27/09/2025
বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে ১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচন একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা। সেনাশাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ৯ বছরের স্বৈরশাসনের অবসানের পর এই নির্বাচনই ছিল বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক অভিযাত্রার আনুষ্ঠানিক প্রথম পদক্ষেপ। দুঃখজনক হলেও সত্য, আজকের তরুণ প্রজন্মা এই গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ঘটনা সম্পর্কে প্রায় অজ্ঞ। পাঠ্যপুস্তকে এর স্থান নেই, জাতীয় আলোচনাতেও এর অনুপস্থিতি লক্ষণীয়। অথচ এই একটি নির্বাচনই আমাদের শিখিয়েছে, রাজনীতি কেবল স্লোগানসর্বস্ব বা শক্তি প্রদর্শনের মঞ্চ
আওয়ামী লীগের পরাজয়ের মূল কারণগুলোর মধ্যে ছিল অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি, গণমাধ্যমে তাদের বিজয়ী মনোভাবের প্রকাশ, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রচারণায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে বিএনপি নিজেদের একটি সাধারণ, নির্ভরযোগ্য এবং 'বিকল্প' শক্তি হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল।
নয়; এটি জনগণের হৃদয়ের স্পন্দন অনুধাবনের এক সূক্ষ্ম, জটিল প্রক্রিয়া।
১৯৮২ সালে সামরিক প্রধান হিসেবে ক্ষমতা দখলের পর এরশাদ একটি ছদ্ম-গণতান্ত্রিক কাঠামো তৈরির চেষ্টা করেন। 'নির্বাচন', 'দল গঠন', 'সংবিধান সংশোধন'-সবই ছিল তাঁর ক্ষমতাকে বৈধতা দেওয়ার কৌশল মাত্র। তবে ১৯৮৭ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত দেশের ছাত্রসমাজ, পেশাজীবী সংগঠন এবং বিএনপি-আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন দুটি প্রধান রাজনৈতিক জোটের সম্মিলিত ও ধারাবাহিক আন্দোলনের মুখে তাঁর শাসনের ভিত নড়বড়ে হয়ে যায়। ফলস্বরূপ, ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ পদত্যাগে বাধ্য হন। এরপর প্রধান বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়, যা জনগণের মধ্যে সত্যিকারের গণতান্ত্রিক নির্বাচনের এক নতুন প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে। ওই নির্বাচনে সদ্য গণআন্দোলন থেকে বেরিয়ে আসা বিএনপি সাংগঠনিকভাবে কিছুটা দুর্বল ছিল। ৩০০ আসনে প্রার্থী খুঁজে বের করতে গিয়ে অনেক ক্ষেত্রে তাদের অরাজনৈতিক বা কম পরিচিত স্থানীয় ব্যক্তিদের মনোনয়ন দিতে হয়েছে। কিন্তু এই সাংগঠনিক
দুর্বলতাই তাদের মধ্যে এক ধরনের কৌশলগত নম্রতা ও জনসংযোগমুখী মানসিকতা তৈরি করে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ ছিল বিপুল আত্মবিশ্বাসে ভরপুর। এমনকি নির্বাচনের আগেই দলের ভেতরে মন্ত্রিসভার পদ বণ্টন নিয়ে আলোচনা এবং বিভিন্ন স্থানে বিজয় উৎসবের আয়োজন শুরু হয়ে গিয়েছিল। নির্বাচনের দিন দেশের জনগণ অভূতপূর্ব উৎসাহে ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হয়, রাতে একের পর এক আসনে বিএনপির বিজয় নিশ্চিত হতে থাকে। প্রাথমিকভাবে এটিকে 'অঘটন' মনে হলেও, দ্রুতই এটি একটি অকাট্য বাস্তবতায় রূপান্তরিত হয়। চূড়ান্ত ফলে বিএনপি ১৪০টি আসন পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, যেখানে আওয়ামী লীগ পায় মাত্র ৮৮টি আসন। এরশাদের জাতীয় পার্টি ও অন্যান্য দল বাকি আসনগুলো লাভ করে। আওয়ামী লীগের পরাজয়ের মূল কারণগুলোর মধ্যে ছিল অতিরিক্ত আত্মতুষ্টি, গণমাধ্যমে তাদের বিজয়ী মনোভাবের প্রকাশ, দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দল এবং প্রচারণায় অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস। অন্যদিকে বিএনপি নিজেদের একটি সাধারণ, নির্ভরযোগ্য এবং 'বিকল্প' শক্তি হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছিল। এই নির্বাচন সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দেয় যে, রাজনৈতিক ফল চূড়ান্তভাবে ঘোষিত না হওয়া পর্যন্ত কিছুই নিশ্চিত নয়। জনগণের মন বুঝতে না পারলে সব আয়োজন, ইতিহাস বা প্রচারণাই অর্থহীন হয়ে যেতে পারে। বর্তমান রাজনৈতিক দৃশ্যপটেও ১৯৯১ সালের নির্বাচনের শিক্ষা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিএনপি যেন ধরেই নিয়েছে যে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের অনুপস্থিতিতে স্বয়ংক্রিয়ভাবে তাদের বিজয়ের দরজা খুলে গেছে। তবে জনগণ কাকে ভোট দেবে, তা নির্ভর করে তাদের নিজস্ব বাস্তবতা, অভিজ্ঞতা এবং ভবিষ্যৎ নির্ভরতার আশার ওপর। সামাজিক মাধ্যমে জনপ্রিয়তা, বিশাল মিছিলের আয়োজন-দিন শেষে ভোটের মাঠে খুব বেশি প্রভাব ফেলবে না। গণতন্ত্রের মর্মার্থ এখানেই নিহিত-ক্ষমতা নেতার হাতে নয়, জনগণের হাতে। জনগণের মানসিক অবস্থা ও প্রকৃত চাহিদা অনুধাবন করতে ব্যর্থ হলে, যত বড় আন্দোলন, যত সুমহান ইতিহাস, যত সুসংগঠিত প্রচার বা মিডিয়া সমর্থনই থাকুক না কেন, তা বিজয়ের নিশ্চয়তা দিতে পারে না। আত্মবিশ্বাস ভালো, তবে তা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়, তাহলে তা কখনোই ভালো ফলাফল বয়ে আনে না।