি না করে বন্ধক রেখে কবির জন্য টাকা পাঠাতে শুরু করেন ৷ কিন্তু কবির ঋণ এবং আর্থিক চাহিদার পরিমান এত বেশি ছিলো যে উপায়অন্ত না পেয়ে বিদ্যাসাগর তাঁর পৈতৃক সম্পত্তি বিক্রি করতে বাধ্য হন ৷ অবশেষে বিদ্যাসাগরের আন্তরিক সহযোগিতার ফলে ১৮৬৭ সালে ব্যরিষ্টারি পাশ করে তিনি কলকাতায় আসেন ৷ হেনরিয়েটা পাঁচ মাসের গর্ভবতী থাকায় তাকে লন্ডনে রেখে আসতে হয় ৷
কবির অনেকগুলো নেশার মাঝে সবচেয়ে বড় নেশা ছিলো ঘন ঘন বাড়ি পরিবর্তন করা ৷ যখনই একটু আর্থিক স্বচ্ছলতার মুখ দেখতেন, তখনই তিনি বাড়ি পরিবর্তন করতেন ৷ আয়ের সাথে সাথে তাঁর বাড়ি ভাড়ার ব্যয় বৃদ্ধি পেত ৷ যার কারনে আমৃত্যু তিনি অর্থকষ্টে ভূগেছেন ৷ দেশে আসার পর তাঁর জন্য বিদ্যাসাগর যে বাড়ি ভাড়া করেছিলেন তাতে না উঠে তিনি বিলাসবহুল স্পেন্সেস হোটেলে উঠেন ৷ তখনো তিনি ব্যরিষ্টার হিসেবে কলকাতা বার এসোসিয়েশন থেকে ওকলতির লাইসেন্স পাননি, হাতে কোন মামলাও নেই, এমতাবস্থায় স্পেন্সেস হোটেলের মত বিলাস বহুল ঘরে থাকা যে তাঁর জন্য আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত, বিদ্যাসাগর তাকে এ কথা বোঝাতে গিয়ে ব্যর্থ হন ৷ তিনি চাইছিলেন কবি আগে প্রতিষ্ঠিত হোক ৷
বেহিসেবী কবি ব্যরিষ্টারি পড়তে গিয়ে পৈতৃক সম্পত্তি খুইয়েছেন ৷ ব্যরিষ্টার হিসেবেও তিনি তেমন একটা সাফল্য অর্জন করতে পারলেন না ৷ আদালতে যুক্তি তর্কের পরিবর্তে তিনি কবিতা শুনিয়ে থাকেন ৷ তাঁর চেয়ে দেশী উকিলদের মক্কেল এবং আয় বেশি ৷ স্পেন্সেস হোটেলে প্রথম দিকে তাকে খুব খাতির করলেও, ঋণ বাড়তে থাকায় ধীরে ধীরে সেখানে সম্মানে টান পড়ে ৷ তবুও তাঁর বাবুগিরি একটুও কমেনি ৷ এধরনের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্তের কারনে বিদ্যাসাগরের সাথে তাঁর সম্পর্কের চিড় ধরে ৷
কবি যখন কলকাতায় বাবুগিরিতে ব্যস্ত, হেনরিয়েটা তখন লন্ডনে সদ্য প্রসূত সন্তানকে নিয়ে লন্ডনে নিদারুন কষ্টে দিনাতিপাত করছিলেন ৷ অব্যাহত আর্থিক অনটনের কারনে হতাশা ও নিঃসঙ্গতা থেকে তিনি মাদকাসক্ত হয়ে পড়েন ৷ কবি নিজেও মদ পান করতেন, হেনরিয়েটা পূর্ব থেকেই কবিকে সঙ্গ দিতে গিয়ে অল্প বিস্তর মদ পান করতেন ৷ কবির অনুপস্থিতে এবার পুরোপুরি আসক্ত হয়ে পড়েন ৷ এ সময়ে হেনরিয়েটা শারিরীক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷ সংকটে পড়ে মাতাল হলেও তিনি কান্ডজ্ঞান হারাননি ৷ তিনি কলকাতায় ফিরে যাবার সিদ্ধান্ত নেন ৷
১৮৬৯ সালের দিকে হেনরিয়েটা সন্তানদের নিয়ে দেশে ফিরে আসেন ৷ ব্যারিষ্টার স্বামীর যে আর্থিক স্বচ্ছলতার স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন, সে আশায় গুঁড়োবালি ৷ দু' বছর আইন ব্যবসা করেও কবি এক পয়সা সঞ্চয়তো দূরের কথা ঋণ থেকেই মুক্ত হতে পারেন নি ৷ এই দুই বছরে কবি অনেক মোটা হয়ে গেছেন ৷ হেনরিয়েটা কবিকে হোটেল ছাড়তে রাজি করান ৷ সন্তানদের ভবিষৎ নিরাপদ করার স্বপ্নে হোটেলের বিলাসিতা ছেড়ে তিনি কবিকে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে উঠেন ৷ বাড়ির ব্যাপারে কবি সব সময়ই বিলাসী ছিলেন ৷ কোন রকম মাথা গোঁজার ঠাঁই পাওয়ার মত একটা ঘর হলেই চলবে, এমন ধারাণায় তিনি বিশ্বাস করতেন না ৷
লাউডন স্ট্রীটে যে পাড়ায় তিনি বাড়ি ভাড়া নিয়েছিলেন সে এলাকাটা ছিলো কলকাতার সবচেয়ে বিলাস বহুল পাড়া ৷ এপাড়ায় একজনও দেশী লোক ছিলো না ৷ বাড়ি ভাড়া ছিলো চারশ টাকা ৷ কবি এ বাড়ি সাজিয়েছিলেন অত্যাধুনিক আসবাবপত্র এবং বিলাসিতার নানান উপকরণ দিয়ে ৷ বিলাসিতার উপকরণ এবং চাকর চাকরাণী রাখতে গিয়ে তাঁর অনেক খরচ হত ৷ ব্যরিষ্টারি করে তিনি যা আয় করতেন তার চেয়ে বেশি ব্যয় করার কারনে তার কোন সঞ্চয় ছিলো না ৷ দীর্ঘদিন থেকে অতিরিক্ত মদপান এবং অনিয়মের কারনে তাঁর স্বাস্থ্য দিন দিন খারাপ হতে থাকে ৷ স্বাস্থ্য খারাপ হওয়ার কারনে তাঁর কাজ করার ক্ষমতা কমে যায় ৷
তাঁর স্বাস্থ্য এত দ্রুত ভেঙ্গে পড়ছিলো যা তিনি কল্পনাও করতে পারেননি ৷ গলায় ঘা দেখা দিয়েছিলো ৷ মাঝে মাঝে গলা দিয়ে রক্ত পড়ত ৷ জ্বর হতো কখনো কখনো ৷ ভালো করে নড়াচড়ার ক্ষমতাও তাঁর লোপ পাচ্ছিলো ৷ ওদিকে সময়মত বাড়ি ভাড়া পরিশোধ করতে না পারায় একটার পর একটা বাড়ি থেকে তাকে বের করে দেওয়া হচ্ছিলো ৷ শেষে তাঁর আশ্রয় জুটলো বস্তিতে ৷ নিদারুণ অনটন, রোগ কাতর দেহ এবং সর্বোপরি সন্তানদের ভবিষৎ সম্পর্কে উদ্বেগ তাকে একান্তভাবে বিপন্ন করে তোলে ৷ এই পরিস্থিতিতে কবি মরিয়া হয়ে তের বৎসর বয়সী কন্যা শর্মিষ্ঠার বিয়ে ঠিক করেন ৷ শর্মিষ্ঠার বিয়ের পর কবি এবং হেনরিয়েটা উভয়েই অসুস্থ হয়ে পড়েন ৷
শর্মিষ্ঠার স্বামীর বাড়িতে হেনরিয়েটার এবং আলিপুর হাসপাতালে কবির চিকিৎস্যা চলতে থাকে ৷ হাসপাতালে তিনি সাত অথবা আট দিন ছিলেন ৷ এরই মাঝে তিনি হেনরিয়েটার মৃত্যুর সংবাদ পান ৷ ১৮৭৩ সালের ২৬ জুন হেনরিয়েটা যখন মারা যান তখন তাঁর বয়স ছিলো মাত্র ৩৭ বছর ৷
রেবেকা ছিলেন গরীব গোলন্দাজের মেয়ে ৷ মাত্র সাড়ে বার বছরে পিতা মারা যাওয়ায় তাঁর স্থান হয়েছিলো অনাথ আশ্রমে ৷ পড়ালেখাও তেমন ছিলো না ৷ কোনো দিন স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে মানুষ হননি বলেই হয়ত চাহিদাটাও বেশি ছিলো না ৷ আর তাছাড়া মাইকেলের যে চাল-চুলো নেই, সব জেনে শোনেই তিনি কবিকে বিয়ে করেছেন ৷ তাই, কবির দারিদ্র্যতার সাথে মানিয়ে নিতে তাঁর কোন কষ্ট হচ্ছিলো না ৷
হেনরিয়েটার পিতা জর্জ হোয়াইট ছিলেন সাহিত্যের শিক্ষক ৷ সাহিত্য সম্পর্কে তাঁর মোটামুটি ধারণা ছিলো ৷ পরবর্তীতে তিনি বাংলাও শিখেছিলেন এবং বিভিন্ন সময় লেখালেখিতে কবিকে সহায়তাও করেছিলেন ৷ তাঁরও তেমন বেশি চাহিদা ছিলো এমন বলা যায় না ৷ কিন্তু মাইকেল ছিলেন অন্য দশ জনের চেয়ে একটু আলাদা ৷ তিনি অর্ধেক বাস্তব আর অর্ধেক কল্প জগতে বাস করতেন ৷
রেবেকা যদি তাঁর বাস্তব জীবনের যোগ্য সঙ্গীনী হয়ে থাকেন, তাহলে হেনরিয়েটা ছিলেন তাঁর কল্প জগতের যোগ্য সঙ্গিনী ৷ খৃষ্ট ধর্মানুসারে একাধিক স্ত্রী রাখার বিধান নেই ৷ এখনো ইংরেজ সমাজে দশটা গার্লফ্রেন্ড রাখার অনুমতি থাকলেও একটার বেশি বৌ রাখার অনুমতি নেই ৷ খৃষ্ট ধর্মে তালাক দেওয়ার বিধান ছিলো না ৷ পরবর্তীতে আইন করে তালাক দেওয়ার বিধান চালু করা হয় ৷
রেবেকা কবিকে ডিভোর্স দেয়নি বলে, হেনরিয়েটাকে তাঁর জীবনসঙ্গী হিসেবে পরিচয় দিলেও চার্চে গিয়ে তাকে বিয়ে করতে পারেন নি ৷ কিন্তু তাঁর প্রতি কবির ভালোবাসার কোন কমতি ছিলো না ৷ তাইতো হেনরিয়েটার মৃত্যুর সংবাদ শোনে কবি ব্যাকুল হয়ে বলেছিলেন , "বিধাতা, তুমি একই সাথে আমাদের দু'জনকে নিলে না কেন?"
কবির আক্ষেপ হয়ত বিধাতা শুনেছিলেন ৷ হেনরিয়েটার মৃত্যুর মাত্র তিন দিন পর ১৮৭৩ সালের ২৯ জুন কবি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ৷ আর রেবেকা মারা যান তারও অনেক বছর পরে ১৮৯২ সালে ৷