01/06/2025
#নীহারিকা_মন্জিল
#লেখনীতে_অল্প_সল্প_গল্প
( কপি করা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ । এবং নিয়মিত গল্প পেতে আমার পেজ ফলো দিয়ে রাখুন)
পর্ব : ৪১
-
এখন বিকেল, নিরব আর নিশিকে একটি ঘরে মাটিতে শীতল পাটি বিছিয়ে বসতে দেয়া হয়েছে। তাদের পাশে গোল হয়ে বসেছে নিশির বান্ধবীরা, আপারা, আর মতিন। তারা নিশিকে একটু পরপর কানে কানে কী যেন বলছে আর হাসছে। মোরিয়ম বেগম ধান-ধূপ আনতে গেছেন বাড়ির পেছনের ধানক্ষেত থেকে। রহিম মাস্টার পাশের ঘরে অতিথিদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলাপ করছেন।
মতিন নিরবের দিকে মোহভরা চোখে তাকিয়ে আছে। মতিনকে এভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে নিক মতিনকে জিজ্ঞেস করল,
— কী দেখছো? (নিরব)
মতিন বোকার মতো হেসে বলল,
— কারে আর দেখমু! আপনে'রে দেখতেছিলাম দুলাভাই! কত সুন্দর আপনে! বিশ্বাস করেন, এত সুন্দর মানুষ আমি আর চক্ষে দেখি নাই। (মতিন)
— এটা ভুল বলেছো মতিন! তোমার আপা কি কম সুন্দর? তোমার আপা কিন্তু আমার থেকেও সুন্দর। (নিরব)
— আপা তো মাইয়ার মধ্যে সুন্দর। আর আপনে পোলার মধ্যে সবথেকে সুন্দর। (মতিন)
— উঁহু, তুমি কি জানো আমার থেকেও সুন্দর আরও কত মানুষ আছে? আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টির সেরা জীব হিসেবে সৃষ্টি করেছেন। আল্লাহর সকল সৃষ্টি সুন্দর। এই পৃথিবীতে কেউ অসুন্দর নয়। জানো, আমার একটা খুব ভালো বন্ধু আছে, ও আমার থেকেও বেশি সুন্দর...
নিরব কথা শেষ করার আগেই মোরিয়ম বেগম ধান-ধূপ নিয়ে হাজির হন।
— অই মতিন, এতক্ষণ ধইরা কি এত বকবক করস? নাত জামাইরে বিরক্ত করিস না। সর দেহি, ছইর্যা বয়!
নাত জামাই আমি বুজতাম পারসি। এহন খালি একটা নিয়ম বাকী আছে। এইটা পালন করলি তুই বাড়ি চইলা যাইতে পারবি। (মোরিয়ম বেগম)
— সমস্যা নাই দাদি! আমার কোনো অসুবিধা হচ্ছে না। আপনি নিয়ম পালন করুন। (নিরব)
— আচ্ছা। (মোরিয়ম)
মোরিয়ম বেগম নিরব ও নিশিকে দিয়ে বাকি নিয়ম পালন করান।
রিং... রিং... রিং...
এই সময় নিরবের ফোনে একটি অজানা নম্বর থেকে কল আসে। সে একটু দূরে গিয়ে কলটি রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসে,
— We catch them. But ওরা কিছুতেই মুখ খুলছে না! তুমি যত তারাতারি সম্ভব চলে আসো। It's urgent. (অজ্ঞাত)
— Ok. তোমরা ট্রিটমেন্ট চালিয়ে যাও, আমি আসছি। (নিরব)
নিরব এইটুকু বলেই কলটি কেটে দিল। তারপর 'S' নাম দিয়ে সেভ করা একটি নম্বরে একটি মেসেজ পাঠিয়ে ফোনটি পকেটে ঢুকিয়ে ফেলল। তারপর সে ইশারায় নিশিকে ডাকল। নিরবের ইশারা পেয়ে নিশি সবার মাঝ থেকে উঠে এল।
— কী হল? সবার মাঝ থেকে ডেকে আনলেন যে! (নিশি)
— নিশি, আমায় এখন একটু বের হতে হবে। It's urgent. (নিরব)
— মানে? এখন কোথায় যাবেন আপনি? সবাইকে আমি কী বলব? আর আব্বাকে আমি কী বলব? (নিশি)
— চাচাকে আমি ম্যানেজ করে নেব। তুমি শুধু বাকিদের কিছু একটা বলে ম্যানেজ করে নিও, প্লিজ। আমায় এখনই বের হতে হবে। টেনশন কোরো না, আমি খুব তাড়াতাড়ি চলে আসব। ঠিক আছে? বাই। (নিরব)
— কিন্তু...
— কোনো "কিন্তু" না। প্লিজ, একটু বোঝার চেষ্টা করো। প্লিজ। বাই। আল্লাহ হাফেজ। (নিরব)
নিরব নিশিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
-
এখন সন্ধ্যা হওয়ার আগমুহূর্ত। প্রায় সব অতিথি চলে গেছেন। ‘নিহারিকা মঞ্জিল’-এ এখন শুধু প্রান্ত, প্রিয়া, প্রান্তর পরিবার ও মি. শিকদার রয়েছেন। সবাই হল রুমে বসে আছেন কৌতূহল নিয়ে। কারণ আরফান শিকদার সব অতিথির সাথে মি. শিকদারের টুকটাক পরিচয় করালেও, বাড়ির কারও সাথে এখনো তার পরিচয় করাননি। উপস্থিত সবার দৃষ্টি আরফান সাহেবের দিকে থাকলেও, প্রেমার দৃষ্টি শাওনের দিকে।
মি. শিকদার বাড়িতে পা রাখামাত্রই তার চোখ-মুখ শক্ত হয়ে গেছে, এটা সে অনেকক্ষণ ধরে খেয়াল করছে। প্রমা সবার আড়ালে শাওনের পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। সে মৃদু স্বরে শাওনকে জিজ্ঞেস করে,
— শাওন ভাই, আপনি ঠিক আছেন? (প্রেমা)
— হ্যাঁ... ঠিক আছি। ঠিক আছি আমি। (শাওন)
— আপনি সত্যি বলছেন তো? (প্রেমা)
— তোমাকে মিথ্যে বলবো কেন? (শাওন)
— কিন্তু, আমার মনে হচ্ছে আপনি ঠিক নেই। মি. শিকদারকে দেখার পর আপনি কেমন যেন করছেন! কিছু কি হয়েছে? (প্রেমা)
— তোমার কি মনে হচ্ছে না, তুমি আমায় নিয়ে একটু বেশি ভাবছো আজকাল! আমায় নিয়ে এত ভেবো না প্রেমময়ী। পরে নিজেই নিজেকে ঘৃণা করবে।
কে বলতে পারে আজ যাকে নিয়ে তুমি এত ভাবছো,
কাল তার নামটাই হয়তো তুমি মুখে নিতে চাইবে না। (শাওন)
শাওনের মুখে এত কঠিন কথা শুনে প্রমা ভেতরে ভেতরে নিজের উপর রাগ হল ঠিকই, কিন্তু মুখে একটি শব্দও করলো না। রাগ, অভিমান গুলো অশ্রুকণা হয়ে তার চোখ থেকে ঝরে পড়লো। মনে মনে নিজের ১৪ গুষ্টি উদ্ধার করলো সে।
"কেন বারবার বেহায়ার মতো গিয়ে কথা শুনতে যাচ্ছিস প্রেমা? জানিস না, উনি কখনো তোর কথার সোজা উত্তর দেয় না। তবুও কেন?"
প্রেমার চোখে পানি দেখে আরফান সাহেব প্রেমাক জিজ্ঞেস করেন,
— প্রেমা কী হয়েছে? চোখে পানি কেন? (আরফান)
— কিছু না, আব্বু! চোখে কী যেন পড়েছে, তাই! (প্রেমা)
— ও আচ্ছা। সবাই শুনুন, আপনারা অনেকেই মি. শিকদার কে সেটা জানার জন্য অধীর আগ্রহে বসে আছেন। তো, আপনাদের এতক্ষণ অপেক্ষা করানোর জন্য আমি দুঃখিত।
এখন আসি মূল কথায়— উনি কে?
উনি হচ্ছেন মি. শিকদার, পুরো নাম কাইফ শিকদার।
ঈশা, তুমি আমায় অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলে না, এত কম দামে এত সুন্দর, এত বড় বাড়িটা আমাদের কে দিলো?
এই যে, উনি আমার কাছে এই বাড়িটা বিক্রি করেছেন। উনি এই বাড়ির মালিক। (আরফান)
— এক মিনিট, মি. চৌধুরী! একটা ভুল আছে। আমি এই বাড়ির মালিক আগে ছিলাম, এখন এই বাড়ির মালিক কিন্তু আপনারা। (কাইফ)
— তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন ছিল। আপনার অনুমতি পেলে প্রশ্নটা করবো! (প্রেমা)
— এতে অনুমতি নেওয়ার কী আছে! কী জানতে চাও বলো। (কাইফ)
— আচ্ছা, এত বড় বাড়ি, এত বিলাসবহুল — নিশ্চয়ই অনেক টাকা খরচ করে বানিয়েছেন! তাহলে এত কম দামে আমাদের দিলেন কেন? (প্রেমা))
— গুড কোয়েশ্চেন! তবে এই বিষয় নিয়ে বলতে গেলে অনেক সময় লাগবে। এর থেকে বরং শর্টকাটে বলি...
আজ থেকে প্রায় ৯ বছর আগে, আমি এখানকার মন্ত্রী ছিলাম। এই বাড়িতে আমি আর আমার স্ত্রী নিহারিকা থাকতাম। এই বাড়িটা আমাদের বিয়ের পর আমার শ্বশুর মশাই আমায় উপহার দিয়েছিলেন। কিন্তু, দুর্ভাগ্যবশত, বিয়ের ২ বছর পর এক অগ্নিকাণ্ডে আমার স্ত্রী মারা যায়। তারপর আমি খুব আপসেট হয়ে পড়ি। এই বাড়ির প্রতিটি কোণায় নিহারিকার স্মৃতি রয়ে গেছে, যা আমাকে বারবার ওর কথা মনে করিয়ে দিত। আমি কোনো কাজেই মন দিতে পারতাম না। কিন্তু আমার জন্য এই চট্টগ্রাম অচল হয়ে পড়ছিল। তাই সহকর্মীদের পরামর্শে আমি এই বাড়ি ছেড়ে অন্য জায়গায় শিফট হয়ে যাই এবং বাড়ির নিরাপত্তার জন্য কয়েকজন গার্ডকে বাড়ির দায়িত্ব দিয়ে যাই।
কিন্তু তারা কেউ বেশিদিন থাকল না। গ্রামের অনেক ভিতরে হওয়ায় তেমন কোনো সুযোগ-সুবিধা ছিল না। তার উপর তখন এখানে বাঘের প্রচুর উপদ্রব ছিল। তাই কেউ ১ মাসের বেশি থাকেনি।
এদিকে গার্ড না থাকায় চোর-ছ্যাঁচোরা বাড়ির অনেক কিছু চুরি করে নিয়ে যাচ্ছিল। এজন্য আমি বাড়ি বিক্রির সিদ্ধান্ত নিই।
প্রথমে অনেকেই এসেছিল, কিন্তু বাড়ি ঘুরে দেখার পর কেউ রাজি হচ্ছিল না বাড়ি কিনতে। তাদের মধ্যে অনেকেই দাবি করেছিল, এখানে নাকি তারা জ্বিন-ভূত দেখেছে। আমি নিজে এখানে এসে ঘুরে গেছি, কিন্তু তেমন কিছুই দেখিনি।
শেষে, দাম কমিয়েও যখন কাউকে পাচ্ছিলাম না, তখন আরফান সাহেব সব শুনে বাড়ি কিনতে রাজি হলেন— আমিও দ্বিমত পোষণ করলাম না।
এই হচ্ছে মূল কাহিনি। (কাইফ)
প্রেমা কাইফ শিকদারের কথায় বাঁকা হাসল। অতঃপর বলল,
— ও, তাহলে এই কাহিনি! সবকিছু কেমন সিনেমার মতো লাগলো না! থ্রিলার সিনেমা! (প্রেমা)
প্রেমা কথায় কাইফ তার দিকে একরকম ডেভিল স্মাইল দিয়ে এগিয়ে এসে বলল,
— তা বলতেই পারো! তবে একটা কথা কি জানো— আমাদের সবার জীবনই সিনেমার মতো।
কারোটা থ্রিলার সিনেমা,
কারোটা রোমান্টিক সিনেমা।
কাইফের কথার মাঝেই শাওন খেয়াল করল, কাইফ প্রেমার কোমরের দিকে হাত বাড়াচ্ছে। সে কাইফ শিকদারের কাছে এগিয়ে গিয়ে তার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল,
— কার জীবন কেমন হবে, তা তো আল্লাহই ভালো জানেন— তাই না, মি. শিকদার? (শাওন)
শাওনের কথায় কাইফ অপ্রস্তুত বোধ করল। সে জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে বলল,
— হুঁম। ইউ আর রাইট! (কাইফ)
শাওন কাইফের দিকে তির্যক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,
— I know!
By the way, খুব ভালো লাগলো পরিচিত হয়ে। Nice to meet you!
আচ্ছা, আমি এখন বের হচ্ছি— আমার একটা জরুরি কাজ পড়ে গেছে। কাজ সেরে আমি বাসায় চলে যাব। মামনি, এখন কিছু জিজ্ঞেস করো না। কোন কাজে যাচ্ছি, কোথায় যাচ্ছি— সব পরে বলব। (শাওন)
শাওন কাউকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে বেরিয়ে গেল।
চলবে...
Send a message to learn more