25/06/2025                                                                            
                                    
                                                                            
                                            হযরত সৈয়দ হুসাইন শাহবাজি। জগতে এমন কিছু মানুষ আছেন, যারা সকল জায়গা, সব দেশ ভ্রমণ করেনি, অথচ সারা পৃথিবী দেখে ফেলেছেন। তিনি এমন।
হজরত সৈয়দ হুসাইন শাহবাজি। আমি মনে করি, তাঁর জন্ম, কেবল জৈবিক ঘটনা নয়, বরং তা ছিল খোদার ভান্ডার থেকে নেমে আসা রহমত। ভাগলপুর থেকে ছায়া হয়ে ধীরে ধীরে নেমে এসেছেন ঢাকার আকাশে।
তাঁর পরিবার, তাঁর পূর্বপুরুষেরা, তাঁরা কেবল নামধারী বংশধর নন, প্রত্যেকেই ছিলেন তাওয়াক্কুলের ধারক। হাজার বছরের বেশি সময় ধরে তাঁদের রক্তে বহমান সেই রূহানিয়াত হজরতের মধ্যে পূর্ণতা পেয়েছে।
পরিবারের রয়েছে সুদীর্ঘ হাজার বছরের ইতিহাস। কেবল লিখিত ইতিহাস-ই রয়েছে দীর্ঘ চারশত বছরের।
হজরতের নামকরণ নিয়ে রয়েছে এক রহস্যময় আধ্যাত্মিক কাহিনী। অনুমতি ছাড়া সেটি বলা যাবে না, কারণ এটি কেবল একটি ইতিহাস নয়, বরং, রুহের সংযোগের ফসল।
তবে যা বলা যায়, তা হলো, হজরতের নাম যাঁর নামে রাখা হয়েছে, তিনি ছিলেন ষষ্ঠ পুরুষ পূর্বের এক মহান অলী। তাঁর উপাধি ছিলো, ‘রাইস-এ-ভাগলপুর।’ অর্থাৎ ভাগলপুরের প্রতাপশালী নেতা, সমাজপতি এবং আধ্যাত্মিক সম্রাট।
তিনি কেবল জাগতিক অর্থে ধনী নন, বরং, আধ্যাত্মিক ও আত্মিক জগতেও ধনী। তাঁর দরবারে আসত শাসক, সাধারণ মানুষ, আলেম ও তালেবান। তাঁর কাছ থেকে সবাই কিছু না কিছু নিয়েই ফিরত, কারও হৃদয় হালকা হতো, কারও চোখে পানি আসত, কারও চিন্তার জট খুলে যেত।
যার নামে নাম রাখা হয়েছে তিনি ‘রাইস-এ-ভাগলপুর’, আর যিনি সেই নাম ধারণ করেছেন, তিনি? তিনি হয়ে উঠেছেন ‘রাইস-এ-ঢাকা’। এক অলিখিত উপাধি। যার পেছনে কোনো জাগতিক পৃষ্ঠপোষকতা নেই। আছে কেবল মানুষের প্রেম, ভক্তির অশ্রু, এবং আধ্যাত্মিক আকর্ষণ।
পোশাকে রাজকীয়তা নেই, কিন্তু চলনে প্রজ্ঞার স্থিরতা। নিজের পরিচয়ের ক্ষেত্রে বলেন, ‘ফকির’, একজন পথিক। অথচ তাঁকেই ধরে আমরা পথ চিনেছি। আমরা দেখেছি, একজন মানুষ কিভাবে নিরব থেকে সবকিছু পরিবর্তন করে দিতে পারেন। সবার জন্য আছে দোয়া ও আন্তরিক আশ্রয়।
আমার মতো একজন ক্ষুদ্র মানুষ, যাঁর না আছে বিশাল ইবাদতের ন্যূনতম অর্জন, না আছে কোনো সাধনার ইতিহাস, না উল্লেখযোগ্য জ্ঞান, তাঁর কাছাকাছি আসার সৌভাগ্য কীভাবে হলো, সেটা আজও এক বিস্ময়। আমি জানি, এটি আমার কোন কর্মফল নয়। বরং তাঁর দয়াই আমাকে টেনে এনেছে। তিনি সেই মহাসমুদ্র, যেখানে আমার মতো তুচ্ছ কুয়াও ঠাঁই পায়।
এমন একজন মানুষ, যাঁর পাশে বসলে মনে হয়, সময় থেমে গেছে। সমস্ত ব্যস্ততা, জটিলতা, অভিমান, অপরাধবোধ ধুয়ে যায় এক অদ্ভুত প্রশান্তিতে। যেন কেয়ামতের দিনেও তাঁর পাশে থাকলে ভয় লাগবে না। তিনি যেন সে-ই ছায়া, যেখানে দাঁড়িয়ে মানুষ নিজেকে আবার চিনে নিতে পারে।
সেদিন টাঙ্গুয়ার হাওরে, ধূসর আকাশের নিচে, তীরজলছোঁয়া এক হাওরের পাড়ে বাঁশ কাঠের তৈরি একটা চারপায়ার উপর তিনি বসেছিলেন। কোনো কথা বলছিলেন না। কেবল বসেছিলেন। তবু তাঁর নিরবতায় মনে হচ্ছিল, সময় থেমে গেছে। বাতাস থেমে গেছে। শব্দ থেমে গেছে। কেবল তাঁর প্রশান্ত মুখাবয়ব এবং শান্ত চোখ। যা দেখেও প্রশান্ত লাগে।
তাঁর চোখে চোখ পড়লে আমার মনে হয়, তিনি আমার অতীত জানেন। আমার ভয়, আমার গোপন কান্না, আমার মায়া, সব কিছু। অথচ তিনি কিছুই বলেন না। কেবল মুচকি হাসেন। সেই হাসিতে থাকে পৃথিবীর সব মাফ করে দেওয়ার ভাষা। যেন কোনো এক কুয়াশা-ঢাকা সকালের আলোর মতো, তিনি সকল দুঃখের উপর শান্তির চাদর বিছিয়ে দেন।
তিনি আমাদের শেখান না, বরং আমাদের মাঝে শিখিয়ে দেওয়ার ক্ষমতা জাগিয়ে দেন। এমনভাবে বলেন, যেন মনে হয়, এ তো আমি জানতামই, শুধু ভুলে গিয়েছিলাম! তাঁর উপস্থিতি শুধু ‘আলাপ’ নয়, তা এক ধরনের ‘ইলহাম’। যেন তাঁর কথা থেকে আত্মার ভিতর কোথাও নতুন এক দরজা খুলে যায়।
আমরা যারা তাঁকে কাছ থেকে দেখেছি, আমরা জানি, তিনি কেমনভাবে হাঁটেন, কথা বলেন, কীভাবে নীরব থাকেন, এগুলো কোনো সাধারণ বিষয় নয়। তাঁর প্রতিটি ভঙ্গি, প্রতিটি নিরবতা, এমনকি ঠোঁটের সামান্য কম্পন, সবই যেন খোদাপ্রদত্ত।
আমরা কথা বলি, তিনি অনুভব করেন।
আমরা প্রশ্ন করি, তিনি চোখে উত্তর দেন।
আমরা কান্না লুকাই, তিনি ছায়া হয়ে পাশে থাকেন।
একদিন একজন প্রশ্ন করেছিল, ‘আজকের দিনে এমন কাকে দেখে মানুষ আল্লাহর দিকে ফিরে যেতে পারে?’ আমি একটুও না ভেবে বলেছিলাম, ‘হজরতকে দেখেই।’ কারণ তিনি কাউকে ইসলামে ডাকার চেষ্টা করেন না। তিনি এমনভাবে থাকেন—যাতে নিজেই এক দাওয়াত হয়ে ওঠেন।
পশ্চিমা বিশ্বে আজকের দিনে 'স্পিরিচুয়াল লিডার/কোচ' শব্দের ছড়াছড়ি। অথচ হজরতের মাঝে নেই কোনো আত্মপ্রচারের চিহ্ন। তিনি ফকির, পথিক, তাঁর নিজের ভাষায়। অথচ তিনিই তো পথ!
হজরতের সাথে শিশুদের সম্পর্ক যেন ফেরেশতার মতো। ছোট্ট বাচ্চা এসে তাঁর কোলেই বসে পড়ে। বিড়ালগুলো এসে তাঁর পায়ের কাছে ঘুমায়। পাখিরাও এসে বসে থাকে নির্ভয়ে। এটা কোনো কাকতাল নয়। এটা একটা সূক্ষ্ম প্রমাণ, যে প্রাণীও বোঝে, তাঁর মাঝে আছে এক আধ্যাত্মিক কম্পন, যা, ভয় নয়, ভালোবাসা তৈরি করে।
তাঁর জন্মদিনে আমি কিছু লিখতে চেয়েছিলাম। কিন্তু প্রতিবারই মনে হয়েছে, ভাষার কোনো ক্ষমতা নেই তাঁকে ব্যাখ্যা করার। শত কবিতা, শত নিবন্ধ, শত বক্তৃতা দিয়েও তিনি প্রকাশিত হবেন না।
তবুও লিখি। লিখি এই ভেবে, যদি কেউ একদিন এই লেখাগুলো পড়ে, তারা হয়তো জানবে, এমন একজন মানুষ ছিলেন, যাঁর সাহচর্যে রাত্রি শেষ হয়ে ভোর হয়ে যেত, দুঃখ গলে শান্তি হয়ে যেত।
অনেকেই আজকাল মনে করেন, ভালো কিছু সব আগেই হয়ে গেছে। আর ভালো কিছু আসবে না। কিন্তু হজরতের কাছে এসে আমি বুঝেছি, ভালো এখনও আসে। মহান মানুষ এখনও পৃথিবীতে আছেন। তাঁরা আমাদের চারপাশেই থাকেন, কখনো বন্ধু রূপে, কখনো পথপ্রদর্শক রূপে, কখনো কেবল নিরব একজন শ্রোতা হয়ে।
তিনি আমাদের শেখান, ‘না’ না বলে, ‘আচ্ছা, আরেকভাবে ভাবি’ বলা। তাঁর দস্তরখান, যেখানে মানুষ খায় একত্রে, সেটি শুধু খাদ্যদানের জায়গা নয়, সেটি হাজারও মানুষের সংযোগস্থল। মেহমানদারি, আদব, আদর, এসবের মধ্যেই আছে খোদার সন্তুষ্টি।
আমরা তাঁর সামনে গেলে, অহংকার, মুখোশ, ফাঁপা কথাগুলো ঝরে পড়ে। আমরা হয়ে যাই স্রোতের মতো, তিনি হয়ে যান সাগর। তাঁর দিকে তাকালে হৃদয় নত হয়ে আসে, ক্ষুধার্ত মস্তিষ্ক খাবার খোঁজে।
তাঁর সাহচর্য যে পেয়েছে, সে জানে, এই জীবন আর আগের মতো থাকেনা। কিছু একটার পরিবর্তন ঘটে যায় ভিতরে ভিতরে। যেন আকাশ হঠাৎ করে আরেকটু নীল হয়ে ওঠে, বাতাসে একটা সুর খেলা করে, আর আত্মা নিজেকে খুঁজে পায়।
হজরত হলেন সেই এক আলো, যার পাশে দাঁড়ালে নিজের ছায়াও চিনে ফেলা যায়। তিনি কেবল একজন ব্যক্তি নন, তিনি এক আয়না, যাঁর চোখে চোখ রেখে মানুষ নিজের আত্মাকে আবিষ্কার করতে শেখে।
তিনি সেই নীরব বিপ্লব, যাঁর অস্তিত্বই সমাজকে বদলে দেয়। যে সমাজে হিংসা, বিভাজন, আত্মমর্যাদার অভাব, সেখানে তিনি দাঁড়িয়ে বলে, ক্ষমা করো, ভালোবাসো, ধৈর্য ধরো।
হজরতের সাথে কাটানো প্রতিটি মুহূর্ত, প্রতিটি কথা, প্রতিটি নিরবতা, আমার জন্য ধ্যান। আমি যেন এই সান্নিধ্য হারিয়ে না ফেলি। আমি যেন তাঁর দেখানো পথেই চলি।
জীবনে অনেক শিক্ষক আসে, অনেক বন্ধু হয়, অনেক নেতা দেখা যায়। কিন্তু হজরত সেসবের উর্ধ্বে। তিনি একজন ধারা, একজন প্রবাহ, একজন নিরব বিপ্লব—যিনি বদলে দেন, না বলে। গড়ে দেন, না ছুঁয়ে। জাগিয়ে দেন, নিঃশব্দে।
তিনি বলেন, তিনি পথিক।
আমি বলি তিনিই পথ।
তিনি বলেন, তিনি ভ্রমণকারী।
আমি বলি, তিনিই গন্তব্য।
তিনি বলেন, তিনি ছায়া।
আমি বলি, তিনিই আলো।
তিনি বলেন, তিনি স্রোত।
আমি বলি, তিনিই উৎস।
তিনি বলেন, তিনি ফুল।
আমি বলি, তিনিই বসন্ত।
তিনি বলেন, তিনি ঢেউ।
আমি বলি, তিনিই সাগর।
তিনি বলেন, তিনি কণামাত্র।
আমি বলি, তিনিই মহাবিশ্ব।
এই লেখাটি তাঁর সাথে কাটানো কিছু মুহুর্তের টুকরো অভিজ্ঞতার খণ্ডাংশ। কৃতজ্ঞতার সামান্য প্রকাশ। যদিও জানি, আমার কলম তাঁর প্রজ্ঞার সামনে শিশুর আঁচড়মাত্র। তবুও লিখলাম, কারণ ভালোবাসা লিখতে চায়।
ইতি,
আপনার ভাই।
শেখ ফাহিম ফয়সাল
জন্মদিন ও প্রতিটি দিন শুভ হোক ভাইয়া।
শতায়ু হোন।