04/06/2025
বৌদ্ধ সংস্কৃতিতে বাংলা–ভারত ও চিন/তিব্বতের বিনিময়
অতীশা দীপঙ্কর
অতীশা দীপঙ্কর শ্রীজ্ঞান ছিলেন প্রাচ্যবঙ্গ (আধুনিক বাংলাদেশ) অঞ্চলের বৌদ্ধ পণ্ডিত। তিনি বিক্রমশীলা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন এবং ১০৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতে গমন করেন। তিব্বতে অতীশা তুলনারহীন ভূমিকা রাখেন তাকে তিব্বতে পদান্ত বৌদ্ধধর্মের মূলস্রোতের পুনরুজ্জীবক বলা হয়। তিনি কাদম্ব (কদম) বৌদ্ধধর্মের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে সম্মানিত।
অতীশার প্রবচন ও গ্রন্থগুলি তিব্বতে আজও অধ্যয়ন করা হয়। এভাবে অতীশার ভারত ও তিব্বতের মধ্যে সরাসরি ধর্ম ও সাংস্কৃতিক সেতুবন্ধন গড়ে ওঠে....
অতীশ নিজে চীনে যাননি, তবে তাঁর রচনাগুলি ও চিন্তাধারা চীনা বৌদ্ধ পণ্ডিতদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ে। আবার চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং তাঁর পূর্বসূরি যুগে ভারত সফর করে যা চীন ও বাংলার মধ্যকার বৌদ্ধ সংযোগের প্রমাণ দেয়।
ধর্মপাল
পাল রাজবংশের ধর্মপাল সম্রাট বৌদ্ধ ধর্মের নিবেদিত অনুপ্রেরক ছিলেন। তিনি ষষ্ঠ-সপ্তম শতাব্দীতে নালন্দার পাশাপাশি বিক্রমশীলা মহাবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। বিক্রমশীলা ছিল তৎকালীন ভারতের অন্যতম প্রধান বৌদ্ধ মহাবিদ্যালয়, যেখানে শতাধিক শিক্ষকের তত্ত্বাবধানে হাজারাধিক ছাত্র পড়াশোনা করত। এর ফলে বঙ্গপালের এই কেন্দ্র থেকেই প্রমুখ পণ্ডিত তিব্বতে পাঠানো হয়। তাই ধর্মপালের প্রতিষ্ঠিত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতীয় বৌদ্ধসংস্কৃতি পরবর্তীতে চীনে ও তিব্বেতে বিস্তৃত হতে সহায়তা করে।
শীলভদ্র
শীলভদ্র ছিলেন সপ্তম শতাব্দীর নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের জ্যেষ্ঠ পণ্ডিত।
কিছু তথ্য মতে তিনি প্রাচীন সমতট রাজ্য বর্তমানে কুমিল্লার চান্দিনা উপজেলা থেকে ছিলেন ... তাঁর শিষ্য ছিলেন চীনা ভিক্ষু হিয়েন সাং।
হিয়েন সাং যখন ভারত গমন করেন, তখন তাঁকে নালন্দার সিনিয়র পণ্ডিত হিসেবে শীলভদ্রই আদর সহকারে অভ্যর্থনা জানান এবং তিন বছর শেখান। ফলত শীলভদ্রের মাধ্যমে ভারতের যোগাচারা দর্শন ও মহায়ান বৌদ্ধ শিক্ষা হিয়েন সাং-এর মাধ্যমে পূর্ব এশিয়ায় পৌঁছায়
কমলশীল
কমলশীল ছিলেন সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর একজন বিশিষ্ট ভারতীয় বৌদ্ধ পণ্ডিত। ৭৯২–৭৯৪ খ্রিষ্টাব্দে তিব্বতের সাম্যে (Samyé) বিহারে ভারতের পক্ষের শিক্ষক হিসেবে তিনি আমন্ত্রণ পান। এখানে একজন চীনা চ্যান (ধ্যান) পণ্ডিতের বিপরীতে কমলশীল ধীরোদ্ধার (মধ্য পথ) মাধ্যামিকা দর্শন উপস্থাপন করেন, দীর্ঘ অধ্যয়ন ও অনুশীলনের মাধ্যমে তপোবোধ অর্জনের পক্ষে যুক্তি দেন। শেষমেশ তিব্বতের রাজা ভারতের এই মাধ্যামিকা দৃষ্টিভঙ্গি সমর্থন করেন। এ বিতর্কে কমলশীলের অবদান ছিল ভারতীয় বৌদ্ধধর্মের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ ও নীতির মাধ্যমে তিব্বত এবং চীনের মধ্যে চিন্তার প্রভাব বিনিময়।
বজ্রবোধি
বজ্রবোধি ছিলেন ৭ম শতাব্দীর ভারতীয় বৌদ্ধ তান্ত্রিক পণ্ডিত, যিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন করেন ও পরে চীনের তাং রাজবংশে ধর্মশিক্ষক হন।
বেশিরভাগ বিবরণ অনুসারে, বজ্রবোধি দক্ষিণ ভারতের একটি তামিল পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাবা কাঞ্চিপুরমের একজন রাজকীয় পুরোহিত এবং স্থপতি ছিলেন বলে জানা গেছে।
তিনি ও তার শিষ্য অমোঘবোধর ৮ম শতাব্দীতে ভারতীয় তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্ম চীনে পরিচয় করান। এর ফলে সে সময়কার চীনের মহাযান বৌদ্ধধর্মে শিল্পীর সঙ্গে উন্নত তান্ত্রিক পাঠ এবং নতুন বাণীতত্ত্ব ছড়িয়ে পড়ে।
সিল্ক রোড ইতিহাসে তাঁদের অবদানের কারণে বজ্রবোধিকে বাংলা থেকে পূর্ব চীনে বৌদ্ধ তত্ত্বজ্ঞান বহনকারী হিসেবে বর্ণনা করা হয়েছ।
অভয়াকরগুপ্ত
তিনি ছিলেন একজন তান্ত্রিক গুরু ও বিক্রমশীলার অধ্যক্ষ।
আভয়করগুপ্তের মহান গ্রন্থ, বজ্রাবলী, হল তান্ত্রিক উপাসনার একটি মহান সংশ্লেষণ যা একটি একীভূত তান্ত্রিক অনুষ্ঠান পদ্ধতি তৈরি করেছিল যা সমস্ত তান্ত্রিক বৌদ্ধ মণ্ডলে প্রয়োগ করা যেতে পারে।
কিছু তিব্বতি সূত্র তার জন্মস্থান জারিখণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে, যা তারানাথ ওড়িশার পাশে রেখেছেন।
সুভূতিচন্দ্র
তিনি ছিলেন একজন ব্যাকরণবিদ ও কবি। তাঁর রচিত Kavikāmadhenu গ্রন্থটি সংস্কৃত অভিধান Amarakośa-র উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য। তাঁর কাজ ভারত, তিব্বত, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় প্রভাব বিস্তার করেছে।
হরিভদ্র
তিনি ছিলেন পাল সম্রাট ধর্মপালের উপাধ্যায় এবং বিক্রমশীলার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর রচিত Ālokā গ্রন্থটি Abhisamayālaṅkāra-র উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষ্য, যা তিব্বতে ব্যাপকভাবে অনূদিত হয়েছে
বুদ্ধজ্ঞানপাদ
তিনি ছিলেন বিক্রমশীলার প্রথম অধ্যক্ষ এবং হরিভদ্রের শিষ্য। তিনি Guhyasamāja Ta**ra প্রচারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
মৈত্রিপদ
মৈত্রিপদ ছিলেন ১১শ শতকের একজন প্রখ্যাত বৌদ্ধ পণ্ডিত ও সিদ্ধাচার্য, যিনি পাল রাজবংশের শাসনামলে (প্রায় ১০০৭–১০৮৫ খ্রিষ্টাব্দ) জন্মগ্রহণ করেন। তিনি মগধ অঞ্চলের (বর্তমান বিহার) কাপিলাবস্তুর নিকটে একটি ব্রাহ্মণ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন।
যিনি তান্ত্রিক বৌদ্ধধর্মের মহামুদ্রা সম্প্রচারের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাঁর শিক্ষক ছিলেন শবরিপ এবং নরোপ। তাঁর ছাত্রদের মধ্যে রয়েছে অতীশ, মারপা, বজ্রপাণি, করোপ, নাটেকর (সহজবজ্র নামেও পরিচিত), দেবাকরচন্দ্র (শূন্যতাসমাধি নামেও পরিচিত), এবং রামপাল।
Teachings of Buddha X তথাগতময় ইতিহাস