
08/08/2025
Gautam Mitra :রোগক্লান্ত জীবনের শেষ নববর্ষ। ততক্ষণে হাতে হাতে বিলি হয়ে গেছে জন্মোৎসবের ভাষণ 'সভ্যতার সংকট' পুস্তিকাটি।
রবীন্দ্রনাথ তো আর যাপন ও লিখনকে আলাদা করে দেখেননি কখনও! শরীর দিয়ে সত্তা দিয়ে অস্তিত্ব দিয়ে তাঁর একেকটি লেখা নির্মাণ করেছেন।
কী ছিল 'সভ্যতার সংকট' নিবন্ধটিতে!
ছিল আশাভঙ্গের কথা। আলগা হয়ে যাওয়া সম্পর্কের কথা। মানবতাবোধ থেকে বিচ্যুতির কথা। কারণ তিনি বুঝেছিলেন:
'...আমার জীবনের এবং সমস্ত দেশের মনোবৃত্তির পরিণতি দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। সেই বিচ্ছিন্নতার মধ্যে গভীর দুঃখের কারণ আছে।'
অনুভব করেছিলেন:
'...য়ুরোপে বর্বরতা কিরকম নখদন্ত বিকাশ করে বিভীষিকা বিস্তার করতে উদ্যত।এই মানবপীড়নের মহামারী পাশ্চাত্য সভ্যতার মজ্জার ভিতর থেকে জাগ্রত হয়ে উঠে আজ মানবত্মার অপমানে দিগন্ত থেকে দিগন্ত পর্যন্ত বাতাস কুলষিত করে দিয়েছে।'
আমরা জানি এই অভিভাষণটি সেই ১লা বৈশাখ ১৩৪৮-এর সভায় ক্ষিতিমোহন সেন পাঠ করেছিলেন।কিন্তু আমরা যা জানি না তা কিছু দিন আগে একজনের কাছ থেকে শুনলাম।যাঁর কাছে শুনলাম তিনি তখন বালক। সেই সভার দর্শকাসনে সেই বালকটিও ছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ নাকি নিজেই ভাষণটি পড়া শুরু করেছিলেন।কিন্তু পড়তে পড়তে এতটাই উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে অসুস্থবোধ করছিলেন।তখন ক্ষিতিমোহন সেন উঠে এসে রচনাটির পাঠ সম্পূর্ণ করেন।
কখন এমন হয়? যখন ভাবনা ও লেখার আর কোনও আলাদা অস্তিত্ব থাকে না।একটি বিন্দুতে তারা মিলে যায়।শরীরের ভাঙন রবীন্দ্রনাথের কাছে বড়ো নয়, মনেও তো তার ভাঙন ধরেছে বারবার।রবীন্দ্রনাথের কাছে ১৯৪১-এর দিনগুলোতে বড়ো হয়ে দেখা দিল সভ্যতার ভাঙন।এই বিপর্যয় হয়তো রবীন্দ্রনাথকে দ্রুত অসুস্থতার দিকে নিয়ে গেল।
উল্টোদিকে একটা আশ্রয় খুঁজছিলেন রবীন্দ্রনাথ ।সেদিনের গাওয়া গানটিতে যেন সেই আশ্রয়েরই আভাস:
'ওই মহামানব আসে,
দিকে দিকে রোমাঞ্চ লাগে
মর্তধূলির ঘাসে ঘাসে।'
এরপর, ১ লা বৈশাখ থেকে ২২ শ্রাবণ অবধি, কবিতা লিখবেন মাত্র ৯টি।সেই ৯ টি কবিতায় শুধু জীবনমোচনের কথা!মোহমুক্তির কথা।ছলনাভঙ্গের কথা।
জীবনের প্রথম গ্রন্থ থেকে যা লেখা হল তা 'মুছে ফেলে বর্ণ তার রেখা তার উদাসীন চিত্রকর কালো কালি দিয়ে।' উপলব্ধি করলেন,'সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম।' বা 'এই হার-জিত খেলা, জীবনের মিথ্যা এ কুহক,... দুঃখের পরিহাসে ভরা।'
চিঠিতে লিখবেন:
'...স্বৈরাচার আমাকে পেয়ে বসেছে।কিন্তু স্বৈরাচারের অন্তর্নিহিত যে নিয়ম তাকে ভিতরে ভিতরে চালনা করে, সে আমার কাছে অত্যন্ত গোপন আছে।'
আর জীবনের শেষ কবিতার সেই মন্ত্রপ্রতিম উচ্চারণ:
'তোমার সৃষ্টির পথ রেখেছ আকীর্ণ করি
বিচিত্র ছলনাজালে,
হে ছলনাময়ী।'
আসলে দীপশিখা যখন ফুরিয়ে যায় তখন তা শেষবারের মতো দপ করে জ্বলে ওঠে।এই সময় রবীন্দ্রনাথের সেই প্রজ্জ্বলিত সময়।বুদ্ধদেব বসুর যাকে মনে হবে 'বর্ণাঢ্য গীতিনিঃস্বন'!
আসলে রবীন্দ্রনাথ তো কোনও মানুষের নাম নয়, রবীন্দ্রনাথ একটি যুগের নাম, একটি চেতনার নাম, বাঙালির অণু-পরমাণুতে অনুরণনের নাম।
২৫ শে বৈশাখ থেকে ২২ শে শ্রাবণের দূরত্ব মাত্র চারমাসের নয়, বাংলার জন্য তা আলোকবর্ষ।
আজ সেই ২২শে শ্রাবণ!