27/04/2025
আচ্ছা বলুন তো, কোনো মানুষের সফল বা ব্যর্থ হওয়ার পিছনে Root Factor হিসেবে কাজ করে কোনটা। তার জিন (Gene), তার শৈশব, সে কীভাবে বেড়ে উঠেছে, তার পরিবেশ, নাকি অন্য কিছু?
এগুলোর কোনটাই না। আসল Root Factor হলো তার নিজের নেয়া ছোট ছোট কিছু চয়েজ।
এই পুরো পৃথিবীতে শুধুমাত্র একটাই জিনিস আছে যেটা যদি আমরা চাই তাহলে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। সেটা হচ্ছে আমাদের চয়েজ। আর এই চয়েজগুলোই আমাদের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ভবিষ্যৎ ঠিক করে দেয়।
আপনি যদি ইচ্ছা করেন তাহলে অফিস থেকে ফেরার পর জিমে যেতে পারেন বা সোফাতে শুয়ে টিভিও দেখতে পারেন। আপনি যদি চান কোনো কারণে আপনার স্ত্রীর সাথে ঝগড়া হওয়ার পর সবকিছু ভুলে তাকে জড়িয়ে ধরতে পারেন বা আপনার ইগোকে প্রশ্রয় দিয়ে তার সাথে দূরত্ব তৈরি করতে পারেন।
এরকম ছোট ছোট চয়েজগুলোই আপনার সবকিছুর গতিপথ নির্ধারণ করে — আপনি সারাজীবন সুস্থ্য থাকবেন নাকি রোগ বয়ে বেড়াবেন, আপনি একটা দীর্ঘ এবং মধুর সম্পর্ক পাবেন নাকি আপনার ছেলেমেয়েকে জবাব দিতে হবে কেন তার মাকে আপনি ডিভোর্স দিয়েছিলেন।
কিন্তু আমরা এরকম ছোট ছোট চয়েজগুলোতে বেশি মন দিই না। আমি বিষয়টি ব্যাখ্যা করছি। ধরুন আমি আপনাকে এখন দুটো অপশন দিলাম :
১. আপনাকে ১ টাকা দেব যেটা আগামী ১ মাস প্রতিদিন দ্বিগুণ হবে, অথবা
২. এখনই আপনাকে একবারে ১০ কোটি টাকা দিয়ে দেব।
আপনি এর মধ্যে কোন অফারটি নিতে পছন্দ করবেন?
বেশিরভাগ মানুষই, হয়তো প্রায় সবাই ২ নাম্বার অপশন অর্থাৎ ১০ কোটি টাকাই নেবে। আচ্ছা, আমি ১ নাম্বার অফারটা নিলাম। এবার দেখা যাক ১ মাস পর এর আউটকাম কী আসে।
৫ দিন পর আমার কাছে আছে ১৬ টাকা আর আপনার কাছে ১০ কোটি। ১০ দিন পর আমার কাছে আছে ৫১২ টাকা আর আপনার কাছে সেই ১০ কোটি। ২০ দিন পর আমার কাছে ৫,২৪,২৮৮ আর আপনার কাছে সেই ১০ কোটি টাকা। আপনি ভাবছেন আমি কত বড় বোকা, তাইনা?
এবার দেখা যাক ৩১ দিন পর কার কাছে কত টাকা আছে। আপনার কাছে আছে এখনো সেই ১০ কোটি, কিন্তু আমার কাছে আছে ১০৭,৩৭,৪১,৮২৪ অর্থাৎ ১০৭ কোটি টাকা, যেটা কিনা আপনার থেকে ১০ গুণ বেশি।
সাকসেস জিনিসটাও ঠিক এই প্যাটার্নটাই ফলো করে। যে ব্যক্তি ছোট ছোট চয়েজগুলো সঠিকভাবে নেয় সে ৩১ মাস পর রাতারাতি সাফল্য অর্জন করে।
আরো সহজভাবে বোঝানোর জন্য রাজীব, সাগর এবং আকাশ নামের তিন বন্ধুর উদাহরণ দেওয়া যাক। তিনজনই একই রকম পরিবেশে বড় হয়েছে, একই জায়গায় থাকে আর ইনকাম মোটামুটি একই। আর হ্যাঁ, ধরা যাক তিনজনেরই বিয়ে হয়ে গেছে এবং সবারই স্ত্রীর সাথে একটু মনোমালিন্য চলছে।
নতুন মাস বা বছরের শুরু থেকে রাজীব সবসময় যা করে সেটাই করতে থাকল, কারণ তার মনে হলো সে এটাতেই খুশী আছে। সে কিছুটা খুঁতখুঁতে টাইপের, অর্থাৎ অন্যের দোষ খুঁজে বেড়ানো তার স্বভাব। আগের মতোই সে সবার ব্যাপারে বিভিন্ন বিষয়ে অভিযোগ করে যেতে লাগল।
আরেক বন্ধু সাগর তার জীবনে কিছু ছোট ছোট Insignificant Negative Change আনা শুরু করল। যেমন :
১. প্রতিদিন জাংকফুড খাওয়া।
২. কাজের চাপের অজুহাতে ব্যয়াম না করা।
৩. প্রতিদিন অফিস থেকে ফেরার সময় ১ বোতল কোল্ড ড্রিঙ্কস খাওয়া।
৪. টিভিতে ফেভারিট শো দেখার জন্য ইভিনিং ওয়াক বন্ধ করে দেওয়া।
৫. সময়ের অভাবের অজুহাতে অফিসিয়াল যোগাযোগ কমিয়ে দেওয়া।
৬. এছাড়া ব্যস্ততার অজুহাত দেখিয়ে সে স্ত্রীর সাথে বাইরে যাওয়াও বন্ধ করে দিল।
অন্যদিকে, আকাশ একটি Daily Checklist বানিয়ে নিজের মধ্যে কিছু ছোট ছোট Insignificant Positive Change আনা শুরু করলো। যেমন :
১. প্রতিদিন ঘুমানোর আগে একটা ভাল বইয়ের ১০ পৃষ্ঠা পড়া।
২. প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার বা ফেরার সময় গাড়িতে বসে বা সুবিধামতো সময়ে ৩০ মিনিট কোনো মোটিভেশনাল ভিডিও দেখা।
৩. নিজের ডেইলি ডায়েট প্ল্যান থেকে ১২৫ ক্যালরি কমালো।
৪. প্রতিদিন এক্সট্রা অন্তত ২ লিটার পানি খাওয়া।
৫. সকালে ১ কিলোমিটার হাঁটা।
৬. ব্যবসায়িক স্বার্থ জড়িত প্রতিদিন অন্তত এমন ২/৩ জনকে ফোন দিয়ে খোঁজখবর নেয়া বা সম্পর্কোন্নয়ন।
৭. নিজের স্ত্রীকে নিয়ে প্রতি সপ্তাহে ১ দিন ঘুরতে যাওয়া।
পরবর্তী ৫ মাসে ৩ বন্ধুর মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য দেখা গেল না। ১০ মাস পরেও একই। এবার আকাশ একটু একটু হতাশ হতে লাগল। কেননা এখনো সে কোনো পজটিভ রেজাল্ট দেখতে পায়নি। তবুও সে কোনোরকমে জেদ ধরে তার অভ্যাসগুলো চালিয়ে গেল। অপরদিকে, সাগর কম কাজ করে জীবনকে উপভোগ করতে থাকল। আর রাজীবও খুশিতেই আছে।
কিন্তু ২৫ মাস পর হঠাৎই এদের মধ্যে বড় পার্থক্য দেখতে পাওয়া গেল, আর ২৭ মাস পর সেটা আরো স্পষ্টভাবে ফুটে উঠল। এবং ৩১ মাস পর পার্থক্যগুলি বিশাল আকারে দৃশ্যমান হলো।
রাজীব এখন সবার ব্যাপারে আরো বেশি অভিযোগ করে। সে বেশিরভাগ সময়ই নিজেকে বোরিং এবং উদ্দেশ্যহীন অনুভব করে।
সাগর রোজ একটু একটু জাংকফুড খেয়ে এবং জিম বাদ দিয়ে ১৫ কেজি ওজন বাড়ালো, সাথে নানান রোগব্যাধি। যোগাযোগ কমিয়ে দেয়ার ফলে বিজনেসের অবস্থাও খারাপ হতে লাগল। ফলস্বরূপ আর্থিক অবস্থাও বাজে হয়ে গেল। সেই সাথে স্ত্রীর সাথেও সম্পর্ক আরো অবনতি হয়ে ডিভোর্সের পর্যায়ে চলে গেল। অর্থাৎ ৩১ মাস ধরে ছোট ছোট Negative change-গুলো একটি ভয়াবহ ফলাফল এনেছে।
এবার আসা যাক আকাশের ব্যাপারে। এই ৩১ মাসে সে প্রায় ৫০ টি বই এবং ৪৬৫ ঘন্টা মটিভেশনাল ভিডিও দেখে নিয়েছে যেটাতে তার জ্ঞান এবং প্রজ্ঞা দুটোই আগের থেকে অনেকগুণ বেড়ে গেল। প্রতিদিন ১২৫ ক্যালরি কমিয়ে আর ১ মাইল হেঁটে ১৫ কেজি ওজন কমাল যে কারণে সে এখনো আগের মতই স্লিম আর হ্যান্ডসাম। প্রতিদিন মাত্র ২ লিটার পানি খেয়ে সে মোট ২ হাজার লিটার পানি খেয়ে নিল যা কিনা তার ভেতরের অনেক রোগের বেড়ে ওঠা কমিয়ে দিল। আর প্রতিদিন মাত্র দুইটা ফোন করে সে মোট ১৮০০ কল দিল যাতে সম্পর্ক ভালো হলো, ফলে বিজনেসও বাড়তে থাকল। সপ্তাহে মাত্র একদিন স্ত্রীকে ঘুরতে নিয়ে গিয়ে মোট ১২৪ টা ডেট করে ফেলল, যাতে স্ত্রী সাথে তার সম্পর্কটাও মজবুত হলো।
কিন্তু!
যদি সাকসেস পাওয়া এতোটাই সোজা হয় আর আমরা সবাই প্রসেসটাও জানি, তাহলে কেন আমরা এই সূত্রটা ফলো করতে ব্যর্থ হই?
৪টি ফাঁদ আছে যার কারণে আমরা ব্যর্থ হই বা ধারাবাহিকতা ধরে রাখতে পারি না।
১. ভাবুন যদি আপনি আজ একটা বার্গার খান আর পরদিন সকালে ১৫ কেজি ওজন বাড়িয়ে ঘুম থেকে ওঠেন তাহলে কি আপনি কোনোদিন বার্গার খেতেন? অথবা আজ একটি সিগারেট খেলে পরদিন দেখেন আপনার গলায় ক্যান্সার হয়েছে তাহলে কি আপনি কখনো সিগারেট খাওয়ার সাহস করতেন? কিন্তু সমস্যাটা হলো শুরুতে কোনো পরিবর্তনই চোখে ধরা পরে না। কিছু মাস বা কিছু বছর পর হঠাৎ যেন রাতারাতি কিছু ভয়ানক ফলাফল সামনে এসে যায়, যতক্ষণে সেটাকে আটকানোর আর সুযোগ থাকে না। এই ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য আপনাকে সবসময় এটা মনে রাখতে হবে, Every choice you make ignites a butterfly effect। মানে আপনার বেছে নেওয়া ক্ষুদ্র চয়েজগুলো ভবিষ্যতে এক বৃহদাকার প্রভাব সৃষ্টি করে।
২. নিউইয়র্কগামী কোনো বিমান যদি ১ ডিগ্রিও Off route হয়ে যায় তো সেই প্লেন লস এঞ্জেলস থেকে ১৫০ মাইল দূরে অন্য কোনো দ্বীপে গিয়ে ল্যান্ড করবে। এবার আপনি ভাবুন যদি আপনিও নিজের জীবনে শুধুমাত্র ১ ডিগ্রি Off route হয়ে যান ১০ বা ১৫ বছরের জন্য, তাহলে জীবনের কোথায় গিয়ে ল্যান্ড করবেন! এটা থেকে বাঁচার জন্য একটা গাইডলাইন থাকা খুবই দরকার। যেমন একটা Daily checklist, যেটা একটা ফুটপ্রিন্টের মতো আপনাকে On track থাকার জন্য সাহায্য করবে। যদি আপনি কোনো কারণে কিছুদিনের জন্য Off track হয়েও যান তখন এই চেকলিস্টটা আপনাকে On track-এ ফিরে আসার জন্য অনেকটাই সাহায্য করবে।
৩. আপনার কাছে দুটো অপশন আছে, ডিনারের পর আপনি একটা হট চকলেট কেক খেতে পারেন অথবা শুধু ১ গ্লাস পানি। আপনি পানি বেছে নিলেন আর আপনার একটা বন্ধু নিলো কেক। বন্ধু খুব আনন্দে ওই কেকটাকে আপনার চোখের সামনে মজা করে খেতে লাগল। আর এদিকে আপনি শুধু পানি খাচ্ছেন যেটার এতটুকুও স্বাদ নেই। তখন কেমন লাগবে আপনার?
এটাই ফাঁদ!
যদি আপনি শর্ট টার্মে দেখেন তাহলে কোনো ভাল চয়েজ বেছে নিলে তাতে আপনি কিছুই পান না, কিন্তু যদি একটা খারাপ চয়েজকে বেছে নেন তাহলে আপনি অনেক খুশী আর মজা লাভ করেন। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে স্বল্পমেয়াদী আনন্দ দীর্ঘমেয়াদী ব্যথা সৃষ্টি করে এবং স্বল্পমেয়াদী ব্যথা দীর্ঘমেয়াদী আনন্দ সৃষ্টি করে।
জীবনে একটা কষ্ট তো আপনাকে করতেই হবে, আপনি এটাকে এড়িয়ে যেতে পারবেন না। এই কষ্ট দুই ধরনের হয় : নিয়মশৃঙ্খলার কষ্ট এবং আফসোস বা অনুশোচনার কষ্ট। নিয়মশৃঙ্খলার কষ্টের ওজন শুধু কয়েক গ্রাম এবং কিছুদিনের, যেখানে অনুশোচনার কষ্টের ওজন কয়েক টন এবং আজীবনের।
এবার চয়েজ আপনার।
৪. Checklist মেনে চলা, প্রতিদিন অতিরিক্ত দুই বোতল পানি খাওয়া, ১ মাইল হাঁটা — এইসব কাজ করা একদিক থেকে খুবই সহজ আবার আরেক দিক থেকে মুশকিলেরও। কারণ কেউই নিয়মশৃঙ্খলার মধ্যে বাঁধা থাকতে পছন্দ করে না। শুধুমাত্র একটা জিনিস এরকম আছে যেটা সফল এবং ব্যর্থ দু'ধনের লোকের মধ্যেই কমন; তাদের কেউই ভালো চয়েজটা মন থেকে বেছে নেয় না।
হ্যাঁ এটাই সত্যি!
হট চকলেট কেকের পরিবর্তে শুধু স্বাদহীন পানি খেতে কেউই ভালবাসে না, কিন্তু সাকসেসফুল লোকেরা তাও যেকোনভাবে তাদের Will Power বা নিজের Why Power-কে কাজে লাগিয়ে সেই কাজটা করে যায়। যেমনটা মোহাম্মদ আলী বলেছেন, আমি ট্রেনিংয়ের প্রতিটা মিনিটকে ঘৃণা করতাম, কিন্তু বিশ্বচ্যাম্পিয়ন হওয়াটাকে ভালোবাসতাম। অর্থাৎ মানুষ সফল হতে চায় কিন্তু সাফল্য লাভের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয় সেটা করতে রাজি নয়। এই ফাঁদ থেকে বাঁচার জন্য আপনার ওই Why-টাকে খুঁজে বের করতে হবে। এই Why যত শক্তিশালী হবে আপনিও ততটাই শক্তিশালী হবেন। এখন সিদ্ধান্ত আপনার আপনি কোনটা করবেন।