02/06/2023
ইসলামি ব্যাংকিংঃ ঘুরিয়ে খাওয়া!!!?
বাবু যামিনী কান্ত রায় ছিলেন আমাদের স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি আর আমার বাবা প্রধান শিক্ষক। একজনের ধবধবে সাদা চুল আরেকজনের সাদাকাচা দাড়ি। দুজনেই বেশ ধর্ম পরায়ণ। আব্বু যখন সোনারহাট মসজিদে কোরানের দারস দিতেন যামিনী বাবু আব্বুর পাশে বসে শুনতেন।
একটি উপলক্ষে যামিনী বাবু তার নিজ বাড়িতে দাওয়াতের আয়োজন করলেন যেখানে মুসলিম অমুসলিম উভয়েই অংশ নিবেন। দুজনের পরামর্শ অনুযায়ী মুসলিমদের জন্য পশুগুলো ইসলামি রীতি অনুযায়ী জবেহ এবং হিন্দুদের জন্য তাদের রীতি শতভাগ মেনে দেবতার নামে বলি দেয়া হয়। আলাদা রান্না শেষে একই টেবিলে দুটি আলাদা পাত্রে পরিবেশন করা হয়।
পরিবেশনার দায়িত্বে থাকা আমার ক্ষুদ্র মনে সেদিন প্রশ্ন জেগেছিল what is difference between...? এই দুটি মাংসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্যটা আসলে কোথায়? দেখতে তো একই! রং,স্বাদ ও গন্ধে আলাদা কিছু নয়.....
ঠিক এখানেই ইসলামি ব্যাংকিং ও প্রচলিত ব্যংকিং এর মুল পার্থক্যটা লুকায়িত।
দেখতে ও খেতে একই কিন্তু জবেহের পদ্ধতিগত কারনে মুসলিমদের জন্য একটি মাংস হালাল হলেও আরেকটি নয়।
ধরুন একটি মোটরসাইকেল কেনার জন্য ১০০,০০০/- টাকা প্রয়োজন। প্রচলিত ব্যাংক ১০০,০০০/ টাকার সাথে ১০ হাজার সুদ যোগ করবে। আপনাকে নির্দিষ্ট মেয়াদে ১১০,০০০/- পরিশোধ করতে হবে।
শরীয়াহ ব্যাংকে গেলেন ব্যাংক বলবে আমরা নগদ টাকা দেইনা পণ্য বিক্রি করি। সেক্ষেত্রে ব্যাংক ১০০,০০০/- টাকায় মোটরসাইকেল কিনে আপনার নিকট ১১০,০০০/- টাকায় বিক্রি করবে।
what is difference between...? এই দুই অতিরিক্ত ১০,০০০/- এর মধ্যে পার্থক্য কি?
দুই মাংসের মধ্যে পার্থক্য খুজে না পাওয়া ব্যাক্তি এই দুই ১০,০০০/- মধ্যেও কোন পার্থক্য খুঁজে পাবে না।
এখানে একটি সুদ আরেকটি বিজনেস।
ইসলামি ব্যাংকিং ভাষায় এটাকে বলে মুরাবাহা। এ পদ্ধতিতে গ্রাহকের অর্ডারকৃত পণ্য কিনে তা বেশি দামে বিক্রি করে মুনাফা অর্জন করে যা শরিয়াহসম্মত।’
এখানে পরস্পর রাজি হয়ে ক্রয়বিক্রয় করেছে। এটা জায়েজ। সুরা নিসার ২৯ নং আয়াতে বলা হয়েছে "পরস্পর রাজি হয়ে ব্যবসা করা বৈধ।’
আবার অর্থনীতির ভাষায় এখানে বাজার ভারসাম্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। চাহিদা ও যোগান রেখা ১১০,০০০/- টাকার বিন্দুতে ক্রস করেছে। যেখানে উভয়ের স্বার্থ রক্ষা পেয়েছে। ক্রেতা বাকিতে পন্য পেয়েছে। বিক্রেতা ১০,০০০/- টাকা লাভ করেছে।
ধরুন আপনি ১ কোটি দামের একটি ফ্ল্যাট কিনতে লোনের জন্য প্রচলিত ব্যাংকে গেলেন। আপনার ৩০ লাখ আছে, ব্যাংক থেকে নিলেন ৭০ লাখ। ফ্ল্যাটটি কেনার পর ভাড়া দিবেন নাকি ফেলে রাখবেন এ ব্যাপারে ব্যাংকের কিছু আসে যায় না। সুদ আসল মিলে ১৫/২০ বছর মেয়াদে কিস্তিতে টাকা পরিশোধ করলে ব্যাংক ফ্ল্যাটটির মালিকানা বুঝিয়ে দিবে।
ইসলামি ব্যাংকে গেলেন ব্যাংক বলবে আমরা টাকার বিজনেস করিনা বরং যৌথ মালিকানায় বিজনেস করি। আপনি ৩০ লাখ দিবেন ব্যাংক দিবে ৭০ লাখ।
ফ্ল্যাটটির মালিকানা আপনার ৩০%, আর বাকি ৭০% মালিকানা ব্যাংকের।
ধরুন ফ্ল্যাটটির মাসিক ভাড়া হবে ৪০,০০০ টাকা। এই ভাড়ার টাকা মালিকানা রেশিও অনুযায়ী আপনি পাবেন ৩০% মানে ১২,০০০/- আর ব্যাংক পাবে ৭০% মানে ২৮,০০০/-।
আর এর সাথে প্রতি মাসে ব্যাংকের অংশের ৭০ লাখের কিছু টাকা শোধ করবেন। এভাবে ক্রমান্বয়ে আপনার মালিকানার অনুপাত বাড়বে এবং ব্যাংকের মালিকানা কমবে ফলে ব্যাংকের প্রদেয় ভাড়ার পরিমাণও কমতে থাকবে। যেমন ১ ম মাসে ব্যাংক ভাড়া পাবে-২৮,০০০/- ২য় মাসে-২৭,৯০০/-.....এক সময় ব্যাংকের কোন মালিকানা থাকবে না পুরোটাই আপনার হবে।
এটাকে ইসলামি ব্যাংকিং ভাষায় মুশারাকা বলে। অংশীদারের ভিত্তিতে ব্যবসা। মুশরাকা হলো ইসলামী অর্থনীতির প্রাণ।
এখানে ইসলামি ব্যাংক ২০ বছরে মুল টাকা+বাড়ি ভাড়া বাবদ প্রায় ৫৯ বা ৬০ লাখ টাকা আয় করবে।
সুদি ব্যাংকও মুল টাকার সাথে সুদ বাবদ অন্তত ৬০ লাখ টাকা ইনকাম করবে...
এই দুই কমবেশি ৬০ লাখের মধ্যে পার্থক্য কি? ফলাফল তো একই.....একটি ব্যাংক "বাড়ি ভাড়া বাবদ" শব্দটা ব্যবহার করেছে,আদায় করেছে আরেকটি ব্যাংক ব্যবহার করেছে "সুদ"
পার্থক্য হলো এই-
চলার পথে একটা মেয়েকে পছন্দ করে জনসমক্ষে তার বাবাকে বললেন গেট টুগেদারের জন্য আপনার মেয়েকে আমার কাছে সোপর্দ করুন বিনিময়ে ৩০০,০০০/- টাকা দিবো। বাবা রাজি হলে উভয়ের জন্য এটা চরম অবৈধ।
অন্যভাবে তার বাবাকে বললেন আপনার মেয়েকে আমার সাথে বিবাহ দিন মোহরানা বাবদ ৩০০,০০০/- টাকা ধার্য্য করলাম। রাজি হলে উভয়ের জন্য এটা বৈধ।
উভয় ক্ষেত্রেই মেয়েটাকে কাছে পাওয়ার ফাংশন।
অর্থাৎ ফলাফল একই এবং অভিন্ন। কিন্তু একটি বৈধ আরেকটি চরম অবৈধ।
পার্থক্য হলো একটিতে বিবাহ ও মোহরানা শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে আরেকটিতে অবৈধ গেট টুগেদার।
শরিয়ার জ্ঞান না থাকলে অনূভিক্ষন যন্ত্র দিয়েও যেমন দুটি মাংসের মধ্যে কোন পার্থক্য খুঁজে পাওয়া যায়না ঠিক তেমনি দুটি ব্যাংকের মধ্যে পার্থক্য চোখে পরে না।
একটি প্রশ্ন করতেই পারেন দাওয়াতের পশুগুলো ইসলামী রীতি অনুযায়ী জবেহ করা হয়েছিল কিনা?? এ দায়িত্ব দাওয়াত ব্যাবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের। এর জন্য যেমন আপনি দায়ী নন ঠিক তেমনি ইসলামী ব্যাংকগুলি শরিয়াহ ভিত্তিক চলছে কিনা এটা দেখভালের দায়িত্ব পুরোটাই সুপার ভাইজার কমিটির বা শরিয়াহ বোর্ডের। এর জন্য আপনি দায়ি না।
ইসলামি ব্যাংকগুলি ছাড়াও অনেকগুলি ব্যাংক ইসলামি উইন্ডো খুলেছে প্রতিটিরই শরীয়াহ বোর্ড আছে। আমার কর্মরত ব্যাংকেও ইসলামি উইং(সালাম) আছে এর সফটওয়্যার হিসাবনিকাশ বিজনেস পলিসি অন্যটি থেকে সম্পুর্ন আলাদা। সব ইসলামি ব্যাংক ও উইং গুলি তদারকির জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকেও একটি বোর্ড আছে।
ইসলামি ব্যাংকিং এ যদি ১০০ টি প্রোডাক্ট থাকে প্রতিটিরই শরীয়াহ অনুযায়ী ব্যাখ্যা আছে এবং অর্থনীতির গভীর বিজ্ঞান ও আল ফিকহ ইসলামি আইনের অসাধারণ কম্বিনেশন আছে। বিশ্বের সব হক্কানি আলেমগন এ সিস্টেমে একমত।
ফেইসবুকে একজনের (সম্ভবত কওমি কোন আলেম) বক্তব্য শুনে কিছুটা অবাক হয়ে আমি এই লেখাটি লিখলাম। তিনি বললেন "বাংলাদেশে ইসলামি ব্যাংকিং বলতে কিছু নেই তিনি যুক্তি দেখালেন -
সাগরে ভাটা পড়লে নদীতে জোয়ার সৃষ্টি হয় না"
(Respectfully) তিনি ঠিকই বলেছেন রাস্ট্রীয়ভাবে ইসলাম না থাকলে ব্যাংকিংয়েও ইসলাম হয় না। সাগরে জোয়ার আসলেই কেবল নদীতে জোয়ার আসে।
কিন্তু নদীতে কৃত্রিম বাধ স্থাপন করেও কিন্তু জোয়ার সৃষ্টি করা যায়। আপাতত ইসলামি ব্যাংকিং নদীর পানি ধারক বাধের মত। এতে নদীর দুকুলের অনেকেই উপকৃত হচ্ছেন। পবিত্রতার সুযোগ পাচ্ছেন।
বাধের রক্ষনাবেক্ষনকারীদের দায়িত্বহীনতা,সীমাবদ্ধতা কিংবা দুর্বলতার কারনে এ বাধে লিকেজ থাকতেই পারে। যে কেউ মেরামতে উদ্যোগী হতে পারেন।
তা না করে "ঘুরিয়ে খায়??! বা একই!! এসব বলে বাধটি ভেংগে নদীর অবশিষ্ট প্রবাহটুকু সাগর ভাটায় গুলিয়ে ফেলা নিশ্চয় কোন বুদ্ধিমানের কাজ নয়! এতে মরু এলাকার আয়তনই শুধু বৃদ্ধি পায়।
................হাসানুজ্জামান ফেরদৌস
বিএ অনার্স,এম এ (অর্থনীতি)