18/09/2025
নীলাভ ঢেউ আর তোমার গিলে যাওয়া সকাল
রিয়া সকালবেলা সূর্য উঠতেই জেগে উঠল। সান্তোরিনির সাদা মাথার ঘরগুলো একে একে নীলাভ আলো খাচ্ছিল, আর সমুদ্র থেকে উঠা গা ঘেঁষে আসা হাওয়া তার টু-শোল্ডার টারকোয়েজ ড্রেসের গায়েজটা মৃদু করে নাচালো। এ শহরটা গোধূলি, আকাশ, আর চায়ের কফির গন্ধ রিয়ার খুব পছন্দ। কিন্তু আজ তার মনে শান্তি ছাড়াও একটা অচেনা উচ্ছ্বাস ছিল, যেমন মানুষ নতুন কোনো গল্পের প্রথম পাতায় আঙুল রাখতে চায়।
ফটোগ্রাফার আরিফ আগেই বলেছিল, "শূন্য সকালে ছবি তুলবো—আলোর ভাষা আলাদা, সবকিছু স্বীকৃত।" আর রিয়া জানত, ক্যানভাস শূন্য থাকলে আলোর গল্প লেখা সহজ হয়। তাই চলে এলো—হলিডে প্ল্যান নয়, নিজের জন্য আল হয়ে উঠতে।
আরিফ ক্যামেরা হাতে গ্যালারির ভিতর থেকে বাইরে দেখল রিয়ার ধীর ধীর হাঁটা, ড্রেসের ভাঁজগুলো বাতাসে হালকা করে ভাসছে। সে একটা মৃদু হাসি দিল এবং ভিউফাইন্ডার তুলে নিল, কিন্তু ক্লিক করার আগেই থামল। রিয়া যেন ছবির ভেতর না—একটা জীবন্ত গান। আরিফে একটা অজানা লড়াই খেলে গেল: কবে ক্যামেরা দিয়ে ছবি নেবে আর কবে শুধু এই মুহূর্তটা নিজের চোখে ধরে রাখবে?
"তুমি খুশি তো?" রিয়া হঠাৎ জিজ্ঞেস করল, তাকিয়ে নীল জলের দিকে চোখ রেখে। "খুশি? হ্যাঁ। কিন্তু আরেকটু—" আরিফ কথা থামিয়ে নিল, হাতের কাঁটার ওপর ক্যামেরা বেঁধে নিল। "আরেকটু হাসো, এমন যেন তুমি সমুদ্রের রহস্যটা জানো।"
রিয়ার চোখে রোদ ঠান্ডা করে পড়ল। সে হাসল একটা ছোট্ট, অপরিণত হাসি যার ভেতর ছিল গোপন কোনো কথা। তারা আলোর সামনে খেলতে লাগল। আরিফ ফটোগ্রাফির ভাষায় বলল, "তুমি নিশবে বলে যাও আমি শোনা চাই।" রিয়া ভাবল, নিশবে বলবে কী? শোনাবে না, চাইলেই কী বলার আছে?
ঘন্টাগুলো এগিয়ে গেল। তারা পরস্পরের কাছে ঘুরে ফিরল ক্যামেরার ক্লিকে, কথার ঝটপটেই। কখন যে দূরবীন হয়ে গিয়েছে সময়, কেউ বুঝল না। অবশেষে দুপুরের ধুলো তোলা বাতাসে তারা বসে নিল, এক পাথরের ধারে।
"তুমি কেন একা এসেছিলে?" আরিফ জিজ্ঞেস করল, অপ্রত্যাশিত কৌতূহল নিয়ে। "একলা? আমি তো নিজের সঙ্গেই আসি সবসময়," রিয়া বলল। "কিন্তু মানুষ মাঝে মাঝে নিজের কথাগুলো বলার জন্য দূরে জায় এখানে শব্দ কম, অনুভূতি বেশি।"
আরিফ চুপ করে রইল। রিয়ার চোখে ছিল কোনো পুরোনো গল্পের আভাস—হয়তো কিছু হারানোর দাগ কিংবা কিছু পাওয়ার নিশান। আরিফ তখন বুঝল, তার ফটোগ্রাফি শুধু আলো-কাঠামো ধরার কাজ নয়—এখানে অনুভূতিকে ওদের ক্যানভাসে ঢুকাতে হবে। সে ক্যামেরাটা নামিয়ে রিয়াকে বলল, "তুমি চাইলেই বলো, আমি শুনব।"
রিয়া একটু নড়ল, তারপর ধীরে ধীরে শুরু করল "বাবা বলত, মানুষের জীবনটা দুই রকম একটা যে ভালোবাসে, আর একটা যে বাঁচে। ভালোবাসাটা সব সময় শব্দে আসে না, অনেক সময় তা এক কাপ কফির মতো গায়ে গা লাগানো। সেই কফির গা ঘেঁষে থাকা গরমটাকে মানুষ ভুলে যায় না।" তার কথাগুলো মৃদু। আরিফ মনে মনে লিখে নিল এগুলো ছবি নয়, জীবনের ছোট ছোট সংরক্ষণাগার।
দিন শেষে তারা একটি ছোট কফিশপে গিয়ে বসল। গাছপালার ছায়ায় রিয়া নিজের টুপি খুলে নিল, আরিফ কখনও কখনও তাকিয়ে থাকল, চোখে একটা প্রশ্ন। "এখানে তুমি কী খুঁজে পেতে চেয়েছ?" সে হঠাৎ জানতে চাইল।
"শান্তি," রিয়া উত্তর দিল। "আর সত্যি কথা বলতে পারার সাহস।"
আরিফ জানত সত্যি কথা বলাটা সহজ ছিল না। কিন্তু ক্যামেরা ছাড়াও, কথাও একটা সেতু হতে পারে। সে বলল, "কখনও কখনও আমরা সাঁতার কাটতে গিয়ে ভয় পাই কিন্তু জল যথেষ্ট গভীর হলে, ওর ভিতর লুকিয়ে থাকা রঙগুলোই আমাদের হারিয়ে ভালোবাসতে শেখায়।"
রিয়ার চোখে হাসির ফুল ফুটল "শুনতে ভালো লাগলো। তুমি মিষ্টি কথা বলো, কিন্তু তোমার ক্যামেরাতেই তোমার মিষ্টতা লুকিয়ে আছে।"
রাত নেমে এলো। সান্তোরিনির আকাশ রাজকীয় তারার মত জ্বলে উঠল। তাদের আলাপটা আর শুধুই ফটোগ্রাফি বা ভ্রমণকথা এখন তা জীবন, হারানো স্মৃতি, এবং কিভাবে নতুন প্রভাত গড়ে ওঠে এসব নিয়ে গভীর হল। রাত শেষ হল, কিন্তু তাদের কথা থামল না; তারা জানাল গাড়ির ধারে দাঁড়িয়ে। আলোর অতল থেকে বেরিয়ে আসা শব্দগুলো উড়ন্ত পাখি, দূর পাহাড়ের বাতাস সব মিলেছে এক সুরে।
"শুরুটা কি কবিতার মত হয়েছে?" রিয়া হেসে বলল।
"হয়তো," আরিফ মৃদু কণ্ঠে বলল, "আর শেষটা? শেষটা তুমি করো—কখনো কখনো গল্পকারই গল্পের পরের পাতা খুলে দেয়।"
রিয়া কাঁধ একটু তুলে নিল। "আমি যদি বলি আমরা আবার দেখা করব?" তাঁর চোখে ছিল এক অনিশ্চিত আশা।
আরিফ ক্যামেরাটা চেয়ে নিল না, বরং হাত বাড়িয়ে নিল "আবার দেখা করা একটা প্রতিশ্রুতি হয়ে উঠুক, যেমন ছবিতে বারবার ক্লিক করা প্রতিটি ক্লিকে কিছুটা আলোর নতুন রং আসে।"
তারা আলিঙ্গনে মিলল না কিন্তু বাক্যগুলো তাদের মধ্যে আলোর মতো ছড়িয়ে পড়ল। রিয়া জর্ডানের মতো নিঃশ্বাস নিয়ে হালকা করে হাসল, আর যে হাসিটা ছিল আলোর প্রতিফলন। তারা জানত না ভবিষ্যতে কী হবে, কিন্তু আজকের সন্ধ্যাটা তাদের মধুর স্মৃতির তালিকায় জুড়ে গিয়েছিল একটা নীল ড্রেস, সাদা দেয়াল, আর দুইটি মন যে একসাথে কোনো গান শুনেছে।
পরদিন তারা আবার আলাদা পথে চলল আরিফ নিয়ে গেল তার ক্যামেরা, আর রিয়া নিয়ে গেল তার স্মৃতি। কিন্তু মাঝে মাঝে যখন সমুদ্রের ঢেউ কানে এসে ধাক্কা করে, রিয়া মনে করে আরিফের কথাগুলো "জল গভীর হলে, ওর ভিতর লুকিয়ে থাকা রঙগুলোই আমাদের হারিয়ে ভালোবাসতে শেখায়" কতটা সত্য ছিল। আর আরিফ মাঝে মাঝে পুরনো ছবিগুলো খুলে দেখলে, রিয়ার সেই হালকা হাসিটা ফিরে পায় যেমন কোনো পুরনো গান ফের বাজে।
এভাবেই তারা দুই অচেনা আত্মা একটি ছোটো গল্পে মিলল। গল্পটা বড় না হলেও যথেষ্ট ছিল; কারণ ভালো গল্পগুলো আর কি চায়? শুধু দু’টি মনকে একটি সন্ধ্যায় কাছাকাছি করে রাখা আর সেই কাছাকাছিই অনেক সময় জীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া।
শেষে রিয়া জানত, সে আবার সমুদ্রের কাছে ফিরে আসবে; আরিফ জানত, সে আর একবার সেই নীলাভ ভোরে ক্যামেরা তুলবে। আর গল্পটা? গল্পটা চুপচাপ রয়ে গেল আলোর ভেতরে, বাতাসে, এবং দু’জন মানুষের চোখের কোচে অলৌকিকভাবে সব সময় টিকে থাকার জন্য।
সকালবেলায় রিয়া আবার জানালার ধারে এসে দাঁড়াল। সাদা দেওয়ালের ভেতর দিয়ে ঢুকে আসা আলো তার চোখে লেগে উঠল। আগের রাতের কথা এখনো মনের ভেতর কেঁপে কেঁপে বাজছিল। যেন প্রতিটি শব্দই নতুন করে ডানা মেলছে।
হোটেলের নিচে ছোট্ট গলিতে আরিফকে দেখতে পেল সে ক্যামেরা হাতে, যেন কারও খোঁজ করছে। রিয়ার বুক ধড়ফড় করে উঠল, মনে হল সেই খোঁজটা হয়তো তারই জন্য।
সে নামতে নামতে ভাবল এত দ্রুত কারও সাথে এমন এক অদ্ভুত বন্ধন গড়ে ওঠা কি সম্ভব? না কি এটা শুধুই ভ্রমণের জাদু, যেখানে মানুষ একে অপরকে দ্রুত চিনে ফেলে?
সে আসলে রিয়ার জন্যই দাঁড়িয়ে ছিল। ছবি তোলার কাজের অজুহাত দিলেও তার ভেতরে অন্যরকম টান কাজ করছিল। রাতের কথাগুলো, রিয়ার হাসিটা সব যেন নতুন কোনো অধ্যায় লিখতে চাইছে।
রিয়াকে দেখতে পেয়ে আরিফ মৃদু হেসে বলল
“আজ সমুদ্রের পাশে গেলে কেমন হয়?”
রিয়া কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল,
“সমুদ্র তো শুধু জল না, ওর ভেতর অনেক গল্প থাকে। যদি সেই গল্পগুলো শুনতে পাও, তবে চলি।”
তারা দু’জন সমুদ্রের ধারে হাঁটতে লাগল। ঢেউ এসে বারবার পায়ের আঙুলে লাগছিল, যেন তাদের মধ্যে লুকোনো কোনো গোপন কথোপকথন। রিয়া হাত বাড়িয়ে জলের ছিটে ধরল, হাসতে হাসতে বলল “জানো, আমি ছোটবেলায় সব সময় ভাবতাম ঢেউগুলো আসলে কারও বার্তা নিয়ে আসে। হয়তো অন্য তীর থেকে।”
আরিফ তাকিয়ে রইল তার মনে হল, রিয়া শুধু ঢেউয়ের কথা বলছে না, বরং নিজের হৃদয়েরও এক টুকরো বার্তা ফেলে দিচ্ছে সমুদ্রের ভেতর।
সে হঠাৎ বলল, “তাহলে আজ একটা প্রতিশ্রুতি দিই—যতবার ঢেউ তীরে আঘাত করবে, ততবার মনে করব আমরা আবার দেখা করব।” রিয়া একটু থমকালো, তারপর চোখ নামিয়ে বলল—
“তাহলে এই সমুদ্রই আমাদের সাক্ষী থাকুক।”
সূর্য ধীরে ধীরে ঢলে পড়ছিল, আকাশে কমলা আর বেগুনি রঙের মিশ্রণ। সমুদ্র যেন রঙগুলো নিজের ভেতর গিলে নিচ্ছিল। তারা দু’জন চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল, যেন কথার দরকারই নেই—শুধু নীরবতা আর ঢেউ-ই যথেষ্ট।
হঠাৎ রিয়া বলল “আরিফ, যদি আমাদের গল্পটা এখানেই শেষ হয়ে যায়?”
আরিফ মৃদু হেসে উত্তর দিল “তাহলে এই দৃশ্যটাই শেষ পাতা হয়ে থাকবে। কিন্তু আমি মনে করি, কিছু গল্প শেষ হয় না—শুধু অন্য পাতায় গোপনে চলতে থাকে।”
রিয়া আর কিছু বলল না। শুধু ঢেউয়ের দিকে তাকিয়ে নিজের মনে ফিসফিস করে বলল “হয়তো সত্যিই এ গল্পের শেষ নেই…”
রাত নামার আগেই তারা শহরে ফিরল। সান্তোরিনির সরু গলিগুলোতে বাতি জ্বলে উঠেছে, চারদিকে যেন রঙিন পরীর আলো ঝুলে আছে। সাদা দেয়াল আর নীল দরজার ফাঁকে ফাঁকে দোকান, ক্যাফে, ছোট্ট বাজার—সব এক অদ্ভুত উষ্ণতায় ভরে উঠছে।
রিয়া হাঁটতে হাঁটতে থেমে গেল এক দোকানের সামনে। কাচের ভেতরে ঝুলছে রঙিন কাচের লণ্ঠন। সে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে বলল,
“দেখো, আলো যখন কাচের মধ্যে পড়ে, তখন সব রঙ আলাদা আলাদা হয়ে বেরোয়। মানুষের জীবনও কি এরকম না? একই আলো কিন্তু ভেতরের কাচ আলাদা বলে প্রতিটি মানুষ আলাদা রঙে জ্বলে ওঠে।”
আরিফ চুপ করে শুনছিল। ক্যামেরাটা তার কাঁধে ঝুলছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে ছবি তুলতে ইচ্ছে করল না। শুধু রিয়ার কথাগুলো মনে গেঁথে রাখতে চাইল।
“তুমি কি সবসময় এমন ভাবো?” সে জিজ্ঞেস করল।
রিয়া হাসল, “হয়তো… অথবা আমি শুধু নিজের ভেতরের কথাগুলো জিনিসের মধ্যে খুঁজে পাই।”
হঠাৎ তারা এক গলিতে ঢুকে পড়ল, যেখানে স্থানীয় এক বৃদ্ধ গ্রিক সঙ্গীত বাজাচ্ছিল গিটার দিয়ে। চারপাশে কয়েকজন মানুষ নাচতে শুরু করেছে। রিয়া থেমে গেল, তার চোখে উচ্ছ্বাসের ঝিলিক।
“চলো, নাচি,” সে বলল। আরিফ অবাক হয়ে গেল “আমি তো নাচ জানি না।” “জানো না, তবুও পারবে। এখানে তো কেউ বিচার করছে না,” রিয়া হাত বাড়িয়ে দিল।
আরিফ একটু দ্বিধা করলেও শেষমেশ রিয়ার হাত ধরল। তারা দু’জন ভিড়ের মধ্যে মিশে গেল। সুর, হাসি আর আলো মিলে চারপাশ যেন এক উৎসবে পরিণত হলো। রিয়ার হাসি, বাতাসে দুলতে থাকা তার চুল, আরিফের কানে সেই মুহূর্তে যেন গান হয়ে বাজতে লাগল।
নাচ শেষে দু’জন আবার হেঁটে চলল। রাত আরও ঘন হয়ে এসেছে। তারা সমুদ্রের ধারে গিয়ে বসলো, পাশে এক ছোট্ট লণ্ঠনের আলো।
রিয়া ধীরে বলল,
“জানো, আমি অনেক কিছু হারিয়েছি জীবনে। মাঝে মাঝে মনে হয় নতুন কাউকে কাছে আসতে দিলে, আবার হারাবার ভয় কাজ করে। তবু আজ মনে হচ্ছে, ভয়টা একটু কমে গেছে।”
আরিফ চুপ করে থাকল। কিছু কথা শব্দ দিয়ে বলা যায় না। শুধু হাতের কাছে থাকা মানুষটির উপস্থিতিই যথেষ্ট।
সে শুধু বলল,
“যা হারিয়েছে, তা হয়তো তোমার ভেতরেই নতুনভাবে রঙ হয়ে থেকে গেছে। আজ তুমি যেভাবে আলো আর রঙের কথা বলছিলে, সেটা হয়তো সেই হারানোর রঙ থেকেই এসেছে।”
রিয়া তার দিকে তাকাল। চোখে ছিল বিস্ময় আর অদ্ভুত এক স্বস্তি। রাতের সমুদ্র গর্জন করছিল, আর তার ভেতর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল এক নতুন গল্পের স্রোত যা তারা দু’জন মিলে লিখছে, ধীরে ধীরে, কোনো তাড়া ছাড়াই।
Part 1
Next.....coming....