27/07/2025
$অপণ্ণক-জাতক$
শ্রাবস্তী নগরের কাছে জেতবন মহাবিহারে ভগবান বুদ্ধ অবস্থান করছিলেন। সেখানে তিনি ধ্রুবসত্যের শিক্ষা দেওয়ার জন্য একটি ঘটনা বর্ণনা করেছিলেন। ঘটনার পটভূমি এই:
অনাথপিণ্ডিক নামে এক শ্রেষ্ঠী ছিলেন। তাঁর পাঁচশো বন্ধু বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ না করে অন্য গুরুদের শিষ্য হয়েছিলেন। একদিন অনাথপিণ্ডিক তাঁদের সঙ্গে নিয়ে জেতবনে যান। তিনি সঙ্গে প্রচুর ফুল, গন্ধদ্রব্য, তেল, মধু, গুড়, কাপড় ও অন্যান্য উপহার নিয়ে গিয়েছিলেন। তিনি ভগবানের পূজা করলেন, ভিক্ষুসঙ্ঘকে কাপড় ও ওষুধ দান করলেন এবং শান্তভাবে একপাশে বসলেন। তাঁর বন্ধুরাও ভগবানের পায়ে প্রণাম করে তাঁর পাশে বসে তাঁর অলৌকিক সৌন্দর্য ও প্রভা দেখে মুগ্ধ হলেন। ভগবানের মুখমণ্ডল ছিল পূর্ণচন্দ্রের মতো, তাঁর দেহ বুদ্ধত্বের লক্ষণে ভরা এবং আলোর রশ্মিতে ঘেরা।
ভগবান তখন তাঁদের উপদেশ দেওয়ার জন্য গম্ভীর কিন্তু মধুর কণ্ঠে ধর্মের কথা বলতে শুরু করলেন। তাঁর কথা শুনে যেন আকাশ থেকে গঙ্গা নেমে আসছে বা রত্নের মালা গাঁথা হচ্ছে। এই উপদেশ শুনে বন্ধুরা প্রসন্ন হয়ে ভগবানের শরণ নিলেন। তারপর থেকে তারা প্রতিদিন অনাথপিণ্ডিকের সঙ্গে বিহারে যেতেন, ধর্ম শুনতেন, দান করতেন, শীল পালন করতেন এবং উপোসথ দিনে সংযমী জীবনযাপন করতেন।
কিন্তু ভগবান যখন শ্রাবস্তী ছেড়ে রাজগৃহে গেলেন, তখন এই পাঁচশো ব্যক্তি বৌদ্ধ ধর্ম ত্যাগ করে আগের শরণে ফিরে গেলেন। ভগবান সাত-আট মাস পর জেতবনে ফিরে এলে অনাথপিণ্ডিক আবার তাঁদের নিয়ে ভগবানের কাছে গেলেন। তিনি ভগবানকে পূজা করে বন্ধুদের আগের আচরণের কথা জানালেন।
ভগবান জিজ্ঞাসা করলেন, “উপাসকরা, তোমরা কি ত্রিশরণ ত্যাগ করে অন্য শরণ নিয়েছ? এটা কি সত্যি?” তাঁর মুখ থেকে বের হওয়া দিব্য গন্ধে চারদিক আমোদিত হয়ে উঠল। বন্ধুরা সত্য গোপন করতে না পেরে বললেন, “হ্যাঁ, ভদন্ত, এটা মিথ্যা নয়।”
ভগবান বললেন, “উপাসকরা, নরক থেকে স্বর্গ পর্যন্ত এই বিশ্বে এমন কেউ নেই যিনি শীল ও গুণে বুদ্ধের সমকক্ষ হতে পারেন। ত্রিরত্নের শরণ নিলে কেউ নরকে যায় না, সে পুনর্জন্মের দুঃখ থেকে মুক্তি পায় এবং দেবলোকে সুখ ভোগ করে। তোমরা এই শরণ ত্যাগ করে ভুল করেছ।” তিনি ত্রিরত্নের গুণ ব্যাখ্যা করে গাথা আবৃত্তি করলেন:
> বুদ্ধের শরণ নিলে নরকে যেতে হয় না,
> মানুষের জন্ম ছেড়ে দেবলোকে স্থান পায়।
> ধর্মের শরণ নিলে নরকে যেতে হয় না,
> মানুষের জন্ম ছেড়ে দেবলোকে স্থান পায়।
> সঙ্ঘের শরণ নিলে নরকে যেতে হয় না,
> মানুষের জন্ম ছেড়ে দেবলোকে স্থান পায়।
> পাহাড়ের গুহা বা জনহীন বন,
> শান্তির জন্য মানুষ শত শরণ নেয়।
> কিন্তু ত্রিরত্নের শরণ সব দুঃখ দূর করে,
> তাই এই শরণ নিতে সবসময় এগিয়ে যাও।
তিনি আরও বললেন, “বুদ্ধ, ধর্ম ও সঙ্ঘের স্মরণের মাধ্যমে মানুষ স্রোতাপত্তি, সকৃদাগামী, অনাগামী এবং অর্হত্ত্ব ফল লাভ করে। তোমরা এই শরণ ত্যাগ করে মূর্খতা করেছ।” তিনি আরও বললেন, “পূর্বে যারা অসত্যের পথে চলেছিল, তারা যক্ষের হাতে ধ্বংস হয়েছিল। কিন্তু যারা সত্যের পথে চলেছিল, তারা নিরাপদে গন্তব্যে পৌঁছেছিল।”
অনাথপিণ্ডিক তখন বললেন, “প্রভু, এই উপাসকরা ভুল করেছে, তা বুঝলাম। কিন্তু অতীতে যক্ষের কান্তারে তার্কিকদের ধ্বংস ও সত্যপথীদের সাফল্যের কথা আমরা জানি না। দয়া করে সেই কাহিনী বলুন।”
ভগবান বললেন, “আমি সর্বজ্ঞত্ব লাভ করেছি জগতের সংশয় দূর করার জন্য। তোমরা মন দিয়ে শোনো।”
*অতীতের কাহিনী*
প্রাচীনকালে বারাণসীতে ব্রহ্মদত্ত নামে এক রাজা ছিলেন। সেই সময় বোধিসত্ত্ব এক বণিকের ঘরে জন্ম নিয়েছিলেন। বড় হয়ে তিনি বাণিজ্য শুরু করেন। তাঁর ছিল পাঁচশো গরুর গাড়ি। তিনি এই গাড়িতে মাল বোঝাই করে পূর্ব বা পশ্চিমে বাণিজ্য করতে যেতেন। বারাণসীতে আরেক তরুণ বণিক ছিল, যে ছিল খুবই নির্বোধ।
একবার বোধিসত্ত্ব মূল্যবান দ্রব্য নিয়ে দূর দেশে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি শুনলেন, নির্বোধ বণিকও একই জায়গায় পাঁচশো গাড়ি নিয়ে যাচ্ছে। বোধিসত্ত্ব ভাবলেন, “একসঙ্গে এক হাজার গাড়ি গেলে রাস্তা নষ্ট হবে, খাবার-জলের অভাব হবে। তাই একজন আগে, আরেকজন পরে যাওয়া উচিত।” তিনি নির্বোধ বণিককে ডেকে বললেন, “তুমি আগে যাবে, না আমি?” নির্বোধ বণিক ভাবল, আগে গেলে ভালো রাস্তা, ভালো ঘাস, ফলমূল ও জল পাওয়া যাবে। তাই সে বলল, “আমি আগে যাব।”
বোধিসত্ত্ব বললেন, “ঠিক আছে, তুমি আগে যাও।” তিনি ভাবলেন, পরে গেলে সুবিধা বেশি। নির্বোধ বণিকের গাড়ি রাস্তা সমান করবে, বলদের জন্য নতুন ঘাস গজাবে, ফলমূল পাওয়া যাবে, আর তিনি নির্বোধ বণিকের স্থির করা দামে ক্রয়-বিক্রয় করতে পারবেন।
নির্বোধ বণিক পাঁচশো গাড়ি নিয়ে যাত্রা করল। কিছুদিন পর সে এক ভয়ঙ্কর কান্তারে পৌঁছল, যেখানে ষাট যোজন পথে জলের কোনো চিহ্ন ছিল না। এই কান্তারে যক্ষরা বাস করত। বণিকের লোকেরা জলের ভাণ্ড বোঝাই করে নিয়েছিল। কিন্তু কান্তারের মাঝখানে পৌঁছতেই যক্ষরাজ ভাবল, “এই নির্বোধ বণিককে বোঝাতে হবে জল ফেলে দিতে। তাহলে তারা পিপাসায় কাতর হয়ে পড়বে, আর আমরা তাদের মাংস খেতে পারব।”
যক্ষরাজ মায়াবলে একটি সুন্দর শকট সৃষ্টি করল। সেটি টানছিল সাদা ষাঁড়। তার মাথায় নীল ও সাদা পদ্মের মালা, কাপড় ভিজে, শকটের চাকা কাদায় মাখা। তার সঙ্গে দশ-বারোজন যক্ষ অস্ত্র হাতে ছিল, তাদেরও কাপড় ভিজে, মুখে পদ্মের ডাঁটা।
বণিক তখন দলের সামনে ছিল। যক্ষরাজ তার কাছে গিয়ে বলল, “আপনি কোথা থেকে আসছেন?” বণিক বলল, “বারাণসী থেকে। আপনার কাপড় ভিজে, শকটে কাদা। পথে বৃষ্টি হয়েছে? পদ্মের জলাশয় দেখেছেন?” যক্ষরাজ বলল, “এই যে নীল বন দেখছেন, ওখানে প্রচুর জল, বৃষ্টি হচ্ছে, পদ্মে ভরা সরোবর আছে।” তারপর সে জিজ্ঞাসা করল, “আপনার গাড়িতে কী আছে?” বণিক বলল, “শেষের গাড়িতে জল।” যক্ষরাজ বলল, “জল আনা ভালো করেছেন, কিন্তু এখন আর দরকার নেই। সামনে প্রচুর জল পাবেন। জল ফেলে দিন, গাড়ি হালকা হবে।”
নির্বোধ বণিক তার কথায় ভুলে সব জল ফেলে দিল। তারা আরও এগিয়ে গেল, কিন্তু কোথাও জল পেল না। পিপাসায় সবাই কাতর হয়ে পড়ল। সূর্যাস্তের পর তারা গাড়ি থামিয়ে বলদ বাঁধল, গাড়ি দিয়ে ঘেরা স্কন্ধাবার তৈরি করল। কিন্তু জল না পেয়ে কেউ ভাত রাঁধতে পারল না। সবাই ক্ষুধায়-পিপাসায় ক্লান্ত হয়ে মাটিতে পড়ে রইল। রাতে যক্ষরা এসে সবাইকে মেরে মাংস খেয়ে চলে গেল। গাড়ি ও মাল অক্ষত রইল, কিন্তু কঙ্কাল ছড়িয়ে পড়ল।
দেড় মাস পর বোধিসত্ত্ব পাঁচশো গাড়ি নিয়ে যাত্রা করলেন। কান্তারে পৌঁছে তিনি প্রচুর জল নিলেন এবং অনুচরদের সাবধান করে বললেন, “এই কান্তারে জল নেই, বিষাক্ত গাছও আছে। আমার অনুমতি ছাড়া জল বা ফল-ফুল খাবে না।”
কান্তারের মাঝখানে যক্ষরাজ আবার সেই বেশে এল। বোধিসত্ত্ব তাকে দেখে বুঝলেন, এ যক্ষ। তার চোখ লাল, ছায়া পড়ে না। তিনি উচ্চৈঃস্বরে বললেন, “দূর হও, পাপী! আমরা বণিক, জলাশয় না দেখলে জল ফেলি না।” যক্ষরাজ চলে গেল।
অনুচররা বলল, “মহাশয়, ওই লোক বলল, সামনে জল আছে। জল ফেলে দিই?” বোধিসত্ত্ব গাড়ি থামিয়ে সবাইকে জিজ্ঞাসা করলেন, “এখানে জলাশয় আছে বলে কখনও শুনেছ? ঠান্ডা হাওয়া, মেঘ, বিদ্যুৎ বা গর্জন দেখেছ?” সবাই বলল, “না।” তিনি বললেন, “ওরা যক্ষ। নির্বোধ বণিক ওদের কথায় ভুলে জল ফেলে ধ্বংস হয়েছে। আমরা সাবধানে চলব।”
তারা এগিয়ে গিয়ে নির্বোধ বণিকের গাড়ি ও কঙ্কাল দেখল। বোধিসত্ত্ব বিশ্রামের ব্যবস্থা করলেন, বলদদের খাওয়ালেন, জীর্ণ গাড়ি ফেলে ভালো গাড়ি নিলেন, মূল্যবান দ্রব্য বেছে নিলেন। তারপর গন্তব্যে পৌঁছে দ্বিগুণ-ত্রিগুণ মূল্যে মাল বিক্রি করে সবাই নিরাপদে ফিরলেন।
# # # # উপসংহার
ভগবান বললেন, “পূর্বে তার্কিকরা ভুল পথে গিয়ে ধ্বংস হয়েছিল, কিন্তু সত্যের পথে চলা বোধিসত্ত্ব নিরাপদে ফিরেছিলেন।” তিনি গাথা বললেন:
> সত্যপথ সব সুখের কারণ,
> পণ্ডিতরা সদা তা প্রদর্শন করে।
> তার্কিকরা কিন্তু কুপথে চালায়,
> লোকের অহিত করে।
> তাই বিচার করে বুদ্ধিমান মানুষ,
> সত্যের শরণ নেয়, যা সব দুঃখ দূর করে।
তিনি আরও বললেন, “সত্যপথে চললে ত্রিবিধ কুশল, কামস্বর্গ, ব্রহ্মলোক এবং অর্হত্ত্ব পাওয়া যায়। অসত্যপথে চললে নরক ও নীচকুলে জন্ম হয়।” তাঁর উপদেশ শুনে পাঁচশো উপাসক স্রোতাপত্তি ফল লাভ করলেন।
ভগবান শেষে বললেন, “তখন দেবদত্ত ছিল নির্বোধ বণিক, তার শিষ্যরা ছিল তার অনুচর। আমার শিষ্যরা ছিল বোধিসত্ত্বের অনুচর, আর আমি ছিলাম সেই বুদ্ধিমান বণিক।”