11/10/2025
আগেকার দিনে গ্রামীণ মানুষের জীবন ছিল রীতি-নীতি, কৃষ্টি আর ঋতু অনুসারে চলমান। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে গড়ে উঠেছিল এক সহজ-সরল জীবনপ্রণালি—যেখানে ছিল আত্মীয়তার বন্ধন, পারস্পরিক সহমর্মিতা আর আন্তরিকতা। সুখে-দুঃখে সবাই মিলেমিশে থাকত, অল্পতেই তুষ্ট থাকতেন মানুষ।
সেই সময়ের পরিবারে নারীদের পর্দা করা ছিল সামাজিক নিয়ম। বিয়ের পর মেয়েদের চলাফেরায় আরও সংযম আসত। তারা যখন বাবার বাড়ি বা শ্বশুরবাড়ি যেতেন, রিকশায় বসার সময় চারপাশে সূতি শাড়ি বা বিছানার চাদর দিয়ে পেঁচিয়ে পর্দা করা হতো—যেন কেউ বউকে দেখতে না পায়। এভাবেই রিকশার ভেতরে স্বামী-স্ত্রী পাশাপাশি বসতেন। রিকশার পাদানিতে থাকত পিঠার ডেকচি বা ছোট একটা রঙিন ট্রাঙ্ক। কখনও পরিবারের ছোটরা রিকশার সামনের পাদানিতে বসত, আবার কেউ পেছনের ডাণ্ডায় দাঁড়িয়ে যাত্রা করত।
শ্বশুরবাড়ির লোকজন জামাইয়ের পছন্দের খাবার দিতে ব্যস্ত থাকত। পর্দার ভেতর থেকে বধূ বারবার উঁকি দিয়ে দেখার চেষ্টা করত, কতদূর এসেছে রিকশা। মুখে প্রশ্ন করত, “ডেরাইভার ভাই, নিশচিন্তপুর আর কতদূর?” আর রিকশাওয়ালা জবাব দিত, “এই তো আর ইকটু।” বউয়ের অধীর অপেক্ষা যেন আর থামত না—কখন যে প্রিয় বাবা-মায়ের মুখ দেখবে!
তখন গ্রামে রিকশা ছিল বিরল। সহজে পাওয়া যেত না। তাই রিকশা না পেলে সন্ধ্যার পর হারিকেন হাতে হেঁটে যাত্রা করত পরিবারের কেউ, মাথায় থাকত পিঠার ডেকচি। মেয়েকে পৌঁছে দিয়ে ফেরত আসত ছোট ভাই বা কাজের লোক। বাড়িতে ততক্ষণে উঠানে কুপি বাতি জ্বেলে অপেক্ষা করতেন স্বজনরা। আলো মুখের কাছে তুলে বলতেন, “কই গো কামালের বউ, বিয়ের সময় আসতে পারিনি, এখন দেখলাম!”
গ্রামীণ জীবনে তখন ছিল আন্তরিকতার বন্ধন। কারও দুঃখে, কারও আনন্দে সবাই একসঙ্গে থাকত। কিন্তু রিকশায় কাপড় পেঁচিয়ে পর্দা না দিলে তা ‘অশরাফি’ আচরণ হিসেবে গণ্য হতো। বলা হতো—“অমুকের বাড়ির আদব-লেহাজ নেই, বউ পর্দা করে না।” এমনকি পুকুরে বাড়ির বউ গোসল করাও ভালো চোখে দেখা হতো না।
সময়ের বিবর্তনে এখন আর রিকশায় কাপড় পেঁচিয়ে পর্দা দেওয়ার সেই দৃশ্য দেখা যায় না। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বদলে গেছে সমাজব্যবস্থা, জীবনধারা ও মূল্যবোধ। মুসলিম সমাজের সেই শালীন রীতি, আদব-লেহাজ আর লজ্জাশীলতার চল আজ হারিয়ে গেছে। পর্দা দেওয়া রিকশা এখন শুধুই স্মৃতির এক কোমল ছবি—যা বেঁচে আছে মধ্যবয়সিদের মনে নস্টালজিয়ার মতো।