17/04/2025
কীভাবে সরকার ও কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলো আমাদের নজরদারি করে — আর আপনি কীভাবে নিজেকে কিছুটা সুরক্ষিত রাখতে পারেন
আজকের ডিজিটাল যুগে মোবাইল ফোন, স্মার্ট ডিভাইস আর সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করা আমাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে। কিন্তু আপনি জানেন কি, এই প্রযুক্তিগুলোর মাধ্যমেই সরকার ও বড় বড় কোম্পানিগুলো আমাদের প্রতিদিনের জীবন, অভ্যাস, কথা-বার্তা এমনকি চিন্তাধারাও নজরদারি করছে?
চলুন দেখি, কীভাবে এই নজরদারির কাজগুলো হয়, কীভাবে তারা আমাদের আচরণ আগে থেকেই আন্দাজ করতে পারে — আর আপনি কীভাবে কিছু পদক্ষেপ নিয়ে নিজের প্রাইভেসি রক্ষা করতে পারেন।
---
১. স্মার্টফোন – সবচেয়ে বড় নজরদারি যন্ত্র
কীভাবে নজরদারি হয়:
আপনার ফোনের লোকেশন, অ্যাপ ব্যবহার, কল, মেসেজ এমনকি আপনি কী সার্চ করেন — সবকিছুই রেকর্ড হয়। এমনকি লোকেশন বন্ধ করলেও, ফোনের টাওয়ার, Wi-Fi আর সেন্সরের মাধ্যমে আপনার অবস্থান ট্র্যাক করা যায়।
উদাহরণ:
Google-এর AAID বা Apple-এর IDFA ব্যবহার করে কোম্পানিগুলো আপনার অ্যাপ ব্যবহার বিশ্লেষণ করে। সরকার চাইলে ফোনের তথ্য IMSI catcher বা "Stingray" দিয়ে হ্যাক করতে পারে।
ব্যবহারকারীর সংখ্যা:
বিশ্বে ৬.৬ বিলিয়নেরও বেশি মানুষ স্মার্টফোন ব্যবহার করছে, যারা প্রতিদিন বিপুল পরিমাণে তথ্য তৈরি করছে।
---
২. স্মার্ট হোম ডিভাইস – আপনার ঘরের কথাও বাইরে যাচ্ছে
কীভাবে নজরদারি হয়:
Alexa, Google Nest, স্মার্ট টিভির মতো ডিভাইসগুলো সব সময় শুনতে থাকে। শুধু "ওকে গুগল" বললেই নয় — তারা আগে থেকেই আপনার কথা শুনে রাখে এবং সেগুলো ক্লাউডে জমা হয়।
উদাহরণ:
Amazon-এর Alexa ভয়েস রেকর্ড রেখে দেয়। Vizio-এর মতো টিভি কোম্পানি দেখার ইতিহাস বিক্রি করে দেয় বিজ্ঞাপনদাতাদের কাছে।
ঝুঁকি:
এই ডিভাইসগুলো অনেক সময় হ্যাক করা সহজ, যার মানে হলো, আপনার ব্যক্তিগত তথ্য চুরি হয়ে যেতে পারে।
---
৩. সোশ্যাল মিডিয়া – আপনি যা পছন্দ করেন, তা দিয়েই আপনার চরিত্র আঁকা হয়
কীভাবে নজরদারি হয়:
আপনি ফেসবুকে কী পোস্ট করেন, কীতে লাইক দেন, কতক্ষণ কোন পোস্টে সময় দেন — এগুলো দিয়ে একটি 'সাইকোলজিকাল প্রোফাইল' তৈরি হয়।
উদাহরণ:
TikTok আপনার ভিডিও দেখা সময় বিশ্লেষণ করে বোঝে আপনি কী পছন্দ করেন। Facebook Pixel ব্যবহার করে আপনি কোন ওয়েবসাইটে যান তাও ট্র্যাক করে।
সরকারি নজরদারি:
NSA-এর PRISM প্রোগ্রামের মাধ্যমে সরকার সোশ্যাল মিডিয়ার তথ্য সংগ্রহ করতে পারে।
---
৪. কার্ড ট্রানজেকশন – আপনি কী কিনলেন, কবে কিনলেন, তাও নজরে
কীভাবে নজরদারি হয়:
আপনার কার্ড দিয়ে কেনাকাটা, সময়, দোকান – সব তথ্য লিপিবদ্ধ হয়। ব্যাংক ও থার্ড পার্টি এই ডেটা বিশ্লেষণ করে লাইফস্টাইল বুঝে ফেলে।
উদাহরণ:
Amex দেখে আপনি কোথায় খাচ্ছেন, কতটা ভ্রমণ করছেন — এসব থেকে আপনার জীবনযাত্রা বোঝে। আইনগতভাবে সরকারও এগুলো চাইলে দেখে নিতে পারে।
---
৫. ফেসিয়াল রিকগনিশন – আপনার মুখই আপনার পরিচয়
কীভাবে নজরদারি হয়:
এয়ারপোর্ট, শপিং মল, সিসি ক্যামেরায় AI আপনার মুখ চিনে নেয়। ফোনের ফেস আইডিও এই সিস্টেমে যুক্ত হতে পারে।
উদাহরণ:
চীনের সামাজিক ক্রেডিট সিস্টেম রিয়েল টাইমে মানুষ নজরদারি করে। মার্কিন কোম্পানি Clearview AI ফেসবুক-ইনস্টাগ্রামের ছবি ব্যবহার করে পুলিশকে তথ্য দেয়।
---
কোম্পানিগুলো কীভাবে আপনার ভবিষ্যৎ আচরণ আগেভাগে জানে?
Behavior Modeling: আগে কী কিনেছেন, কী দেখেছেন — এসব বিশ্লেষণ করে ভবিষ্যতে কী কিনবেন, তা আন্দাজ করে।
Sentiment Analysis: আপনার পোস্ট বা কমেন্ট দেখে আপনার মনের অবস্থা বোঝে।
Psychographic Profiling: আপনি কীভাবে চিন্তা করেন, সেটাও অনুমান করা যায়।
Real-Time Bidding: আপনি কী দেখতে পারেন, সেটা বিজ্ঞাপনদাতারা আগেই কিনে নেয় কয়েক মিলিসেকেন্ডের মধ্যে।
---
কীভাবে আপনি কিছুটা নিরাপদ থাকতে পারেন (ডিজিটাল জগতে থেকেও)
মোবাইল ফোন:
অপ্রয়োজনীয় অ্যাপের লোকেশন বন্ধ রাখুন।
Pixel ফোনে GrapheneOS বা CalyxOS ব্যবহার করুন।
শুধু প্রয়োজনীয় পারমিশন দিন।
VPN ব্যবহার করুন (Mullvad, ProtonVPN)।
TrackerControl-এর মতো অ্যাপ দিয়ে ট্র্যাকার বন্ধ রাখুন।
স্মার্ট হোম ডিভাইস:
না ব্যবহার করলে বন্ধ বা mute করুন।
আলাদা Wi-Fi নেটওয়ার্কে এসব ডিভাইস চালান।
Home Assistant-এর মতো প্রাইভেসি-ফোকাসড সফটওয়্যার ব্যবহার করুন।
সোশ্যাল মিডিয়া:
ব্যক্তিগত তথ্য কম শেয়ার করুন।
ad personalization বন্ধ করুন।
uBlock Origin, Privacy Badger, ClearURLs ব্যবহার করুন।
Signal বা Session-এর মতো এনক্রিপ্টেড চ্যাট অ্যাপ ব্যবহার করুন।
লেনদেন:
গোপন কেনাকাটায় নগদ টাকা বা প্রিপেইড কার্ড ব্যবহার করুন।
লয়ালটি প্রোগ্রাম এড়িয়ে চলুন।
Privacy.com দিয়ে ভার্চুয়াল কার্ড ব্যবহার করুন।
ফেসিয়াল রিকগনিশন:
ব্যক্তিগত ছবি শেয়ার করার আগে ফেইস ব্লার করুন।
প্রয়োজন না হলে ফেসিয়াল আনলক ব্যবহার না করাই ভালো।
লোকাল আইন ও আন্দোলনে অংশ নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলুন।
সাধারণ প্রাইভেসি টিপস:
নিয়মিত cookies, cache ক্লিয়ার করুন।
DeleteMe-এর মতো সার্ভিস দিয়ে ডেটা ব্রোকার থেকে নিজের তথ্য সরান।
GDPR বা CCPA-এর অধীনে কোম্পানিকে বলুন আপনার তথ্য মুছে ফেলতে।
Cloudflare বা Quad9-এর মতো এনক্রিপ্টেড DNS ব্যবহার করুন।
শেষ কথা:
সম্পূর্ণ নজরদারি এড়ানো হয়তো সম্ভব না, কিন্তু কিছু জিনিস জানতে পারলে এবং অভ্যাসে আনলে, আপনি নিজের তথ্য কিছুটা হলেও বাঁচাতে পারবেন। আপনি যদি আরও জানতে চান, কোনো টুল ব্যবহার করতে চান বা বাংলাদেশে প্রযোজ্য আইন ও পলিসি নিয়ে জানতে চান — আমি পাশে আছি।
প্রাইভেসি আপনার অধিকার। সচেতন থাকুন, সুরক্ষিত থাকুন।
Protect your payment security. Shield your financial information and protect against credit and debit card fraud with secure, randomly-generated virtual card numbers.