12/06/2025
গেমটা বদলে দিল যে কোম্পানি
বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে দামি কোম্পানির নাম শুনলে হয়তো অনেকে ভাববেন—মাইক্রোসফট, অ্যাপল, বা অ্যামাজন? না, এখন সেই জায়গা দখল করে নিয়েছে NVIDIA।
এটা শুধু একটা তথ্য না—এটা একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকেত। সময় বদলাচ্ছে, প্রযুক্তির চরিত্র বদলাচ্ছে, আর তার প্রতিচ্ছবি NVIDIA।
NVIDIA: শুরু গেমিং দিয়ে, এখন AI এর রাজা
নব্বইয়ের দশকের শেষ দিকে বা দুই হাজার সালের আশেপাশে, NVIDIA এর কাজ ছিল মূলত গ্রাফিক্স কার্ড তৈরি করা—যেটা গেম খেলতে দরকার হতো। তখনকার দুনিয়ায় ওটাই ছিল তাদের চাবিকাঠি।
কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তারা একটা বিশাল সুযোগ দেখতে পায়: AI বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। AI মডেলগুলোকে ট্রেইন করার জন্য যে ধরণের চিপ দরকার, NVIDIA সেটা ডিজাইন করতে পারবে—এই উপলব্ধি তাদের পুরো দিক বদলে দেয়। ধীরে ধীরে গেমিং-এর বাইরে বের হয়ে, তারা হয়ে ওঠে AI-এর জন্য চিপ ডিজাইন করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কোম্পানি।
আজকে NVIDIA মূলত AI-এর জন্য চিপ বানায় (মানে ডিজাইন করে)। তবে, এখানে একটা চমক আছে—এরা নিজেরা চিপ বানায় না!
চিপ ডিজাইন করে NVIDIA, কিন্তু বানায় TSMC
NVIDIA চিপ ডিজাইন করে, আর সেই ডিজাইন বাস্তবে রূপ দেয় Taiwan Semiconductor Manufacturing Company (TSMC)। তাইওয়ানের এই কোম্পানিটি এখন বিশ্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর একটি। কারণ?
সেমিকন্ডাক্টর।
আপনার ঘড়ি, আমার ফোন, আমাদের চারপাশের কম্পিউটার থেকে শুরু করে ড্রোন, রকেট—সবকিছুতেই লাগে সেমিকন্ডাক্টর। আর এগুলোর একটা বড় অংশ বানায় TSMC।
TSMC: বিশ্বশক্তির কেন্দ্রে তাইওয়ান
TSMC এর শুরুটা হয় এক প্রবাসী তাইওয়ানিজ—ড. মরিস চ্যাং–এর হাত ধরে। তিনি টেক্সাসে কাজ করতেন, বুঝলেন, কম খরচে বড় স্কেলে চিপ বানানোর জন্য তাইওয়ানই পারফেক্ট জায়গা। তাই দেশে ফিরে এসে তৈরি করলেন TSMC। আর তাইওয়ান সরকার এটাকে শুধু বিজনেস হিসেবে না, বরং জাতীয় নিরাপত্তার অংশ হিসেবে দেখলো।
আজকে তাইওয়ান বিশ্বের সেমিকন্ডাক্টর প্রোডাকশনের হটস্পট। TSMC এমন প্রযুক্তি তৈরি করে, যেটা এখনো কেউ ঠিকমতো নকল করতে পারেনি। তাদের দক্ষতা, স্কেল আর এক্সপার্টিজ এক কথায় অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
ASML: যে মেশিন ছাড়া চিপ বানানোই অসম্ভব
তবে TSMC-ও পুরোপুরি স্বাধীন না। অত্যাধুনিক চিপ বানাতে যে লিথোগ্রাফি মেশিন লাগে, তা তৈরি করে একটি ডাচ কোম্পানি—ASML। এই মেশিন ছাড়া 5nm বা তার নিচের লেভেলের চিপ বানানোই সম্ভব না।
ট্রাম্পের চাল এবং চীনের রুদ্ধশ্বাস
ডোনাল্ড ট্রাম্প বুঝেছিলেন—আগামী বিশ্ব নেতৃত্ব নির্ধারিত হবে AI দিয়ে। আর AI নির্ভরশীল চিপ-এর উপর। তাই তিনি শুধু নিজের দেশের AI উন্নয়নে নজর দেননি, বরং এমনভাবে কৌশল খাটিয়েছেন যাতে চীন যেন এই রেসে এগিয়ে যেতে না পারে।
তিনি ASML-এর ওপর চাপ দেন যেন তারা চীনের সঙ্গে সেই মেশিনগুলো শেয়ার না করে। একইভাবে NVIDIA, AMD-সহ বড় বড় কোম্পানিগুলোর ওপরও বিধিনিষেধ জারি করেন—তারা যেন চীনে 7nm-এর নিচে কোনো চিপ সরবরাহ না করে।
ফলাফল? চীনের AI শিল্প এক প্রকার হোঁচট খেলো। তাদের হাতে আছে টাকা, দক্ষ জনবল—কিন্তু যুদ্ধে নামার জন্য প্রয়োজনীয় অস্ত্র নেই।
চীন নিজের মতো করে এই সক্ষমতা তৈরি করার চেষ্টা করছে বটে, তবে সেটা সময়সাপেক্ষ। অন্যদিকে আমেরিকা, জাপান চেষ্টা করছে নিজ দেশে TSMC-এর মতো কারখানা বসাতে। কিন্তু সহজ কথা—TSMC-এর লেভেল ছোঁয়া এত সহজ না।
TSMC: তাইওয়ানের ‘ইন্স্যুরেন্স পলিসি’
TSMC কেবল একটা কোম্পানি না—তাইওয়ানের জীবনবীমা। চীন যদি কখনও তাইওয়ান আক্রমণ করে, তাহলে আমেরিকা বাধ্য হবে প্রতিরক্ষা দিতে। কারণ আমেরিকার জাতীয় নিরাপত্তাও এখন অনেকটাই নির্ভর করে TSMC-এর উপর।
তবে তাইওয়ান কি চায় যে এই TSMC-এর কারখানাগুলো আমেরিকায় চলে যাক? সেটা হলে তো আমেরিকার এই সাপোর্ট অনেকটাই কমে যেতে পারে!
ইতিহাস বলে, যেখানে স্বার্থ ফুরায়, সেখানেই বন্ধুত্বের গ্যারান্টি থাকে না।
দক্ষিণ চীন সাগর, তাইওয়ান, আরাকান – একটা গেমের অনেক চাল
এই পুরো প্রসঙ্গের সাথে জড়িয়ে আছে দক্ষিণ চীন সাগর, যেখানে শক্তির লড়াই আরও তীব্র হচ্ছে। তাইওয়ান শুধু ভূ-রাজনীতির প্রশ্ন না—এটা ভবিষ্যতের প্রযুক্তি যুদ্ধের কেন্দ্রবিন্দু।
আর এই যুদ্ধে কার হাতে থাকবে সেমিকন্ডাক্টরের নিয়ন্ত্রণ—সেটাই ঠিক করবে আগামী পৃথিবীর নেতৃত্ব কার হাতে।