23/05/2025
ইনকামে বরকত পাচ্ছি না—এই অভিযোগ নিয়ে একদিন আমি গেলাম আমার প্রিয় এক উস্তাদের কাছে। তিনি শুধু একজন মেন্টর নন, আমার আত্মিক শান্তির ঠিকানা। কোনো দ্বিধা, দুশ্চিন্তা, কিংবা ভেতরের গ্লানিতে আক্রান্ত হলে, তার সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেই মনে হয় মনের আকাশে যেন আলো ফোটে।
সেদিনও ঠিক তেমন এক অস্থির বিকেলে তার সঙ্গে দেখা করতে গেলাম।
উনি আমাকে কোনো কিছু না বলেই একটি গরম পানিতে ডোবানো টি-ব্যাগ এগিয়ে দিলেন—দুধ নেই, চিনি নেই। শুধু চায়ের কষ্ট-সাহিত্য ভেজা সেই পানির কাপে তাকিয়ে আমি চুপচাপ বসে রইলাম।
উনি হালকা হাসিমুখে বললেন, “তানভীর, কেমন আছো?”
আমি একটু আড়ষ্ট হয়ে উত্তর দিলাম, “উস্তাদ, আজ একটু কনফিউজড লাগছে…”
উনি গভীরভাবে আমার চোখের দিকে তাকালেন, কিছুক্ষণ। তারপর চায়ে এক চুমুক দিয়ে বললেন, “কি নিয়ে পেরেশানিতে আছো?”
আমি একটু নিচু গলায় বললাম, “উস্তাদ, আমার ইনকাম নিয়ে আমি দ্বিধায় আছি। সৎ পথে রোজগার করি, শতভাগ আন্তরিকতা দিয়ে কাজ করি। কিন্তু কেন যেন মনে হয়, এত বছরের পরিশ্রমের পরও—আয়ে বরকত নেই।”
উনি মন দিয়ে শুনলেন। তারপর শান্ত গলায় প্রশ্ন করলেন, “এমনটা মনে হচ্ছে কেন?”
আমি বললাম, “সেভিংস হচ্ছে না, উস্তাদ। আয় যেমন বাড়ছে, খরচও তেমনি। যেন এক অদৃশ্য চাকা সব টেনে নিচ্ছে।”
উনি হঠাৎ আমার ডান হাতটা নিজের হাতে নিলেন। চোখে চোখ রেখে বললেন, “তোমার খরচগুলো কী নিয়ে বাড়ছে?”
আমি বললাম, “বাচ্চাদের ভালো স্কুলে পড়ানো, টিচারদের খরচ, কিছু অস্বচ্ছল আত্মীয়-স্বজনের দায়িত্ব।”
উনি জিজ্ঞেস করলেন, “তানভীর, তুমি কি মনে করো, ব্যাংকে টাকা জমা বাড়লেই সেটা বরকত?”
আমি কিছু বলি না। মাথা নিচু।
“তোমার সন্তানরা কি ভালো স্কুলে পড়ছে না?”
“হ্যাঁ, উস্তাদ।”
“ওরা কেমন? উচ্ছৃঙ্খল? কথা শোনে না?”
“না, খুব ভদ্র। লক্ষ্মী।”
উনি হাসলেন, “তাহলে এটাও তো বরকত। কয়জন বাবা-মা পারে এমন স্কুলে সন্তানকে পড়াতে? লক্ষ্মী সন্তান কি কম নেয়ামত?”
আমি মাথা নাড়ি।
“গত কিছু বছরে পরিবারের কেউ বড় অসুস্থ হয়েছিল?”
“না উস্তায, আল্লাহর রহমতে সবাই ভালো। স্ত্রীর হালকা অসুস্থতা ছাড়া…”
“হাসপাতালে ভর্তি?”
“না, দরকার হয়নি। সুস্থ হয়ে গেছে।”
“এটাও তো বরকত তানভীর!”
উনি এবার গলা একটু নিচু করে বললেন, “তোমার স্ত্রী কেমন মানুষ?”
“অসাধারণ উস্তাদ। উন্নত চরিত্রের, যত্নশীল। শুধু আমার না, আমার পরিবার, আত্মীয়, সবার প্রতি।”
“আর কী বরকত চাই, তানভীর? এমন জীবন সঙ্গী কি সহজে মেলে?”
আমার চোখে পানি এসে যায়।
উনি আবার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা-মা?”
“মা নেই উস্তাদ, মা আছেন। আমার সাথেই থাকেন।”
“এই যুগে মা কে নিজের সাথে রাখার সৌভাগ্য কয়জনের হয়, জানো? এ যে আকাশ ছোঁয়া বরকত!”
আমি কিছু বলতে পারি না। উনি আমাকে বুকে টেনে নেন। মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন—
“জীবনে শুধু টাকা-পয়সা জমলেই যে বরকত, তা নয় তানভীর।
সুস্থ থাকা বরকত।
সন্তানের সাফল্য বরকত।
স্ত্রীর ভালোবাসা বরকত।
আত্মীয়স্বজনের খোঁজ নিতে পারা বরকত।
মায়ের মুখ দেখতে পারা বরকত।
জ্ঞান ও হেদায়েতের আলো পাওয়া বরকত।
বরকতের সংজ্ঞা শুধু সংখ্যা না, হৃদয়ের প্রশান্তি।”
আমি চুপচাপ নিচে নেমে আসি। বিদায় নিই।
গাড়িতে উঠে সানরুফ খুলে দিই। সেদিন পূর্ণিমা। রূপালী আলোয় ভেসে যাচ্ছে আকাশ। আমি দাঁড়িয়ে পড়ি, দু’হাত তুলে আকাশের দিকে তাকাই। চোখ বন্ধ করি।
মনে হয়—জীবনের সব বরকত, সমস্ত নেয়ামত আমাকে ছুঁয়ে আছে। শুধু হিসেবটা বোঝার জন্য একটু ভিন্ন দৃষ্টিভঙ্গি দরকার ছিল…
-সংগ্রহীত।