19/05/2025
চট্টগ্রাম বন্দর—বাংলাদেশের অর্থনীতির মেরুদণ্ড, বিশ্বের দুয়ারে আমাদের গর্বের প্রবেশপথ। কথাটা শুনতে দারুণ, তাই না? কিন্তু একটু গভীরে ঢুকলে দেখবেন, এই “গেটওয়ে টু দ্য ওয়ার্ল্ড” আসলে একটা জরাজীর্ণ, শ্বাসকষ্টে ভোগা প্রবেশপথ, যেটা বিশ্বের দৌড়ে অনেক পিছিয়ে পড়েছে। পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপিন্স, নাইজেরিয়া, ঘানা, কেনিয়া, মিশর, মরক্কো, কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম—এই ১১টি দেশের ১৫টি বন্দরের সঙ্গে তুলনা করলে আমাদের বন্দরের করুণ দশা দেখে চোখে পানি চলে আসে। এই লেখায় আমরা ঝাঁকিয়ে দেখব, কেন চট্টগ্রাম বন্দর এতটা “অকেজো” হয়ে গেছে, কীভাবে সিন্ডিকেট আর দুর্নীতি এটাকে গলাটিপে ধরেছে, আর কীভাবে একটু সাহসী সিদ্ধান্ত আমাদের অর্থনীতিকে আবার ডানা মেলতে সাহায্য করতে পারে। প্রস্তুত? চলুন, ডুব দিই!
চট্টগ্রাম বন্দর: বিশ্বের ধীরগতির “চ্যাম্পিয়ন”
চট্টগ্রাম বন্দরের সমস্যাগুলো এমন কিছু নয় যে রাতারাতি হয়েছে। এটা বছরের পর বছর ধরে অব্যবস্থাপনা, সিন্ডিকেটের কব্জা, আর উন্নয়নের প্রতি উদাসীনতার ফল। আসুন, কিছু হতাশাজনক তথ্য দিয়ে শুরু করি:
জাহাজের অপেক্ষার সময়: একটা জাহাজকে চট্টগ্রাম বন্দরে ঘাট পেতে গড়ে ২.৭ দিন লাগে। এটা বিশ্বের সবচেয়ে দীর্ঘ অপেক্ষার সময়ের একটি! তুলনায়, সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো বন্দরে জাহাজ ঘাটে ভেড়ে কয়েক ঘণ্টার মধ্যে কাজ শুরু করে। এমনকি কেনিয়ার মোম্বাসা বন্দরেও এই সময় আমাদের চেয়ে অনেক কম।
টার্নঅ্যারাউন্ড টাইম: ঘাট পাওয়ার পরও জাহাজের কাজ শেষ করে বন্দর ছাড়তে গড়ে ৩.২৩ দিন লাগে। বিশ্বের শীর্ষ বন্দরগুলোতে এই সময় ১.৫ দিনের নিচে। আমাদের বন্দরে জাহাজ যেন ছুটি কাটাতে আসে!
ক্রেনের গতি: আমাদের ক্রেনগুলো ঘণ্টায় মাত্র ১৫-২০টি কনটেইনার হ্যান্ডেল করে। তুলনায়, শ্রীলঙ্কার কলম্বো বন্দরে এই সংখ্যা ২৫-৩০, আর ভারতের গুজরাটের মুন্দ্রা বন্দরে ৩০-৪০। আমাদের ক্রেন যেন ঘুমের ঘোরে কাজ করে!
ঘাটের ক্ষমতা: একটা পুরো ঘাট মিলে চট্টগ্রামে ঘণ্টায় ৩৫টি কনটেইনার হ্যান্ডেল হয়। কলম্বোতে এটা ৮০-১০০, মুন্দ্রায় ২১৫! এমনকি নাইজেরিয়া বা কম্বোডিয়ার বন্দরও আমাদের চেয়ে এগিয়ে। এটা কি লজ্জার নয়?
ডিউয়েল টাইম: এটাই সবচেয়ে হৃদয়বিদারক। রপ্তানির মাল বোঝাই করে জাহাজ বন্দর থেকে বেরোতে ১১ দিনের বেশি লাগে। ভিয়েতনামে এটা ৫-৭ দিন, কলম্বোতে ৭-৮ দিন। এই দীর্ঘ সময়ের জন্য রপ্তানিকারকরা বিশাল লোকসানের মুখে পড়েন, আর বাংলাদেশের পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়ে।
এই পরিসংখ্যানগুলোর ফল? বিশ্বব্যাঙ্কের কনটেইনার পোর্ট পারফরম্যান্স ইনডেক্সে ৪০৫টি বন্দরের মধ্যে চট্টগ্রামের র্যাঙ্কিং ৩৩৪! এটা শুধু লজ্জার নয়, আমাদের অর্থনীতির জন্য একটা বিপদসংকেত।
কে দায়ী? সিন্ডিকেট আর দুর্নীতির জাল
চট্টগ্রাম বন্দরের এই দুর্দশা কোনো দুর্ঘটনা নয়। এটা একটা সুসংগঠিত সিন্ডিকেটের ফল, যারা বছরের পর বছর ধরে বন্দরকে দুধের গাভী হিসেবে ব্যবহার করছে। উদাহরণ? সাইফ পাওয়ারটেক। এই কোম্পানি বন্দরের অপারেশনের বড় অংশ নিয়ন্ত্রণ করে। কিন্তু কীভাবে তারা এই কাজ পায়? টেন্ডারে সবচেয়ে কম দর দেওয়ার মাধ্যমে? না। বরং বেশি দর দিয়ে, আর তারপর কোটি কোটি টাকার কাজ লুটে নিয়ে। এই সিন্ডিকেটের কারণে বন্দরের দক্ষতা বাড়ানোর কোনো উদ্যোগই সফল হয়নি।
এখন যখন সরকার বা কেউ বন্দরের উন্নয়নের জন্য বিদেশি অপারেটর আনার কথা বলছে, তখনই শুরু হয়েছে নাটক। “বন্দর বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়া হচ্ছে!”—এই কান্নাকাটি কারা করছে? তারাই, যারা বছরের পর বছর বন্দরের রক্ত শুষেছে। তাদের দুধের বাটি হাতছাড়া হওয়ার ভয়ে এখন গলা ফাটছে।
বিদেশি অপারেটর: ভয় না সম্ভাবনা?
যারা “বিদেশি অপারেটর” বলে চিৎকার করছেন, তাদের একটু থামিয়ে প্রশ্ন করা দরকার। এই অপারেটররা কারা? এরা সিঙ্গাপুর, দুবাই, ডেনমার্কের মতো দেশের কোম্পানি, যারা বিশ্বের ৩০-৭০টি বন্দরে কাজ করে। তারা কি কখনো কোনো বন্দরের “মালিক” হয়ে গেছে? না। তারা শুধু অপারেশনাল দক্ষতা নিয়ে আসে—আধুনিক প্রযুক্তি, দ্রুত সেবা, আর বিশ্বমানের ব্যবস্থাপনা। সিঙ্গাপুর, কলম্বো, ভিয়েতনাম—এই দেশগুলো বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে কাজ করে শেষ হয়ে যায়নি, বরং বিশ্ব বাণিজ্যের মানচিত্রে উঠে এসেছে। তাহলে আমাদের ভয়টা কীসের?
একজন আশিক চৌধুরী নামের মানুষ এই বন্দরকে বাঁচানোর জন্য লড়ছেন। তিনি চান বিনিয়োগের পরিবেশ ঠিক করতে, যাতে আমাদের পণ্য সময়মতো বিশ্ববাজারে পৌঁছায়, রপ্তানিকারকরা লোকসান থেকে বাঁচে, আর বাংলাদেশ বিনিয়োগকারীদের কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। কিন্তু তাকে বাধা দিচ্ছে সেই পুরোনো সিন্ডিকেট আর তাদের মায়াকান্না।
কী হবে বিদেশি অপারেটর এলে?
আধুনিক অপারেটর এলে চট্টগ্রাম বন্দরের কী কী পরিবর্তন হতে পারে, একটু কল্পনা করুন:
পোর্ট অকুপেন্সি: বর্তমানে ৮০% এর ওপরে থাকা বন্দরের ভিড় ৬০% এর নিচে নেমে আসবে। ফলে জাহাজের অপেক্ষার সময় কমবে।
মাল পরিবহনের সময়: গেট থেকে জাহাজে মাল পৌঁছাতে এখন ২২ দিন লাগে। এটা ৯ দিনে নেমে আসবে।
রপ্তানির গতি: রপ্তানিকারকরা সময়মতো পণ্য পাঠাতে পারবে, লোকসান কমবে, আর বাংলাদেশের পণ্য বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকবে।
বিনিয়োগের আকর্ষণ: দক্ষ বন্দর মানেই বেশি বিদেশি বিনিয়োগ। বাংলাদেশ হবে বিনিয়োগকারীদের প্রথম পছন্দ।
এই পরিবর্তনগুলো কি আমরা চাই না? তাহলে কেন ভয় পাবো? বিদেশি অপারেটর মানে দেশ বিক্রি করে দেওয়া নয়, বরং দেশকে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে দৌড়ানোর সুযোগ দেওয়া।
অন্য দেশ থেকে শিক্ষা
আসুন, একটু চোখ খুলে দেখি অন্য দেশ কী করছে:
সিঙ্গাপুর: বিশ্বের সবচেয়ে দক্ষ বন্দরগুলোর একটি। তারা বিদেশি অপারেটরদের সঙ্গে কাজ করে, কিন্তু নিজেদের সার্বভৌমত্ব হারায়নি।
কলম্বো: শ্রীলঙ্কার এই বন্দরে চীন, ভারত, আর ইউরোপের অপারেটররা কাজ করে। ফল? দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ত হাব।
ভিয়েতনাম: বিদেশি বিনিয়োগ আর আধুনিক অপারেটরদের জন্য ভিয়েতনামের বন্দর এখন এশিয়ার রপ্তানি কেন্দ্রগুলোর একটি।
এই দেশগুলো কেউই “বিদেশিদের হাতে বন্দর তুলে দিয়ে” শেষ হয়ে যায়নি। বরং তারা বিশ্ব বাণিজ্যের মঞ্চে নিজেদের জায়গা করে নিয়েছে। আমরা কেন পারব না?
কী করা দরকার?
চট্টগ্রাম বন্দরকে বাঁচাতে হলে কান্নাকাটি নয়, সাহসী সিদ্ধান্ত দরকার। কিছু পরামর্শ:
আধুনিক অপারেটর নিয়োগ: সিঙ্গাপুর বা দুবাইয়ের মতো অভিজ্ঞ অপারেটরদের এনে বন্দরের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
সিন্ডিকেট ভাঙা: সাইফ পাওয়ারটেকের মতো সিন্ডিকেটদের কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
প্রযুক্তি ও অবকাঠামো: আধুনিক ক্রেন, স্বয়ংক্রিয় সিস্টেম, আর বন্দরের ক্ষমতা বাড়াতে বিনিয়োগ দরকার।
স্বচ্ছ টেন্ডার: বন্দরের কাজে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে, যাতে দুর্নীতি কমে।
শেষ কথা
চট্টগ্রাম বন্দর আমাদের অর্থনীতির লাইফলাইন, কিন্তু এই লাইফলাইন এখন শ্বাসরোধের শিকার। সিন্ডিকেট আর দুর্নীতির জালে আটকে আমরা বিশ্বের দৌড়ে পিছিয়ে পড়ছি। এখন সময় ভয়কে জয় করে সাহসী পদক্ষেপ নেওয়ার।
বিদেশি অপারেটরদের আনা মানে দেশ বিক্রি নয়, বরং দেশকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরা। আসুন, মায়াকান্না ছেড়ে তথ্যভিত্তিক আলোচনায় ফিরে আসি। চোখ খুলে দেখি, অন্য দেশ কীভাবে দৌড়াচ্ছে।
চট্টগ্রাম বন্দরকে আধুনিক করতে পারলে বাংলাদেশের অর্থনীতি নতুন উচ্চতায় পৌঁছাবে। এটা কি আমাদের স্বপ্ন নয়? তাহলে এগিয়ে যাই, পিছিয়ে নয়!