17/07/2025
পড়ন্ত বিকেলে আমার মন যখন বিষণ্ণ; আপন চিত্তের শুক্ল, শুভ্র এবং অমলিন শীর্ষ যখন জাগতিক শ্রীর চূড়া ভেদ করে ঊর্ধ্বাকাশে মিশে যায় তখন আমি ছাদের সবচেয়ে কোণার রেলিং-এ চুপচাপ গিয়ে বসি।
ছাদের এপাশটায় একটা শিশুগাছ আছে— গাছের মাথা ছাদ ছুঁইছুঁই। সেই গাছে গত বছর বৃষ্টির দিনে আশ্রয় নিয়েছিল আমার মতো বোবা দুটো অসহায় প্যাঁচা। রোজ দেখতাম, পালক ফুলিয়ে ঘুপটি মেরে বসে থাকত সারাদিন। রাত হলে ওদের আর খুঁজে পাওয়া যেত না। প্যাঁচার বিচরণ নাকি রাতেই হয়, এজন্যই হয়তো। কিছুদিন পর উধাও হয়ে গেল ওরা, গাছের প্রত্যেকটা ডালে খুঁজেও আর কোথাও পেলাম না। মনটা আর ভালো নেই, কিছু কি করেছি আমি ওদের? অকারণেই চলে গিয়েছে!
এরপর কেটে গিয়েছে অনেকদিন। আমার ক্ষণেক্ষণে মন খারাপ হয়, ছাদে যাই; বসে চুপচাপ তাকিয়ে থাকি গাছের দিকে— না, ওরা আর কোথাও নেই। সত্যিই চলে গিয়েছে, তাই না? অথচ একদিন এই ছাদে বসেই আনমনে কত কথা বলেছি ওদের সাথে; কত অভিযোগ, কত অভিমান আর কতই না রাগ দেখিয়েছি মনের অজান্তে! সন্ধ্যার পর আরেকটু কি থাকা যায় না? একটু অন্ধকার হলেই চলে যেতে হবে কেন? এমন হাজারো বিয়োগব্যাধির অগণিত, অজস্র প্রশ্ন আমি ওদের করেছি। অথচ আজ ওরা নেই। পশুপাখি পর্যন্ত কত নির্মম হয়, মানুষ হবে না কেন?
গত একমাস আগের কথা। রাত প্রায় দেড়টা বাজে, পড়া শেষ করে আমি ছাদে গেলাম। বসে আছি চুপচাপ। হঠাৎ শাঁ করে মাথার খুব কাছ দিয়ে কিছু একটা উড়ে এসে শিশুগাছের মগডালে বসলো। সেদিন পূর্ণিমার চাঁদের আলোয় চারপাশ তুলনামূলক এতটা উজ্জ্বল ছিল যে আমি নিজের ছায়া ছাদের মেঝেতে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম। মগডালে তাকিয়ে দেখি অবয়ব কিছুটা প্যাঁচার মতোই লাগছে। একটুপর দেখি শাঁ করে আরেকটা উড়ে আসলো— হ্যাঁ, এই শব্দ আমার পরিচিত। প্রতিদিন ওরা সন্ধ্যার একটু পর উড়ে চলে যেত, আমি বিষণ্ণ মনে তাকিয়ে থাকতাম আর কানে মনস্তাপের গীত হিসেবে বাজতো এই শব্দটা।
একটুপর দুটোই সবচেয়ে উঁচু ডালে গিয়ে বসলো। আসলেই ফিরে এসেছে ওরা— ঐ যে পেছনে আলো-আঁধারির আকাশে ওদের স্পষ্ট ছাপ দেখা যাচ্ছে! আমার বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল।
এরপর শুরু হলো উপরোধ, অনুরোধ, অভিযোগের বচসা। আমার চোখের ভাষা মনের অজান্তেই ‘তুমি-তামি’ থেকে ‘আপনি’-তে চলে গিয়েছে। অভিযোগ, অভিমান আর অনুরোধের মিশ্রিত রাগ আমাকে সবসময় সুশীল থেকে সুশীলতর করে তোলে— এবারেও তার ব্যতিক্রম নয়। সারাটা রাত বচসা মিটিয়ে শুরু করলাম আমার মনের প্যানপ্যানানি, এতদিনের জমানো সব কথা। জুরাসিক যুগ থেকে শুরু করে প্যাগান, পঞ্চভুজ, মাইটোকন্ড্রিয়া হয়ে সম্রাট বাবরের সিংহাসনের সামনের ডান পায়ার ভরে সৃষ্ট গর্তের ব্যাসার্ধ পর্যন্ত— কী নেই আমার সেই আলোচনায়? হ্যাঁ, সবই আছে। সেই রাত যেন আমাকে জীবন্ত জ্ঞানকোষ বানিয়ে দিচ্ছিল!
এরপর জ্ঞানগর্ভ কলহবিবাদের অন্তিমকালে এসে খেয়াল করলাম, ওখানে দুটি নয়, মোট তিনটে প্যাঁচা বসে আছে! তখন ভোরের আলো ফুটতে শুরু করেছে, একটুপর ব্যাপারটা আরও পরিষ্কার হয়ে গেল। দুটো বড়ো প্যাঁচার ঠিক মাঝখানে বসে আছে একটি ছোট্ট বাচ্চা প্যাঁচা! ওমা, কী কিউট! অজান্তেই মুখ থেকে অস্ফুটস্বরে বের হয়ে এলো ‘বাচু’।
এই সেই বাচু, পৃথিবীতে আমার সবচেয়ে ঘনিষ্ঠ বোবা বন্ধু। এখন অনেকটা বড়ো হয়েছে সে। ওর বাবা-মা কয়েকদিন পরপর আসে, আবার চলে যায়। কিন্তু সে কোথাও যায় না, গেলেও ঘণ্টার আগেই এসে হাজির। সারাদিন, সারারাত সে এভাবেই বসে থাকে একটি ডালে। প্রথমদিকে খুব ভয়ে থাকতাম, বেশি তাকালে যদি ভয় পেয়ে উড়ে যায়, আর কখনো না আসে, এমনিতেও বাচ্চা প্যাঁচা। পরে ধীরেধীরে বিশ্বাস হলো, সে যাবে না। এখন তো গাছের ডাল টেনে কাছে নিয়ে আসলেও সে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে— একটুও ভয় পায় না, তারও বিশ্বাস জমে গিয়েছে আমার উপর। কেউ যদি এসে আমাকে বলে, ওকে আমি খাঁচায় নিয়ে পুষতে চাইবো কি না?
না, চাইবো না। যে থাকার সে এমনিতেই থাকে, খাঁচা দরকার হয় না। ওর সাথে আমার একশ একটা চুক্তি হয়েছে, সে খুব অক্ষরে-অক্ষরে মেনে চলে।
তারও মাঝেমধ্যে মন খারাপ হয়, তখন সে খুব কাছের ডালটায় এসে বসে, আমি বুঝি। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে আমার দিকে, যেন বলতে চায়, ❝জানো, আমিও না ঠিক তোমার মতো। একা, একচর, একচিত্ত— বিশ্বাস করো, তুমি ছাড়া আমার আর কোনো বন্ধু নেই।❞
— হুঁ, জানি আমি।
— আচ্ছা, তোমার মন খারাপ হলে কী করো?
— এই যে, ছাদে চলে আসি, তোমার কাছে।
— তোমার তো আরো কত কী আছে করার মতো, ওসব ছেড়ে আমার কাছে কেন আসো?
— তোমারও তো পাখা আছে, উড়ে যাওয়ার মতো শক্তি আছে, জায়গাও আছে। কেন যাও না?
— হু।
— হুঁ।
— কারণ আমি যেতে চাই না। পাখা থাকলেই সবখানে উড়তে হয় না। আমি তোমার কাছেই সবচেয়ে বেশি নিরাপদবোধ করি।
— শুধু নিরাপত্তাই কি তোমাকে আমার কাছে রেখে দিয়েছে?
— না।
— তাহলে?
— আমরা দুজন একইরকম। তুমি আমাকে সবচেয়ে ভালো বুঝতে পারো। তুমি আমাকে হারাতে ভয় পাও, তোমার চোখ আমি দেখি।
— আর?
— আরও অনেক কিছু।
— হুঁ, অনেক কিছু।
17/07/2025
Labib Uddin Adil
লেখা: ❝তোমার কি মন খারাপ?
হু।
চলো তবে, তোমাকে আজ তেপান্তর পেরিয়ে এন্ড্রোমিডার শেষপ্রান্তে নিয়ে যাব যেখানে শব্দের প্রতিধ্বনি শোনা যায় না। তোমাকে আজ সেই হারানো মুকুটের গল্পটা শুনাবো— শব্দহীন দ্যোতক অভিলাষের প্রচ্ছন্ন এক গল্প।❞