01/10/2025
আমি স্বীকার করি, পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায় বিচার নাই। ওখানে ন্যায় বিচার মরে গেছে ১৯৮৪ সালের ৩১শে মে। সেদিন ছিল শাবান মাসের শেষ দিন। রাত পোহাইলেই পহেলা রমজান।
সেহেরীতে খাওয়া-দাওয়া সেরে সেদিন ফজরের অপেক্ষায় বরকল উপজেলার ভূষণছড়া গ্রামের লোকজন। তবে মুয়াজ্জিনের সুললিত কন্ঠ নয়; শেষরাতের নিরবতা ভেঙে পাওয়া গেল প্রথম গুলিটার আওয়াজ। ঘড়িতে সময় তখন ঠিক ভোর চারটা।
কর্কশ সেই আওয়াজে দৌড়ে বেরিয়ে এলেন জারুলছড়ি বিডিআর ক্যাম্পের কয়েকজন সৈনিক। উড়ে গেছে চোখের ঘুম ঘুম ভাব; হাতে প্রস্তুত চায়নিজ রাইফেল। প্রশিক্ষিত কানে গুলির দিক চিনতে ভুল হয় নাই। ছুটবেন ওই দিকেই।
কিন্তু বাধা দিলেন ক্যাম্পের কমান্ডিং অফিসার; উপর মহলের আদেশ আসার আগে কোন অ্যাকশন চলবে না। তাই নির্বাক চোখে দেখে গেল ‘সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী’— জ্বলছে ভূষণছড়া। দাউ দাউ করে ছড়িয়ে যাচ্ছে দহনের পয়গাম। থেমে থেমে চলছে গুলি; তবে চীৎকার আর কলিজা ফাটা আর্তনাদের মাঝে কোন বিরাম নাই। বিনা বাঁধায় বাঙালী সিভিলিয়ানদের ওপর চলছে পাহাড়ি-আক্রমণ। চলছে নির্বিচার গণহত্যা। নারী-পুরুষ, বৃদ্ধ, শিশু; এমনকি রেহাই পেল না গোয়ালের গরু-ছাগল পর্যন্ত।
জায়গাটায় প্রথম যে সাংবাদিক পৌঁছান, তিনি বাংলাদেশ অবজারভারের সৈয়দ মুরতজা আলি। খাতা, কলম, আর মিনি রেকর্ডার পলিথিনে মুড়ে, নৌকার পাটাতনে লুকিয়ে রেখে, একটা ছেঁড়া লুঙ্গি গায়ে দিয়ে জেলের ছদ্মবেশে তিনি যখন ভূষণছড়া পৌঁছুলেন, তখন ঘটনার তিন দিন পার হয়ে গেছে। কঠোর নিরাপত্তায় ঘেরাও দিয়ে রাখা হয়েছে গ্রাম। হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন ডিসি, ডিআইজি, জিওসি আর জনকতক ব্রিগেডিয়ার। পূর্ণ মনোযোগের সহিত নিশ্চিত করা হচ্ছে— ভূষণছড়া গ্রাম থেকে কেউ যেন বের হতে না পারে। চলছে কঠোর নজরদারি। পাছে ঘটনা আবার ফাঁস হয়ে যায়!
দেখলেন সৈয়দ মুরতজা— তিনদিন পরও এদিক-সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অসংখ্য মৃতদেহ। কিছু গণকবরে পুঁতে দেওয়া হয়েছে; আরও নতুন গণকবর খোড়ার জন্য তোড়জোড় চলমান। বাকি লাশ কুকুর-শেয়ালে জঙ্গলে টেনে নিয়ে গেছে। আসার পথে নদীতে ভাসতেও দেখেছেন বেশ অনেকগুলো। ওগুলার কোন হিসাব নাই।
তবে কেবল ওইটুকুই নয়। চাকমাদের নৃশংসতা দেখে হতভম্ব হয়ে গেলেন একাত্তুরের পোড়-খাওয়া সাংবাদিক। লিখতে গিয়ে কোন ভাষা খুঁজে পাইলেন না। তাই Massacre at Dawn শিরোনামের রিপোর্টটা শুরু করলেন সিম্পল বর্ণনায়—
“The beheaded body of a young woman, Rizia Khatun, was found lying at Poabari para of Bhushanchara settlement, with her dead child in the position of suckling her bosom. Both hands of yet another baby were found severed. Yet another infant was seen cut by half. A seven day old boy was bayoneted to death in front of his parents…”
(ভূষণছড়া গ্রামের তরুণী রিজিয়া খাতুনের মস্তকহীন দেহটা পাওয়া গেল পোয়াবাড়ি পাড়ায়। কোলে থাকা তার শিশু সন্তানটিও মৃত; তখনও কামড়ে ধরে আছে মায়ের স্তন। আরেকটি বাচ্চার দুই হাত কেটে নেওয়া হয়েছে। দুই টুকরা করে ফেলা হয়েছে আরও এক শিশু। সাত দিনের এক বাচ্চাকে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে মারা হয়েছে পিতা-মাতার সামনে…”
ঠিক কতজন বাঙালী যে সেদিন চাকমা সন্ত্রাসীদের হাতে খুন হয়, তার কোন হিসাব আজ পর্যন্ত নাই। নাম-পরিচয় সহ ৩৭০ জনের একটা তালিকা আছে। তবে সেই রিপোর্টে গবেষক আতিকুর রহমান পরিষ্কার করে বলে গেছেন— তালিকা অসমাপ্ত।
বাংলাদেশ ইকোনোমিস্ট-এ ১৯৮৪ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত প্রতিবেদনে সাংবাদিক মইনুদ্দিন নাসের বলেন, মৃতের সংখ্যা কম করে হলেও চার শতাধিক। অনেক বডি চাকমারা এমনভাবে বিকৃত করেছে যা আর ‘আইডেন্টিফিকেশন’ এর উপযুক্ত নাই। অনেক দেহ আগুনে জ্বলে ভষ্ম হয়ে গেছে। আবার বন্য প্রাণী টেনে নিয়ে গেছে বেশ কিছু। তিন শতাধিক পরিবার কাউকে না কাউকে হারিয়েছে। আর এদের মাঝে একশরও বেশি পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন।
চাকমারা বাঙালীদের ওপর গণহত্যা চালিয়েছিল ভোর চারটা থেকে সকাল সাড়ে আটটা পর্যন্ত। স্বাধীন বাংলাদেশে এর সমতূল্য, বা এর অর্ধেক, কিংবা এমনকি সিকিভাগ হত্যাযজ্ঞও আর কখনও হয় নাই। এই ঘটনার জন্য আজতক কারও কোন বিচার হয় নাই। পুলিশ মামলাই নেয় নাই!
ওইদিন থেকে পার্বত্য চট্টগ্রামে ন্যায় বিচার মরে গেছে। আর ন্যায় বিচারের কবর হয়ে গেছে ২০০১ সালে, যেইদিন বিএনপির টিকেট নিয়ে এমপি হয়েছে মণি স্বপন দেওয়ান চাকমা। হয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী।
এই সেই মণি স্বপন, ওরফে শান্তিবাহিনীর “মেজর” রাজেশ, যার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এই গণহত্যা চালানো হয়েছিল। হাতে রাইফেল নিয়ে নিজে হাজির ছিল সেথায়। প্রতিটা নিউজ, রিপোর্ট আর আর্টিকেল এই একটা বিষয়ে একমত— আক্রমণের ফিল্ড-কমান্ডার ছিল মণি স্বপন। কারও কারও বর্ণনা মোতাবেক, গণহত্যা শুরু করার সিগনাল ওই প্রথম গুলিটি ছিল তারই চালানো।
সেই মণি স্বপন এখনও জীবিত। রাজনীতির মাঠে পূর্ণ সক্রিয়। এই কয়েক মাস আগেও রাঙামাটি বিএনপির সমাবেশে গলার রগ ফুলিয়ে বক্তব্য দিয়েছে। ভূষণছড়ার ঘটনা জানতে চাইলে সে মিটিমিটি হাসে। লাজুক মুখে জবাব দেয়, “নো কমেন্ট। অনেকদিন আগের কথা তো।”
কিছুদিন পরপর আমি মণি স্বপনের খোঁজ রাখি। দেখি, পহেলা রমজানে মুসলিমদের ওপর গণহত্যা চালানো ভয়ংকর খুনিটা বাংলার মাটিতে দিব্যি সুখে আছে। ইসলামকে কটাক্ষ করে বৌদ্ধ ধর্মসভায় বক্তব্য দিতেছে— মদের চেয়েও নাকি ধর্মের নেশা ভয়ংকর।
আরও দেখি, ওই রাতে পরিবারের ৭ জনকে হারানো এক বাঙালি জানতে চাইতেছেন, তাকে পাঁচ হাজার টাকা আর এক বস্তা চাউল দেওয়া হইছে। এইটাই জীবনের মূল্য কী না?
জিজ্ঞেস করেন ওই রাতে পরিবারের সবাইকে হারিয়ে একা আব্দুল হাই— খুনীরা শান্তিচুক্তির পর জমি, রেশন, বেতন আর ব্যাংকঋণ পাইল। কিন্তু তার ভাই-বোনদের গণকবরটা সংরক্ষণের জন্য একটা বেড়া পর্যন্ত দিতে দেওয়া হইল না কেন?
বলেন মুহাম্মদ নিজামুদ্দিন, সে রাতে তার গর্ভবতি স্ত্রীর পেট চিরে সন্তান বের করে আনছিল শান্তিবাহিনীর লোকজন। তারপর তার ঘরে আগুন দিয়ে সেখানে তার স্ত্রী ও তিন সন্তানকে ফেলে দেওয়া হয়। পুড়ে তাদের দেহ দলা পাকায়ে গেছিল। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও তাই পৃথক কবর দেওয়া সম্ভব হয় নাই। যখনই ব্যাপারটা স্মরণ হয়, তার মন অশান্ত হয়ে যায়।
শুনে আমার অস্থির অস্থির লাগে। আমিও শান্তি পাই না। তাই আমি পাহাড়িদের সাথে করা শেখ হাসিনার ‘শান্তিচুক্তি’ ঘৃণা করি।
কিসের শান্তি?
মণি স্বপন চাকমাদেরকে ঝুলতে দেখার আগ পর্যন্ত আমার কোন শান্তি নাই।
এটাই নিরীহ উপজাতীদের চেহারা ।
তারা কেন পাহাড় থেকে সেনা প্রত্যাহার চায় সেটা বুঝতে চেষ্টা করুন।