18/10/2025
ঝির ঝির বৃষ্টির ভিতর সুইমিংপুলের পানিতে যখন নিথর দেহটা ভাসতে দেখলাম তখনও জানি না কি ভয়ংকর বিপদে পড়তে যাচ্ছি আমি। চিন্তাও করতে পারিনি কি কঠিন ষড়ষন্ত্রের জাল গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে আমার চারপাশ থেকে।
অথচ চমৎকার এই রিসোর্টের সকালটা অন্য রকম হতে পারত। গাজীপুরের শালবন আর ছোট টিলার উপর দারুন রিসোর্টটা খুব জনপ্রিয়। সপ্তাহের ছুটিতে আমরা চার বন্ধু প্ল্যান করেছিলেম রিসোর্টে মজা করে কিছু সময় কাটাবো। বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। ভেবেছিলাম সারাদিন বৃষ্টি দেখব রিসোর্টে, ছেলেবেলার মতো ফুটবল খেলবো মাঠে, চমৎকার বড় সুইমিংপুলটাতে সাঁতার কাটব, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা আর কার্ড খেলে সময় কাটাবো। গাজীপুরে আমার একটা ক্ল্যায়েন্ট ভিজিট ছিলো, বাসা থেকে ব্যাগপ্যাক নিয়ে সরাসরি ক্লায়েন্ট ভিজিট শেষ করে গতকাল সন্ধ্যার পর রিসোর্টে চলে এসেছি। আমার তিন বন্ধুর একসাথে আসার কথা ঢাকা থেকে, রাফি নতুন গাড়ি কিনেছে সেটাতে অন্যদের নিয়ে আসবে। রাত দশটায় তাদের সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, তখনও তারা উত্তরা পার হয়নি, বৃষ্টির জন্য রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম বলছিল। ওদের কথা শুনে ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। প্ল্যান ছিল সবাই তাড়াতাড়ি অফিস শেষ করে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে রিসোর্টে এসে পড়বে। অথচ রাত দশটার সময়ও তারা রাস্তায়। এদের সময়জ্ঞান হবে না কখনও। বিরক্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এক ঘুমে সকাল। সকালে উঠে ভেবেছিলাম রাফিদের দেখব রুমে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে দেখলাম রুমে কেউ ঢোকেনি। আমরা রিসোর্টের দুইটা ডাবল রুম ভাড়া করেছি। আমার সাথে একজন থাকার কথা। হতে পারে অনেক রাতে এসেছে ওরা তাই আমার রুমে কেউ আসেনি। তিনজনই একই রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতের ঘড়ি দেখলাম, প্রায় দশটা বাজে। এখনও কি ওরা কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি? আমিও এতক্ষণ ঘুমালাম! জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি। এই ঠান্ডা আবহাওয়া আর পুরা সপ্তাহের অফিসে চাপই সম্ভবত আমাদের ক্লান্ত করে রেখেছে। ভাবছিলাম উঠে গিয়ে দেখি অন্যদের ব্যাপারটা কি, এরমধ্যেই একটা ছোট হৈচৈ শুনে রুম থেকে বের হলাম।
কে যেনো বলল সুইমিংপুলে একটা লাশ ভাসছে। আমি সব ভুলে তাড়াতাড়ি সুইমিংপুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। রিসোর্টটার সুইমিং পুল একটা খোলা জায়গায়, আকারে বেশ বড়। পুলের পাড়ে অল্প কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে । গাঁয়ের ড্রেস দেখে বুঝলাম বেশিরভাগই রিসোর্টের লোকজন। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। পুলের পানিতে ঝির ঝির বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, ঠিক মাঝখানে ভেসে আছে একটা মানুষ। দেখে মনে হচ্ছে উল্টো হয়ে শুয়ে সাঁতার কাটছে সে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় নড়ছে না মানুষটা।
দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাঁতার না জানা লোকজন যে কেনো আসে রিসোর্টে। নিশ্চয়ই সকালে একা এসেছিল পুলে, গভীর জায়াগায় চলে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি। আমি দ্রুত সেখান থেকে সরে এলাম। আমার বন্ধুদের রুমে যেতে হবে, তাদের সব জানানো দরকার। এই রিসোর্টে এখন আর থাকার মানে নেই।
আমরা ৭০১ এবং ৭০২ রুম নম্বর দুইটা বুক করেছি। আমি উঠেছি ৭০১ এ। ৭০২ এ গিয়ে দেখি লক করা। কয়েকবার বেল চাপলাম, ভিতরে কোন শব্দ হলো না। তারমানে ভিতরে কেউ নেই। পাওয়ার না থাকায় বেল বাজছে না।
আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। ওরা কোথায় গেল? ফোন করতে গিয়ে দেখি মোবাইল নিয়ে বের হইনি। তাড়াহুড়ায় রুম থেকে বের হয়েছি মোবাইল রেখে।
তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে এসে মোবাইল খুঁজলাম। নেই। কোথাও মোবাইল নেই। কি আশ্চর্য! আমি গতকাল রাতে মোবাইল হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পরিষ্কার মনে আছে। তাহলে মোবাইল কোথায় গেল। সকালে অল্প সময়ের জন্য বের হয়েছিলাম রুম বন্ধ করে, এরমধ্যে রুমে ঢুকে কারও মোবাইল চুরি করার প্রশ্নই নেই।
আমি দ্রুত বের হয়ে রিসিপশন ডেস্কে গেলাম। সেখানে বিরাট জটলা। কানাঘুষা করছে লোকজন। সুইমিং পুলে একজন মারা গেছে কাজেই এটা স্বাভাবিক। আমি কাউকে আমার মোবাইলের ব্যাপারটা জানানোর জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। এক ভদ্রলোক এসে বলল, স্যার আপনি আপনার রুমে যান, আমাদের এখানে একজন মারা গেছে, পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে পুলিশ বলেছে সব গেস্টকে থাকতে। কাইন্ডলি সহযোগিতা করুন, রুমে গিয়ে বসুন। পুলিশ এসে কিছু কথাবার্তা বলবে, এরপর যেতে পারবেন।
আমি তাকে সংক্ষেপে বললাম, আমার মোবাইল খুঁজে পাচ্ছি না। আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা দরকার।
ভদ্রলোক তখন নিজের মোবাইল বের করে দিয়ে বললেন, আপনার মোবাইলের ব্যাপারে এখনই কোন সাহায্য করতে পারছি না বুঝতেই পারছেন তবে আপনি কারও সাথে কথা বলতে চাইলে বলতে পারেন।
আমি দ্রুত তার মোবাইল হাতে নিলাম। আমার বন্ধুদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র শায়ের এর মোবাইল নম্বর মনে আছে আমার। সেটাও ডিজিট গুলো অনেক সহজ বলে। বাকিদের নম্বর মনে রাখা হয় নি কখনই।
শায়ের এর মোবাইলে ফোন দিলাম। বন্ধ।
মেজাজ এতো খারাপ হলো। ফিরে এসে আবার রুম নম্বর ৭০২ এর সামনে গেলাম, রুম খোলা। কিন্তু রুমের সামনে এবং ভিতরে দেখি অনেক মানুষ। আমি উঁকি দিলাম।
জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?
একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু না। আপনি আপনার রুমে যান। এই রুমের ভদ্রলোক মারা গেছেন সকালে।
আমার বুক ধরাস করে উঠল। কে মারা গেছে?
লোকটা বিরক্ত কন্ঠে বলল, এই রুমে যিনি উঠেছিলেন কাল রাতে। সরে যান, পুলিশ রুম আটকে রাখতে বলেছে।
আমার হতভম্ব মুখের সামনে দিয়ে লোকটা রুম বন্ধ করে চলে গেল। সঙ্গে যারা ছিল তারাও চলে গেল।
আমি কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর দৌড়ে রিসোর্টের স্টাফদের ধরলাম। বললাম, ভাই যে মারা গিয়েছে তার নাম কি?
লোকটা একটু থমকালো, শান্ত গলায় বলল, মারা গেছে রিফাত জামান, দেশের বড় গ্রুপ জে এন্ড জে এর এমডি।
আমি এবার ভয়াবহ ভাবে চমকালাম। রিফাত স্যার মারা গেছেন? বলে কি?
রিফাত স্যার আমাদের এমডি স্যার। আমি জে এন্ড জে চাকরি করি দশ বছর হলো।
আমি লোকটাকে বললাম, ভাই আমি একটু লাশ দেখতে চাই। আমি জে এন্ড জে কাজ করি।
রিসোর্টের স্টাফ টা দাঁড়িয়ে আমাকে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর বলল, পুলিশ আসার আগে কারোই কিছু করার অনুমতি নেই। আপনি আপনার রুমে যান, সেখানে থাকুন সেটাই আপনার জন্য ভালো হবে।
লোকটা আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে চলে গেল।
আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রুমে চলে এলাম। এতো শকড হয়েছি যে বলার না। আমার এমডি স্যার মারা গেছেন, আবার তিনি নাকি আমাদের বুক করা রুমেই ছিলেন, বলা যায় আমার পাশের রুমেই, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আমার বন্ধুরা কোথায়?
ইসস! এর মধ্যেই আমার মোবাইল হারালাম। ধুর!
কিছুক্ষণ বসার পর যখন ভাবছি বের হতে হবে, বন্ধুদের খুঁজে বের করা দরকার তখন রুমের কলিংবেল বাজল, খুলে দেখি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।
মোট তিনজন ড্রেস পরা পুলিশ। মাঝখানে একজন সিভিল ড্রেসে, তাদের আশেপাশে রিসোর্টের অনেক ড্রেস পরা কর্মচারী।
সিভিল ড্রেসের পুলিশ নিজের পরিচয় দিলেন, আমি ইন্সপেক্টর জাকির। আপনি তো জে এন্ড জের কর্মকর্তা ইমন?
আমি মাথা ঝাঁকালাম। এরা দেখি আমার পরিচয় বের করে ফেলেছে। অবশ্য এটা কঠিন কিছু না, এই রুম আমার নামেই বুকিং দেয়া, সেখানে আমার অফিস ইনফর্মেশনও দেয়া ছিল।
পুলিশ চারজন ভিতরে ঢুকে বসলেন।
জাকির বললেন, আজ সকালে আপনার এমডি স্যারের সাথে শেষ দেখা কখন হয়েছে? নাকি কাল রাতেই শেষ দেখা হয়েছে?
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমার সাথে আমার এমডি স্যারের দেখাই হয়নি। ইনফ্যাক্ট এমডি স্যার যে এই রিসোর্টে এসেছেন সেটাই জানি না আমি।
জাকির একটু থমকালেন, বললেন, দেখুন উল্টোপাল্টা বলে লাভ হবে না। আপনার পাশের রুমে আপনার এমডি স্যার আছে আপনি জানতেন না বলছেন অথচ আপনি যে পাশের রুমে গিয়েছিলেন সে প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। ঠিক করে বলুন তো কি হয়েছিল? কিভাবে মারা গেলেন আপনাদের এমডি?
আমি মাথা নাড়লাম, বিশ্বাস করেন আমি এর কিছুই জানি না। আমি তো জানি পাশের ওই রুম আমার এক বন্ধুর নামে বুক করা। আমরা চারজন গতকাল রাতে এখানে ছিলাম। ওই রুমে আমার অন্য তিন বন্ধুর থাকার কথা।
ইন্সপেক্টর জাকির বিস্মিত হয়ে বললাম, আপনার অন্য বন্ধুরা কোথায়?
আমি তখন ঘটনা খুলে বললাম।
জাকির সাহেব বললেন, মিস্টার ইমন আপনি কি বলছেন সেটা আপনি ভেবে বলছেন তো? গল্প গুলো কিন্তু খুব জমলো না। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে আপনি আপনার স্যারের রুম ৭০২ এ গিয়েছিলেন।
আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, প্রশ্নই ওঠে না। আমি গতকাল রাতে ক্লান্তির কারনে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানি ওই রুমে আমার বন্ধুদের ওঠার কথা কিন্তু রাত পর্যন্ত তারা আসেনি। তাহলে আমি ঐ রুমে কিভাবে যাবো? আর ধরা যাক স্যার ওই রুমে ছিলেন, তাহলে আমি স্যারের কাছে কেনই বা যাবো এতো রাতে? স্যারের সাথে তো আমি ডাইরেক্ট কাজ করিনা। স্যার আমাকে ভালো মতো চেনেন কি না সেটাও সন্দেহ।
ভদ্রলোক একটা প্যাকেট আমার সামনে ধরলেন। বললেন, দেখেন তো এই মোবাইলটা চেনেন কি না?
আমি ভালো করে দেখলাম, আমার মোবাইল।
বললাম, হ্যাঁ আমার মোবাইল। কোথায় পেলেন?
আপনার স্যারের রুমে।
আমি চমকে গেলাম। বললাম, স্যারের রুমে আমার মোবাইল গেলো কিভাবে? কি আশ্চর্য।
--সেটা তো আপনি বলবেন। এখন চলুন থানায় যাবেন আমাদের সঙ্গে।
আমি প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বললাম, থানায় কেনো?
---কারণ আপনার স্যার খুন হয়েছেন । তাকে কেউ মেরে সুইমিং পুলে ভাসিয়ে রেখেছে। এবং সাক্ষ্য প্রমাণ বলছে আপনি গত রাতে তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন।
আমি বললাম, পরিষ্কার মিথ্যা কথা। আমার বন্ধুরা আছে এখানে। তাদের কাছ থেকেই আপনি আসল সত্য জানতে পারবেন।
--- আপনি যে বন্ধুদের কথা বলছেন সে রকম কোন তথ্য কিন্তু আমাদের দেয়নি রিসোর্ট কর্তপক্ষ। আপনার কোন বন্ধু এই রিসোর্টে আসে নি গতকাল রাতে।
আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি বুঝলাম কোথাও বড় কোন গোলমাল হয়ে গেছে। অথবা কোন ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি।
ইন্সপেক্টরকে বললাম, ভাই গতকাল আমার যাদের সাথে আসার কথা ছিল সেই বন্ধুদের একটু ফোন দিয়ে দেখেন না ওরা কি বলে?
ইন্সপেক্টর কি যেনো ভাবলেন তারপর আমার মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ফোন দেন ওদের।
মুন আর সালাম এর মোবাইল বন্ধ। রাফির মোবাইল খোলা পেলাম, কয়েকবার ফোন দেয়ার পর ধরল সে। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, রাফি তোরা কোথায়? শীগগির আমার রুমে আয়।
রাফি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, স্যরি দোস্ত। কাল তো চরম বৃষ্টির জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারিনি রিসোর্টে। আজ বিকেলের দিকে আসব আমরা। এখন ঘুমাই।
বলেই সে লাইন কেটে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।
আবার ফোন দিতে গেলাম। ইন্সপেক্টর আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলেন। বললেন, আপনার বন্ধুরা তাহলে কাল রিসোর্টে ছিলো না। আপনি মিথ্যা বলছেন। এই ফোন এখন আমরা ফরেন্সিকে পাঠাবো। আপাতত আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হচ্ছে।
বুঝলাম বড়ো রকম ঝামেলায় পড়ে গেছি। দুঃস্বপ্নের মতো , কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন না। সত্যিকারের বিপদ, ভয়ংকর বিপদ। কি করব এখন আমি? ভয়ানক এই বিপদে একজনের কথাই মাথায় এলো আমার।
#পর্ব_০২
তিনদিন হাজত খাটতে হলো। এরপর জামিনের শুনানিতে আদালত জামিন দিয়ে দিলো আমাকে। কি ভয়ংকর ট্রমার মধ্যেই না গেলো দীর্ঘ তিনটা দিন। প্রবল বিস্ময় নিয়ে দেখতে হলো আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে আমারই প্রতিষ্ঠান জে এন্ড জে। বাসায় যখন নিয়ে আসল মিলি আমাকে আমি প্রায় বিধ্বস্ত। সারা বিকেল ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি গুলজার আংকেল আর তার স্ত্রী এসেছেন বাসায়। পিআইবি এর রিটায়র্ড ডি আই জি গুলজার হোসেনের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো এই ভয়ংকর বিপদ থেকে বাঁচার রাস্তা আমার এখনো শেষ হয়ে যায়নি, কারণ একজন যাদুকর আছেন আমার সঙ্গে।
গুলজার হোসেন পুরো ঘটনা শুনলেন। এরপর চুপচাপ অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। সব কিছু এখনো দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে, কোথা থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না। গেলাম বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে পড়লাম ভয়াবহ খুনের চক্রে।
বেশ কিছুক্ষণ পর গুলজার হোসেন কথা বললেন, তোমার বন্ধুদের কি খবর? এর মধ্যে যোগাযোগ করেনি তাই না?
---জ্বী। আমি তো যোগাযোগ করতে পারিনি। কিন্তু এদের কোন খবর নেই সেটাই আশ্চর্য লাগছে আমার কাছে।
---তুমি সবাইকে একবার ফোন দিয়ে দেখ এখন।
আমি সবার নম্বরে কল দিলাম।
মুন এবং সালাম এর মোবাইল আবার বন্ধ পেলাম। রাফি ফোন ধরল।
---দোস্ত, তুই বের হয়েছিস? আমি খুব স্যরি দোস্ত তোর এই বিপদে তোর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। আমার বাবা মারা গেছেন তাই আমি গ্রামের বাড়ি চলে আসছি ওই দিন। এখানে এসে তোর খবর শুনলাম।
আমি দুঃখ প্রকাশ করলাম, বলিস কি আংকেল মারা গেলেন, কিভাবে?
---এক্সিডেন্ট দোস্ত। বাজারে গিয়েছিল, হাইওয়ে দিয়ে অটো করে ফিরছিলো, ট্রাক মেরে দিয়েছে।
আমি বললাম, কি ভয়াবহ। তোর জন্য খারাপ লাগছে ভাই।
কথা সংক্ষেপ করে ফোন রেখে দিলাম। রাফির জন্য এখন উলটো খারাপ লাগছে। আমি একটা বিপদে পড়েছি ঠিক কিন্তু বেচারা তো আরও বড় বিপদে।
গুলজার আংকেল আমার সব কথা শুনে বললেন, তোমার অন্য বন্ধুদের বাসা চেনো?
এরা তিনজনই আমার কলিগ কাম বন্ধু। সবার ঢাকার বাসাতেই গিয়েছি আমি। বললাম, চিনি আংকেল।
---তাহলে আমার মনে হয় একটু বাসায় গিয়ে দেখা দরকার ওদের কি অবস্থা।
আমি বাসার বাইরে যাবো শুনে মিলি বাধা দিল। বেচারির উপর দিয়ে ভয়াবহ ধকল গেছে এই তিনদিন। জামাইকে খুনের মামলায় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেটা তার বাবার বাড়ির লোকজনের কাছে নিশ্চয়ই মারাত্মক রকমের খবর ছিলো। দেশের প্রায় সব কয়টা পত্রিকা নিউজ করেছে এই খুনের ঘটনা নিয়ে। দুই একটা পত্রিকা দেখলাম আগ বাড়িয়ে গল্প ফেঁদেছে আমি নাকি এমডি স্যারকে কৌশলে রিসোর্টে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছি। অনেক পুরানো দ্বন্দ নাকি। অথচ এমডি স্যারের সাথে আমার দেখাই হয়েছে গত একবছরে মাত্র এক দুইবার। এই সব গাল গপ্প একটু দুরের আত্মীয়স্বজনেরা আরও মুখরোচকভাবে আলোচনা করে। কেউ কেউ সহমর্মী হওয়ার ভান করে মিলিকে ফোন করে নানা ধরনের মন্তব্য করেছে এই কয়েকদিন, বেচারির আসলেই খুব খারাপ সময় গেছে।
মিলিকে কোন রকম বুঝিয়ে শুনিয়ে আমরা বাইরে এলাম। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে এসেছে। ঠিক হলো প্রথমে মুনের বাসায় যাবো। সে নতুন বিয়ে করেছে, তার বাসা লালমাটিয়া। সেখান থেকে যাবো সালাম এর মিরপুরের বাসায়। সালাম এখনো ব্যাচেলার। দুইজন কলিগ মিলে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে।
মুনের লালমাটিয়া ফ্ল্যাট তালা দেয়া। আমার জানা মতে সে আর তার স্ত্রী থাকত ছোট ফ্ল্যাটটায়। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন কিছু বলতে পারল না তাদের বিষয়ে। বাসার দারোয়ান বলল, শেষ শুক্রবার সকালে মুন তার স্ত্রীকে নিয়ে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে গেছে আর ফেরেনি।
মিরপুর সালামের ফ্ল্যাটেও সালাম ছিলো না। তার ফ্ল্যাটমেট আমাদেরই কলিগ ইকবাল ভাই। ভাইয়ের ফ্যামিলি বরিশাল থাকে, এই জন্য ভাই আর সালাম মিলে এই ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন ।
ইকবাল ভাই দরজা খুলে আমাকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ড্রেস দেখে বোঝা গেল উনি এই মাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন।
বললেন, সালাম তো নেই, বাড়ি গেছে।
আমি বললাম, কবে বাড়ি গেছে?
---শুক্রবারে সকালে।
ইকবার ভাই দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলেন, বোঝা গেল আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিতে চাচ্ছেন না। অথচ আমি সালামের কাছে এই বাসায় আসলে আগে কত খাতির দিয়েছেন, সেধে এসে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। আজ মনে হলো চিনতেই পারছেন না।
গুলজার হোসেন বললেন, আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিলো আমার।
ইকবাল ভাই দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলেন, বললেন, জ্বী বলুন।
গুলজার হোসেন একটা দম টেনে নিয়ে বললেন, আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন? অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন? আপনার একটা মাত্র ছেলে, পাঁচ ছয় বছরের? নাকি আবার নতুন বাচ্চা আসতেছে আপনাদের ঘরে?
ইকবাল ভাই বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ আমার স্ত্রীর বাচ্চা হবে আগামী পরশু- বুধবার ডেট। ওই জন্য ছুটি নিয়েছি। কিন্ত এতো কিছু আপনি জানলেন কিভাবে?
বলতে বলতে ইকবাল ভাই দরজা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালেন। আমরা ভিতরে ঢুকলাম।
গুলজার হোসেন তার স্বভাব সুল্ভ ভঙ্গীতে ঢুকে রুমের চারপাশ একবার দেখে নিলেন। তারপর বললেন, অনুমান থেকে বলেছি, অনুমান ভুলও হতে পারত।
আমি জানি গুলজার হোসেনের অনুমান কখনও ভুল হয় না। বললাম, কিন্তু আংকেল আপনি কি দেখে এতো কিছু অনুমান করলেন?
গুলজার হোসেন সোফায় বসতে বসতে বললেন, সবকিছু খেয়াল করলে তুমিও বলতে পারতে, উনি বাইরে যাবার ড্রেস পরা অথচ অফিস শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে, তাছাড়া ওনার গায়ের জামা কাপড়গুলোও ফ্রেশ, অফিস শেষ করা জামা কাপড় না, দরজার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সোফার উপর একটা খেলনা রিমোট গাড়ি রাখা। গাড়িটা দেখে আন্দাজ করা যায় যার জন্য কেনা হয়েছে তার বয়স চার পাঁচ হবে। গাড়ির পাশেই একটা প্লাস্টিক কেসিং এ ছোট জুতা রাখা,সুপার শপে গেলে দেখবা ওই জুতা নিউ বর্ন বেবিদের জন্য তৈরি। এরপর এখানে আসার পথে তুমি ওনার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছ যেমন, ভদ্রলোক খুব একটা ছুটি নেন না। উইকলি বাড়িতে যান। সংগে দেখো ওনার শার্টের পকেটে লঞ্চের টিকিটও দেখা যাচ্ছে। এর সংগে যোগ কর গত শুক্রবার উনি সালামকে সকালে বাড়ি যেতে দেখেছেন তারমানে উনি নিজে বাড়ি যাননি । এখন দুইদিন ছুটি নিয়ে যাচ্ছেন। এবার এই তথ্যগুলো কম্পাইল করো। আরও অনেক ধারনা পাবা ওনার সম্পর্কে।
আমি কিছু বললাম না।
ইকবাল ভাই বিস্মিত হয়ে বললেন, কত সহজ ব্যাপারগুলো জোড়া লাগিয়ে আন্দাজ করে ফেললেন। দারুন তো।
গুলজার হোসেন বললেন, আপনার চেহারা পর্যবেক্ষণ করেও অনেক কিছু বলা যায়। এই মূহুর্তে শুধু বলতে পারি আপনার বাচ্চার ডেলিভারি সিচুয়েশন সম্ভবত ক্রিটিকাল। এবং এটা সম্ভবত হঠাৎ করে হওয়া না। আগে থেকেই ছিল। প্রবাবলি প্লাসেন্টা নীচের দিকে জাতীয় কোন পজিশনিং ঝামেলা অথবা আপনার স্ত্রীর কোন ধরনের অসুখের কারনে রিস্ক আছে।
ইকবাল ভাই এবার একটু হতভম্ব হয়ে বললেন, কিভাবে বলছেন জানি না তবে সবগুলোই ঠিক। আমার স্ত্রীর সুগার বেশি হয়েছে এবং হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার সমস্যা আছে। ভাই আপনি অনেক ভালো অবজার্ভার কিন্তু ইমনের সংগে আমার কাছে কেনো এসেছেন?
গুলজার হোসেন বললেন, আমি এসেছি ইমনের বন্ধু সালাম এর খোঁজে। যেদিন আপনাদের এমডি খুন হয়েছে ঐদিন সালামদের ইমনের সঙ্গে ঐ রিসোর্টে থাকার কথা ছিল কিন্তু সালামরা যায়নি কোন কারনে। কেনো সেটা জানতে চাই।
ইকবাল ভাই একটু বিস্মিত হলেন মনে হলো , বললেন, এই তথ্য আমার জানা ছিল না। সালামের সাথে বৃহস্পতিবার অবশ্য দেখা হয়নি আমার, সে ঘুম থেকে উঠে অফিসে চলে গেছে, পরদিন ভোরে উঠে দেখি সালাম ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। যাওয়ার সময় বলে গেলো তার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে আর সে যাচ্ছে বাড়িতে, সেখান থেকে নাকি জরুরী খবর এসেছে।
আমি একটু বিস্মিত হলাম। আমার বন্ধুদের দেখি বিপদ আমার মতোই এসেছিল। একজনের বাবা মারা গেছে। আর একজনের মোবাইল হারিয়ে গেছে আর বাড়ি থেকে ইমার্জেন্সি খবর এসেছে।
ইকবাল ভাইয়ের কথা শুনে গুলজার হোসেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তেমন কিছু আর জিজ্ঞেস করার না থাকায় আমরা বের হয়ে এলাম। বাসায় ফেরার সময় গুলজার হোসেন বললেন, ইমন মনে হচ্ছে তোমার ঘটনার সাথে তোমার বন্ধুদের ঘটনারও যোগ আছে। আমি আরও একটু খোঁজ খবর করি আমার মতো। এর একটা ব্যাপার এতো বড় একজন প্রভাবশালী লোক খুন হয়ে গেল, তার সম্ভাব্য খুনী হিসেবে তোমাকে গ্রেফতার করা হলো অথচ তোমার জামিন কিন্তু দ্রুতই হয়ে গেল। সাধারণত শক্তিশালী লোকজন প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে, তোমার জামিনের ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। তুমি একটু সাবধানে থাকো ইমন। আর চিন্তা করো না , আমি আছি। ঠিকিই বের করে ফেলব কি হয়েছিল।
এরপরের দুইদিন কাটলো ঘরে শুয়ে বসে। মাঝখানে দুই একবার গুলজার আংকেল খোঁজ খবর করলেন, অফিস নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করলেন। এর মধ্যে একদিন অফিসে যেতে চেয়েছিলাম, অফিসে দুই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী নিষেধ করল আমাকে। গুলজার আংকেল বললেন দরকার হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।
ঠিক দুই দিন পর একদিন রাত আটটার দিকে বাসায় বসে আছি ,আমার মোবাইল বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি সালাম ফোন দিয়েছে। আমি দ্রুত ফোন ধরলাম, কিরে দোস্ত তুই কোথায় ? মোবাইল বন্ধ কেন? আমি কত বড় বিপদে পড়েছি।
সালাম বলল, জানি আমি। তুই দ্রুত আমার বাসায় আসতে পারবি? শীগগির আয়।
আমি একটা সিএনজি ভাড়া করে দ্রুত সালামের বাসায় হাজির হলাম। তাদের বিল্ডিং এ কোন দারোয়ান নাই। গেট তালা দেয়া থাকে বেশিরভাগ সময়। যার যার চাবি দিয়ে খোলে। শেষ যে দিন আমি আর গুলজার আংকেল এসেছিলাম সেদিন গেট খোলা ছিল, আজও খোলা দেখলাম। অনেকে একবার বের হয়ে গিয়ে আর তালা দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না হয়ত। আমি সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত তিন তলায় হাজির হলাম। কয়েকবার বেল বাজালাম, দরজা খুলল না কেউ। দরজার বাইরে তালা নেই, তারমানে সালাম বাসায়ই আছে। সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। ইকবাল ভাই নিশ্চয়ই এখনো ফেরেনি। আমি অধৈর্য হয়ে দরজার নবে হাত দিতেই দরজা খুলে গেল।
ভিতরে ঢুকে ডাক দিলাম , সালাম? সালাম?
কেউ সাড়া দিল না। ঘরের লাইট সব জ্বালানো। ব্যাটা কি ঘুমিয়ে গেল? আমি ড্রয়িং রুম পার হয়ে সালামের ঘরে উঁকি দিলাম, সালাম শুয়ে আছে। আমি গিয়ে ধাক্কা দিলাম।
--এই ব্যাটা ওঠ। কি হয়েছে খুলে বল?
এরপরই বুঝলাম কোন গোলমাল আছে। সালাম উলটে ছিলো। আমার ধাক্কায় সোজা হলো, দেখলাম একটা ছুরি ঢুকে আছে তার বুকে, সে এখনও বেঁচে আছে। গোঁ গোঁ জাতীয় শব্দ করছে।
আমি দ্রুত ছুরি ধরে বের করার চেষ্টা করলাম, সে ককিয়ে উঠল, বুঝলাম পারব না।
ফোন বের করে প্রথমে ইমার্জেন্সি ট্রিপল নাইনে কল দিলাম, এম্বুলেন্স পাঠাতে বললাম। এরপর ফোন দিলাম গুলজার হোসেনকে।
ফোন রিসিভ হলো, আমি বললাম হ্যালো গুলজার আংকেল।
কেউ একজন বলল, যাকে ফোন দিয়েছেন উনি তো এক্সিডেন্ট করেছেন, আপনার কি হয়? দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে আসুন।
আমি স্তদ্ধ হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি মিলিকে ফোন দেয়ার জন্য নম্বর বের করলাম। এই সময়ে কেউ একজন বলল, হ্যান্ডস আপ।
তাকিয়ে দেখি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে আমাকে। তখন সংবিৎ ফিরল, সালামের দিকে তাকালাম। স্থির হয়ে গেছে সে। বুঝলাম মারা গেছে, ও যদি সত্যিই মারা গিয়ে থাকে তাহলে ভয়াবহ বিপদে পড়েছি আমি আবার। এবং কেউ ভালোমত ফাঁসিয়েছে আমাকে।
রিসোর্টে_খুন
#পর্ব_০১_০২
©খোন্দকার মেহেদী হাসান