26/11/2024
বাংলাদেশিরা কেন ভারতকে অপছন্দ করে?
কেবল রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে বাঙালি মুসলমানরা ভারতকে দেখতে পারে না, এটা বেঠিক অনুমান। ভারত যদি রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধও করে দেয়, তবু বাঙালি মুসলমানরা ভারতকে ‘আপন’ ভাবতে পারবে না। এখানে বলে রাখা ভালো, বাঙালি মুসলমানদের সাথে পাকিস্তান বা আফ/ গানদের মিলও সামান্য। তাদের চাইতে ভারতীয়দের সাথেই আমাদের ঘনিষ্ঠতা আরও বেশী। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর আফগান-পাকিস্তানি ছাত্র আছে, তবে তাদের সাথে আমাদের কথা হয় সামান্যই। পাশাপাশি থাকলে পার্থক্যগুলো আরও পষ্টভাবে ধরা পড়ে।
তাহলে প্রশ্ন হল, আপেক্ষাকৃত মিল সত্ত্বেও বাঙালি মুসলমানরা ‘ভারতীয়’দের দেখতে পারে না কেন?
এর প্রধান কারণ সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক।
ভারতীয়রা যেসব বিষয়কে সুন্দর বলে ধরে নেয়, আমাদের কাছে এগুলো চূড়ান্ত হ্যাংলামি। আপনি একটা রাবীন্দ্রিক পরিবারের কথা ভাবুন, তাদের ভাবভঙ্গি-রুচি-শিল্প হজম করা বেশ কঠিন। তারা যেসব পাঞ্জাবি-ধূতি পড়ে, সেগুলো আমাদেরকে টানে না, টিপ-খোঁপা-কাজল কয়টা বাঙালি ছেলেকে প্রভাবিত করে, এ নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। রাবীন্দ্রিক ছেলেদের মধ্যে যোদ্ধা মনোভাব থাকে না, এদের অনেকেই কিছুটা কিছুটা মেয়েলি ধরণের। আপনি চারুকলার দিকে তাকালে এসবের পষ্ট দৃষ্টান্ত ধরতে পারবেন।
অর্থাৎ আমাদের সৌন্দর্য-শিল্পবোধ-আভিজাত্য ভারতীয়দের সাথে মেলে না। প্রবাসী বাংলাদেশীদের মাধ্যমে এসব বিরোধ আরও প্রবল আকার ধারণ করেছে।
পহেলা বৈশাখের বিরোধিতা কেবল ধর্মীয় বিষয় নয়, বাঙালি মুসলমানদের পক্ষে এসব চর্চা হজম করা যথেষ্ট কঠিন। ভারতীয় ভাববাদ আমাদের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার সাথে যায় না। দেখুন, লালনফকিররা কেন বাংলাদেশে প্রভাব বিস্তার করতে পারল না, উত্তর ভারতের কারামত আলী জৌনপুরীর স্পর্শ ছুঁয়ে গেল প্রতিটা গ্রামে। ফকির মজনু শাহও কিন্তু উত্তর ভারতের মানুষ ছিলেন এবং আপনাদের মনে থাকার কথা, বালাকোট আন্দোলন বাংলাদেশের কন্ট্রিবিউশন ছিল সিগনিফিকান্ট। দারুল উলুম দেওবন্দ প্রতিষ্ঠার পরে বাংলার ছাত্রদের সংখ্যাই ছিল সবচেয়ে বেশী।
আমাদের মধ্যে কিছু স্পেশাল দিক আছে, সেটা মানতেই হবে।
আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, বাংলাদেশীরা এত ভারতে যায় কেন, অন্য দেশে যেতে পারে না? পাশাপাশি, মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গটাও অনেকে সামনে আনেন। দেখুন, একদিকে মিয়ানমার আর অপরদিকে সাগর, বিকল্প নাই দেখেই বাংলাদেশীরা ভারতে যায়। মালয়েশিয়ার সাথে বাংলাদেশের সরাসরি যোগাযোগ চালু থাকলে কয়জন ভারতে যেতে চাইত, সে নিয়ে আমার ঘোরতর সন্দেহ আছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও ভারতের সাথে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্ধটা অজানা ছিল না। একাত্তরে সেনাবাহিনী ছিল প্রধানত ভারতবিরোধী।
যারা ভারতবিরোধিতাকে পাকিস্তানে নিয়ে ফেলতে চান, তারা হয়ত জানেন না বাঙালিরা পাকিস্তানিদের খুব একটা পছন্দ করে না—দুই পাকিস্তান ভেঙে যাবার প্রধান কারণ এটাই। পাকিস্তান আসলে বাংলাদেশকে ডিজারভ করে না, একাত্তরে না হলেও, আগে বা পরে বাংলাদেশ কখনোই পাকিস্তানের সাথে থাকতে পারত না। আবেগ দিয়ে ইতিহাস বা রাজনীতি চলে না। কাজেই যারা বাংলাদেশীদের স্বতন্ত্রতাকে পাকিস্তানভক্তি বা ভারতবিরোধিতা দিয়ে বুঝতে চান, তারা প্রতারক বা মূর্খ।
আমাদের এখানে ইসলাম কেবল স্থলযোগেই আসেনি, সমুদ্র এই অঞ্চলে ইসলাম আগমনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম, পাশাপাশি আদি যুগ থেকেই এই অঞ্চলের মানুষরা কিছুটা স্বতন্ত্রতাপ্রিয়, আর্যসভ্যতা এদেরকে পরাভূত করতে পারেনি। বাংলাদেশের নদী ও কৃষিভিত্তিক সমাজের সাথে গাঙ্গেয় সমভূমির পার্থক্য অনেক। এশিয়াকে ইউরোপিয়ান চোখে দেখা যেমন বিপদজনক, বাংলাদেশকে ভারতীয় চোখে দেখার ঝুঁকিটাও কম নয়।