21/06/2025
তাকদির একটি গভীর এবং গুরুত্বপূর্ণ ইসলামী ধারণা, যা মুসলিমদের বিশ্বাস ব্যবস্থার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। এটি ঈমানের ছয়টি স্তম্ভের অন্যতম। সহজ কথায়, তাকদির হলো নির্ধারিত ভাগ্য বা নিয়তি। এর মূল ধারণা হলো, এই মহাবিশ্বে যা কিছু ঘটবে, আল্লাহ তাঁর পূর্বজ্ঞান ও প্রজ্ঞা অনুযায়ী সেসব কিছু নির্ধারণ করে রেখেছেন।
তাকদিরের মূল বিষয়গুলো
* আল্লাহর জ্ঞান: আল্লাহ সবকিছুর সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞান রাখেন। তিনি জানেন কে কখন কী করবে, কী ঘটবে। এই জ্ঞান অনুসারে তিনি সবকিছু "লাওহে মাহফুজ" (সংরক্ষিত ফলক) এ লিপিবদ্ধ করে রেখেছেন।
* আল্লাহর ইচ্ছা ও ক্ষমতা: আল্লাহর কার্যকরী ইচ্ছা এবং তাঁর ব্যাপক শক্তি সবকিছুকে নিয়ন্ত্রণ করে। তাঁর ইচ্ছার বাইরে কোনো কিছুই ঘটে না।
* সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণ: আল্লাহ শুধু সবকিছুর জ্ঞান রাখেন না, বরং তিনিই সবকিছু সৃষ্টি করেছেন এবং নিয়ন্ত্রণ করেন।
* ঈমানের অংশ: তাকদিরের প্রতি বিশ্বাস করা আল্লাহর রুবুবিয়াত (প্রভুত্ব) এর উপর বিশ্বাস করার অন্তর্ভুক্ত। এই বিশ্বাস ছাড়া মুসলিমদের ঈমান পূর্ণ হয় না।
তাকদির ও স্বাধীন ইচ্ছা (ইখতিয়ার)
তাকদিরের ধারণাটি প্রায়শই মানুষের স্বাধীন ইচ্ছার (ফ্রি উইল) সাথে সাংঘর্ষিক মনে হতে পারে। তবে ইসলামে এই দুটি ধারণাকে একত্রিত করে ব্যাখ্যা করা হয়:
* আল্লাহর পূর্বজ্ঞান বনাম মানুষের কর্ম: আল্লাহ জানেন মানুষ ভবিষ্যতে কী করবে, কিন্তু এই জানার কারণে মানুষ বাধ্য হয়ে সেই কাজগুলো করে না। বরং, আল্লাহ যা জানেন, মানুষ সেটাই তাদের স্বাধীন ইচ্ছায় করে। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক জানেন যে কোন ছাত্র পরীক্ষায় কেমন ফল করবে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে শিক্ষক জানার কারণে ছাত্রটি সেই ফল করতে বাধ্য। ছাত্রটি তার নিজস্ব চেষ্টা বা অবহেলার কারণেই সেই ফল করে। একইভাবে, আল্লাহ জানেন মানুষ কী করবে, কিন্তু মানুষ তাদের স্বাধীন ইচ্ছার মাধ্যমেই তা করে।
* কর্মের দায়বদ্ধতা: আল্লাহ মানুষকে স্বাধীন ইচ্ছা দিয়েছেন, যার ফলস্বরূপ মানুষ তাদের ভালো-মন্দের কাজের জন্য দায়ী থাকবে। যদি সব কাজ পূর্বনির্ধারিতই হতো এবং মানুষের কোনো স্বাধীন ইচ্ছা না থাকত, তাহলে পুরস্কার বা শাস্তির কোনো অর্থ থাকত না। কুরআন ও হাদিসে বারবার মানুষকে ভালো কাজ করার এবং মন্দ কাজ থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যা প্রমাণ করে যে মানুষের স্বাধীন ইচ্ছা আছে।
* দোয়া ও চেষ্টা: তাকদিরের উপর বিশ্বাস করার অর্থ এই নয় যে মানুষ সবকিছু ছেড়ে দিয়ে ভাগ্যের উপর বসে থাকবে। বরং, ইসলাম মানুষকে কল্যাণ অর্জনের জন্য চেষ্টা করতে এবং আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে উৎসাহিত করে। হাদিসে এসেছে যে, দোয়া আল্লাহর ফয়সালাকে পরিবর্তন করাতে পারে এবং নেক আমল বয়সকে বৃদ্ধি করাতে পারে। এটি তাকদিরে মুআল্লাক (ঝুলন্ত ভাগ্যলিপি) এর ধারণা নির্দেশ করে, যা বান্দার চেষ্টা ও দোয়ার মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে। তবে তাকদিরে মুবরাম (অপরিবর্তনীয় ভাগ্যলিপি) কখনোই পরিবর্তিত হয় না।
তাকদিরের প্রকারভেদ
সাধারণত তাকদিরকে প্রধানত দুই ভাগে ভাগ করা হয়:
* তাকদিরে মুবরাম (অপরিবর্তনীয় ভাগ্যলিপি): এটি এমন তাকদির যা কখনোই পরিবর্তিত হয় না। যেমন: কেয়ামত কখন হবে, কার কখন মৃত্যু হবে ইত্যাদি।
* তাকদিরে মুআল্লাক (ঝুলন্ত ভাগ্যলিপি): এটি এমন তাকদির যা বান্দার নেক আমল, দোয়া এবং প্রচেষ্টার মাধ্যমে পরিবর্তিত হতে পারে। যেমন: অসুস্থতার জন্য ওষুধ গ্রহণ করলে আরোগ্য লাভ, বা দান-খয়রাতের মাধ্যমে বালা-মুসিবত দূর হওয়া।
সারসংক্ষেপ
তাকদিরের উপর বিশ্বাস মানুষকে আল্লাহর প্রতি আরও বেশি নির্ভরশীল করে তোলে, একই সাথে এটি মানুষকে তার কর্মের প্রতি দায়িত্বশীল হতে উৎসাহিত করে। এটি আল্লাহ তা'আলার মহাজ্ঞান, প্রজ্ঞা এবং ক্ষমতার প্রতি গভীর বিশ্বাস স্থাপন করতে সাহায্য করে।