Paranormal Story

Paranormal Story পড়ুন বাংলা ভাষায় আপনার মনের মতো ভৌতিক গল্প প্যারানরমাল স্টোরি পেইজে আপনাদের স্বাগতম।
আপনাদের ভৌতিক ও রহস্যময় বিষয়ে অভিজ্ঞতা বাড়ানোর জন্যই আমাদের পেইজ। ❤️

24/10/2025

তখনও_সন্ধ্যা_নামেনি
ফারহানা_কবীর_মানাল

৭.
মঞ্জুরের বাসা যেমন হওয়া উচিত তেমন নয়। বেশ আলিসান। বাইরের দিকে বেলকনি মত আছে। বেলকনিতে টব সাজানো। গোলাপের গাছ আছে দু'টো। টকটকে লাল রঙের আধফোটা দু'টো কলি ধরে আছে। কলি দুটোকে দেখতে চমৎকার লাগছে। অফিসের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীর বাসা এমন হতে পারে? কেমন যেন খটকা লাগল। সেই সাথে নিজেকে বেশ নিচু মনের ভেবে ফেললাম। একজন মানুষের কাজকে ছোট করে দেখছি! ব্যাপারটা বেশ লজ্জার।

দুবার কলিং বেল বাজতেই দরজা খুলে গেল। মঞ্জুর বলল, “স্যার! আপনি?”

মঞ্জুরের চোখ কোটর থেকে বাইরে বেরিয়ে আসছে। চোখমুখের অবস্থা বলে দিচ্ছে সে আমাকে এখানে আসা করেনি। আমি একটু হাসলাম। সহজ গলায় বললাম, “তোমার বাসায় আসলে আমার মানসম্মান নষ্ট হবে না। কথাটা প্রমাণ করতে বাসা পর্যন্ত চলে এলাম। ভেতরে আসতে বলবে না?”

“জ্বি স্যার। আসুন। ভেতরে আসুন। মতিনের মা, দেখো কে এসেছে।”

ঘরে ঢুকে সোফায় বসলাম। বেশ দামী সোফা। মঞ্জুরের রুচি ভালো। মাঝবয়েসী এক মহিলা নাক পর্যন্ত ঘোমটা টেনে আমার সামনে এসে বসল। মিনমিনে গলায় বলল, “ভালো আছেন?”

তার কথার জবাবে শুধু হাসলাম। আমার হাসি দেখেই সে ভেতরে চলে গেল। মঞ্জুর বলল, “স্যার, রাতের খানাটা কিন্তু খেয়ে যেতে হবে। আজকের পাক খুব ভালো। গ্রাম থেকে দেশি মুরগি আর গলদা চিংড়ি আসছে। আমার বিবির রান্না খুব ভালো।”

অমত করলাম না। রাতের খাওয়া শেষ করে তারপরই বের হলাম। পুরোটা সময় মঞ্চুর তার জীবনের ঘটনা শুনিয়েছে। কীভাবে মেয়ে পছন্দ করে বিয়ে করেছে, কীভাবে কী করল সবকিছুই বলল। বাসর রাতের ঘটনাও কিছু বলল। থামিয়ে না দিলে হয়তো আরও বলত। বাঁচাল লোকেরা কথায় কথায় অনেক কিছুই বলে ফেলে। হুঁশ করতে পারে না।

রাস্তায় দুই চারটে রিকশা আছে। হাত নাড়িয়ে একটা রিকশা ডাকলাম। হাসপাতালে যাব। তুহিন ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। সন্ধ্যার দিকে ওখানকার এক ওয়ার্ড বয়কে কল দিয়েছিলাম। তুহিন ভাইয়ের অবস্থা আগের চেয়ে ভালো। কথাবার্তা বলতে পারছে।

তুহিন ভাই আমাকে দেখে একটুও চমকালে না। যেন সে জানত আমি আসব। হাতে করে এক ঠোঙা বাদাম নিয়ে এসেছি। বাদামের ঠোঙাটা তার হাতে দিয়ে বললাম, “কী অবস্থা? শরীর ভালো?”

“ভালো।”

“তারপর?”

“তারপর আর কী! কিছুই না।”

“আপা এসেছিল?”

“নাহ! সে আমার খোঁজ খবর রাখে না। প্রয়োজন মনে করে না।”

“একটা প্রশ্ন করব?”

“হু।”

“হঠাৎই আপনাদের মধ্যে কী এমন হলো যে আপা আপনার খোঁজ পর্যন্ত নিচ্ছে না। অথচ গতবার যখন আপা আমাদের বাড়িতে এলো মিনিটে মিনিটে ফোন দিয়ে আপনার খোঁজ নিয়েছে।”

তুহিন ভাই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। তরল গলায় বলল, “সবই আমার কপাল। পৃথিবীতে এমন অনেক মানুষ থাকে যাদের কপালে সুখ সহ্য হয় না।”

“এ কথা কেন বলছেন?”

সে আবারও দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল। ফট করেই আমি তার হাত চেপে ধরলাম।

“তুহিন ভাই, আপনার সাথে আমার সম্পর্ক খারাপ না। ভাইয়ের মত। আমাকে তো বলতেই পারেন।”

“বললে কী কিছু বদলে যাবে?”

“তবুও বলেন।”

“অন্য একদিন বলব। এখন ইচ্ছে করছে না।”

তুহিন ভাই খোসা ছাড়িয়ে বাদাম খাচ্ছে। একটা একটা বাদাম ছিলছে, খোসা ছুঁড়ে ছুঁড়ে মেঝেতে ফেলছে। সে বর্তমানে কেবিনে আছে। হুট করেই চিৎকার করার কেউ নেই বিধায় এতটা করার সাহস পাচ্ছে।

“রাতের খাবার খেয়েছেন?”

“খেয়েছি। হাসপাতাল থেকে দিয়েছিল। জ’ঘ’ন্য স্বাদ। জীবন বাঁচতে হবে, তাই চোখ নাক বন্ধ করে গিলে ফেলেছি।”

“আপনি অসুস্থ আপনার বাড়ির লোকেদের বলেননি?”

“বললে কী হতো? তারা কী আমায় সুস্থ করে ফেলত?”

“আপনার কী হয়েছে বলেন তো?”

“আমার কথা বাদ দাও। তোমার কথা বলো।”

“আমার কথা আর কী বলব! অফিসে গিয়েছিলাম। টুকটাক কাজকর্ম করলাম। শরিফুল সাহেব তার বাসায় ডেকেছিল।”

“বাসায় ডেকেছিল?”

তুহিন ভাই খুব উত্তেজিত হয়ে প্রশ্ন করল। তার চোখ জ্বলছে। চট করে তার কথার জবাব দিলাম না। সে আরও একই প্রশ্ন করল।

“হ্যাঁ।”

“কী বলেছে?”

“স্যারের মেয়েকে টিউশনি পড়াতে হবে।”

তুহিন ভাই আমার হাত চেপে ধরল। মাথা দুলিয়ে বলল, “এই ভুল করো না। জীবন শে'ষ হয়ে যাবে।”

“জীবন শে'ষ হয়ে যাবে মানে?”

সে হাতের উপর ভর করে উঠে দাঁড়াল। কেবিনের দরজা খুলে বাইরে উঁকি দিলো। আশেপাশে কেউ আছে কি-না নিশ্চিত করে এসে আমার গা ঘেঁষে বসল। গলার স্বর অনেকখানি নিচু করে বলল, “নজু, তুমি আমার ভাইয়ের মত। বিয়ের পর থেকে তোমার সাথে আমার সম্পর্ক ভালো। ঝগড়াঝাঁটি হয়নি। তর্কাতর্কি, মুখ কালকালিও না। তোমাকে আমি আমার ভাইয়ের মত ভালোবাসি। ভাই হিসেবেই বলছি– এই ফাঁ’দে পা দিও না।”

“আমি আপনার কথা বুঝতে পারছি না।”

হঠাৎই তুহিন ভাই কাঁদতে শুরু করল। জড়ানো গলায় বলল, “এই ফাঁ’দে পা দিয়ে আমার সুখের সংসার শেষ হওয়ার পথে। জীবন নিয়েও টানাটানি।”

“খুলে বলুন। অর্ধেক অর্ধেক কথা বলবেন না।”

“বলব। আমাকে বলতেই হবে। আমার মত করে আমি তোমার জীবন ন’ষ্ট হতে দেব না।”

তুহিন ভাই হাতের উল্টো পিঠ দিয়ে চোখের পানি মুছল। পানির বোতল নিয়ে পানি পান করল। লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “বছর খানেক আগের কথা, অফিসে একটা ঝামেলা হয়েছিল। মাস দুয়েকের জন্য বেতন বন্ধ। ঝামেলার কয়েকদিন আগেই তোমার আপাকে সোনার একটা গহনা গড়িয়ে দিয়েছি। হাতে টাকা পয়সা নেই। বাজার-সদাই করতে ঝামেলা হয়। এই নিয়ে তোমার আপার সাথে টুকটাক অশান্তি লেগেই থাকত।”

“এর সাথে আমার টিউশনি পড়ানোর সম্পর্ক কী?”

“সম্পর্ক আছে। যেন পরিষ্কার বুঝতে পারো তাই পুরো ঘটনা খুলে বলছি।”

“আচ্ছা বলুন। আমি শুনছি।”

“টাকা না থাকলে বেশিরভাগ মানুষই তোমাকে বাঁকা চোখে দেখবে। ঘরের বউও যা ইচ্ছে ব্যবহার করবে। নিজের মন মেজাজ ভাল থাকবে না। আমার এই সবগুলো সমস্যা আমার ভেতরে দেখা দিলো। টাকার চিন্তায় মাথা খারাপ। অফিসে কোন সুরাহা হয় না। এর মধ্যেই শরিফুল সাহেব আমাকে তার বাসায় ডেকে নিয়ে গেলেন। তার মেয়েকে পড়াতে হবে। বেতনের পরিমাণ খুব বেশি। লোভনীয় অফার। মেয়ের পড়াশোনার খরচ তার মামা দেয় বিধায় বেতন নিয়ে কোন চিন্তা নেই। সাত-পাঁচ না ভেবেই রাজি হয়ে গেলাম। ভাবনার কিছু ছিলও না। অফিসের বসের মেয়ে। এখানে চিন্তা কী? পড়ানো শুরু করলাম। মাসখানেক ভালোই চলল। ঠিক তারিখে বেতন হাতে পেলাম। এর মধ্যে অফিসের সমস্যা মিটে গেছে। আমার খুশি দেখে কে!”

“তারপর কী হলো?”

“দ্বিতীয় মাসের প্রথমদিন টিউশনে যেতেই দেখি– রিমি শাড়ি পরে বসে আছে। তাকে নাকি দেখতে এসেছিল। বিয়ের কথা চলছে। মেহমানদের জন্য যে-সব খাবারের আয়োজন হয়েছিল। সেগুলো আমাকে খেতে দেওয়া হলো। সারাদিনের ক্লান্তি নিয়ে পড়াতে গিয়েছি। গোগ্রাসে সব খাবার খেয়ে ফেললাম। তারপর আমার আর কিছু মনে নেই।”

“আর কিছু মনে নেই বলতে?”

“মনে নেই বলতে অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিলাম। কতক্ষণ অজ্ঞান ছিলাম ঠিক খেয়াল করতে পারি না। জ্ঞান ফিরে দেখি গায়ে কোন কাপড় নেই। সোফায় শুয়ে আছি। আমি তো আকাশ থেকে পড়লাম। আশেপাশে তাকিয়ে দেখি– কেউ নেই। এই অবস্থা কাউকে ডাকতেও পারছিলাম না। ঘর খোঁজা খুঁজি করে একটা শপিং ব্যাগ পেলাম। ব্যাগের ভেতরে নতুন কাপড়। তড়িঘড়ি করে ওই কাপড় পরে বাইরে চলে এলাম। আমার মাথায় কোন কাজ করছিল না। কী হলো না হলো কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। শরিফুল সাহেবের কাছেও কিছু জিজ্ঞেস করতে পারছিলাম না। গলায় কাঁ'টার মত ফুটে রইল ব্যাপারটা।”

“এই ব্যাপার খোলাসা হয়নি?”

“হয়েছে। পরদিন অফিসে যেতেই শরিফুল সাহেব আমাকে ডেকে পাঠালেন। আমার হাতে একটা মেমোরি কার্ড ধরিয়ে দিয়ে বললেন– এখানে কিছু ফাইল আছে। দেখে আমাকে উত্তর জানান। আমি একটু বাইরে যাচ্ছি। ক্যাসেল হোটেলের দিকে যাব। ওখানে এসে জানিয়ে যাবেন। কেমন?”

“কী ছিল?”

“আমার ছবি। ভিডিও।”

তুহিন ভাইয়ের চোখে পানি চলে এসেছে। সে খানিকক্ষণ ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। চোখ মুছতে মুছতে বলল, “নিজেকে ওই অবস্থায় দেখে কী করব বুঝতে পারছিলাম না। মাথায় কাজ করছিলাম না। অমন কুৎসিত জিনিস আমি আমার জীবনে আর কিছু দেখিনি। তড়িঘড়ি করে ক্যাসেল হোটেলে ছুটলাম। শরিফুল সাহেব আমাকে দেখে দেদার হাসলেন। তাচ্ছিল্য করে বললেন– আপনার ফিগার বেশ চমৎকার। আকাশের রঙের দুনিয়ায় গেলে এক চান্সে টিকিট পাকা।

‘কেন করছেন এসব?’

‘আপনাকে আমার হাতের পুতুল বানাতে। অবশ্য টাকার গন্ধ পেলে মানুষ সহজেই বিবেক বিক্রি করে দেয়। তবুও আমি কোথাও কোন খাদ রাখতে চাই না। সীসা গলা প্রাচীরে ছিদ্র থাকে না।’

‘কী চান আপনি?’

‘তোমাকে আমার হয়ে কাজ করতে হবে। যা বলব তা-ই করতে হবে। আর আমি জানি, তুমি নিজের অমন ফিগার লোককে দেখাতে চাইবে না।’

‘কী কাজ আপনার?’

‘ব্যবসা! ব্যবসার কাজ।’

‘ব্যবসাটা কিসের?’

‘ই'য়া'বার। গোলাপি রঙের ছোট ছোট ওষুধ। খেতে বেশ দারুণ।’

‘এই ব্যবসার আসল উদ্দেশ্য কী?’

‘ধীরে ধীরে জানবে। এত তাড়া কিসের? শিকারকে আমি খুব যত্ন নিয়ে নিজের বশে আনি।’

তুহিন ভাই থামল। দু-হাত দিয়ে নিজের কপাল চেপে ধরে বলল, “আমি ওর ওই ফাঁদ থেকে আর বের হতে পারিনি। টাকা লোভ, সম্মানের ভয় সবকিছু মিলে আমি, আমি শে'ষ হয়ে গেছি।”

“আপা তাহলে সত্যি কথা বলেছে!”

“হ্যাঁ। ও আমার হা'রা'ম টাকা খাবে না। আমার ছেলেকেও খেতে দেবে না।”

তুহিন ভাই অদ্ভুত আচরণ শুরু করল। অনেক কষ্টে তাকে থামালাম। ডাক্তার ডেকে দেখালাম। ডাক্তার বললেন, “উত্তেজিত হয়ে এমন করছে। সমস্যা নেই। টেনশন ফ্রি থাকার ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। খেয়ে ঘুমাবে।”

ওষুধ খাওয়াতে তাকে বেশ জোর করতে হলো। কিছুতেই খাবে না। অনেক বলার পর মুখে নিলো। কোনরকমে ওষুধটা গিয়ে শুয়ে পড়ল। শোয়ার প্রায় সাথেই সাথেই ঘুমিয়ে গেল। তুহিন ভাই ঘুমানোর পর শরিফুল সাহেব এলেন। তিনি আমাকে দেখে ভীষণ অবাক হলেন। বিস্মিত গলায় বললেন, “তুমি এখানে?”

“দেখতে এসেছিলাম।”

“ওহ আচ্ছা!”

শরিফুল সাহেব খানিকক্ষণ বসে চলে গেলেন। রাতে আর বাড়িতে ফিরলাম না। হাসপাতালে রয়ে গেলাম। নীল কচুর ব্যাপারে একটা স’ন্দে’হ মাথায় ঘুরছে। মঞ্জুরের বেলকনিতে রাখা বেশ কয়েকটা টব ফাঁকা। ফাঁকা বললে ভুল হবে। টবে কোন গাছ ছিল। গাছগুলো গোড়া মে'রে কে'টে নেওয়া হয়েছে।

পরেরদিন অফিসের সময়টা খুব স্বাভাবিক। গিয়ে কাজকর্ম করলাম। কেউ আমাকে কিছু বলল না। আমিও কাউকে কিছু বললাম না। সন্ধ্যায় রিমিকে পড়াতে গেলাম। সে শাড়ি পরে বসে আছে। আমাকে দেখেই মুচকি হেসে লম্বা সালাম দিলো। লজ্জা মাখা মুখে বলল, “স্যার, আমাকে দেখতে এসেছিল।”

চলবে

23/10/2025

তখনও_সন্ধ্যা_নামেনি
ফারহানা_কবীর_মানাল
#পর্ব_০৬

বসার ঘরের উত্তর কোণায় একটা ইজিচেয়ার রাখা। চেয়ারের পাশে ছোট্ট টেবিলে কাঁচের গ্লাস। গ্লাসে লাল রঙের তরল লেগে আছে। র'ক্ত নাকি? কথাটা মাথায় আসতেই চমকে উঠলাম। যেন শিরদাঁড়ার ভেতরে ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। তবে কী মঞ্জুরের কথা ঠিক? এই বাড়িতে মানুষখে’কো থাকে? হঠাৎই শরীরটা একটু খারাপ লাগতে শুরু করল। শরিফুল সাহেব বললেন, “নজু, জবুথুবু হয়ে বসে আছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে?”

“জ্বি স্যার। শরীরের ভেতরে ভালো লাগছে না। কেমন শীত শীত করছে।”

শরিফুল সাহেব আৎকে এসির দিকে তাকালেন। জিভ কামড়ে বললেন, “মেয়েটার কাণ্ড দেখেছ! এসির তাপমাত্রা সতেরোয় সেট করে রেখেছে। দাঁড়াও! দাঁড়াও! আমি দেখছি।”

এসির তাপমাত্রা পঁচিশে সেট করা হলো। মাঝবয়েসী এক মহিলা এসে চা নাস্তা দিয়ে গেলেন। শরিফুল সাহেব বললেন, “তোমার বাসায় ডাকার বিশেষ একটা কারণ আছে।”

“জ্বি স্যার।”

“কারণটা ব্যক্তিগত। অফিসে বলা সুবিধার মনে হয়নি।”

“কী কারণ?”

খানিকটা সংকোচ নিয়েই প্রশ্নটা করলাম। তিনি বললেন, “আমার একটাই মেয়ে। ওর নাম রিমি। এ বছর এইচএসসি পরীক্ষা দেবে। পড়াশোনায় খুব বেশি ভালো না, আবার অনেক খারাপও না। মাঝামাঝি ধরনের স্টুডেন্ট। ওর জন্য একজন টিচার প্রয়োজন। বেতন নিয়ে কোন চিন্তা নেই। বাড়িতে এসে ঘন্টা খানেক পড়িয়ে যাবে। চা নাস্তার বাইরে পাঁচ হাজার টাকা।”

“আমাকে এসব বলছেন কেন?”

“আমি চাইছি তুমি আমার মেয়েকে পড়াও। আজকালকার ছেলেদের বিশ্বাস হয় না। এরা ছাত্রীদের সাথে প্রেম করা শুরু করে দেয়।”

“আমাকে এতটা বিশ্বাস করছেন কীভাবে?”

শরিফুল সাহেব কথার জবাব দিলেন না। ঠোঁট চেপে হাসলেন। চা শেষ। চায়ের স্বাদ ভালো। আরও এক কাপ খেতে ইচ্ছে করছে। মুখ ফুটে চাইতে পারলাম না। চানাচুর চিবুতে লাগলাম।

“কী ভাবছ? পড়াবে?”

“অফিসের কাজ শেষ করে পড়ানোর সময় পাওয়া যাবে না। তাছাড়া আমার শরীরও খুব একটা ভালো না। ডাক্তার কিছুদিন বিশ্রাম নিতে বলেছে।”

“অফিসের কাজ সম্পর্কে আমার ধারণা স্পষ্ট। ওখানে খুব বেশি কাজ নেই।”

“আচ্ছা বেশ। রিমিকে ডাকুন। ওর সাথে কথা বলে যাই।”

শরিফুল সাহেব রিমির নাম ধরে ডাকতে ডাকতে ঘরের ভেতরে চলে গেলেন। রিমিকে পড়ানোর ইচ্ছে আমার নেই। ডেকেছি কারণ ওর কণ্ঠস্বর শুনতে হবে। রাতের মেয়েটার কণ্ঠস্বর কি-না নিশ্চিত হওয়া প্রয়োজন।

রিমি এলো মাথায় ঘোমটা টেনে। লম্বা সালাম দিয়ে বলল, “স্যার, আমি আপনার কাছে পড়ব না।”

“পড়বে না যখন স্যার ডাকছ কেন?”

“কারণ আপনাকে মাস্টারদের মত গম্ভীর মনে হচ্ছে।”

“আচ্ছা।”

“স্যার, কিছু মনে না করলে একটা কথা বলব?”

“বলো।”

“আপনার মাথার বামপাশের একটা চুল পেকে গেছে। কলপ দিয়ে নিবেন। নয়তো আপনার বিয়ে হবে না। হিহি।”

“আচ্ছা রিমি, তোমাকে একটা প্রশ্ন করি।”

“করুন।”

“নিজের সীমানা ভুলে গেলে খুব বিপদ হবে– এই বাক্যটা একবার বলো তো।”

রিমি তোতাপাখির মত বাক্যটি বলল। পরক্ষণেই চোখ-মুখে বিস্ময়ের ভাব ফুলিয়ে ফেলল।

“কী আশ্চর্য! আপনিও এই বাক্যটি বলতে বললেন!”

“আর কেউ কী বলতে বলেছিল?”

রিমি কথার জবাব দিতে পারল না। শরিফুল সাহেব চলে এলেন। তিনি আমাদের দূরে সরে ফোনে কথা বলছিলেন। ফোনটা পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, “কথা শেষ হলো?”

আমি বললাম, “জ্বি, হয়েছে। আমি ওকে পড়াব। সপ্তাহে চারদিন সন্ধ্যার পরে এসে পড়িয়ে যাব। আগামীকাল থেকেই আসব।”

শরিফুল সাহেব হাসলেন। রিমি ঘরে চলে গেল। দরজার ওপাশে গিয়ে উঁকি দিয়ে একবার তাকাল। তারপর ভেতরে ঢুকে গেল।

রাস্তায় তেমন লোকজন নেই। ল্যামপোস্টের আলো জ্বলছে। ফোন কলের রহস্য ভেদ করতে পারছি না। এই নিয়ে দু'বার অনুরিমার ফোন নম্বর নিলাম। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে সে দু'বার দু'টো নম্বর দিয়েছে। গলার স্বরও আলাদা। প্রথমবার অনুরিমার কণ্ঠের সাথে ফোনের মেয়েটার গলা বেশ মিল ছিল। ভিন্ন শোনালেও, তাদের গলা এক। একটু আলাদা করে কথা বলার চেষ্টা করলে যেন শোনায় তেমন। কিন্তু দ্বিতীয়বার তেমন মনে হয়নি। কাল রাতের মেয়েটার সাথে রিমির গলার খুব মিল। মিল বললে ভুল হবে, হুবহু একই গলা। রহস্যটা কী? এসবের পেছনে কে আছে? দীর্ঘশ্বাস ছাড়লাম।

একের পর এক প্রশ্ন তৈরি হচ্ছে। কিন্তু কোন প্রশ্নের উত্তর নেই। ছোট আপা তুহিন ভাইয়ের ব্যাপারে যা বলেছে তা আমার বিশ্বাস হয়নি। আবার ঠিক অবিশ্বাসও করতে পারিনি। এই ব্যাপারে তুহিন ভাইয়ের সাথে কথা বলতে হবে। ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি– কীভাবে এমন সমস্যা হলো তিনি খুঁজে বের করবেন। আমার এক বন্ধু আছে পুলিশে চাকরি করে। ওর সাথে একবার কথা বলতে হবে। যদি কোন সমাধান পাওয়া যায়।

ডাক্তার সাহেব মাথা নিচু করে বসে আছেন। তার চোখমুখ শান্ত, তবে তিনি খুব চিন্তায় আছেন।

“স্যার, কিছু জানতে পেরেছেন?”

“দেখুন মিস্টার নজু, আপনার ব্যাপারটা আমি সিরিয়াসলি নিয়েছি। আমার পক্ষে যতটা করা সম্ভব আমি করেছি।”

তিনি আমার হাতে বেশ কিছু কাগজ দিলেন। টেস্টের রিপোর্ট। কাগজগুলো উল্টেপাল্টে দেখতে লাগলাম। তুহিন ভাইয়ের রিপোর্ট। ডাক্তার সাহেব বললেন, “বেশ কয়েকটা টেস্ট করেছি। সিরাম ক্যালসিয়াম: ৭.৮ মিলিগ্রাম প্রতি ডেসিলিটার। যা স্বাভাবিকের চেয়ে কম। প্রস্রাবের মাইক্রোস্কোপিতে অক্সালেট স্ফটিক পাওয়া গেছে। ক্রিয়েটিনিনও স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে বেশি।”

“এর মানে কী?”

“সবকিছুর মিলিয়ে বলা যায় তুহিনের শরীরের নীল কচুর রস ঢুকেছে। খাবারের সাথে খেয়েছে এই ব্যাপারে কোন স’ন্দে’হ নেই। এখন প্রশ্ন ইচ্ছে করে খেয়েছে নাকি কেউ তার অজান্তে খাইয়ে দিয়েছে।”

“আমি ঠিক বুঝলাম না। তুহিন ভাই বিরিয়ানি খেয়েছিল। বিরিয়ানি সে নিজেই কিনে এনেছে।”

“আপনাকে তো আগেই বলেছি যে কোন বি'ষ'ক্রি'য়ার প্রভাবে এমন হয়েছে। নীল কচুর রসে থাকা ক্যালসিয়াম অক্সালেট ক্রিস্টাল র’ক্তের ক্যালসিয়াম কমিয়ে দেয়।”

“বলতে চাইছেন– বিরিয়ানিতে নীল কচুর রস মেশানো ছিল?”

“থাকতে পারে। আবার অন্য কোন খাবারও থাকতে পারে। নিশ্চিতভাবে বলার জন্য খাবার পরীক্ষা করে দেখতে হবে।”

“ছোট্ট একটা প্রশ্ন ছিল।”

“নীল কচুর রসের কারণে ডাইরিয়ার মত সমস্যা হতে পারে?”

“হতে পারে। পরিমাণে খুব অল্প হলে এমন হতে পারে।”

একটা ব্যাপার পরিষ্কার হলো। বিরিয়ানির ভেতরে নীল কচুর রস মেশানো ছিল। তুহিন ভাই যে প্যাকেট খেয়েছিল– তাতে রসের পরিমাণ বেশি ছিল। আমাদের বেলায় কম। অর্থাৎ তুহিন ভাই এই ব্যাপারে কিছু জানত না। জানলে নিজের এমন ক্ষ’তি করে বসত না। তাহলে কে জানত? অনুরিমা? ছোট আপা? নাকি অন্য কেউ? এতসব রহস্য আমার একার পক্ষে ভেদ করা সম্ভব না। এমন একজনকে প্রয়োজন যে এই ব্যাপারে ভালো বুঝবে। ভালো মানের একজন গোয়েন্দা খুঁজতে হবে। টাকা গেলে যাক। কিনারায় পৌঁছাতে না পারলে হাবুডুবু খেতে খেতে মা'রা যাব।

রাত দশটার মত বাজে। বাড়ি ফিরতে ইচ্ছে করছে না। ফোন বের করে অনুরিমাকে কল দিলাম। অনুরিমা কল রিসিভ করে সালাম দিলো। সহজ গলায় বলল, “নজু ভাই, কিছু বলবেন?”

“তেমন কিছু বলব না। ভালো লাগছিল না, তাই তোমাকে কল দিলাম।”

“ওহ! দুঃখিত নজু ভাই। কিন্তু এখন আমার গল্প করার সময় নেই।”

“কাজ করছ?”

“জ্বি। মায়ের সাথে আছি। পরে সময় পেলে আপনাকে কল দেব।”

“রুপসীর নম্বর দিতে পারবে?”

“না ভাই। রুপসী কাউকে নিজের নম্বর দেয় না। আমার কাছে আছে। কিন্তু অনুমতি ছাড়া আপনাকে আমি ওর নম্বর দিতে পারব না।”

“ঠিক আছে। ভালো থাকো।”

অনুরিমা কল কে'টে দিলো। যাওয়ার জায়গায় না পেয়ে বাড়িতে চলে এলাম। জারিফ ঘুমায়নি। ছোট আপা ওকে কোলে নিয়ে হাঁটাহাটি করছে। হাতমুখ ধুয়ে জারিফকে কোলে নিলাম। ছোট আপাকে বললাম, “আপা, তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে।”

“আমার সাথে কথা আছে? কোন ব্যাপারে?”

“তুহিন ভাইয়ের ব্যাপারে।”

“ওর ব্যাপারে আমি কোন কথা বলতে চাই না।”

“না চাইলেও বলতে হবে। তুহিন ভাইয়ের সাথে তোমার কথা হয়? কেমন কী আছে জানো কিছু?”

“আমার সাথে কথা হয় না। বোধহয় ভালো আছে।”

“কীভাবে বুঝলে? তুমি কী তাকে কল দিয়েছ?”

“বেশ কয়েকবার দিয়েছিলাম। কল রিসিভ করে না।”

“তোমাদের বাসায় গিয়েছিলে?”

“না। কোথাও যাইনি। তুহিন ঠিকই আছে। ভালোমন্দ কিছু হলে ওর বাড়ির লোক আমাকে জানাত। তাছাড়া সে আমাকে কিছু কেন জানাবে? আমি তো তার কিছু হই না।”

শেষ কথাগুলো বলতে আপার গলা ধরে এলো। আমি আর তুহিন ভাইয়ের অবস্থা বললাম না। জারিফকে আপার কোলে দিয়ে ঘরে চলে এলাম। রাতে আর কোন কল এলো না।

মঞ্জুর চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে আছে। ভাবসাব দেখে মনে হচ্ছে সে এখানে দাঁড়াতে চাইছে না।

“কী হয়েছে? কোন কাজ আছে?”

“না স্যার, কোন কাজ নেই। তয় এসির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকতে ভালো লাগে না।”

“আচ্ছা, তোমার বাড়ি কোথায়?”

“দেশের বাড়ি নড়াইলে। কাজের খোঁজে এদিকে এসে ছিলাম। আর ফেরা হয়নি।”

“এখানে কোথায় থাকো?”

“বাসা ভাড়া করে থাকি। আমার বাসায় যাবেন স্যার?”

“দাওয়াত দিলে যাব। দেবে নাকি?”

মঞ্জুরের চোখ-মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল। ঝলমলে গলায় বলল, “দেব না কেন? গরিব হতে পারি মেহমান খাতিরে আমার সাথে বাঘা-বাঘা লোকেরাও ফেল করবে।”

“তাহলে আজ রাতে তোমার বাসায় আসছি। ভালো-মন্দ কিছু করতে হবে না। এমনিতে আমার বেড়াতে যাওয়ার মত বাড়িঘর নেই। তাই তোমাকে বললাম।”

সে দাঁত বের করে হাসল। লজ্জা লজ্জা ভাব করে বলল, “স্যার, বিয়েসাদী করেন কেন?”

“ভালো মেয়ে পেলে করব। চাকরি জুটে গেছে। এখন আর অমত নেই।”

মঞ্জুর হেসে বেরিয়ে গেল। আমার খুব বিরক্ত লাগছে। নানান রহস্য একসাথে দলা পাকিয়ে আছে। কূল কিনারা পাচ্ছি না। এই পরিস্থিতি খুব বিরক্তির।

অফিস শেষে রুপসীর সাথে দেখা। রুপসী আমায় দেখে অল্প হাসল।

“আপনি অনুরিমার কাছে আমার ফোন নম্বর চেয়েছেন?”

“চেয়েছিলাম।”

“কেন চেয়েছেন?”

“কথা বলতে ইচ্ছে করছিল।”

“আসলে আমি কাউকে আমার ফোন নম্বর দেই না। সবাইকে বলা আছে। যেন কেউ কাউকে আমার নম্বর না দেয়।”

“আমি কী পেতে পারি?”

রুপসী আমার দিকে তাকাল। অন্যরকম গলায় বলল, “রাতবিরেত কল দিয়ে বিরক্ত না করলে পেতে পারেন।”

“আচ্ছা বেশ।”

রুপসী নিজের ফোন নম্বর বলল। নম্বরটা সেভ করে নিয়ে বললাম, “মাঝেমধ্যে কল দিয়ে বসতে পারি। বিরক্ত হলে বলবে।”

“আচ্ছা একটা কথা, মঞ্জুর ভাই কী করেছে কিছু জানেন?”

“না তো। কেন কী হয়েছে?”

“কবির ভাইকে দেখলাম উনাকে খুব ধমকাচ্ছে।”

ডানে-বামে মাথা দোলালাম। রুপসী চলে গেল। সে চলে যেতেই মঞ্জুর এলো। ম'রা গলায় বলল, “আপনাকে আমার বাসায় নিয়ে যেতে পারব না।”

“কেন পারবে না?”

“গরিব মানুষের বাসায় গেলে আপনাদের মানসম্মান থাকবে না।”

কথাটা বলে সে হনহনিয়ে চলে গেল। কোন কিছু জিজ্ঞেস করার সুযোগ দিলো না। ব্যাপারটা আমার কাছে ভালো লাগল না। সাজ্জাদকে কল দিয়ে বললাম, “আমার একটা কাজ করে দিতে পারবি?”

সাজ্জাদ বলল, “কী কাজ?”

“একজন গোয়েন্দা ঠিক করতে হবে। জাদরেল ধরনের। সে সব রহস্য সমাধান করতে পারবে।”

“তা না হয় বুঝলাম। কিন্তু গোয়েন্দা দিয়ে তুই কী করবি?”

“মাথায় দেব।”

কল কে'টে দিলাম। ভুলভাল প্রশ্ন শুনলে মাথা গরম হয়ে যায়। মাথার মধ্যে বিরক্তিকর অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ে।

চলবে

১.অদৃশ্য সুতোর টান
নাইমা আজ-কাল ঘুমুতে পারছে না। মাঝরাতে ঘর্মাক্ত শরীর নিয়ে জেগে উঠছে। তার শরীর ঘেমে যাবার মূল কারণ তীব্র ভয়। জেগে ওঠার পর কয়েক মিনিট তার বুক ধড়ফড় করে। নিঃশ্বাস ঘন হয়ে যায়। তারপরই আবার সব ঠিক। এ ঘটনা একদম নতুন। কয়েকদিন আগে আরম্ভ হয়েছে। সুুমনা মেয়েটাও এর জন্য বেশ অনেকটা দায়ী। সেদিন পড়ার ফাঁকে হুট করে তার ভাবীর গহনা হারিয়ে যাবার কথা তুলল। বলল– ‘নতুন ভাবীর অবস্থা বেশি ভালো না। সারাটা দিন কাঁদে। চাচি বলেছে অমন বউ ঘরে রাখবে না। ফাহিম সাথে তা’লা’ক করিয়ে দেবে। ভাবীর তিন কূলে কেউ নেই। এতিমখানায় মানুষ হয়েছে। খুব বেশি পড়াশোনাও জানে না।’ সুমনার ভাবীর হারিয়ে যাবা হারের নকশা তাকে খুব টানছে। সে এই আকর্ষণ অগ্রাহ্য করতে পারছে না।

২.প্রিয় শ্রাবণ
বিয়ের পরেই তিথিকে বাপের বাড়িতে রেখে চলে যায় নাইম। খোঁজ নেওয়া বলতে ওই ফোনের কথাবার্তা। তিথির খুব ইচ্ছে স্বামীর সাথে সংসার করবে। মাঝেমধ্যেই সে স্বামীর কাছে চলে যেতে চায়। পারে না? সব পেরিয়ে কী তিথির সংসার হবে?

20/10/2025

তখনও_সন্ধ্যা_নামেনি
ফারহানা_কবীর_মানাল
#পর্ব_৫

হাসপাতালের পরিবেশ শান্ত হয় না। কোথাও না কোথাও কেউ না কেউ কাঁদতে থাকে। বাচ্চারা কাঁদে, বুড়োরা কাঁদে। আজ কেউ কাঁদছে না। সব কেমন ঝিমিয়ে পড়েছে। নাকি কাঁদছে? একটু খোঁজ খবর করে দেখতে হয়। নিঃশব্দে বিছানা ছেড়ে নামলাম। শান্ত পায়ে হেঁটে বারান্দায় এসে দাঁড়ালাম। বাতাস বইছে। হালকা ধরনের বাতাস। কেউ কোথাও নেই। চাঁদের আলো আছে, হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছে।

বারান্দার এক কোণে একটা ছায়া দেখা যাচ্ছে। গুটিগুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ার মানুষটা ছোট আপা। আপা আমাকে দেখে চমকে উঠল। হাতের ফোনটা কাপড়ের নিচে লুকোতে লুকোতে বলল, “তুই এখানে?”

“তুমি এখানে কী করছ?”

“কই! কিছু করছি না তো। ভালো লাগছিল না। তা-ই।”

“ওহ আচ্ছা!”

“বললি না তো তুই এখানে কী করছিস?”

“তোমাকে দেখছি।”

আপা একটু চমকালো। আমতা আমতা করে বলল, “আমাকে দেখছিস মানে?”

“তেমন কিছু না। বাদ দাও।”

আপা হাসার চেষ্টা করল। আপার ফোনের লাইট জ্বলছিল। এত রাতে ফোনে কী কাজ থাকতে পারে? আমাকে কল দিয়েছিল? আর কিছু ভাবতে ইচ্ছে করল না। আপা বলল, “ঠান্ডা বাতাসে দাঁড়িয়ে থাকিস না। জ্বর-টর হবে।”

“ঠিক আছে।”

বলেই বিছানায় চলে এলাম। আপা আমার পিছন পিছন এলো। বাকি রাতটা আর ঘুমতে পারলাম না। অদ্ভুত কষ্ট বুকে জড়িয়ে বিছানায় পড়ে রইলাম।

সকাল দশটার দিকে ডাক্তার সাহেব এলেন। শরীরের অবস্থা জিজ্ঞেস করে ছুটি দিয়ে দিলেন। বড় আপা বলল, “নজু রে! তোর তো ছুটি হয়ে গেল। আমরা কী এখানেই থাকব নাকি?”

“আর একটা দিন থেকে যাও। ডাক্তার তো বলল– তোমাদের শরীর এখনও ঠিক হয়নি।”

বড় আপা মন খারাপ করে ফেললেন। ছাড়পত্র পেতে দুপুর দু'টো। ভরদুপুরে বাড়িতে গিয়ে বসে থাকতে ইচ্ছে করে না। আজকেও করছে না। এই শরীর নিয়ে রাস্তায় হাঁটাহাঁটি করা যাবে না। অনেক ভেবে অফিসের দিকে এলাম। অফিসে ঢুকতেই রূপসী এগিয়ে এলো। কোমল গলায় বলল, “আপনার শরীর কেমন আছে?”

“ভালো আছে। আগের চেয়ে অনেক সুস্থ।”

“আর আপনি কেমন আছেন?”

আমি একটু অবাকই হলাম। বিস্মিত মুখে রূপসীর দিকে তাকাতাম। রূপসী বলল, “শরীর মন দুটোই ভালো থাকলে মানুষ ভালো থাকে। আপনার শরীর ভালো। তবে মুখ দেখে মনে হচ্ছে মন ভালো নেই।”

“ওহ আচ্ছা!”

“দুপুরে খাওয়া হলো? নাকি এখনও না খেয়ে আছেন?”

“না খেয়ে আছি।”

“ক্যান্টিনে যাবেন? আমি ওদিকেই যাচ্ছি। একসাথে যেতে পারি।”

মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানালাম। রূপসী হাঁটতে শুরু করল। দু'জনে পাশাপাশি হাঁটছি। তেমন কোন জড়তা নেই। আড়চোখে রূপসীর দিকে তাকালাম। সরু গলায় বললাম, “একটা প্রশ্ন করব?”

“জ্বি।”

“এই অফিসের ভেতরে সবচেয়ে ভালো মানুষ কে?”

“শরিফুল সাহেব। আমার তাকেই সবচেয়ে ভালো মনে হয়।”

“কেন মনে হয়?”

“উনি খুব দয়ালু এবং মহৎ হৃদয়ের।”

“এমন মনে করার বিশেষ কোন কারণ আছে?”

“আছে।”

“আমি কী জানতে পারি?”

“পারেন।”

“আচ্ছা।”

“এর আগে আমি বেসরকারি হাসপাতালে নার্সের কাজ করতাম। হুট করে হাসপাতাল বন্ধ হয়ে গেল। তখন আব্বার শরীর খুব খারাপ। কাজকর্ম করতে পারে না। সংসারে টাকার খুব অভাব। চাল নুনের অভাব তুঙ্গে। ঠিক সেই সময়ে শরিফুল সাহেব আমাকে এখানে চাকরি দিলেন। নার্সদের কর্পোরেট অফিসে তেমন কোন কাজ নেই। তবুও তিনি আমাকে কাজ করার সুযোগ করে দিয়েছেন।”

“শরিফুল সাহেব বলেছিলেন কর্মী ছাঁটাই করবে। এ ব্যাপারে কিছু জানা আছে?”

রূপসীর মুখ শুকিয়ে গেল। ভীতু গলায় বলল, “কর্মী ছাঁটাই করবে কেন?”

“অফিসের কিছু কর্মী অ’শ্লী’ল কাজে জড়িয়ে পড়েছে। তিনি এসব সহ্য করবেন না।”

“ওহ আচ্ছা!”

রূপসীর চেহারার উজ্জ্বলতা ফিরে এসেছে। সে হাসি-হাসি মুখ করে এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে।

“অফিসের ভেতরে কারা এসব করে জানা আছে?”

“না, আমার এসব জানা নেই।”

খাওয়ার সময়ে কোন কথাবার্তা হলো না। সামান্য হু হা-ও না। খাওয়া শেষ করে নিজের কেবিনে চলে এলাম। আজ এসি চলছে। এসির ঠান্ডা বাতাসে কম্বল জড়িয়ে ঘুম দিতে পারলে মন্দ হতো না। কম্বলের ব্যবস্থা নেই। মঞ্জুরকে ডেকে কম্বল চাইতে পারলে বেশ হতো। তবে তাকে ডাকতে ইচ্ছে করল না। কেমন আলসেমি লাগল। চোখ বন্ধ করে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে রইলাম।

কবির দরজার ঠেলে রুমের ভেতরে ঢুকল। চেয়ার টেনে বসতে বসতে বলল, “শরীর ভালো?”

“ভালো।”

“তুহিন ভাইয়ের কী অবস্থা?”

“জানি না।”

“সত্যি করে একটা কথা বলো তো। তোমরা সবাই কী খেয়েছিলে? একবার পুরো পরিবার ধরে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে গেলে।”

“তুহিন ভাই বিরিয়ানি কিনে নিয়ে গেছিল। গুরুপাক ছিল বোধহয়।”

“তুহিন ভাই বিরিয়ানি কিনে নিয়ে গেছিল!”

কবির আকাশ থেকে পড়ল। ভ্রু কুঁচকে বললাম, “এভাবে বলছেন কেন?”

“আরে অনুরিমা! অনুরিমাই তো তুহিন ভাইকে বিরিয়ানি কিনতে বলেছিল। দোকানের নামও বলে দিয়েছিল। একটার সাথে একটা ফ্রি দিচ্ছিল।”

“ওহ আচ্ছা!”

“বাড়ি ফেরার পথে আমিও চার প্যাকেট নিয়ে গিয়েছিলাম। কই! আমাদের তো কিছু হয়নি।”

“আপনাদের হজম শক্তি ভালো। হা হা হা।”

হো হো করে হেসে উঠলাম। কবিরের কাছ থেকে বিরিয়ানির দোকানের নাম জেনে নিলাম। অফিস শেষে ওই দোকানে একবার যেতে হবে।

কবির বেরিয়ে যাওয়ার পরপরই শরিফুল সাহেব এলেন। গম্ভীর গলায় বললেন, “এই শরীর নিয়ে অফিসে এসেছ কেন? বাড়িতে বসে বিশ্রাম নেওয়া উচিত ছিল।”

“বাড়িতে কেউ নেই। এখানেই বেশ ভালো লাগছে।”

“তা ভালো। তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে। খুব জরুরি কথা।”

“জ্বি স্যার। বলুন।”

“এখানে নয়। আমার বাড়িতে বলব। সন্ধ্যা নাগাদ আমার বাড়িতে চলে আসবে।”

“আচ্ছা আসব।”

“আমার বাড়ির ঠিকানা জানো?”

“না স্যার।”

“এই নাও কাগজ। আমি বলছি, তুমি লিখে নাও।”

ঠিকানা লেখা কাগজটা পকেটে রেখে দিলাম। শরিফুল সাহেব শরীরের খোঁজ খবর নিয়ে বেরিয়ে গেলেন। তিনি বের হওয়ার পর মঞ্জুর ঢুকল। হাতে চায়ের কাপ। গরম চা থেকে ধোঁয়া উঠছে।

“চা-টা খেয়ে নেন। ভালো লাগবে।”

“উঁহু মঞ্জুর ভাই! চা খাওয়া যায় না। তরল জিনিস আমরা খেতে পারি না। তরল জিনিস পান করতে হয়। সেই হিসেবে বলতে হবে– চা পান করুন।”

“গরিব মানুষ, লেখাপড়া জানি না। এত কথা শিখে আমার কী কাজ বলুন?”

“সে যাইহোক। সঠিক কথা জেনে রাখা ভালো।”

মঞ্জুর সরু চোখে আমার দিকে তাকাল। গলার স্বর অনেকখানি নিচু করে বলল, “সঠিক কথা জেনে রাখা ভালো?”

“অবশ্যই।”

“স্যার, আপনাকে একটা কথা বলি?”

“বলো।”

মঞ্জুর কিছু বলল না। ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল। ধীরেসুস্থে চা শেষ করলাম। চা-টা খুব ভালো। আদা চা। মঞ্জুর চায়ের কাপ তুলে বেরিয়ে গেল। পরক্ষনেই ফিরে এসে বলল, “বড় স্যারের বাসায় যাবেন না স্যার। ওই বাসায় মানুষখে’কো আছে।”

“কী আছে?”

মঞ্জুর আর কিছু বলল না। হুড়মুড়িয়ে বেরিয়ে গেল। আমি তার কথাবার্তা কিছু বুঝলাম না। সাধারণ মজা মশকরা ধরে নিলাম। কিন্তু মঞ্জুর আমার সঙ্গে মজা করবে কেন? তার সাথে তো আমার মজার সম্পর্ক না।

এখনও সন্ধ্যা নামেনি। নামবে নামবে ভাব। সূর্যের আলো লাল হয়ে এসেছে। অফিসের কাজ শেষ করে বেরিয়েছি। মাথায় নানান ধরনের চিন্তা ঘুরছে। রহস্যময় ফোনকল, তুহিন ভাইয়ের অসুস্থতা, শরিফুল সাহেবের নিজের বাসায় ডাকা, মঞ্জুরের বলা কথা। সবকিছু মিলিয়ে জগাখিচুড়ি মার্কা অবস্থা।

সাজ্জাদের সাথে আর একবার কথা বলতে হবে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হয়ে ছোট আপার সাথে কথা বলব। এই দ্বিধাদ্বন্দে আর থাকতে পারছি না।

বিরিয়ানির দোকানে অনুরিমার সাথে দেখা হলো। সে এক লোকের সাথে কথা বলছে। আমাকে দেখে লোকটা একটু সরে দাঁড়াল। অনুরিমা এগিয়ে এসে বলল, “নজু ভাই, আপনি এখানে?”

“কবির ভাই বলল এই দোকানে একটার সাথে একটা ফ্রি অফার চলছে। তা-ই চলে এলাম। বাঙালি তো! ফ্রি পেলে কোন কিছুই ছাড়তে ইচ্ছে করে না।”

“আজকেই হাসপাতাল থেকে ফিরলেন। এখন আবার বিরিয়ানি। এটা ঠিক হবে না।”

“ঠিক না হলে আর কী! বেঠিক হোক।”

“না, একদমই না। বেঠিক কিছু করে শরীর খারাপ করা যাবে না। আপনি বিরিয়ানি খাবেন না। আমি কিছুতেই আপনাকে এই কাজ করতে দেব না।”

“মানে?”

অনুরিমা চোখ ছোট করে তাকাল। আমি মুখ ঘুরিয়ে ফেললাম। সে আমার একটু কাছে এগিয়ে এলো। আদুরে গলায় বলল, “শত হলেও আমরা একই অফিসে চাকরি করি। এতটুকু খেয়াল তো রাখতেই পারি। পারি না?”

“না।”

অন্যকেউ হলে দমে যেত। অনুরিমা দমে গেল না। ফট করে আমার হাত ধরে ফেলল।

“চলুন তো। আপনি না আমি শুনব না।”

হাত ছাড়িয়ে নিলাম। বিরক্ত গলায় বললাম, “এবার কিন্তু বাড়াবাড়ি হচ্ছে।”

অনুরিমা তবুও শুনলো না। আমি নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে তবে থামল। অনুরিমার আমার শরীর নিয়ে চিন্তা নেই– কথাটা আমার অজানা না। এমন নয় যে আমরা দু’জনে বন্ধু। ঘনিষ্ঠ পরিচিতও না। সাধারণ পরিচিত। সাধারণ পরিচিতদের মধ্যে এত আন্তরিকতা মানায় না।

“অনুরিমা!”

“জ্বি, নজু ভাই।”

“একটা কথা বলি।”

“হ্যাঁ নিশ্চয়ই।”

“আপনার ফোন নম্বরটা পেতে পারি। অফিসে কিছু হলে জানিয়ে দিতেন আর কি। শরীরের যে অবস্থা কখন কী হয়।”

অনুরিমা তার ফোন নম্বর দিলো। তারপর রিকশায় উঠে গেল। আমিও রিকশায় উঠলাম। রিকশায় বসেই অনুরিমার নম্বরে কল দিলাম। সে কল রিসিভ করল।

“ধন্যবাদ। আপনি না থাকলে আজ আবার বিরিয়ানি কিনে ফেলতাম।”

“ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই। সহকর্মীদের জন্য এতটুকু তো করা যেতেই পারে।”

“আচ্ছা, এখন রাখছি।”

“জ্বি, নজু ভাই।”

অনুরিমার গলার স্বর রাতদুপুরে কল দেওয়া মেয়ের মত না। কেমন অন্যরকম। তাহলে ওই স্বর কার? রূপসীর? ওর সাথেও একবার কথা বলতে হবে। সবার সাথে কথা বলতে হবে।

মানুষ হিসেবে শরিফুল সাহেব বেশ আন্তরিক। কলিং বেল বাজাতেই দরজার খুলে দিলেন। একগাল হেসে বললেম, “নজু, চিনতে পেরেছ তাহলে?”

“জ্বি স্যার।”

“বেশ তো। ঘরের ভেতরে এসে বসো।”

“জ্বি স্যার।”

বাসাটা বেশ বড়। তিনটে ফ্লাট একসাথে মেশানো। বসার ঘরে একুরিয়াম আছে। তাতে রঙবেরঙের মাছ সাঁতার কাটছে। খানিকক্ষণ সেদিকে তাকিয়ে রইলাম। মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছি, হঠাৎই শরীর কেঁপে উঠল। একটি মেয়েলি কণ্ঠ শুনে। হুবহু ফোনের সেই গলা। মেয়েটি শরিফুল সাহেবের সাথে ঝগড়া করছে। কান খাঁড়া করলাম। যদি কিছু শোনা যায়। শোনা গেল। মেয়েলি কণ্ঠটা বলল, “তুমি আমার জন্য এই ছেলেকে পছন্দ করেছ? তুমি কী নিশ্চিত আমার ওকে পছন্দ হবে?”

শরিফুল সাহেব কী বললেন শোনা গেল না। এই আশেপাশে কোন কথাই আমার কানে ঢুকছে না। মঞ্জুরের কথা মনে পড়ছে– এই বাসায় মানুষখে’কো আছে।

চলবে

৫০% ছাড়ে পড়ুন আমার লেখা দু’টি ই-বুক। শুধুমাত্র বইটই অ্যাপে। অ্যাপ লিংক কমেন্ট বক্সে।

১. অদৃশ্য সুতোর টান
শাশুড়ির স্বর্নের হার হারিয়ে ফেলার অপরাধে যেদিন আমার তা’লা’কের সিদ্ধান্ত হয় সেদিন আমার স্বামী নিরব ছিলেন। ভালো-মন্দ কিছুই বলেননি। রাতে শোবার সময় আমি তার গায়ে হাত রাখলাম। নরম গলায় বললাম, “সামান্য একটা গহনা হারিয়ে যাবার কারণে আমায় ডি’ভো’র্স দিবেন? সারাজীবনের একটা সম্পর্ক এভাবে ন’ষ্ট হয়ে যাবে?”

তিনি জবাব দিলেন না। পাশ ফিরে শুয়ে পড়লেন। বুকে পাথর চাপা দিয়ে চোখ বুঁজে রইলাম। কত-শত স্বপ্ন নিয়ে একটা মেয়ে স্বামীর সংসারে পা রাখে। নতুন বাড়ি, নতুন মানুষ, নতুন জীবন! কত প্রত্যাশা! সবকিছুই যেন এক নিমেষে শেষ হয়ে গেল।

২.প্রিয় শ্রাবণ
চৈত্রের ঝাঁঝাঁ দুপুরে হুট করেই পাত্রপক্ষ নিয়ে হাজির হয় তিথির বড় মামা। অচেনা অজানা ছেলের সাথে বিয়ে হয়ে যায় তিথির। তারপর? কেমন হয় তার বৈবাহিক জীবন?

18/10/2025

ঝির ঝির বৃষ্টির ভিতর সুইমিংপুলের পানিতে যখন নিথর দেহটা ভাসতে দেখলাম তখনও জানি না কি ভয়ংকর বিপদে পড়তে যাচ্ছি আমি। চিন্তাও করতে পারিনি কি কঠিন ষড়ষন্ত্রের জাল গুটিয়ে ফেলা হচ্ছে আমার চারপাশ থেকে।

অথচ চমৎকার এই রিসোর্টের সকালটা অন্য রকম হতে পারত। গাজীপুরের শালবন আর ছোট টিলার উপর দারুন রিসোর্টটা খুব জনপ্রিয়। সপ্তাহের ছুটিতে আমরা চার বন্ধু প্ল্যান করেছিলেম রিসোর্টে মজা করে কিছু সময় কাটাবো। বৃষ্টির পূর্বাভাস ছিল। ভেবেছিলাম সারাদিন বৃষ্টি দেখব রিসোর্টে, ছেলেবেলার মতো ফুটবল খেলবো মাঠে, চমৎকার বড় সুইমিংপুলটাতে সাঁতার কাটব, অনেক রাত পর্যন্ত আড্ডা আর কার্ড খেলে সময় কাটাবো। গাজীপুরে আমার একটা ক্ল্যায়েন্ট ভিজিট ছিলো, বাসা থেকে ব্যাগপ্যাক নিয়ে সরাসরি ক্লায়েন্ট ভিজিট শেষ করে গতকাল সন্ধ্যার পর রিসোর্টে চলে এসেছি। আমার তিন বন্ধুর একসাথে আসার কথা ঢাকা থেকে, রাফি নতুন গাড়ি কিনেছে সেটাতে অন্যদের নিয়ে আসবে। রাত দশটায় তাদের সাথে আমার শেষ কথা হয়েছিল, তখনও তারা উত্তরা পার হয়নি, বৃষ্টির জন্য রাস্তায় প্রচন্ড জ্যাম বলছিল। ওদের কথা শুনে ভীষণ মেজাজ খারাপ হচ্ছিল। প্ল্যান ছিল সবাই তাড়াতাড়ি অফিস শেষ করে সন্ধ্যা সাতটার মধ্যে রিসোর্টে এসে পড়বে। অথচ রাত দশটার সময়ও তারা রাস্তায়। এদের সময়জ্ঞান হবে না কখনও। বিরক্ত হয়ে আমি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। এক ঘুমে সকাল। সকালে উঠে ভেবেছিলাম রাফিদের দেখব রুমে, কিন্তু আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করে দেখলাম রুমে কেউ ঢোকেনি। আমরা রিসোর্টের দুইটা ডাবল রুম ভাড়া করেছি। আমার সাথে একজন থাকার কথা। হতে পারে অনেক রাতে এসেছে ওরা তাই আমার রুমে কেউ আসেনি। তিনজনই একই রুমে ঘুমিয়ে পড়েছে। হাতের ঘড়ি দেখলাম, প্রায় দশটা বাজে। এখনও কি ওরা কেউ ঘুম থেকে ওঠেনি? আমিও এতক্ষণ ঘুমালাম! জানালার দিকে তাকিয়ে দেখি বাইরে ঝির ঝির বৃষ্টি। এই ঠান্ডা আবহাওয়া আর পুরা সপ্তাহের অফিসে চাপই সম্ভবত আমাদের ক্লান্ত করে রেখেছে। ভাবছিলাম উঠে গিয়ে দেখি অন্যদের ব্যাপারটা কি, এরমধ্যেই একটা ছোট হৈচৈ শুনে রুম থেকে বের হলাম।

কে যেনো বলল সুইমিংপুলে একটা লাশ ভাসছে। আমি সব ভুলে তাড়াতাড়ি সুইমিংপুলের দিকে এগিয়ে গেলাম। রিসোর্টটার সুইমিং পুল একটা খোলা জায়গায়, আকারে বেশ বড়। পুলের পাড়ে অল্প কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে আছে । গাঁয়ের ড্রেস দেখে বুঝলাম বেশিরভাগই রিসোর্টের লোকজন। আকাশ মেঘলা হয়ে আছে। পুলের পানিতে ঝির ঝির বৃষ্টির ফোঁটা পড়ছে, ঠিক মাঝখানে ভেসে আছে একটা মানুষ। দেখে মনে হচ্ছে উল্টো হয়ে শুয়ে সাঁতার কাটছে সে। কিন্তু একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায় নড়ছে না মানুষটা।

দেখেই মনটা খারাপ হয়ে গেল। সাঁতার না জানা লোকজন যে কেনো আসে রিসোর্টে। নিশ্চয়ই সকালে একা এসেছিল পুলে, গভীর জায়াগায় চলে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি। আমি দ্রুত সেখান থেকে সরে এলাম। আমার বন্ধুদের রুমে যেতে হবে, তাদের সব জানানো দরকার। এই রিসোর্টে এখন আর থাকার মানে নেই।

আমরা ৭০১ এবং ৭০২ রুম নম্বর দুইটা বুক করেছি। আমি উঠেছি ৭০১ এ। ৭০২ এ গিয়ে দেখি লক করা। কয়েকবার বেল চাপলাম, ভিতরে কোন শব্দ হলো না। তারমানে ভিতরে কেউ নেই। পাওয়ার না থাকায় বেল বাজছে না।
আমি একটু বিভ্রান্ত হয়ে গেলাম। ওরা কোথায় গেল? ফোন করতে গিয়ে দেখি মোবাইল নিয়ে বের হইনি। তাড়াহুড়ায় রুম থেকে বের হয়েছি মোবাইল রেখে।

তাড়াতাড়ি রুমে ফিরে এসে মোবাইল খুঁজলাম। নেই। কোথাও মোবাইল নেই। কি আশ্চর্য! আমি গতকাল রাতে মোবাইল হাতে নিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম পরিষ্কার মনে আছে। তাহলে মোবাইল কোথায় গেল। সকালে অল্প সময়ের জন্য বের হয়েছিলাম রুম বন্ধ করে, এরমধ্যে রুমে ঢুকে কারও মোবাইল চুরি করার প্রশ্নই নেই।

আমি দ্রুত বের হয়ে রিসিপশন ডেস্কে গেলাম। সেখানে বিরাট জটলা। কানাঘুষা করছে লোকজন। সুইমিং পুলে একজন মারা গেছে কাজেই এটা স্বাভাবিক। আমি কাউকে আমার মোবাইলের ব্যাপারটা জানানোর জন্য এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলাম। এক ভদ্রলোক এসে বলল, স্যার আপনি আপনার রুমে যান, আমাদের এখানে একজন মারা গেছে, পুলিশে খবর দেয়া হয়েছে পুলিশ বলেছে সব গেস্টকে থাকতে। কাইন্ডলি সহযোগিতা করুন, রুমে গিয়ে বসুন। পুলিশ এসে কিছু কথাবার্তা বলবে, এরপর যেতে পারবেন।

আমি তাকে সংক্ষেপে বললাম, আমার মোবাইল খুঁজে পাচ্ছি না। আমার বন্ধুদের সাথে যোগাযোগ করা দরকার।

ভদ্রলোক তখন নিজের মোবাইল বের করে দিয়ে বললেন, আপনার মোবাইলের ব্যাপারে এখনই কোন সাহায্য করতে পারছি না বুঝতেই পারছেন তবে আপনি কারও সাথে কথা বলতে চাইলে বলতে পারেন।

আমি দ্রুত তার মোবাইল হাতে নিলাম। আমার বন্ধুদের তিনজনের মধ্যে একমাত্র শায়ের এর মোবাইল নম্বর মনে আছে আমার। সেটাও ডিজিট গুলো অনেক সহজ বলে। বাকিদের নম্বর মনে রাখা হয় নি কখনই।

শায়ের এর মোবাইলে ফোন দিলাম। বন্ধ।

মেজাজ এতো খারাপ হলো। ফিরে এসে আবার রুম নম্বর ৭০২ এর সামনে গেলাম, রুম খোলা। কিন্তু রুমের সামনে এবং ভিতরে দেখি অনেক মানুষ। আমি উঁকি দিলাম।

জিজ্ঞেস করলাম কি হয়েছে?

একজন আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কিছু না। আপনি আপনার রুমে যান। এই রুমের ভদ্রলোক মারা গেছেন সকালে।

আমার বুক ধরাস করে উঠল। কে মারা গেছে?

লোকটা বিরক্ত কন্ঠে বলল, এই রুমে যিনি উঠেছিলেন কাল রাতে। সরে যান, পুলিশ রুম আটকে রাখতে বলেছে।

আমার হতভম্ব মুখের সামনে দিয়ে লোকটা রুম বন্ধ করে চলে গেল। সঙ্গে যারা ছিল তারাও চলে গেল।

আমি কিছুক্ষণ নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকলাম। তারপর দৌড়ে রিসোর্টের স্টাফদের ধরলাম। বললাম, ভাই যে মারা গিয়েছে তার নাম কি?

লোকটা একটু থমকালো, শান্ত গলায় বলল, মারা গেছে রিফাত জামান, দেশের বড় গ্রুপ জে এন্ড জে এর এমডি।

আমি এবার ভয়াবহ ভাবে চমকালাম। রিফাত স্যার মারা গেছেন? বলে কি?

রিফাত স্যার আমাদের এমডি স্যার। আমি জে এন্ড জে চাকরি করি দশ বছর হলো।

আমি লোকটাকে বললাম, ভাই আমি একটু লাশ দেখতে চাই। আমি জে এন্ড জে কাজ করি।

রিসোর্টের স্টাফ টা দাঁড়িয়ে আমাকে কিছুক্ষণ দেখল, তারপর বলল, পুলিশ আসার আগে কারোই কিছু করার অনুমতি নেই। আপনি আপনার রুমে যান, সেখানে থাকুন সেটাই আপনার জন্য ভালো হবে।

লোকটা আমাকে কিছু বলতে না দিয়ে চলে গেল।

আমি বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে রুমে চলে এলাম। এতো শকড হয়েছি যে বলার না। আমার এমডি স্যার মারা গেছেন, আবার তিনি নাকি আমাদের বুক করা রুমেই ছিলেন, বলা যায় আমার পাশের রুমেই, তাহলে প্রশ্ন হচ্ছে আমার বন্ধুরা কোথায়?

ইসস! এর মধ্যেই আমার মোবাইল হারালাম। ধুর!

কিছুক্ষণ বসার পর যখন ভাবছি বের হতে হবে, বন্ধুদের খুঁজে বের করা দরকার তখন রুমের কলিংবেল বাজল, খুলে দেখি পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে।

মোট তিনজন ড্রেস পরা পুলিশ। মাঝখানে একজন সিভিল ড্রেসে, তাদের আশেপাশে রিসোর্টের অনেক ড্রেস পরা কর্মচারী।

সিভিল ড্রেসের পুলিশ নিজের পরিচয় দিলেন, আমি ইন্সপেক্টর জাকির। আপনি তো জে এন্ড জের কর্মকর্তা ইমন?

আমি মাথা ঝাঁকালাম। এরা দেখি আমার পরিচয় বের করে ফেলেছে। অবশ্য এটা কঠিন কিছু না, এই রুম আমার নামেই বুকিং দেয়া, সেখানে আমার অফিস ইনফর্মেশনও দেয়া ছিল।

পুলিশ চারজন ভিতরে ঢুকে বসলেন।

জাকির বললেন, আজ সকালে আপনার এমডি স্যারের সাথে শেষ দেখা কখন হয়েছে? নাকি কাল রাতেই শেষ দেখা হয়েছে?

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, আমার সাথে আমার এমডি স্যারের দেখাই হয়নি। ইনফ্যাক্ট এমডি স্যার যে এই রিসোর্টে এসেছেন সেটাই জানি না আমি।

জাকির একটু থমকালেন, বললেন, দেখুন উল্টোপাল্টা বলে লাভ হবে না। আপনার পাশের রুমে আপনার এমডি স্যার আছে আপনি জানতেন না বলছেন অথচ আপনি যে পাশের রুমে গিয়েছিলেন সে প্রমাণ আমাদের হাতে আছে। ঠিক করে বলুন তো কি হয়েছিল? কিভাবে মারা গেলেন আপনাদের এমডি?

আমি মাথা নাড়লাম, বিশ্বাস করেন আমি এর কিছুই জানি না। আমি তো জানি পাশের ওই রুম আমার এক বন্ধুর নামে বুক করা। আমরা চারজন গতকাল রাতে এখানে ছিলাম। ওই রুমে আমার অন্য তিন বন্ধুর থাকার কথা।

ইন্সপেক্টর জাকির বিস্মিত হয়ে বললাম, আপনার অন্য বন্ধুরা কোথায়?

আমি তখন ঘটনা খুলে বললাম।

জাকির সাহেব বললেন, মিস্টার ইমন আপনি কি বলছেন সেটা আপনি ভেবে বলছেন তো? গল্প গুলো কিন্তু খুব জমলো না। আমাদের কাছে প্রমাণ আছে আপনি আপনার স্যারের রুম ৭০২ এ গিয়েছিলেন।

আমি বিস্মিত হয়ে বললাম, প্রশ্নই ওঠে না। আমি গতকাল রাতে ক্লান্তির কারনে তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম। আমি জানি ওই রুমে আমার বন্ধুদের ওঠার কথা কিন্তু রাত পর্যন্ত তারা আসেনি। তাহলে আমি ঐ রুমে কিভাবে যাবো? আর ধরা যাক স্যার ওই রুমে ছিলেন, তাহলে আমি স্যারের কাছে কেনই বা যাবো এতো রাতে? স্যারের সাথে তো আমি ডাইরেক্ট কাজ করিনা। স্যার আমাকে ভালো মতো চেনেন কি না সেটাও সন্দেহ।

ভদ্রলোক একটা প্যাকেট আমার সামনে ধরলেন। বললেন, দেখেন তো এই মোবাইলটা চেনেন কি না?

আমি ভালো করে দেখলাম, আমার মোবাইল।

বললাম, হ্যাঁ আমার মোবাইল। কোথায় পেলেন?

আপনার স্যারের রুমে।

আমি চমকে গেলাম। বললাম, স্যারের রুমে আমার মোবাইল গেলো কিভাবে? কি আশ্চর্য।

--সেটা তো আপনি বলবেন। এখন চলুন থানায় যাবেন আমাদের সঙ্গে।

আমি প্রচন্ড বিস্মিত হয়ে বললাম, থানায় কেনো?

---কারণ আপনার স্যার খুন হয়েছেন । তাকে কেউ মেরে সুইমিং পুলে ভাসিয়ে রেখেছে। এবং সাক্ষ্য প্রমাণ বলছে আপনি গত রাতে তার সঙ্গে সময় কাটিয়েছেন।

আমি বললাম, পরিষ্কার মিথ্যা কথা। আমার বন্ধুরা আছে এখানে। তাদের কাছ থেকেই আপনি আসল সত্য জানতে পারবেন।
--- আপনি যে বন্ধুদের কথা বলছেন সে রকম কোন তথ্য কিন্তু আমাদের দেয়নি রিসোর্ট কর্তপক্ষ। আপনার কোন বন্ধু এই রিসোর্টে আসে নি গতকাল রাতে।
আমার মাথা ঘুরতে লাগল। আমি বুঝলাম কোথাও বড় কোন গোলমাল হয়ে গেছে। অথবা কোন ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখছি আমি।
ইন্সপেক্টরকে বললাম, ভাই গতকাল আমার যাদের সাথে আসার কথা ছিল সেই বন্ধুদের একটু ফোন দিয়ে দেখেন না ওরা কি বলে?
ইন্সপেক্টর কি যেনো ভাবলেন তারপর আমার মোবাইলটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, ফোন দেন ওদের।
মুন আর সালাম এর মোবাইল বন্ধ। রাফির মোবাইল খোলা পেলাম, কয়েকবার ফোন দেয়ার পর ধরল সে। আমি উত্তেজিত হয়ে বললাম, রাফি তোরা কোথায়? শীগগির আমার রুমে আয়।
রাফি ঘুম জড়ানো কন্ঠে বলল, স্যরি দোস্ত। কাল তো চরম বৃষ্টির জন্য আমরা শেষ পর্যন্ত যেতে পারিনি রিসোর্টে। আজ বিকেলের দিকে আসব আমরা। এখন ঘুমাই।

বলেই সে লাইন কেটে দিলো। আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম।

আবার ফোন দিতে গেলাম। ইন্সপেক্টর আমার হাত থেকে ফোন নিয়ে নিলেন। বললেন, আপনার বন্ধুরা তাহলে কাল রিসোর্টে ছিলো না। আপনি মিথ্যা বলছেন। এই ফোন এখন আমরা ফরেন্সিকে পাঠাবো। আপাতত আপনাকে আমাদের সাথে যেতে হচ্ছে।
বুঝলাম বড়ো রকম ঝামেলায় পড়ে গেছি। দুঃস্বপ্নের মতো , কিন্তু এটা দুঃস্বপ্ন না। সত্যিকারের বিপদ, ভয়ংকর বিপদ। কি করব এখন আমি? ভয়ানক এই বিপদে একজনের কথাই মাথায় এলো আমার।

#পর্ব_০২

তিনদিন হাজত খাটতে হলো। এরপর জামিনের শুনানিতে আদালত জামিন দিয়ে দিলো আমাকে। কি ভয়ংকর ট্রমার মধ্যেই না গেলো দীর্ঘ তিনটা দিন। প্রবল বিস্ময় নিয়ে দেখতে হলো আমার বিরুদ্ধে চলে গেছে আমারই প্রতিষ্ঠান জে এন্ড জে। বাসায় যখন নিয়ে আসল মিলি আমাকে আমি প্রায় বিধ্বস্ত। সারা বিকেল ঘুমালাম। ঘুম থেকে উঠে দেখি গুলজার আংকেল আর তার স্ত্রী এসেছেন বাসায়। পিআইবি এর রিটায়র্ড ডি আই জি গুলজার হোসেনের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো এই ভয়ংকর বিপদ থেকে বাঁচার রাস্তা আমার এখনো শেষ হয়ে যায়নি, কারণ একজন যাদুকর আছেন আমার সঙ্গে।

গুলজার হোসেন পুরো ঘটনা শুনলেন। এরপর চুপচাপ অনেকক্ষণ চিন্তা করলেন। আমি অপেক্ষা করতে লাগলাম। সব কিছু এখনো দুঃস্বপ্নের মতো লাগছে, কোথা থেকে কি হয়ে গেল কিছুই বুঝতে পারছি না। গেলাম বন্ধুদের সাথে আনন্দ করতে পড়লাম ভয়াবহ খুনের চক্রে।

বেশ কিছুক্ষণ পর গুলজার হোসেন কথা বললেন, তোমার বন্ধুদের কি খবর? এর মধ্যে যোগাযোগ করেনি তাই না?

---জ্বী। আমি তো যোগাযোগ করতে পারিনি। কিন্তু এদের কোন খবর নেই সেটাই আশ্চর্য লাগছে আমার কাছে।

---তুমি সবাইকে একবার ফোন দিয়ে দেখ এখন।

আমি সবার নম্বরে কল দিলাম।

মুন এবং সালাম এর মোবাইল আবার বন্ধ পেলাম। রাফি ফোন ধরল।

---দোস্ত, তুই বের হয়েছিস? আমি খুব স্যরি দোস্ত তোর এই বিপদে তোর সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। আমার বাবা মারা গেছেন তাই আমি গ্রামের বাড়ি চলে আসছি ওই দিন। এখানে এসে তোর খবর শুনলাম।

আমি দুঃখ প্রকাশ করলাম, বলিস কি আংকেল মারা গেলেন, কিভাবে?

---এক্সিডেন্ট দোস্ত। বাজারে গিয়েছিল, হাইওয়ে দিয়ে অটো করে ফিরছিলো, ট্রাক মেরে দিয়েছে।

আমি বললাম, কি ভয়াবহ। তোর জন্য খারাপ লাগছে ভাই।

কথা সংক্ষেপ করে ফোন রেখে দিলাম। রাফির জন্য এখন উলটো খারাপ লাগছে। আমি একটা বিপদে পড়েছি ঠিক কিন্তু বেচারা তো আরও বড় বিপদে।

গুলজার আংকেল আমার সব কথা শুনে বললেন, তোমার অন্য বন্ধুদের বাসা চেনো?

এরা তিনজনই আমার কলিগ কাম বন্ধু। সবার ঢাকার বাসাতেই গিয়েছি আমি। বললাম, চিনি আংকেল।

---তাহলে আমার মনে হয় একটু বাসায় গিয়ে দেখা দরকার ওদের কি অবস্থা।

আমি বাসার বাইরে যাবো শুনে মিলি বাধা দিল। বেচারির উপর দিয়ে ভয়াবহ ধকল গেছে এই তিনদিন। জামাইকে খুনের মামলায় পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে সেটা তার বাবার বাড়ির লোকজনের কাছে নিশ্চয়ই মারাত্মক রকমের খবর ছিলো। দেশের প্রায় সব কয়টা পত্রিকা নিউজ করেছে এই খুনের ঘটনা নিয়ে। দুই একটা পত্রিকা দেখলাম আগ বাড়িয়ে গল্প ফেঁদেছে আমি নাকি এমডি স্যারকে কৌশলে রিসোর্টে নিয়ে গিয়ে হত্যা করেছি। অনেক পুরানো দ্বন্দ নাকি। অথচ এমডি স্যারের সাথে আমার দেখাই হয়েছে গত একবছরে মাত্র এক দুইবার। এই সব গাল গপ্প একটু দুরের আত্মীয়স্বজনেরা আরও মুখরোচকভাবে আলোচনা করে। কেউ কেউ সহমর্মী হওয়ার ভান করে মিলিকে ফোন করে নানা ধরনের মন্তব্য করেছে এই কয়েকদিন, বেচারির আসলেই খুব খারাপ সময় গেছে।

মিলিকে কোন রকম বুঝিয়ে শুনিয়ে আমরা বাইরে এলাম। সন্ধ্যা পার হয়ে রাত নেমে এসেছে। ঠিক হলো প্রথমে মুনের বাসায় যাবো। সে নতুন বিয়ে করেছে, তার বাসা লালমাটিয়া। সেখান থেকে যাবো সালাম এর মিরপুরের বাসায়। সালাম এখনো ব্যাচেলার। দুইজন কলিগ মিলে একটা ফ্ল্যাট নিয়ে থাকে।

মুনের লালমাটিয়া ফ্ল্যাট তালা দেয়া। আমার জানা মতে সে আর তার স্ত্রী থাকত ছোট ফ্ল্যাটটায়। পাশের ফ্ল্যাটের লোকজন কিছু বলতে পারল না তাদের বিষয়ে। বাসার দারোয়ান বলল, শেষ শুক্রবার সকালে মুন তার স্ত্রীকে নিয়ে তাড়াহুড়া করে বের হয়ে গেছে আর ফেরেনি।

মিরপুর সালামের ফ্ল্যাটেও সালাম ছিলো না। তার ফ্ল্যাটমেট আমাদেরই কলিগ ইকবাল ভাই। ভাইয়ের ফ্যামিলি বরিশাল থাকে, এই জন্য ভাই আর সালাম মিলে এই ফ্ল্যাট ভাড়া করে থাকেন ।

ইকবাল ভাই দরজা খুলে আমাকে দেখে গম্ভীর হয়ে গেলেন। ড্রেস দেখে বোঝা গেল উনি এই মাত্র অফিস থেকে ফিরেছেন।
বললেন, সালাম তো নেই, বাড়ি গেছে।

আমি বললাম, কবে বাড়ি গেছে?

---শুক্রবারে সকালে।

ইকবার ভাই দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলেন, বোঝা গেল আমাদের ভিতরে ঢুকতে দিতে চাচ্ছেন না। অথচ আমি সালামের কাছে এই বাসায় আসলে আগে কত খাতির দিয়েছেন, সেধে এসে গল্প জুড়ে দিয়েছেন। আজ মনে হলো চিনতেই পারছেন না।

গুলজার হোসেন বললেন, আপনার কাছে কিছু প্রশ্ন ছিলো আমার।

ইকবাল ভাই দরজা আটকে দাঁড়িয়ে থাকলেন, বললেন, জ্বী বলুন।

গুলজার হোসেন একটা দম টেনে নিয়ে বললেন, আপনি কি বাড়ি যাচ্ছেন? অফিস থেকে ছুটি নিয়েছেন? আপনার একটা মাত্র ছেলে, পাঁচ ছয় বছরের? নাকি আবার নতুন বাচ্চা আসতেছে আপনাদের ঘরে?

ইকবাল ভাই বিস্মিত হয়ে বললেন, হ্যাঁ আমার স্ত্রীর বাচ্চা হবে আগামী পরশু- বুধবার ডেট। ওই জন্য ছুটি নিয়েছি। কিন্ত এতো কিছু আপনি জানলেন কিভাবে?

বলতে বলতে ইকবাল ভাই দরজা ছেড়ে দিয়ে দাঁড়ালেন। আমরা ভিতরে ঢুকলাম।

গুলজার হোসেন তার স্বভাব সুল্ভ ভঙ্গীতে ঢুকে রুমের চারপাশ একবার দেখে নিলেন। তারপর বললেন, অনুমান থেকে বলেছি, অনুমান ভুলও হতে পারত।
আমি জানি গুলজার হোসেনের অনুমান কখনও ভুল হয় না। বললাম, কিন্তু আংকেল আপনি কি দেখে এতো কিছু অনুমান করলেন?

গুলজার হোসেন সোফায় বসতে বসতে বললেন, সবকিছু খেয়াল করলে তুমিও বলতে পারতে, উনি বাইরে যাবার ড্রেস পরা অথচ অফিস শেষ হয়েছে অনেকক্ষণ আগে, তাছাড়া ওনার গায়ের জামা কাপড়গুলোও ফ্রেশ, অফিস শেষ করা জামা কাপড় না, দরজার ভিতর দিয়ে দেখা যাচ্ছিল সোফার উপর একটা খেলনা রিমোট গাড়ি রাখা। গাড়িটা দেখে আন্দাজ করা যায় যার জন্য কেনা হয়েছে তার বয়স চার পাঁচ হবে। গাড়ির পাশেই একটা প্লাস্টিক কেসিং এ ছোট জুতা রাখা,সুপার শপে গেলে দেখবা ওই জুতা নিউ বর্ন বেবিদের জন্য তৈরি। এরপর এখানে আসার পথে তুমি ওনার সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়েছ যেমন, ভদ্রলোক খুব একটা ছুটি নেন না। উইকলি বাড়িতে যান। সংগে দেখো ওনার শার্টের পকেটে লঞ্চের টিকিটও দেখা যাচ্ছে। এর সংগে যোগ কর গত শুক্রবার উনি সালামকে সকালে বাড়ি যেতে দেখেছেন তারমানে উনি নিজে বাড়ি যাননি । এখন দুইদিন ছুটি নিয়ে যাচ্ছেন। এবার এই তথ্যগুলো কম্পাইল করো। আরও অনেক ধারনা পাবা ওনার সম্পর্কে।

আমি কিছু বললাম না।

ইকবাল ভাই বিস্মিত হয়ে বললেন, কত সহজ ব্যাপারগুলো জোড়া লাগিয়ে আন্দাজ করে ফেললেন। দারুন তো।

গুলজার হোসেন বললেন, আপনার চেহারা পর্যবেক্ষণ করেও অনেক কিছু বলা যায়। এই মূহুর্তে শুধু বলতে পারি আপনার বাচ্চার ডেলিভারি সিচুয়েশন সম্ভবত ক্রিটিকাল। এবং এটা সম্ভবত হঠাৎ করে হওয়া না। আগে থেকেই ছিল। প্রবাবলি প্লাসেন্টা নীচের দিকে জাতীয় কোন পজিশনিং ঝামেলা অথবা আপনার স্ত্রীর কোন ধরনের অসুখের কারনে রিস্ক আছে।

ইকবাল ভাই এবার একটু হতভম্ব হয়ে বললেন, কিভাবে বলছেন জানি না তবে সবগুলোই ঠিক। আমার স্ত্রীর সুগার বেশি হয়েছে এবং হিমোগ্লোবিন কমে যাওয়ার সমস্যা আছে। ভাই আপনি অনেক ভালো অবজার্ভার কিন্তু ইমনের সংগে আমার কাছে কেনো এসেছেন?

গুলজার হোসেন বললেন, আমি এসেছি ইমনের বন্ধু সালাম এর খোঁজে। যেদিন আপনাদের এমডি খুন হয়েছে ঐদিন সালামদের ইমনের সঙ্গে ঐ রিসোর্টে থাকার কথা ছিল কিন্তু সালামরা যায়নি কোন কারনে। কেনো সেটা জানতে চাই।

ইকবাল ভাই একটু বিস্মিত হলেন মনে হলো , বললেন, এই তথ্য আমার জানা ছিল না। সালামের সাথে বৃহস্পতিবার অবশ্য দেখা হয়নি আমার, সে ঘুম থেকে উঠে অফিসে চলে গেছে, পরদিন ভোরে উঠে দেখি সালাম ব্যাগ গুছিয়ে বাড়ি যাচ্ছে। যাওয়ার সময় বলে গেলো তার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে আর সে যাচ্ছে বাড়িতে, সেখান থেকে নাকি জরুরী খবর এসেছে।

আমি একটু বিস্মিত হলাম। আমার বন্ধুদের দেখি বিপদ আমার মতোই এসেছিল। একজনের বাবা মারা গেছে। আর একজনের মোবাইল হারিয়ে গেছে আর বাড়ি থেকে ইমার্জেন্সি খবর এসেছে।

ইকবাল ভাইয়ের কথা শুনে গুলজার হোসেন একটু গম্ভীর হয়ে গেলেন। তেমন কিছু আর জিজ্ঞেস করার না থাকায় আমরা বের হয়ে এলাম। বাসায় ফেরার সময় গুলজার হোসেন বললেন, ইমন মনে হচ্ছে তোমার ঘটনার সাথে তোমার বন্ধুদের ঘটনারও যোগ আছে। আমি আরও একটু খোঁজ খবর করি আমার মতো। এর একটা ব্যাপার এতো বড় একজন প্রভাবশালী লোক খুন হয়ে গেল, তার সম্ভাব্য খুনী হিসেবে তোমাকে গ্রেফতার করা হলো অথচ তোমার জামিন কিন্তু দ্রুতই হয়ে গেল। সাধারণত শক্তিশালী লোকজন প্রভাব খাটাতে চেষ্টা করে, তোমার জামিনের ক্ষেত্রে সেটা হয় নি। তুমি একটু সাবধানে থাকো ইমন। আর চিন্তা করো না , আমি আছি। ঠিকিই বের করে ফেলব কি হয়েছিল।

এরপরের দুইদিন কাটলো ঘরে শুয়ে বসে। মাঝখানে দুই একবার গুলজার আংকেল খোঁজ খবর করলেন, অফিস নিয়ে নানা কথা জিজ্ঞেস করলেন। এর মধ্যে একদিন অফিসে যেতে চেয়েছিলাম, অফিসে দুই একজন শুভাকাঙ্ক্ষী নিষেধ করল আমাকে। গুলজার আংকেল বললেন দরকার হলে তাকে সঙ্গে নিয়ে যেতে।

ঠিক দুই দিন পর একদিন রাত আটটার দিকে বাসায় বসে আছি ,আমার মোবাইল বেজে উঠল। তাকিয়ে দেখি সালাম ফোন দিয়েছে। আমি দ্রুত ফোন ধরলাম, কিরে দোস্ত তুই কোথায় ? মোবাইল বন্ধ কেন? আমি কত বড় বিপদে পড়েছি।

সালাম বলল, জানি আমি। তুই দ্রুত আমার বাসায় আসতে পারবি? শীগগির আয়।

আমি একটা সিএনজি ভাড়া করে দ্রুত সালামের বাসায় হাজির হলাম। তাদের বিল্ডিং এ কোন দারোয়ান নাই। গেট তালা দেয়া থাকে বেশিরভাগ সময়। যার যার চাবি দিয়ে খোলে। শেষ যে দিন আমি আর গুলজার আংকেল এসেছিলাম সেদিন গেট খোলা ছিল, আজও খোলা দেখলাম। অনেকে একবার বের হয়ে গিয়ে আর তালা দেয়ার প্রয়োজন মনে করে না হয়ত। আমি সিঁড়ি বেয়ে দ্রুত তিন তলায় হাজির হলাম। কয়েকবার বেল বাজালাম, দরজা খুলল না কেউ। দরজার বাইরে তালা নেই, তারমানে সালাম বাসায়ই আছে। সম্ভবত ঘুমাচ্ছে। ইকবাল ভাই নিশ্চয়ই এখনো ফেরেনি। আমি অধৈর্য হয়ে দরজার নবে হাত দিতেই দরজা খুলে গেল।

ভিতরে ঢুকে ডাক দিলাম , সালাম? সালাম?

কেউ সাড়া দিল না। ঘরের লাইট সব জ্বালানো। ব্যাটা কি ঘুমিয়ে গেল? আমি ড্রয়িং রুম পার হয়ে সালামের ঘরে উঁকি দিলাম, সালাম শুয়ে আছে। আমি গিয়ে ধাক্কা দিলাম।

--এই ব্যাটা ওঠ। কি হয়েছে খুলে বল?

এরপরই বুঝলাম কোন গোলমাল আছে। সালাম উলটে ছিলো। আমার ধাক্কায় সোজা হলো, দেখলাম একটা ছুরি ঢুকে আছে তার বুকে, সে এখনও বেঁচে আছে। গোঁ গোঁ জাতীয় শব্দ করছে।

আমি দ্রুত ছুরি ধরে বের করার চেষ্টা করলাম, সে ককিয়ে উঠল, বুঝলাম পারব না।

ফোন বের করে প্রথমে ইমার্জেন্সি ট্রিপল নাইনে কল দিলাম, এম্বুলেন্স পাঠাতে বললাম। এরপর ফোন দিলাম গুলজার হোসেনকে।

ফোন রিসিভ হলো, আমি বললাম হ্যালো গুলজার আংকেল।

কেউ একজন বলল, যাকে ফোন দিয়েছেন উনি তো এক্সিডেন্ট করেছেন, আপনার কি হয়? দ্রুত ঢাকা মেডিকেলে আসুন।

আমি স্তদ্ধ হয়ে গেলাম। তাড়াতাড়ি মিলিকে ফোন দেয়ার জন্য নম্বর বের করলাম। এই সময়ে কেউ একজন বলল, হ্যান্ডস আপ।

তাকিয়ে দেখি পুলিশ ঘিরে ফেলেছে আমাকে। তখন সংবিৎ ফিরল, সালামের দিকে তাকালাম। স্থির হয়ে গেছে সে। বুঝলাম মারা গেছে, ও যদি সত্যিই মারা গিয়ে থাকে তাহলে ভয়াবহ বিপদে পড়েছি আমি আবার। এবং কেউ ভালোমত ফাঁসিয়েছে আমাকে।

রিসোর্টে_খুন
#পর্ব_০১_০২
©খোন্দকার মেহেদী হাসান

Address

Cumilla

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Paranormal Story posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Paranormal Story:

Share