31/05/2025
২০২১ সালের পহেলা জুন, ঠিক ৪ বছর আগের কথা। আমি অনূর্ধ্ব-২০ আন্তর্জাতিক স্ট্যান্ডার্ড ফরম্যাটে খেলতে গিয়েছি। হোটেলে আমার রুমমেট বন্ধুপ্রমিত বাংলাদেশের অন্যতম মেধাবী প্লেয়ার জনাব ‘ক’ (নামটা সংগত কারণে গোপন রাখছি)। ‘ক’ আমার ক্লাসমেট ছিল কিন্তু পড়াশোনা ছেড়ে পুরোপুরি দাবায় মনোনিবেশ করেছে। আমি এর ঠিক উলটোটা করেছিলাম। ইতোমধ্যে তার ঝুলিতে যুক্ত হয়েছে দু দুটি আন্তর্জাতিক নর্ম। ছেলেটা হিন্দু, মুক্তমনা এবং যথেষ্ট প্রতিবাদী। ২০২৩ সালে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের অযাচিত কর্মকাণ্ড এবং বণ্টন নিয়ে কথা বলায় তৎকালীন কমিটি তাকেও বহিষ্কার করেছিল, পরবর্তীতে সে চলে যায় ভারতে। যারা দাবার সাথে জড়িত আছেন তারা ইতোমধ্যে বুঝতে পেরেছেন আমি কার কথা বলছি।
একদিন রাতে আমি ম্যাচ শেষ করে দ্রুত হোটেলে ফিরলাম। সুইচ লীগ চতুর্থ রাউন্ডের খেলা ছিল সেদিন। আমার রুমমেট পয়েন্ট টেবিলে তখন ১ম স্থানে লিড করছে বাংলাদেশের হয়ে। আগেরদিন আমার ঘুম হয়নি, ঘুমানো দরকার। গোসল সেরে যেই বিছানায় গা এলিয়ে দিতে যাব অমনি দরজায় নক, “আদিল ভাই”।
“আসছো? দাঁড়াও।” দরজা খুলে দিলাম। দেখি তার জামাকাপড় এলোমেলো, গলার বো-টাই হাতের মুঠোয়।
– কী ব্যাপার, গেম শেষ? রেজাল্ট কী?
– আরে, আর বোলো না; আমি একটা আস্ত মাদারচোদ।
– কী? ব্লান্ডার করেছ?
– পুরাই!
– কার সাথে?
– এক নেপালি প্লেয়ার।
– ডেম!
এরপর তার হাত থেকে নোটেশন পেপারটা নিলাম। মুভ টু মুভ প্রত্যেকটা স্টকফিশে আপলোড করলাম বসে বসে। অ্যাকুরেসি ৮৯.৭%, খারাপ না। কিন্তু বেচারা শেষের দুটো চাল খেয়াল করেনি। ষষ্ঠ সারিতে পন সেক্রিফাইস করতে গিয়ে নিশ্চিত জেতা গেম স্টেলমেট করে চলে আসছে। স্বান্তনা দিয়ে বললাম, “আরে, সমস্যা নেই। হাফ পয়েন্ট তো পেয়েছই। এখনো যৌথভাবে দ্বিতীয় পজিশনে আছো তুমি।”
এরপর কিছুক্ষণ চুপচাপ বসে থাকলাম আমরা। নীরবতা ভেঙে সে বলল, অমুক তোমার লিস্টে এখনো আছে তাই না?
– হ্যাঁ।
– আমার ব্যাপারে কিছু বলেছে তোমাকে?
– সব জানি আমি।
– কই, কখনো তো বলোনি আমায়!
– বলে কী হবে? সে তোমার বিপক্ষে বলে, তুমি তার বিপক্ষে বলো। আমি কারোটাই কানে নিই না।
– হুঁ।
জনাব ‘ক’ তার প্রেমিকার কথা জিজ্ঞেস করছিল। সেও ভালো প্লেয়ার কিন্তু মুসলিম। এতদিন ধরে সব ঠিকঠাক যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ মেয়েটা ধর্মের অযুহাতে তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এখন মনস্তাপে ক্লিষ্ট হয়ে ‘ক’ এমন কোনো নেশা নেই যা করে না।
– আচ্ছা আদিল ভাই, আমাকে একটা কথা বলো তো।
– হুঁ।
– হিন্দু-মুসলিম প্রেম করলে হিন্দুকেই কেন সবসময় ধর্মান্তরিত হতে হবে? মুসলিমকে কেন নয়?
কী বলব ভেবে পাচ্ছি না। অনেক্ষণ চুপ থেকে বললাম— যারা উদার, যারা ভালোবাসতে জানে উৎসর্গ শুধু তাদেরই অধিকার। মুসলিম তুলনামূলক স্বার্থপর সম্প্রদায়, তারা প্রেমের জন্য ধর্মকে উৎসর্গ করতে চায় না।
– তাহলে তো মুসলিমদের জন্য সত্যিকার ভালোবাসা আসেনি।
– শুধু মুসলিম কেন? কোনো ধর্মান্ধের জন্যই আসেনি।
– একটা কথা বলব?
– বলো।
– নাহ, বাদ দাও।
– আচ্ছা।
– নাহ, বলি।
– বলো।
– আমি মুসলিমদের অনেক ঘৃণা করি।
– আচ্ছা।
– তোমাকে করি না, অন্যদের করি।
– আমাকে করলেও আমি অবাক হব না। গত ৮ দিন ধরে আমার সাথে আছো অথচ আমার সামনে রুমের ভেতর সিগারেট ধরাতে দিইনি বলে নিশ্চয় ক্ষোভ জমে আছে আমার উপর?
– না, নেই। বরং আমি খুশি হয়েছি। খেলতে এসে পট করলে গেমে সমস্যা হতো আমার।
– আসলেই?
– হ্যাঁ, সত্যি নেই। আর তুমি ধর্মান্ধও নও, আমি জানি।
– কীভাবে জানো?
– তোমার কন্টেন্ট দেখে, লেখা পড়ে, তোমার সাথে চলে, তোমাকে অনুভব করে।
– বাহ!
– তুমি রাগ করোনি, তোমার ধর্মকে ঘৃণা করি বললাম তাই?
– না, করিনি।
– কেন?
– ধর্ম আর ধার্মিক এক না। আর আমি ফান্ডামেন্টালিস্ট নই। কাউকে ভালোবাসার অধিকার যার আছে, কাউকে ঘৃণা করার অধিকারও তার থাকা উচিত।
– আদিল ভাই, তুমি খুব সুশীল।
– কেন?
– তোমার সামনে মন খুলে কথা বলা যায়, তোমার বিপক্ষে অবস্থান নেওয়া যায়, তর্ক করা যায়, তোমার মতবাদ বা আইডিয়োলজি নিয়ে সমালোচনা করা যায়, তুমি বাধা দাও না— কখনো তোমাকে মন খারাপ করতেও দেখিনি।
– হুঁ।
– খেতে নামবে?
– হুঁ। তুমি গোসল সেরে আসো আগে।
– ঠিক আছে।
– আচ্ছা শুনো, তুমি কি গোরুর মাংস খাও?
– না, খাই না।
– গোরু বাদে বাকিসব তো খাও।
– তোমরা গোরু জবাই করো, এতেই আমার খারাপ লাগে।
– আমারও লাগে।
– তোমার লাগাটা স্বাভাবিক।
– সুশীল হওয়া এত সোজা না।
– যেমন?
– যে সভ্য, যে সুশীল সে বলিদান, হত্যা, যুদ্ধ, রক্ত সবকিছুর বিপক্ষে থাকবে। সেটা মানুষ হত্যা হোক অথবা কোনো জীবহত্যা।
– আমিও সেটাই মনে করি।
– তুমি মনেও করো, আবার তুমি পাঁঠাও বলি দাও পূজায়।
– দিই, কিন্তু খারাপ লাগে।
– প্রাণ কোনো ভগ্নাংশ নয়, জনাব। প্রাণের কোনো ক্লাসিফিকেশান হয় না। তুমি মানুষ হত্যা করলেও অপরাধী, একটা নিরীহ মাছি হত্যা করলেও সমান অপরাধী। যে কুরবানির আগে গোরুকে খাওয়ানোর ছবি আপলোড দেয়, একই ব্যক্তি আবার পরদিন গোরুর মাংসে ছুরি চালায়। সমাজ-সভ্যতা আজ তাদের পক্ষে, তারাই কথিত ধনাঢ্য সুশীল ব্যক্তি, আজ তারাই সমাজের ত্রাতা। একটা প্রাণীকে হাসতে হাসতে নিজহাতে জবাই করছে অথচ নিজের মধ্যে বিন্দুমাত্র অনুশোচনা নেই, উলটো দাঁত কেলিয়ে হাসছে— এর চেয়ে জঘন্যতা আর আছে না কি?
– তার মানে তুমি বলছো, যারা কুরবানি দেয় তারা কেউ ভালো মানুষ নয়?
– তারাই ভালো মানুষ। বরং আমরাই খারাপ। আমরা সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারি না। সহিংসতা আমাদের কষ্ট দেয়।
– তোমরা কুরবানি করো না?
– দুঃখজনকভাবে প্রতি বছরই করে আমার পরিবার। খুব ঘটা করেই করা হয়।
– তাহলে তুমিও তো ভালো নও।
– আমরা কেউ ভালো নই। সভ্য মানুষ কখনো পৃথিবী থেকে কাউকে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে নয়। স্পেশালি আমি সরিয়ে দিতে চাই না কাউকে। এই পৃথিবী আমার একার নয়, এটুকু বুঝার মতো বিবেক আমার থাকা উচিত। এতে মানুষ যেমন আছে, গোরুও থাকবে, পাঁঠাও থাকবে, ক্ষুদ্র যে আণুবীক্ষণিক জীব— সেও থাকবে।
স্মৃতিচারণ
৩১/০৫/২০২৫