
29/06/2025
অদৃশ্যকরণ প্রযুক্তি কী? : আলো, তাপ আর শব্দ লুকানোর বিজ্ঞান!
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এমন প্রযুক্তি বানানোর চেষ্টা করছেন যা আমাদের দৃষ্টির আড়ালে রাখবে। কিন্তু সত্যিই কি আমরা অদৃশ্য হওয়ার দ্বারপ্রান্তে?
প্রাচীন ইচ্ছা, আধুনিক বিজ্ঞান
অদৃশ্য হওয়ার ইচ্ছা অনেক পুরোনো। শিকারি আর সৈনিকরা শত শত বছর ধরে নিজেদের লুকাতে নানা রকম কৌশল ব্যবহার করে আসছেন। তবে আজকের বিজ্ঞানীরা সত্যিকার অর্থেই এমন প্রযুক্তির দিকে এগোচ্ছেন যা বস্তুকে আলো, তাপ এবং শব্দ থেকে আড়াল করতে পারে। স্টেলথ প্রযুক্তি আজ শুধু রাডার এড়াতে পারে না, বরং ইনফ্রারেড ক্যামেরায় দেখা যাওয়া তাপের চিহ্ন বা এমনকি শব্দও লুকিয়ে ফেলতে সক্ষম।
---
আলো লুকানোর বিজ্ঞান: মেটাম্যাটেরিয়াল ও মেটালেন্স
আমরা কোনো বস্তু দেখি, কারণ আলো সেটিতে পড়ে প্রতিফলিত হয়ে চোখে পৌঁছায়। কিন্তু যদি আলোকে এমনভাবে চালিত করা যায় যাতে তা কোনো বস্তুর গায়ে না লাগে, তবে সেই বস্তু আমাদের চোখে পড়বে না।
২০০৬ সালে ডিউক ইউনিভার্সিটির গবেষকরা মেটাম্যাটেরিয়াল দিয়ে তৈরি একটি "ক্লোকিং ডিভাইস" তৈরি করেন, যা মাইক্রোওয়েভ তরঙ্গে অদৃশ্য বলে মনে হত। এটি ছিল একধরনের তামার সিলিন্ডার, যা আলোকে বস্তুর চারপাশ ঘুরিয়ে দেয়। যদিও এই ডিভাইস দৃশ্যমান আলোতে কাজ করত না, এটি অদৃশ্যতার গবেষণায় এক বিশাল পদক্ষেপ ছিল।
২০১৮ সালে হার্ভার্ড ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়াটারলু একসঙ্গে একটি মেটালেন্স (metalens) তৈরি করে। এটি এক ধরনের অতি পাতলা লেন্স, যার পৃষ্ঠে অসংখ্য ন্যানোফিন থাকে। এই ন্যানোফিনগুলি আলোকে নির্দিষ্টভাবে বাঁকিয়ে দেয়, ফলে একাধিক রঙের আলোও একই পয়েন্টে ফোকাস করা সম্ভব হয়। মেটালেন্স প্রযুক্তি ভবিষ্যতের অদৃশ্যকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
---
তাপ লুকানোর বিজ্ঞান: ইনফ্রারেড ক্যামেরার ফাঁকি
ইনফ্রারেড ক্যামেরা মানুষের শরীরের তাপমাত্রা দেখে কাজ করে। সাধারণ মানুষের শরীর প্রায় ২০০ ওয়াট তাপ বিকিরণ করে, যা সহজেই ইনফ্রারেড ক্যামেরায় ধরা পড়ে। এক ধরনের অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কম্বল এই তাপ বাইরে যেতে দেয় না—ফলে ক্যামেরায় শরীর ধরা পড়ে না।
তবে এই ফয়েলের সমস্যা হলো, কিছুক্ষণ পর ভেতরের তাপ জমে পুরো কম্বল গরম হয়ে যায়। ফলে তা আবার ক্যামেরায় দেখা যায়।
গ্রাফিন নামের এক আধুনিক উপাদান দিয়ে গবেষকেরা এমন স্মার্ট সারফেস বানাচ্ছেন যা পরিবেশ অনুযায়ী নিজেকে বদলে ফেলতে পারে—একেবারে গিরগিটির মতো! ইউনিভার্সিটি অব ম্যানচেস্টারের গবেষকেরা ৪২টি গ্রাফিন প্যাচ দিয়ে একটি জ্যাকেট তৈরি করেছেন, যা আশেপাশের তাপমাত্রা অনুযায়ী নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে এবং ইনফ্রারেড ক্যামেরা থেকে আড়াল রাখতে পারে।
---
রাডার ফাঁকি দেওয়া: স্টেলথ বিমানের কৌশল
স্টেলথ প্রযুক্তি প্রধানত রাডার ফাঁকি দিতে ডিজাইন করা হয়। সাধারণ বিমান ধাতু দিয়ে তৈরি হওয়ায় রাডার তরঙ্গ প্রতিফলিত করে। তবে স্টেলথ বিমান ধারালো কোণযুক্ত, চ্যাপ্টা গঠন এবং রাডার শোষণকারী পেইন্ট (যেমন iron ball paint) দিয়ে তৈরি, যা রাডার তরঙ্গ শোষণ করে ও প্রতিফলন কমায়।
এই পেইন্টে থাকা ছোট আয়রন বল রাডার তরঙ্গ শুষে নিয়ে তা তাপে রূপান্তর করে। ফলে রাডার প্লেনটিকে খুঁজে পায় না। এছাড়া বিমানের ইঞ্জিন থেকে বের হওয়া উত্তাপ কমানোর জন্য ঠাণ্ডা বাতাস মেশানো হয়, বা এমনভাবে এক্সহস্ট ডিজাইন করা হয় যাতে তা সহজে দেখা না যায়।
---
শব্দ লুকানোর বিজ্ঞান: প্রাকৃতিক অনুপ্রেরণা
আফ্রিকান ক্যাবেজ ট্রি এম্পেরর মথ-এর ডানার সূক্ষ্ম আঁশ ও লোম শব্দ শুষে নিতে পারে। এর ফলে বাদুড়ের ইকোলোকেশন প্রতিফলিত হয় না—বাদুড় বুঝতে পারে না যে শিকার তার কাছেই আছে।
এটি একটি প্রাকৃতিক অ্যাকোস্টিক মেটাম্যাটেরিয়াল হিসেবে পরিচিত। University of Southampton-এর গবেষকরা এমন পাতলা স্তর তৈরি করছেন যা কংক্রিটের দেয়ালের মতো শব্দ আটকাতে পারে। ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তি দিয়ে বিমান, ভবন, এমনকি সেন্সর চালাতে ব্যবহৃত শক্তিও সংগ্রহ করা যাবে।
---
ভবিষ্যতের অদৃশ্য প্রযুক্তি
আলো, তাপ এবং শব্দ—এই তিনটি ক্ষেত্রেই বিজ্ঞানীরা উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছেন। যদিও এখনো "ইনভিজিবিলিটি ক্লোক" পরে হেঁটে বেড়ানো সম্ভব হয়নি, তবুও মেটাম্যাটেরিয়াল, গ্রাফিন, এবং স্মার্ট ডিজাইনের মাধ্যমে আমরা সেই ভবিষ্যতের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছেছি যেখানে অদৃশ্য হওয়া কল্পবিজ্ঞানের নয়—বাস্তবতার দ্বারপ্রান্তে।